বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. মিজানুর রহমান-গণতন্ত্র থাকলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ৩৮ বছর পর গঠিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ কমিশনের অর্থ ও লোকবলের তীব্র সংকট রয়েছে। তবে মানবাধিকার রক্ষায় কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কমিশন কাজ করছে। তাঁর সঙ্গে খোলামেলা আলাপ হয়েছে কালের কণ্ঠের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুজ্জামান তুহিন ও রেজাউল করিম
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন?
ড. মিজানুর রহমান : আমাদের দেশের মানবাধিকার বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, পুলিশি নির্যাতন, রাজনৈতিক নির্যাতন, গুম, হত্যা ইত্যাদি। আসলে মানবাধিকারের এই ধারণাটি বিভ্রান্তিকর। মানবাধিকারের সংজ্ঞা অনেক বিস্তারিত, যার মধ্যে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জীবন ধারণের সংগ্রাম, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ অনেক কিছুই পড়ে। তো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বলব না যে একেবারে ভালো। তবে বলতে পারি, আগের তুলনায় অনেক ভালো। আবার বলব না যে এখানেই সমাপ্তি। কারণ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইলে মানবাধিকারের অবস্থা আরো অনেক বেশি উন্নত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে আরো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মানবাধিকার কমিশন গঠনের আগে ও পরে মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র কেমন?
ড. মিজানুর রহমান : মানবাধিকার কমিশন গঠনের আগে ও পরে মানবাধিকার পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গণমাধ্যমের সহযোগিতায় মানবাধিকারের নামটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। এ বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে মানবাধিকার ধারণাটি কিন্তু ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। মানবাধিকারের বিষয়ে মানুষ যত বেশি সচেতন হবে, মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা তা রক্ষার জন্য বেশি করে দাবি তুলবেন। সেখান থেকে বলা যায়, কমিশন গঠন ও গঠনের পরে মানবাধিকারের বিষয়টির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। গুমের মতো একটি দম বন্ধ করা পরিস্থিতি দেশে রয়েছে। এর মধ্যেই আবার কমিশন আত্মপ্রকাশ করেছে। তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
ড. মিজানুর রহমান : বিচারবহির্ভূত কোনো ঘটনা শূন্যে নেমে আসতে গেলে রাষ্ট্রকে আরো যে রকম পরিশীলিত হতে হবে, সে পর্যায়ে আমাদের রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়নি। অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়ার একটা অপসংস্কৃতি কিন্তু আমাদের দেশে রয়ে গেছে। এখান থেকেই অপরাধ করার যে প্রবণতা, সেটা বন্ধ না হয়ে বরং আরো উসকে দেয়। বিশেষ করে '৭৫-পরবর্তী সময় এটা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো সপরিবারে নির্মমভাবে। সেই খুনিদের শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষা করা হলো আইন করে। জাতীয় চার নেতা পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা জেলখানায় খুন হলেন, যারা খুনি তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হলো না। এই ট্রেন্ডটি কিন্তু চলছে। এটি চলার কারণ কী? '৭১-এ স্বাধীনতার সময় যারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন করেছিল, তাদেরও শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আমরা বন্ধ করে রেখেছিলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি আমরা শেষ করতে পারি, তাহলে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে যাবে যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার দিন শেষ। অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
আমি সব সময় বলি, যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে আসেন তাঁদের। যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আসছে সেই র্যাব একটি সংকর বাহিনী। এই র্যাবের মধ্যে যত ধরনের বিভাগ থেকেই লোক এসে থাকুক না কেন, বিশেষত যাঁরা এক্সিবিউশনের দায়িত্বে থাকেন তাঁরা এসেছেন আমাদের সামরিক বাহিনী থেকে। সামরিক বাহিনীকে শিক্ষা দেওয়া হয় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির। সেখানে শত্রুকে নির্মূর্র্র্ল করাই সামরিক বাহিনীর কাজ। এই সামরিক বাহিনীর লোক যখন র্যাবের হয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করতে যান, তাঁরা তো দেখেন শত্রুকে নির্মূল করার জায়গা থেকে। যাদের নির্মূল করা হচ্ছে তারা হলো ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত। এই অভিযুক্তদের দ্বারা কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না। 'তুমি দেখিবা মাত্রই গুলি করিবে'- এখন যার যে ট্রেনিং, যাকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে তারা কিন্তু সেভাবেই কাজটি করছে। সুতরাং র্যাবে যত দিন সেনাবাহিনীর লোকজন থাকবে, তত দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবেই। আমরা ট্রেনিংই দিয়েছি হত্যা করার জন্য, তাদের দোষ দিলে চলবে না। এই পদ্ধতিটাই ভুল। আমরা কেন র্যাবে সেনাবাহিনীর লোকদের যুক্ত করেছি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটছে তা উদ্বেগজনক। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে একটি তালিকা দিই যে এরা নিখোঁজ। আমি তালিকা দেওয়ার পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতি স্পর্শকাতর দুটি ঘটনার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এটাও বলেছি যে গুম, হত্যা, অপহরণের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। নইলে আমরাই গণমাধ্যমে আমাদের ভূমিকা ও আপনাদের নিষ্ক্রিয়তার কথা তুলে ধরব। যে দেশে গণতন্ত্র থাকে সে দেশে গুম হয় না, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও হয় না।
