আমরা কি কার্যকর সংসদ দেখতে পাব না? by সাইদ সিদ্দিকী
দিনে দিনে অকার্যকর হয়ে পড়ছে জাতীয় সংসদ। এর শুরুটা প্রায় দুই দশক আগে। স্বৈরশাসক এরশাদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পর এ দেশের মানুষ আশান্বিত হয়েছিল যে, এবার বুঝি গণতান্ত্রিক ধারায় দেশটা এগিয়ে যাবে। কিন্তু না, মানুষের আশা পরিণত হলো হতাশায়।
আমাদের গণতন্ত্র আটকে রইল স্রেফ নির্বাচনের মধ্যে। নির্বাচন হয়, নিয়মমাফিক একটি দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। সরকারি দল মনে করে, জনগণ এবার তাদের লাইসেন্স দিয়েছে। আর এই লাইসেন্স হলো সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে গালাগালি করার। বিরোধী দল মনে করে, যেহেতু জনগণ তাদের সরকার গঠনের ম্যান্ডেট দেয়নি তাই দেশের জন্য তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আছে বলে ৯০ দিন পর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সংসদে যেতে হয়। ব্যস, এ পর্যন্তই। এই ধারা চলে আসছে গত দুটি দশক ধরে। আরও স্পষ্ট করে বললে এই সংকট দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে বর্তমান সংসদ অকার্যকর হওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছে। তাই টিআইবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন মোটেও অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। 'বর্তমান জাতীয় সংসদের ৯৭ ভাগ সদস্য নেতিবাচক কাজে জড়িত। এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৫ ভাগ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এবং ২৪ দশমিক ১ ভাগের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই দলীয় নেতাকর্মীদের অপরাধের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সংসদ সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে হত্যা, সরকারি নদী, খাল, পুকুর দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা ইত্যাদি।' উলি্লখিত প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত ১৪ অক্টোবর 'নবম জাতীয় সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা পর্যালোচনা' নামক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তুলে ধরা হয়। ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের মাঝামাঝি সময় ছিল এ প্রতিবেদনের আওতাভুক্ত। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, নেতিবাচক কাজে জড়িত ৯৭ ভাগ সংসদ সদস্যের মধ্যে ৮১ দশমিক ৮ ভাগ স্থানীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রমে প্রভাব সৃষ্টি করেন ও ৭৬ দশমিক ৯ ভাগ স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, যার মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়ন্ত্রণ, সংসদ সদস্যের নিজের পছন্দের সদস্য নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ, অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া, কমিশনের বিনিময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দে অপব্যবহার, বরাদ্দ পেতে দুর্নীতি ইত্যাদি। টিআইবির মতে, গবেষণায় ১৪৯ জন সংসদ সদস্য সম্পর্কে তথ্য সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে ১৪১ জন পুরুষ সদস্য এবং ৮ জন নারী সদস্য। অন্যদিকে ১৪৯ জনের মধ্যে সরকারদলীয় সদস্য ১৩৬ জন এবং বিরোধীদলীয় সদস্য ১৩ জন। এদের মধ্যে ২৭ জন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সম্পর্কেও তথ্য ও মতামত সংগৃহীত হয়।
সংসদ সদস্যদের এরূপ নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। আমরা প্রতিদিনই প্রত্রিকার পাতায় এসব দেখে থাকি। টিআইবির প্রতিবেদনে এসব গুছিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র। সংসদ সদস্যদের এরূপ নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে পড়ার সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। রাখঢাক না রেখে বললে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনকে চিন্তা করেন বিনিয়োগ হিসেবে। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নির্র্বাচিত হতে যা খরচ হয়েছে, পরবর্তী পাঁচ বছরে তার কয়েকগুণ উসুল করাই হয় তার ধ্যান-জ্ঞান। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তিনি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কারণ দুর্নীতি ছাড়া এই বিশাল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে সংসদ প্রায় অকার্যকর। বিরোধী দলবিহীন সংসদ এমনিতেই ম্যাড়মেড়ে আর পানসে, তার ওপর বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তির ক্ষেত্রে সংসদে নেই কোনো আলোচনা। জবাবদিহিতা বলতেও তেমন কিছু নেই। সংসদে অনুপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে রয়েছে অবারিত সুযোগ। এসব কারণে সদস্যরা সংসদে উপস্থিত থাকেন না। এখানে কোরাম সংকট হয় প্রায়ই।
প্রতিবেদনের একটি অংশে উঠে এসেছে, 'চলতি সংসদের ৮০ ভাগ অধিবেশন বর্জন করেছে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।' অথচ সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের আনুকূল্য ভোগ করেছেন শত ভাগ। টিআইবি সুপারিশ করেছে দলগত সংসদ বর্জন আইন করে নিষিদ্ধ করার। এ ছাড়া বর্তমান ৯০ দিনের অনুমোদন কমিয়ে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া সর্বোচ্চ ৩০ দিন এবং একটানা ৭ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা। সময় এসেছে এসব ভেবে দেখার। সংসদকে কার্যকর করতে আইন করে হলেও বিরোধী দলকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায়, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের সব সদস্যকে যে কোনো মূল্যে সংসদমুখী করতে হবে। অন্যথায় সংসদকে কার্যকর করা সম্ভব নয় আর সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ কার্যকর না থাকলে দেশ কি পশ্চাৎমুখী হবে না?
সাইদ সিদ্দিকী : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sayd.rahman@yahoo.com
সংসদ সদস্যদের এরূপ নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। আমরা প্রতিদিনই প্রত্রিকার পাতায় এসব দেখে থাকি। টিআইবির প্রতিবেদনে এসব গুছিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র। সংসদ সদস্যদের এরূপ নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে পড়ার সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। রাখঢাক না রেখে বললে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনকে চিন্তা করেন বিনিয়োগ হিসেবে। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নির্র্বাচিত হতে যা খরচ হয়েছে, পরবর্তী পাঁচ বছরে তার কয়েকগুণ উসুল করাই হয় তার ধ্যান-জ্ঞান। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তিনি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কারণ দুর্নীতি ছাড়া এই বিশাল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে সংসদ প্রায় অকার্যকর। বিরোধী দলবিহীন সংসদ এমনিতেই ম্যাড়মেড়ে আর পানসে, তার ওপর বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তির ক্ষেত্রে সংসদে নেই কোনো আলোচনা। জবাবদিহিতা বলতেও তেমন কিছু নেই। সংসদে অনুপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে রয়েছে অবারিত সুযোগ। এসব কারণে সদস্যরা সংসদে উপস্থিত থাকেন না। এখানে কোরাম সংকট হয় প্রায়ই।
প্রতিবেদনের একটি অংশে উঠে এসেছে, 'চলতি সংসদের ৮০ ভাগ অধিবেশন বর্জন করেছে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।' অথচ সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের আনুকূল্য ভোগ করেছেন শত ভাগ। টিআইবি সুপারিশ করেছে দলগত সংসদ বর্জন আইন করে নিষিদ্ধ করার। এ ছাড়া বর্তমান ৯০ দিনের অনুমোদন কমিয়ে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া সর্বোচ্চ ৩০ দিন এবং একটানা ৭ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা। সময় এসেছে এসব ভেবে দেখার। সংসদকে কার্যকর করতে আইন করে হলেও বিরোধী দলকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায়, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের সব সদস্যকে যে কোনো মূল্যে সংসদমুখী করতে হবে। অন্যথায় সংসদকে কার্যকর করা সম্ভব নয় আর সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ কার্যকর না থাকলে দেশ কি পশ্চাৎমুখী হবে না?
সাইদ সিদ্দিকী : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sayd.rahman@yahoo.com
No comments