‘বছরে তিন কাল—গরম-শীত-বাদলা’ by উদিসা ইসলাম
দুপুর। রাজধানীর বিজয় সরণিতে জ্বলছে লালবাতি। নানা বয়সী শিশুরা নানা রকম জিনিস বিক্রি করে যাচ্ছে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে। সংবাদপত্র-পপকর্ন-চকলেট-তোয়ালে-ফুল-মুঠোফোনের আবরণ, আরও কত কি। সবুজ বাতিতে রাস্তা ব্যস্ত হলে সব বিক্রেতা মোড়ের ফোয়ারার বেদিতে বিশ্রাম নিতে বসে। মাথা গুনে দেখা গেল, ওরা ১৭ জন। এর মধ্যে ছয়জনের হাতে ফুল—গোলাপ, মল্লিকা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ। এরই মধ্যে আবারও জ্বলে ওঠে লালবাতি। লাল-সবুজ-লাল বাতির আসা-যাওয়ার মধ্যেই ওদের সঙ্গে পরিচিত হই। এরপর ওদের পাশে পাশে রাস্তায় নেমে যাই। ওরা কী বলে এসব জিনিস বিক্রি করে তা শুনব। ওরা কী নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে তা জানব।
জানতে চাইলাম, এক জায়গায় রোজ বিক্রি করো, ক্রেতা পাও? ফোকলা দাঁতে হেসে উত্তর দেয় আট বছরের মেয়ে বেলি, ‘পেত্যেক দিন নতুন নতুন কথা তৈরি কইরা দেয় মায়ে। এক কথা রোজ শুনব নাকি?’
‘গতকাল কী বলে বিক্রি করছিলে?’ জানতে চাই।
‘মনে নাই।’
ফুল কখন বিক্রি হয় বেশি বলতে গিয়ে সে বলে, ‘কদম ফুটলে আর ভাইয়া বেড়াইতে নিয়া আইলে।’
এখন কী কাল চলছে, সেটা সে জানে কি না জানতে চাইলে দুই পাশে মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয়, সে জানে না।
তাকে কিছুক্ষণ আমাদের কালগুলো নিয়ে গল্প করেতই সে বলল, ‘বুঝছি, ফুল বেশি ফুটলেই বসন্ত।’
অমনি নয় বছরের ছেলে বেলাল বলে ওঠে, ‘আপনে মিথ্যা বলতেছেন। এক বছরে তিন কাল—গরম-শীত-বাদলা।’
ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সংসদ ভবনের পেছনে। আট বছরের শিশু লাইলী এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের অনুরোধ করছে, ‘একটা নেন, খিদে লাগসে, খাব।’ খালি পা, হাতাকাটা ময়লা জামা, এলোমেলো চুল।
‘কবে থেকে এখানে বিক্রি করছ?’
‘এই রবিবারের আগের রবিবার।’ মোটামুটি শুদ্ধ ভাষা। মা কোথায়, জানতে চাইলে সে সতর্ক হয়ে পাশের ১১ বছরের পপকর্ন বিক্রেতা হালিমকে ডাক দেয়। ছেলেটি কাছে আসতেই এবার মেয়েটি বলে ওঠে, ‘অপরিচিত কেউ কথা বলতে আইলে মা হালিম ভাইরে ডাকতে বলে।’ ওদের দুজনেরই মা শ্যামলীর একটি বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে থাকেন। ওদের একজনের মা ফুলের তোড়া বানান আর অন্যজনের মা ছোট ভাইকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করেন।
ওদের সঙ্গে সারা দিন থাকতে চাইলে একজন বলে, ‘আমরা তো সারা দিন রোডেই থাকি। এখানে আপনি কী করবেন?’
‘তোমাদের সারা দিনের কাজ দেখব’—বলতেই ওরা উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। কারণ জানতে চাইলে একটু দূরে বসে থাকা প্রতিবন্ধী মোখলেস বলেন, ‘এখানে এনজিওর মহিলারা আসে মাঝে মাঝে। কাজ বন্ধ রাইখ্যা তাদের সাথে কথা বললে দিন শেষে বয়স বুঝে টাকা দেয়। পর পর দুবার তাদের সাথে কথা বলে দিন শেষে এনজিও আপারা যে টাকা দিছে, তা তাদের দিনের আয়ের চেয়ে কম হইছে। তাই এরা আর এনজিওদের কথা শুনবে না বলছে।’
পথে হকার বা ভিক্ষা করা শিশুদের বেসরকারি উদ্যোগে পড়ানোর প্রচেষ্টা কাগজে-কলমে থাকলেও আসলে সেগুলো কার্যকর কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। রোকেয়া সরণি থেকে প্রেসক্লাবের সামনে পর্যন্ত যত জন শিশু রয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই হাতেখড়িও হয়নি। মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও নাজুক।
বেলির মা শেফালি বেগম বিক্রিবাটা শেষ হলে মেয়েকে ডাকতে আসেন। বেলিকে কোনোভাবে স্কুলে পাঠানো যায় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যারা নাকি পুরা পড়াবে না। দু-তিন বছর পেটে শিক্ষা ঢুকার পর মাইয়া কী করব? পড়ার দেমাগে তো রাস্তায় নামবার চাইবে না?’ বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ একেবারেই কম কেন, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিশু অধিকারবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেগুলোর সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছা নেই। যেটুকু চেষ্টা আছে, সেটা শ্রমজীবী শিশুদের জন্য, পথশিশুদের সেখানে কম উৎসাহিত করা হয়।’
রাজধানীর নানা সড়ক ওদের বাঁচিয়ে রাখে, কখনো কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় সেখানেই ওদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। শীতে গায়ে সোয়েটার নেই, গরমে মশা আছে, কিন্তু মশারি নেই। মাথার ওপর ফ্যান নেই। বর্ষায় বৃষ্টি নামলে মধ্যরাতে দৌড়ে আশ্রয় খুঁজতে হয়। এরা বসন্ত চিনবে কেন? ভাত-কাপড় আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ওদের জীবনের শেষ। এই পথশিশুদের অভিভাবক কিংবা এদের পড়ানোর বিষয়ে যে সংস্থাগুলো ভাবে বলে দাবি করা হয়, তাদের সবাই মনে করে, পড়ার পেছনে সময় দিলে হয়তো দুবেলা পেটে ভাত জুটবে না। আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে দিতে পারছে না বলেও এদের ভাগ্যে নতুন মাত্রা যোগ হবে না। আমরা কি ওদের খাবারের জোগান বা পড়ার সুযোগ করে দিতে পারব?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের না জানা থাকলেও ওরা জানে। ওরা জানে, খুব কম মানুষ অন্যের ভালো করে। ওরা জানে, জোর করে নিজের জায়গা করে নিতে হয়। ওরা এও জানে, ওদেরও মানুষের মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল, যাঁরা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করছেন, তাঁরাই সেই কথা রাখেননি।
জানতে চাইলাম, এক জায়গায় রোজ বিক্রি করো, ক্রেতা পাও? ফোকলা দাঁতে হেসে উত্তর দেয় আট বছরের মেয়ে বেলি, ‘পেত্যেক দিন নতুন নতুন কথা তৈরি কইরা দেয় মায়ে। এক কথা রোজ শুনব নাকি?’
‘গতকাল কী বলে বিক্রি করছিলে?’ জানতে চাই।
‘মনে নাই।’
ফুল কখন বিক্রি হয় বেশি বলতে গিয়ে সে বলে, ‘কদম ফুটলে আর ভাইয়া বেড়াইতে নিয়া আইলে।’
এখন কী কাল চলছে, সেটা সে জানে কি না জানতে চাইলে দুই পাশে মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয়, সে জানে না।
তাকে কিছুক্ষণ আমাদের কালগুলো নিয়ে গল্প করেতই সে বলল, ‘বুঝছি, ফুল বেশি ফুটলেই বসন্ত।’
অমনি নয় বছরের ছেলে বেলাল বলে ওঠে, ‘আপনে মিথ্যা বলতেছেন। এক বছরে তিন কাল—গরম-শীত-বাদলা।’
ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সংসদ ভবনের পেছনে। আট বছরের শিশু লাইলী এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের অনুরোধ করছে, ‘একটা নেন, খিদে লাগসে, খাব।’ খালি পা, হাতাকাটা ময়লা জামা, এলোমেলো চুল।
‘কবে থেকে এখানে বিক্রি করছ?’
‘এই রবিবারের আগের রবিবার।’ মোটামুটি শুদ্ধ ভাষা। মা কোথায়, জানতে চাইলে সে সতর্ক হয়ে পাশের ১১ বছরের পপকর্ন বিক্রেতা হালিমকে ডাক দেয়। ছেলেটি কাছে আসতেই এবার মেয়েটি বলে ওঠে, ‘অপরিচিত কেউ কথা বলতে আইলে মা হালিম ভাইরে ডাকতে বলে।’ ওদের দুজনেরই মা শ্যামলীর একটি বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে থাকেন। ওদের একজনের মা ফুলের তোড়া বানান আর অন্যজনের মা ছোট ভাইকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করেন।
ওদের সঙ্গে সারা দিন থাকতে চাইলে একজন বলে, ‘আমরা তো সারা দিন রোডেই থাকি। এখানে আপনি কী করবেন?’
‘তোমাদের সারা দিনের কাজ দেখব’—বলতেই ওরা উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। কারণ জানতে চাইলে একটু দূরে বসে থাকা প্রতিবন্ধী মোখলেস বলেন, ‘এখানে এনজিওর মহিলারা আসে মাঝে মাঝে। কাজ বন্ধ রাইখ্যা তাদের সাথে কথা বললে দিন শেষে বয়স বুঝে টাকা দেয়। পর পর দুবার তাদের সাথে কথা বলে দিন শেষে এনজিও আপারা যে টাকা দিছে, তা তাদের দিনের আয়ের চেয়ে কম হইছে। তাই এরা আর এনজিওদের কথা শুনবে না বলছে।’
পথে হকার বা ভিক্ষা করা শিশুদের বেসরকারি উদ্যোগে পড়ানোর প্রচেষ্টা কাগজে-কলমে থাকলেও আসলে সেগুলো কার্যকর কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। রোকেয়া সরণি থেকে প্রেসক্লাবের সামনে পর্যন্ত যত জন শিশু রয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই হাতেখড়িও হয়নি। মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও নাজুক।
বেলির মা শেফালি বেগম বিক্রিবাটা শেষ হলে মেয়েকে ডাকতে আসেন। বেলিকে কোনোভাবে স্কুলে পাঠানো যায় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যারা নাকি পুরা পড়াবে না। দু-তিন বছর পেটে শিক্ষা ঢুকার পর মাইয়া কী করব? পড়ার দেমাগে তো রাস্তায় নামবার চাইবে না?’ বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ একেবারেই কম কেন, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিশু অধিকারবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেগুলোর সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছা নেই। যেটুকু চেষ্টা আছে, সেটা শ্রমজীবী শিশুদের জন্য, পথশিশুদের সেখানে কম উৎসাহিত করা হয়।’
রাজধানীর নানা সড়ক ওদের বাঁচিয়ে রাখে, কখনো কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় সেখানেই ওদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। শীতে গায়ে সোয়েটার নেই, গরমে মশা আছে, কিন্তু মশারি নেই। মাথার ওপর ফ্যান নেই। বর্ষায় বৃষ্টি নামলে মধ্যরাতে দৌড়ে আশ্রয় খুঁজতে হয়। এরা বসন্ত চিনবে কেন? ভাত-কাপড় আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ওদের জীবনের শেষ। এই পথশিশুদের অভিভাবক কিংবা এদের পড়ানোর বিষয়ে যে সংস্থাগুলো ভাবে বলে দাবি করা হয়, তাদের সবাই মনে করে, পড়ার পেছনে সময় দিলে হয়তো দুবেলা পেটে ভাত জুটবে না। আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে দিতে পারছে না বলেও এদের ভাগ্যে নতুন মাত্রা যোগ হবে না। আমরা কি ওদের খাবারের জোগান বা পড়ার সুযোগ করে দিতে পারব?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের না জানা থাকলেও ওরা জানে। ওরা জানে, খুব কম মানুষ অন্যের ভালো করে। ওরা জানে, জোর করে নিজের জায়গা করে নিতে হয়। ওরা এও জানে, ওদেরও মানুষের মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল, যাঁরা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করছেন, তাঁরাই সেই কথা রাখেননি।
No comments