কালের কণ্ঠ : আপনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে বাহিনী যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে, তাকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা হলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে। কারণ তারা অভিযুক্তকে দেখে শত্রু হিসেবে। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে তারা নির্মূর্ল করবেই। তাহলে কি এটা বলা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই যে যুদ্ধ তা রাষ্ট্র তার জনগণের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে?
ড. মিজানুর রহমান : আপনি যেভাবে বলছেন, এ রকম কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। আমাদের কাছে এ রকম কোনো অভিযোগও নেই। আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আসে। কিন্তু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এ রকম কোনো তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
কালের কণ্ঠ : এ পর্যন্ত যত মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে দুই হাজারের মতো হলেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী। এসব নিষিদ্ধ পার্টির নেতার মধ্যে মোফাখখার চৌধুরী, কামরুল মাস্টার ও ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের মতো নেতারা রয়েছেন। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ড. মিজানুর রহমান : রাষ্ট্র যাদের অবৈধ শক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে, অবৈধ দল হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এক ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তা যেকোনো রাষ্ট্র পারে। সেই বিষয়টি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হবে কি না সেটা দেখার বিষয়। যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাদের নির্মূল করতে রাষ্ট্র পাল্টা কাজ করলে কিন্তু রাষ্ট্রকে দোষারোপ করলে চলবে না। গোপন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর পক্ষ থেকেও কিন্তু এক ধরনের চরমপন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, সেই চরমপন্থাকে রাষ্ট্রের চরমপন্থা দিয়ে মোকাবিলা করা হচ্ছে। আমাদের মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকতেই পারে; কিন্তু যেকোনো রাষ্ট্র তার টিকে থাকার জন্য একটা ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে।
কালের কণ্ঠ : র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে? আবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশও করেছে। এ ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য?
ড. মিজানুর রহমান : এক. দেখুন এই মানবাধিকারের লঙ্ঘন শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে মদদ দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান হওয়ার পর থেকে। যখন এই জঙ্গিবাদ তাদের গিলে ফেলতে চেয়েছে তখন তারা বাধ্য হয়ে র্যাব নামের একটি এলিট ফোর্স গঠন করে। আমি যত দূর জানি, সাতটি বাহিনী নিয়ে র্যাব গঠিত। সেখানে সেনাবাহিনীও রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা যাদের কাজ, তারা যখন র্যাবের অধীনে আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত হয়, তখন তো মানবাধিকার লঙ্ঘন হবেই। সেনাবাহিনীর কাজ হলো 'টু কিল' আর পুলিশের কাজ হলো 'টু কন্ট্রোল'। কিল আর কন্ট্রোল যখন একসঙ্গে কাজ করছে, তখন তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবেই। বিভিন্ন সময় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে যারা গ্রেপ্তার হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ওই অস্ত্রগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করে নম্বর দেওয়ার জন্য বলেছে মানবাধিকার কমিশন। যাতে এগুলো বারবার ব্যবহৃত না হতে পারে।
দুই. সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে প্রতিবেদন দিয়েছে, ওই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে তাদের কথা বলা উচিত ছিল। আর দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে এত বড় হস্তক্ষেপ করা ঠিক হয়নি।
কালের কণ্ঠ : রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝখানে স্বাধীন বিভিন্ন রেগুলেটরি বডি ও কমিশন কাজ করে, যাতে রাষ্ট্র জনগণের ওপর নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে হাজির না হতে পারে। এ জায়গা থেকে দেখলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে মানবাধিকার কমিশন জনগণকে কতখানি রক্ষা করতে পেরেছেন?
ড. মিজানুর রহমান : আমার তো মনে হয় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে রাষ্ট্র বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। রাষ্ট্র- আদর্শিক দিক থেকে জনগণকে রক্ষা করা হলো তার দায়িত্ব। কিন্তু তারই কোনো বাহিনী যখন বিনা বিচারে জনগণের ওপর কোনো নির্যাতন চালায়, তখন তা রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। আপনি একটা অভিযোগও পাবেন না, যা আমাদের কাছে এসেছে আর আমরা রাষ্ট্রের কাছে সে প্রশ্ন তুলিনি। আমাদের কাজটিই হচ্ছে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সতর্ক করে দেওয়া, যাতে তারা এ কাজটি আর না করে। আমাদের অতি সীমিত অর্থ ও জনবল নিয়ে এ কাজটি আমরা করে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : লিমনের ইস্যুতে দেখা গেছে, র্যাবের গুলিতে এক পা নেই, পঙ্গু-হতদরিদ্র একটি ছেলে একদিকে আর রাষ্ট্র আরেক দিকে। যেন এই পঙ্গু ছেলেটার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু লিমনের বিষয় নিয়ে আপনারা মানবাধিকার কমিশন থেকে অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন। মানবাধিকার কমিশনের তো এই আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার বিধানই রয়েছে।
ড. মিজানুর রহমান : আমরা বলিনি যে আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করব না। আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যিনি আমাদের আইনজীবী তিনি এ মুহূর্তে দেশের বাইরে। তিনি দেশে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করব।
কালের কণ্ঠ : আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানবাধিকারের ওপর তেমন কোনো শিক্ষামূলক পাঠ্যক্রম নেই। এ ব্যাপারে কমিশনের ভূমিকা কী?
ড. মিজানুর রহমান : মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাই, তিনি আমার অনুরোধে এবারই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে মানবাধিকার সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন করেছেন। আন্তর্জাতিক একটি সাহায্যকারী সংগঠনের সহযোগিতায় আমরা ইতিমধ্যে দুটি প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। যেটা হয়তো আমরা খুব শিগগির শুরু করতে পারব। একটি হচ্ছে 'ব্রেভ ম্যান ক্যাম্পেইন'। এই ব্রেভ ম্যান ক্যাম্পেইনটা হবে শুধু ছেলেদের মাধ্যমিক স্কুলে। এটি দেশব্যাপী চলবে। ছেলেদের স্কুলে এই ক্যাম্পেইন করার কারণ হচ্ছে, ছেলেরা যাতে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং নিজেদের অবস্থানের প্রতিও যাতে সজাগ হয়- এটাই এ ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য। যখন একটি স্কুলের সব ছাত্র অঙ্গীকার করবে, আমরা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তখন আমরা সেই প্রতিষ্ঠানকে 'ব্রেভ ম্যান স্কুল' বলে স্বীকৃতি দেব। আরেকটি প্রোগ্রাম হলো, আমরা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে মানবাধিকারের বিষয়ে প্রচার অভিযানে নামব।
কালের কণ্ঠ : স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সম্প্রতি কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ পল্লীতে নারকীয় হামলা করতে সমর্থ হয়েছে দুর্বৃত্তরা। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
ড. মিজানুর রহমান : আমি আগেই বলেছি, স্থানীয় প্রশাসনের আশ্চর্য রকম নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যেভাবে বৌদ্ধবিহার ও বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, তাতে কিন্তু যে কেউ বুঝতে পারবেন অনেক পরিকল্পনা করে, সময় নিয়ে এই হামলা করা হয়েছে। সেখানে যে হামলা হবে তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এটা সরকারের মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিরাও বলছেন। পূর্বপরিকল্পিত যদি হয়েই থাকে, তাহলে কেন প্রতিরোধ করা গেল না? গোয়েন্দারা কী করলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বহু বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এখানেই যদি সংখ্যালঘু জাতি বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে আমাদের জন্য তা বেদনাদায়ক ও লজ্জার। সেই লজ্জা কিছু সংগঠিত দুর্বৃত্ত আমাদের দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারলে আমাদের জন্য সামনে আরো বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. মিজানুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন?
ড. মিজানুর রহমান : আমাদের দেশের মানবাধিকার বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, পুলিশি নির্যাতন, রাজনৈতিক নির্যাতন, গুম, হত্যা ইত্যাদি। আসলে মানবাধিকারের এই ধারণাটি বিভ্রান্তিকর। মানবাধিকারের সংজ্ঞা অনেক বিস্তারিত, যার মধ্যে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জীবন ধারণের সংগ্রাম, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ অনেক কিছুই পড়ে। তো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বলব না যে একেবারে ভালো। তবে বলতে পারি, আগের তুলনায় অনেক ভালো। আবার বলব না যে এখানেই সমাপ্তি। কারণ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইলে মানবাধিকারের অবস্থা আরো অনেক বেশি উন্নত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে আরো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মানবাধিকার কমিশন গঠনের আগে ও পরে মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র কেমন?
ড. মিজানুর রহমান : মানবাধিকার কমিশন গঠনের আগে ও পরে মানবাধিকার পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গণমাধ্যমের সহযোগিতায় মানবাধিকারের নামটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। এ বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে মানবাধিকার ধারণাটি কিন্তু ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। মানবাধিকারের বিষয়ে মানুষ যত বেশি সচেতন হবে, মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা তা রক্ষার জন্য বেশি করে দাবি তুলবেন। সেখান থেকে বলা যায়, কমিশন গঠন ও গঠনের পরে মানবাধিকারের বিষয়টির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। গুমের মতো একটি দম বন্ধ করা পরিস্থিতি দেশে রয়েছে। এর মধ্যেই আবার কমিশন আত্মপ্রকাশ করেছে। তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
ড. মিজানুর রহমান : বিচারবহির্ভূত কোনো ঘটনা শূন্যে নেমে আসতে গেলে রাষ্ট্রকে আরো যে রকম পরিশীলিত হতে হবে, সে পর্যায়ে আমাদের রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়নি। অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়ার একটা অপসংস্কৃতি কিন্তু আমাদের দেশে রয়ে গেছে। এখান থেকেই অপরাধ করার যে প্রবণতা, সেটা বন্ধ না হয়ে বরং আরো উসকে দেয়। বিশেষ করে '৭৫-পরবর্তী সময় এটা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো সপরিবারে নির্মমভাবে। সেই খুনিদের শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষা করা হলো আইন করে। জাতীয় চার নেতা পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা জেলখানায় খুন হলেন, যারা খুনি তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হলো না। এই ট্রেন্ডটি কিন্তু চলছে। এটি চলার কারণ কী? '৭১-এ স্বাধীনতার সময় যারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন করেছিল, তাদেরও শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আমরা বন্ধ করে রেখেছিলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি আমরা শেষ করতে পারি, তাহলে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে যাবে যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার দিন শেষ। অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
আমি সব সময় বলি, যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে আসেন তাঁদের। যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আসছে সেই র্যাব একটি সংকর বাহিনী। এই র্যাবের মধ্যে যত ধরনের বিভাগ থেকেই লোক এসে থাকুক না কেন, বিশেষত যাঁরা এক্সিবিউশনের দায়িত্বে থাকেন তাঁরা এসেছেন আমাদের সামরিক বাহিনী থেকে। সামরিক বাহিনীকে শিক্ষা দেওয়া হয় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির। সেখানে শত্রুকে নির্মূর্র্র্ল করাই সামরিক বাহিনীর কাজ। এই সামরিক বাহিনীর লোক যখন র্যাবের হয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করতে যান, তাঁরা তো দেখেন শত্রুকে নির্মূল করার জায়গা থেকে। যাদের নির্মূল করা হচ্ছে তারা হলো ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত। এই অভিযুক্তদের দ্বারা কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না। 'তুমি দেখিবা মাত্রই গুলি করিবে'- এখন যার যে ট্রেনিং, যাকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে তারা কিন্তু সেভাবেই কাজটি করছে। সুতরাং র্যাবে যত দিন সেনাবাহিনীর লোকজন থাকবে, তত দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবেই। আমরা ট্রেনিংই দিয়েছি হত্যা করার জন্য, তাদের দোষ দিলে চলবে না। এই পদ্ধতিটাই ভুল। আমরা কেন র্যাবে সেনাবাহিনীর লোকদের যুক্ত করেছি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটছে তা উদ্বেগজনক। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে একটি তালিকা দিই যে এরা নিখোঁজ। আমি তালিকা দেওয়ার পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতি স্পর্শকাতর দুটি ঘটনার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এটাও বলেছি যে গুম, হত্যা, অপহরণের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। নইলে আমরাই গণমাধ্যমে আমাদের ভূমিকা ও আপনাদের নিষ্ক্রিয়তার কথা তুলে ধরব। যে দেশে গণতন্ত্র থাকে সে দেশে গুম হয় না, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও হয় না।
কালের কণ্ঠ : আপনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে বাহিনী যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে, তাকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা হলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে। কারণ তারা অভিযুক্তকে দেখে শত্রু হিসেবে। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে তারা নির্মূর্ল করবেই। তাহলে কি এটা বলা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই যে যুদ্ধ তা রাষ্ট্র তার জনগণের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে?
ড. মিজানুর রহমান : আপনি যেভাবে বলছেন, এ রকম কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। আমাদের কাছে এ রকম কোনো অভিযোগও নেই। আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আসে। কিন্তু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এ রকম কোনো তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
কালের কণ্ঠ : এ পর্যন্ত যত মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে দুই হাজারের মতো হলেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী। এসব নিষিদ্ধ পার্টির নেতার মধ্যে মোফাখখার চৌধুরী, কামরুল মাস্টার ও ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের মতো নেতারা রয়েছেন। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ড. মিজানুর রহমান : রাষ্ট্র যাদের অবৈধ শক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে, অবৈধ দল হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এক ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তা যেকোনো রাষ্ট্র পারে। সেই বিষয়টি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হবে কি না সেটা দেখার বিষয়। যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাদের নির্মূল করতে রাষ্ট্র পাল্টা কাজ করলে কিন্তু রাষ্ট্রকে দোষারোপ করলে চলবে না। গোপন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর পক্ষ থেকেও কিন্তু এক ধরনের চরমপন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, সেই চরমপন্থাকে রাষ্ট্রের চরমপন্থা দিয়ে মোকাবিলা করা হচ্ছে। আমাদের মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকতেই পারে; কিন্তু যেকোনো রাষ্ট্র তার টিকে থাকার জন্য একটা ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে।
কালের কণ্ঠ : র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে? আবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশও করেছে। এ ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য?
ড. মিজানুর রহমান : এক. দেখুন এই মানবাধিকারের লঙ্ঘন শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে মদদ দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান হওয়ার পর থেকে। যখন এই জঙ্গিবাদ তাদের গিলে ফেলতে চেয়েছে তখন তারা বাধ্য হয়ে র্যাব নামের একটি এলিট ফোর্স গঠন করে। আমি যত দূর জানি, সাতটি বাহিনী নিয়ে র্যাব গঠিত। সেখানে সেনাবাহিনীও রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা যাদের কাজ, তারা যখন র্যাবের অধীনে আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত হয়, তখন তো মানবাধিকার লঙ্ঘন হবেই। সেনাবাহিনীর কাজ হলো 'টু কিল' আর পুলিশের কাজ হলো 'টু কন্ট্রোল'। কিল আর কন্ট্রোল যখন একসঙ্গে কাজ করছে, তখন তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবেই। বিভিন্ন সময় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে যারা গ্রেপ্তার হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ওই অস্ত্রগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করে নম্বর দেওয়ার জন্য বলেছে মানবাধিকার কমিশন। যাতে এগুলো বারবার ব্যবহৃত না হতে পারে।
দুই. সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে প্রতিবেদন দিয়েছে, ওই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে তাদের কথা বলা উচিত ছিল। আর দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে এত বড় হস্তক্ষেপ করা ঠিক হয়নি।
কালের কণ্ঠ : রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝখানে স্বাধীন বিভিন্ন রেগুলেটরি বডি ও কমিশন কাজ করে, যাতে রাষ্ট্র জনগণের ওপর নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে হাজির না হতে পারে। এ জায়গা থেকে দেখলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে মানবাধিকার কমিশন জনগণকে কতখানি রক্ষা করতে পেরেছেন?
ড. মিজানুর রহমান : আমার তো মনে হয় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে রাষ্ট্র বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। রাষ্ট্র- আদর্শিক দিক থেকে জনগণকে রক্ষা করা হলো তার দায়িত্ব। কিন্তু তারই কোনো বাহিনী যখন বিনা বিচারে জনগণের ওপর কোনো নির্যাতন চালায়, তখন তা রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। আপনি একটা অভিযোগও পাবেন না, যা আমাদের কাছে এসেছে আর আমরা রাষ্ট্রের কাছে সে প্রশ্ন তুলিনি। আমাদের কাজটিই হচ্ছে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সতর্ক করে দেওয়া, যাতে তারা এ কাজটি আর না করে। আমাদের অতি সীমিত অর্থ ও জনবল নিয়ে এ কাজটি আমরা করে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : লিমনের ইস্যুতে দেখা গেছে, র্যাবের গুলিতে এক পা নেই, পঙ্গু-হতদরিদ্র একটি ছেলে একদিকে আর রাষ্ট্র আরেক দিকে। যেন এই পঙ্গু ছেলেটার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু লিমনের বিষয় নিয়ে আপনারা মানবাধিকার কমিশন থেকে অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন। মানবাধিকার কমিশনের তো এই আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার বিধানই রয়েছে।
ড. মিজানুর রহমান : আমরা বলিনি যে আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করব না। আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যিনি আমাদের আইনজীবী তিনি এ মুহূর্তে দেশের বাইরে। তিনি দেশে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করব।
কালের কণ্ঠ : আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানবাধিকারের ওপর তেমন কোনো শিক্ষামূলক পাঠ্যক্রম নেই। এ ব্যাপারে কমিশনের ভূমিকা কী?
ড. মিজানুর রহমান : মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাই, তিনি আমার অনুরোধে এবারই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে মানবাধিকার সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন করেছেন। আন্তর্জাতিক একটি সাহায্যকারী সংগঠনের সহযোগিতায় আমরা ইতিমধ্যে দুটি প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। যেটা হয়তো আমরা খুব শিগগির শুরু করতে পারব। একটি হচ্ছে 'ব্রেভ ম্যান ক্যাম্পেইন'। এই ব্রেভ ম্যান ক্যাম্পেইনটা হবে শুধু ছেলেদের মাধ্যমিক স্কুলে। এটি দেশব্যাপী চলবে। ছেলেদের স্কুলে এই ক্যাম্পেইন করার কারণ হচ্ছে, ছেলেরা যাতে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং নিজেদের অবস্থানের প্রতিও যাতে সজাগ হয়- এটাই এ ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য। যখন একটি স্কুলের সব ছাত্র অঙ্গীকার করবে, আমরা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তখন আমরা সেই প্রতিষ্ঠানকে 'ব্রেভ ম্যান স্কুল' বলে স্বীকৃতি দেব। আরেকটি প্রোগ্রাম হলো, আমরা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে মানবাধিকারের বিষয়ে প্রচার অভিযানে নামব।
কালের কণ্ঠ : স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সম্প্রতি কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ পল্লীতে নারকীয় হামলা করতে সমর্থ হয়েছে দুর্বৃত্তরা। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
ড. মিজানুর রহমান : আমি আগেই বলেছি, স্থানীয় প্রশাসনের আশ্চর্য রকম নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যেভাবে বৌদ্ধবিহার ও বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, তাতে কিন্তু যে কেউ বুঝতে পারবেন অনেক পরিকল্পনা করে, সময় নিয়ে এই হামলা করা হয়েছে। সেখানে যে হামলা হবে তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এটা সরকারের মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিরাও বলছেন। পূর্বপরিকল্পিত যদি হয়েই থাকে, তাহলে কেন প্রতিরোধ করা গেল না? গোয়েন্দারা কী করলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বহু বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এখানেই যদি সংখ্যালঘু জাতি বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে আমাদের জন্য তা বেদনাদায়ক ও লজ্জার। সেই লজ্জা কিছু সংগঠিত দুর্বৃত্ত আমাদের দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারলে আমাদের জন্য সামনে আরো বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. মিজানুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments