আরও দুর্দিনে দুগ্ধশিল্প by শাইখ সিরাজ
আবারও সেই চিত্র। রাস্তার কালো পিচ সাদা হয়ে যাচ্ছে দুধে। মণকে মণ দুধ ঢালা হচ্ছে রাস্তায়। ক্ষোভে-দুঃখে হাহাকার করে উঠছেন হাজারো দুগ্ধ খামারি। তাঁদের সামনে এগোনোর সমস্ত পথই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। গত বছর এপ্রিলে ঠিক একই চিত্র দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেবার পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় টনকে টন দুধ রাস্তায় ঢেলে প্রতিবাদ জানান দুগ্ধ খামারিরা। তখন খামারিদের অভিযোগ ছিল, সরকারি-বেসরকারি দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরে থেকে দুধ আনায় তাঁদের দুধের চাহিদা কমে গেছে। এ জন্য পথে বসার উপক্রম হয়েছে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের লক্ষাধিক খামারি ও দুধ সংগ্রহকারী এজেন্টদের।
দুগ্ধ খামারিদের তখনকার দাবি ছিল, বাইরে থেকে কম দামে গুঁড়া ও তরল দুধ আনা বন্ধ করতে হবে। তখন আকস্মিকভাবে ভারত থেকে বিভিন্ন পথে তরল ও গুঁড়া দুধ এত বেশি আসতে থাকে যে, স্থানীয় বাজারে দুধের চাহিদা একেবারেই পড়ে যায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলো বৈধ-অবৈধ পথে আসা দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে পাঠানোকেই বেশি লাভজনক হিসেবে গ্রহণ করে। যা হোক, পরবর্তী সময় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও সরকারের কাছে দুগ্ধ খামারিদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয় দুধের দেশীয় বাজার কাঠামো জোরদার করার। তিল তিল করে গড়ে ওঠা যে শিল্পের সঙ্গে একে একে বহু মানুষ যুক্ত হয়েছে, এ শিল্প দেশের মোট দুধের চাহিদার খুব অল্প অংশ পূরণ করলেও জাতীয় অর্থনীতি তথা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যে ভূমিকা রাখছে, তা বলাই বাহুল্য। এখন ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সামগ্রিক দুগ্ধশিল্পে। কিন্তু ৬০ লাখ মানুষের স্বার্থের কথা কি আমরা ভাবছি?
প্রশ্নটি উঠল এ কারণে যে ২০১০-২০১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এবার দেশীয় দুগ্ধশিল্পের জন্য চরম ক্ষতিকর একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দিয়ে পরপর তিন বছর বাইরে থেকে আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। এবারের এই শুল্ক হ্রাসের বিষয়টি অনেক বড় আকারের ও দৃষ্টান্তমূলক। প্রস্তাবিত বাজেটে গুঁড়া দুধ আমদানির শুল্কহার ১২ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটিও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৯ সালের বাজেটে গুঁড়া দুধ আমাদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশ করা হয়। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালে ঘোষিত বাজেটে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এই যে পরপর তিন বছর সরকারের এ সিদ্ধান্তের কোনো কার্যকারণ সাধারণ খামারি তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিষ্কার নয়। খামারিরা বুঝেই নিয়েছেন যে দুগ্ধ শিল্পকে কেন্দ্র করে তাঁদের স্বপ্ন দেখার দিন শেষ। পাশাপাশি তাঁরা এও বুঝতে পারছেন যে সরকারও চাইছে না দেশীয় দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন। বাজেট ঘোষণার দুদিন পর পাবনা অঞ্চলের এক দল দুগ্ধ খামারির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। ওই চিঠির শিরোনামে তাঁরা সরকারের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আমাদের পেটে লাথি না মেরে দেশীয় দুগ্ধশিল্পকে বাঁচান।’ খামারিদের এই আকুতি এবং লিখিত বিবরণ পড়ে হতাশ হতে হলো। তাঁরা লিখেছেন, ‘পত্রিকা মারফত জেনেছি যে দেশে নাকি আড়াই শ কোটি লিটার দুধ উৎপাদিত হয়, যার দ্বারা দেশের দুধের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এত বিপুল পরিমাণ তরল দুধ উৎপাদিত হলেও মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ দুধ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে প্রতিবছর ৪০ হাজার মেট্রিক টন গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। আমরা যে দুধ উৎপাদন করছি, তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে উল্টো আমদানি শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে দুধ আমদানিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।’ হয়তো খামারি ভায়েরা খুব বেশি তীব্রভাবে সরকারের কাছে তাঁদের যন্ত্রণা উপস্থাপন করতে পারেননি, কিন্তু সমস্যার মূলে পৌঁছে সরকারের কাছে আসল আবেদনটি করেছেন। খামারিদের ওই চিঠি পড়ে দুগ্ধশিল্পের প্রতি এ পর্যন্ত সরকারের দৃষ্টিপাত এবং ব্যর্থতার নানা চিত্র যা দেখেছি তার অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়।
সত্তর-পরবর্তী সময় দেশীয় দুগ্ধশিল্পের প্রসার এবং গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের জন্য বিদেশি সহায়তায় সাভারে প্রতিষ্ঠিত হয় সাভার ডেইরি। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় দেশে শুরু হয় কৃত্রিম প্রজনন। বাইরে থেকে ষাঁড় এনে দেশের প্রতিটি পশুসম্পদ বিভাগে কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা চালু হয়। গ্রাম পর্যায়ে উন্নত জাতের ষাঁড় ও গাভি বিস্তারের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। দেশীয় গাভির যেখানে দুই তিন সের দুধ হতো, সেখানে উন্নত জাতের গাভির দুধ উৎপাদন শুরু হলো ১৫-২০ সের দিয়ে। কৃষকের ঘরের গাভিটি আঙিনায় কিংবা বাড়ির পাশের মাঠে চরে এবং গৃহস্থালি উপকরণ খেত, কিন্তু উন্নত জাতের গাভিটির খাদ্যব্যবস্থাপনা ভিন্ন। তার খাবারের জন্যও নতুন ভাবনা ভাবতে হলো। প্রয়োজন হলো গাভির সুষম খাবার প্রদানের। এই সুষম খাবার মানেই উচ্চমূল্যের খাবার, বিশেষ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার। এর ধারাবাহিকতায় দেশে শুরু হলো উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন। এভাবেই কৃষক কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার হাত ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করল দুগ্ধশিল্প, কিন্তু এসব খামারির ঘরে উৎপাদিত দুধের বাজারজাত ব্যবস্থা হলো না। অর্থাৎ তৎকালীন সময়ের সেই প্রকল্পটি ছিল অসম্পূর্ণ ও অদূরদর্শী একটি প্রকল্প। তখন চিন্তা করা হয়নি, কোথায় বিক্রি হবে খামারিদের উৎপাদিত দুধ—শুধু মিষ্টির দোকানে কিংবা মানুষের ঘরে ঘরে গৃহস্থালির প্রয়োজনে? তখন পরিকল্পিতভাবে চিলিং প্লান্টও করা হলো না, অথচ সে সময় পৃথিবীর যেখানেই দুগ্ধশিল্পের বিকাশ ঘটছে, সেখানেই সমন্বিতভাবে চিলিং প্লান্ট ও বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। যেটি শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই হলো না।
এই পরিকল্পহীনতার কারণে এখন এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ২০ টাকায় বিক্রি হলেও এক লিটার দুধ ১২-১৪ টাকায়ও বিক্রি হয় না। এটি রাজধানী কিংবা নগরে অবস্থানকারীরা খুব বেশি বুঝে উঠতে পারবেন না। যেসব গ্রামে দুগ্ধশিল্পের প্রসার ঘটেছে, দরিদ্র কৃষক-কৃষাণীরা ঘরে ঘরে দুগ্ধ খামার গড়ে তুলেছেন, তাঁদের দুর্দশার চিত্র কাছে গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্তসংখ্যক চিলিং প্লাট করা হলে তবেই খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারতন, দুধ পাঠাতে পারতেন বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে। বেসরকারি দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই তাদের কারখানা এলাকার মধ্যেই গড়ে তুলেছে চিলিং প্লান্ট, কিন্তু এলাকার বাইরে থেকে দুধ সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা বা কাঠামো তাদের নেই। এর চেয়ে তাদের জন্য গুঁড়া দুধ প্রক্রিয়াজাত করে তরল করাটিই বেশি লাভজনক। তাদের এ সুবিধার পাল্লাই সরকার ভারি করে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে শুধু সরকারের শুল্ক মার যাচ্ছে তা-ই নয়, তিল তিল করে গড়ে ওঠা দেশের বিশাল একটি শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে।
দেশে মিল্ক ভিটার মাধ্যমে দুগ্ধশিল্পকেন্দ্রিক সমবায় বিকাশের যে উদ্যোগ, তাও সীমিত ও ছোট্ট একটি পরিধির মধ্যেই রয়ে গেছে। বেসরকারি দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরের জেলার খামারিদের দুধ কেনার ব্যাপারে কার্যকর কোনো অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। পচনশীল একটি পণ্য হিসেবে খামারির ঘরেই দুধ নষ্ট হচ্ছে। অথচ সারা বিশ্বের সামনে দুগ্ধশিল্পের প্রশ্নে প্রতিবেশী দেশ ভারত এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাদের বিনিয়োগ ও সরকারি-বেসরকারি দৃষ্টিভঙ্গি শুরু থেকেই ছিল নিজস্ব শিল্প সম্প্রসারণের পক্ষে। অথচ আমরা আমাদের নিজস্ব শিল্পকে স্থানীয়ভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলছি। এবারের বাজেটে সরকারি পদক্ষেপ সে কথাই জানান দিচ্ছে। বিষয়টি বাজেট পাস হওয়ার আগেই সরকার ভেবে দেখবে এবং দেশীয় শিল্প রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সেটিই প্রত্যাশা।
শাইখ সিরাজ: কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
shykhseraj@channelitv.net
দুগ্ধ খামারিদের তখনকার দাবি ছিল, বাইরে থেকে কম দামে গুঁড়া ও তরল দুধ আনা বন্ধ করতে হবে। তখন আকস্মিকভাবে ভারত থেকে বিভিন্ন পথে তরল ও গুঁড়া দুধ এত বেশি আসতে থাকে যে, স্থানীয় বাজারে দুধের চাহিদা একেবারেই পড়ে যায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলো বৈধ-অবৈধ পথে আসা দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে পাঠানোকেই বেশি লাভজনক হিসেবে গ্রহণ করে। যা হোক, পরবর্তী সময় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও সরকারের কাছে দুগ্ধ খামারিদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয় দুধের দেশীয় বাজার কাঠামো জোরদার করার। তিল তিল করে গড়ে ওঠা যে শিল্পের সঙ্গে একে একে বহু মানুষ যুক্ত হয়েছে, এ শিল্প দেশের মোট দুধের চাহিদার খুব অল্প অংশ পূরণ করলেও জাতীয় অর্থনীতি তথা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যে ভূমিকা রাখছে, তা বলাই বাহুল্য। এখন ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সামগ্রিক দুগ্ধশিল্পে। কিন্তু ৬০ লাখ মানুষের স্বার্থের কথা কি আমরা ভাবছি?
প্রশ্নটি উঠল এ কারণে যে ২০১০-২০১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এবার দেশীয় দুগ্ধশিল্পের জন্য চরম ক্ষতিকর একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দিয়ে পরপর তিন বছর বাইরে থেকে আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। এবারের এই শুল্ক হ্রাসের বিষয়টি অনেক বড় আকারের ও দৃষ্টান্তমূলক। প্রস্তাবিত বাজেটে গুঁড়া দুধ আমদানির শুল্কহার ১২ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটিও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৯ সালের বাজেটে গুঁড়া দুধ আমাদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশ করা হয়। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালে ঘোষিত বাজেটে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এই যে পরপর তিন বছর সরকারের এ সিদ্ধান্তের কোনো কার্যকারণ সাধারণ খামারি তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিষ্কার নয়। খামারিরা বুঝেই নিয়েছেন যে দুগ্ধ শিল্পকে কেন্দ্র করে তাঁদের স্বপ্ন দেখার দিন শেষ। পাশাপাশি তাঁরা এও বুঝতে পারছেন যে সরকারও চাইছে না দেশীয় দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন। বাজেট ঘোষণার দুদিন পর পাবনা অঞ্চলের এক দল দুগ্ধ খামারির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। ওই চিঠির শিরোনামে তাঁরা সরকারের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আমাদের পেটে লাথি না মেরে দেশীয় দুগ্ধশিল্পকে বাঁচান।’ খামারিদের এই আকুতি এবং লিখিত বিবরণ পড়ে হতাশ হতে হলো। তাঁরা লিখেছেন, ‘পত্রিকা মারফত জেনেছি যে দেশে নাকি আড়াই শ কোটি লিটার দুধ উৎপাদিত হয়, যার দ্বারা দেশের দুধের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এত বিপুল পরিমাণ তরল দুধ উৎপাদিত হলেও মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ দুধ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে প্রতিবছর ৪০ হাজার মেট্রিক টন গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। আমরা যে দুধ উৎপাদন করছি, তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে উল্টো আমদানি শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে দুধ আমদানিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।’ হয়তো খামারি ভায়েরা খুব বেশি তীব্রভাবে সরকারের কাছে তাঁদের যন্ত্রণা উপস্থাপন করতে পারেননি, কিন্তু সমস্যার মূলে পৌঁছে সরকারের কাছে আসল আবেদনটি করেছেন। খামারিদের ওই চিঠি পড়ে দুগ্ধশিল্পের প্রতি এ পর্যন্ত সরকারের দৃষ্টিপাত এবং ব্যর্থতার নানা চিত্র যা দেখেছি তার অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়।
সত্তর-পরবর্তী সময় দেশীয় দুগ্ধশিল্পের প্রসার এবং গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের জন্য বিদেশি সহায়তায় সাভারে প্রতিষ্ঠিত হয় সাভার ডেইরি। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় দেশে শুরু হয় কৃত্রিম প্রজনন। বাইরে থেকে ষাঁড় এনে দেশের প্রতিটি পশুসম্পদ বিভাগে কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা চালু হয়। গ্রাম পর্যায়ে উন্নত জাতের ষাঁড় ও গাভি বিস্তারের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। দেশীয় গাভির যেখানে দুই তিন সের দুধ হতো, সেখানে উন্নত জাতের গাভির দুধ উৎপাদন শুরু হলো ১৫-২০ সের দিয়ে। কৃষকের ঘরের গাভিটি আঙিনায় কিংবা বাড়ির পাশের মাঠে চরে এবং গৃহস্থালি উপকরণ খেত, কিন্তু উন্নত জাতের গাভিটির খাদ্যব্যবস্থাপনা ভিন্ন। তার খাবারের জন্যও নতুন ভাবনা ভাবতে হলো। প্রয়োজন হলো গাভির সুষম খাবার প্রদানের। এই সুষম খাবার মানেই উচ্চমূল্যের খাবার, বিশেষ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার। এর ধারাবাহিকতায় দেশে শুরু হলো উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন। এভাবেই কৃষক কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার হাত ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করল দুগ্ধশিল্প, কিন্তু এসব খামারির ঘরে উৎপাদিত দুধের বাজারজাত ব্যবস্থা হলো না। অর্থাৎ তৎকালীন সময়ের সেই প্রকল্পটি ছিল অসম্পূর্ণ ও অদূরদর্শী একটি প্রকল্প। তখন চিন্তা করা হয়নি, কোথায় বিক্রি হবে খামারিদের উৎপাদিত দুধ—শুধু মিষ্টির দোকানে কিংবা মানুষের ঘরে ঘরে গৃহস্থালির প্রয়োজনে? তখন পরিকল্পিতভাবে চিলিং প্লান্টও করা হলো না, অথচ সে সময় পৃথিবীর যেখানেই দুগ্ধশিল্পের বিকাশ ঘটছে, সেখানেই সমন্বিতভাবে চিলিং প্লান্ট ও বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। যেটি শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই হলো না।
এই পরিকল্পহীনতার কারণে এখন এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ২০ টাকায় বিক্রি হলেও এক লিটার দুধ ১২-১৪ টাকায়ও বিক্রি হয় না। এটি রাজধানী কিংবা নগরে অবস্থানকারীরা খুব বেশি বুঝে উঠতে পারবেন না। যেসব গ্রামে দুগ্ধশিল্পের প্রসার ঘটেছে, দরিদ্র কৃষক-কৃষাণীরা ঘরে ঘরে দুগ্ধ খামার গড়ে তুলেছেন, তাঁদের দুর্দশার চিত্র কাছে গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্তসংখ্যক চিলিং প্লাট করা হলে তবেই খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারতন, দুধ পাঠাতে পারতেন বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে। বেসরকারি দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই তাদের কারখানা এলাকার মধ্যেই গড়ে তুলেছে চিলিং প্লান্ট, কিন্তু এলাকার বাইরে থেকে দুধ সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা বা কাঠামো তাদের নেই। এর চেয়ে তাদের জন্য গুঁড়া দুধ প্রক্রিয়াজাত করে তরল করাটিই বেশি লাভজনক। তাদের এ সুবিধার পাল্লাই সরকার ভারি করে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে শুধু সরকারের শুল্ক মার যাচ্ছে তা-ই নয়, তিল তিল করে গড়ে ওঠা দেশের বিশাল একটি শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে।
দেশে মিল্ক ভিটার মাধ্যমে দুগ্ধশিল্পকেন্দ্রিক সমবায় বিকাশের যে উদ্যোগ, তাও সীমিত ও ছোট্ট একটি পরিধির মধ্যেই রয়ে গেছে। বেসরকারি দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরের জেলার খামারিদের দুধ কেনার ব্যাপারে কার্যকর কোনো অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। পচনশীল একটি পণ্য হিসেবে খামারির ঘরেই দুধ নষ্ট হচ্ছে। অথচ সারা বিশ্বের সামনে দুগ্ধশিল্পের প্রশ্নে প্রতিবেশী দেশ ভারত এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাদের বিনিয়োগ ও সরকারি-বেসরকারি দৃষ্টিভঙ্গি শুরু থেকেই ছিল নিজস্ব শিল্প সম্প্রসারণের পক্ষে। অথচ আমরা আমাদের নিজস্ব শিল্পকে স্থানীয়ভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলছি। এবারের বাজেটে সরকারি পদক্ষেপ সে কথাই জানান দিচ্ছে। বিষয়টি বাজেট পাস হওয়ার আগেই সরকার ভেবে দেখবে এবং দেশীয় শিল্প রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সেটিই প্রত্যাশা।
শাইখ সিরাজ: কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
shykhseraj@channelitv.net
No comments