নির্বাচনের তাৎপর্য by রবার্ট ফিস্ক
২০০৫ সালের নির্বাচনে হাজার হাজার ইরাকি তাদের দেশকে ‘গণতান্ত্রিক’ প্রমাণ করার জন্য আত্মঘাতী বোমা হামলা অগ্রাহ্য করে ভোট দেয়। শিয়ারা ভোট দেয় তাদের ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশে আর সুন্নিরা নীরব প্রতিবাদ হিসেবে নির্বাচন বয়কট করে। সেই নির্বাচনের পরই আসে আধুনিক ইরাকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী সময়। আর এ বছর ৭ মার্চ আবার হাজার হাজার ইরাকি মর্টারের গুলির শব্দ ছাপিয়ে গেল ভোট দিতে। ভোটকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আগেই মারা পড়ল কমপক্ষে ২৪ জন। আরেকবার ইরাককে ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ প্রমাণ করতে তারা ভোট দিল।
এবারের নির্বাচনে সুন্নিরাও ভোট দিল। পশ্চিমারা চায় অতীতকে ভুলতে, এমনকি নিকট অতীতকেও। সংবাদমাধ্যমে খুব কমসংখ্যক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও কয়েক শ প্রার্থীর উপর একসময় বাথ পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অজুহাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তাঁদের বেশির ভাগ সুন্নি। এটা ছিল স্পষ্টত গোষ্ঠীগত রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন। উল্লেখ্য, সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ শিয়ারা ‘গণতান্ত্রিক’ ইরাকে এখনো তাদের পদ ঠিকই ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন।
ইরাকের নতুন আইনের আওতায় নির্বাচনব্যবস্থা এমনভাবে উল্টেপাল্টে দেওয়া হয়েছে, যেন কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় আসতে না পারে তা নিশ্চিত করা যায়। ৮৬টি দলের ছয় হাজার প্রার্থীর মধ্যে যারাই সংসদে আসুক না কেন, তাদের ক্ষমতাসীন হতে হলে কোনো না কোনো জোট গঠন করতেই হবে—এমনটাই জানাচ্ছেন টেলিভিশনের বিশ্লেষকেরা। কিন্তু এই সবকিছুর অর্থ হলো, যে গোষ্ঠীগত সরকার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতার বিন্যাস হবে দেশটির শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের সংখ্যানুপাতে।
পশ্চিমা বিশ্ব সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে এমন ব্যবস্থা চেয়েছে। তারা জানে, এমন ‘গণতন্ত্রে’ যে সরকার আসবে তাতে প্রতিটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা হবে। উত্তর আয়ারল্যান্ডে এমনটা করা হয়েছে। সাইপ্রাসে করা হয়েছে। ফ্রান্স এমন এক লেবানন তৈরি করে গেছে, যেখানে সংসদ, সরকারি সেবা খাতের মতো জায়গায় প্রতিটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে অংশীদারি থাকার কথা। এর ফলে প্রতিটি গোষ্ঠী দেশটির অস্তিত্বের স্বার্থে সন্দেহপূর্ণ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। এমনকি আফগানিস্তানেও পশ্চিমারা দুর্নীতিবাজ হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে লেনদেনে এবং পশ্চিমাদের পক্ষে শাসন চালিয়ে যেতে দিতে আগ্রহী। কারজাই শাসন চালাচ্ছেন বেতনভুক উপজাতীয় সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে তৈরি এক সেনাবাহিনী দিয়ে। এটা হয়তো ‘জেফারসনীয় গণতন্ত্র’ নয়, কিন্তু পশ্চিমাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্পও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আর শোচনীয় এসব ব্যবস্থার সমর্থনে পশ্চিমারা বারবার একই ধরনের কথার ধোয়া তোলেন। আপনি কি চান তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসুক? সাদ্দামের প্রত্যাবর্তন ঘটুক? কিংবা সাইপ্রাস বা লেবাননে কয়েক দশক আগের মতো অটোমান তুর্কিদের প্রত্যাবর্তন কি চান? আর নির্বাচনে যতই জালিয়াতি হোক বা নির্বাচনপ্রক্রিয়া যতই জটিল হোক, নির্বাচনের ফল তো একটি অগ্রগতি—এভাবে দেখলে কারা আসলে নির্বাচনে জিতল তা নিয়ে আর ভাবা হয়ে ওঠে না।
ইরাকের সুন্নি রাজনীতিকেরা দাবি করেন, ইরান সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইরাকে হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু বর্তমানে শাসক দলগুলোর বেশির ভাগ ইরানে প্রতিপালিত হওয়ায় ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির হস্তক্ষেপের কোনো দরকার আসলে নেই। যে দলটির প্রতি এখন পশ্চিমারা শ্রদ্ধায় নতজানু হয়, সেই দাওয়া পার্টি বছর কুড়ি আগেও বৈরুতে বিদেশিদের অপহরণ করত, আর কুয়েত সিটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফরাসি দূতাবাসে বোমা হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমারা এখন উত্তর ইরাকের মসুল ও অন্য নগরগুলোর নামও নিচ্ছে না। এসব এলাকায় নির্বাচনে গণতন্ত্র কোনো মুখ্য বিষয় নয়, বরং আরব-কুর্দি সীমান্ত এলাকার তেলের নিয়ন্ত্রণ কে করবে তার মীমাংসাটাই প্রধান বিবেচ্য।
ইরাকি জনগণ অত্যন্ত সাহসী। মর্টারের গুলির ভেতর ভোট দিতে যেতেন কয়জন ব্রিটিশ? কিংবা আমেরিকান? মুসলমানেরা স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র চায় না এমন নয়। আসলে যখন কোনো দেশ পশ্চিমা সেনাদের দখলে থাকে, তখন সে দেশে ‘গণতন্ত্র’ ভালোমতো কাজ করে না বলে মনে হয়। আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ কাজ করেনি। ইরাক থেকে আমেরিকার ‘যোদ্ধা’বাহিনী প্রত্যাহারের অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখে ইরাকে রয়ে যাবে না।
আর যত দিন পর্যন্ত মোবারক আর বাদশাহ আবদুল্লাহর মতো নেতারা পশ্চিমাদের প্রশ্নহীন রাজনৈতিক সমর্থন পেতে থাকবেন, তত দিন তাঁদের দেশগুলো মুক্তি অর্জনের পথে সত্যিকারের কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারবে না।
তাই ইরাকে নির্বাচনের দিনটিতে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাড়তি কোনো প্রমাণ মেলে না। এই নির্বাচনের সত্যিকার অর্থ হলো, ইরাকের সাহসী জনগণ এখনো বিশ্বাস করে, যে ব্যবস্থার অধীনে তারা ভোট দিচ্ছে তা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাবে।
অবশ্য অতীতের বহুবারের মতো এই নির্বাচন ধারণ করবে গোষ্ঠীগত বিভক্তিকে, যে বিভক্তি কাজে লাগিয়ে একসময় নির্মম শাসন চালিয়েছিলেন সাদ্দাম। এবার সেই বিভক্তির আত্তীকরণ ঘটছে পশ্চিমাদের চোখের সামনেই।
দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
এবারের নির্বাচনে সুন্নিরাও ভোট দিল। পশ্চিমারা চায় অতীতকে ভুলতে, এমনকি নিকট অতীতকেও। সংবাদমাধ্যমে খুব কমসংখ্যক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও কয়েক শ প্রার্থীর উপর একসময় বাথ পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অজুহাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তাঁদের বেশির ভাগ সুন্নি। এটা ছিল স্পষ্টত গোষ্ঠীগত রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন। উল্লেখ্য, সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ শিয়ারা ‘গণতান্ত্রিক’ ইরাকে এখনো তাদের পদ ঠিকই ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন।
ইরাকের নতুন আইনের আওতায় নির্বাচনব্যবস্থা এমনভাবে উল্টেপাল্টে দেওয়া হয়েছে, যেন কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় আসতে না পারে তা নিশ্চিত করা যায়। ৮৬টি দলের ছয় হাজার প্রার্থীর মধ্যে যারাই সংসদে আসুক না কেন, তাদের ক্ষমতাসীন হতে হলে কোনো না কোনো জোট গঠন করতেই হবে—এমনটাই জানাচ্ছেন টেলিভিশনের বিশ্লেষকেরা। কিন্তু এই সবকিছুর অর্থ হলো, যে গোষ্ঠীগত সরকার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতার বিন্যাস হবে দেশটির শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের সংখ্যানুপাতে।
পশ্চিমা বিশ্ব সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে এমন ব্যবস্থা চেয়েছে। তারা জানে, এমন ‘গণতন্ত্রে’ যে সরকার আসবে তাতে প্রতিটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা হবে। উত্তর আয়ারল্যান্ডে এমনটা করা হয়েছে। সাইপ্রাসে করা হয়েছে। ফ্রান্স এমন এক লেবানন তৈরি করে গেছে, যেখানে সংসদ, সরকারি সেবা খাতের মতো জায়গায় প্রতিটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে অংশীদারি থাকার কথা। এর ফলে প্রতিটি গোষ্ঠী দেশটির অস্তিত্বের স্বার্থে সন্দেহপূর্ণ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। এমনকি আফগানিস্তানেও পশ্চিমারা দুর্নীতিবাজ হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে লেনদেনে এবং পশ্চিমাদের পক্ষে শাসন চালিয়ে যেতে দিতে আগ্রহী। কারজাই শাসন চালাচ্ছেন বেতনভুক উপজাতীয় সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে তৈরি এক সেনাবাহিনী দিয়ে। এটা হয়তো ‘জেফারসনীয় গণতন্ত্র’ নয়, কিন্তু পশ্চিমাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্পও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আর শোচনীয় এসব ব্যবস্থার সমর্থনে পশ্চিমারা বারবার একই ধরনের কথার ধোয়া তোলেন। আপনি কি চান তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসুক? সাদ্দামের প্রত্যাবর্তন ঘটুক? কিংবা সাইপ্রাস বা লেবাননে কয়েক দশক আগের মতো অটোমান তুর্কিদের প্রত্যাবর্তন কি চান? আর নির্বাচনে যতই জালিয়াতি হোক বা নির্বাচনপ্রক্রিয়া যতই জটিল হোক, নির্বাচনের ফল তো একটি অগ্রগতি—এভাবে দেখলে কারা আসলে নির্বাচনে জিতল তা নিয়ে আর ভাবা হয়ে ওঠে না।
ইরাকের সুন্নি রাজনীতিকেরা দাবি করেন, ইরান সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইরাকে হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু বর্তমানে শাসক দলগুলোর বেশির ভাগ ইরানে প্রতিপালিত হওয়ায় ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির হস্তক্ষেপের কোনো দরকার আসলে নেই। যে দলটির প্রতি এখন পশ্চিমারা শ্রদ্ধায় নতজানু হয়, সেই দাওয়া পার্টি বছর কুড়ি আগেও বৈরুতে বিদেশিদের অপহরণ করত, আর কুয়েত সিটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফরাসি দূতাবাসে বোমা হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমারা এখন উত্তর ইরাকের মসুল ও অন্য নগরগুলোর নামও নিচ্ছে না। এসব এলাকায় নির্বাচনে গণতন্ত্র কোনো মুখ্য বিষয় নয়, বরং আরব-কুর্দি সীমান্ত এলাকার তেলের নিয়ন্ত্রণ কে করবে তার মীমাংসাটাই প্রধান বিবেচ্য।
ইরাকি জনগণ অত্যন্ত সাহসী। মর্টারের গুলির ভেতর ভোট দিতে যেতেন কয়জন ব্রিটিশ? কিংবা আমেরিকান? মুসলমানেরা স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র চায় না এমন নয়। আসলে যখন কোনো দেশ পশ্চিমা সেনাদের দখলে থাকে, তখন সে দেশে ‘গণতন্ত্র’ ভালোমতো কাজ করে না বলে মনে হয়। আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ কাজ করেনি। ইরাক থেকে আমেরিকার ‘যোদ্ধা’বাহিনী প্রত্যাহারের অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখে ইরাকে রয়ে যাবে না।
আর যত দিন পর্যন্ত মোবারক আর বাদশাহ আবদুল্লাহর মতো নেতারা পশ্চিমাদের প্রশ্নহীন রাজনৈতিক সমর্থন পেতে থাকবেন, তত দিন তাঁদের দেশগুলো মুক্তি অর্জনের পথে সত্যিকারের কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারবে না।
তাই ইরাকে নির্বাচনের দিনটিতে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাড়তি কোনো প্রমাণ মেলে না। এই নির্বাচনের সত্যিকার অর্থ হলো, ইরাকের সাহসী জনগণ এখনো বিশ্বাস করে, যে ব্যবস্থার অধীনে তারা ভোট দিচ্ছে তা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাবে।
অবশ্য অতীতের বহুবারের মতো এই নির্বাচন ধারণ করবে গোষ্ঠীগত বিভক্তিকে, যে বিভক্তি কাজে লাগিয়ে একসময় নির্মম শাসন চালিয়েছিলেন সাদ্দাম। এবার সেই বিভক্তির আত্তীকরণ ঘটছে পশ্চিমাদের চোখের সামনেই।
দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments