নাম বদলে আমজনতার কী লাভ by সোহরাব হাসান

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকেরা নাকি উত্তরসূরিদের জন্য তিনটি সিলবদ্ধ খাম রেখে যেতেন এবং নির্দেশ দিয়ে যেতেন কখন কোন খামটি খুলতে হবে। প্রথম খামটি খুলতে হবে মেয়াদের প্রথম বছরে। এতে লেখা থাকত, পূর্বসূরিদের ভ্রান্তনীতির কারণে দেশের এত দুরবস্থা। দ্বিতীয় খামটি খুলতে হবে মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে। তাতে লেখা থাকত, গত সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো বাতিল করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। আর শেষ খামটিতে থাকত, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে কাজ শেষ করা সম্ভব হলো না। দেশ ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে তাদের আরো দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা জরুরি জনগণের দায়িত্ব।
বাংলাদেশেও যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন বা অতীতে ছিলেন, তারা কমবেশি এই নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। ভবিষ্যতে যারা আসবেন, তাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই ধারণা করি। তবে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ক্ষমতাসীনদের আরেকটি ফরজ কাজ হয়ে দাঁড়ায় পুরোনো নামফলক তুলে নতুন নামফলক বসানো। প্রবাদ আছে—নামে কী বা আসে যায়। কাজই নাকি আসল পরিচয়। কিন্তু আমাদের জনদরদি নেতা-নেত্রীরা কাজের চেয়ে নামকেই বেশি গুরুত্ব দেন। ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারি বেতার-টিভিতে হররোজ তাঁদের নাম ও মহিমা প্রচার হয়। পত্রিকার পাতায় নিজেদের ছবি দেখে তাঁরা যারপরনাই আহলাদিত হন। আবার বিরোধী দলে গেলে সরকারি বেতার-টিভিতে কারও চেহারা দেখা যাবে না, কথাও শোনা যাবে না। এই হলো কথিত গণতান্ত্রিক শাসনের অদ্ভুত নীতি। এ কারণেই ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য মরিয়া তাঁরা। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ মঙ্গলবার সংসদে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁরা ক্ষমতায় আসবেন এবং আওয়ামী লীগের বদলে দেওয়া নাম তাঁরা আবার বদলে ফেলবেন। এই যে বারবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করা হচ্ছে তাতে আমজনতার কী আসে যায়?
নির্বাচনের আগে নেতা-নেত্রীরা জনগণের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁরা জনগণের কথা খুব একটা মনে রাখেন না। নির্বাচনের আগে নেতা-নেত্রীরা বড় বড় বুলি কপচান। কেউ বাংলাদেশকে ইমার্জিং টাইগার হওয়ার খোয়াব দেখান, কেউ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন। কিন্তু সেসব স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিতে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরের স্থান পৃথিবীর মন্দ শহরের তালিকার দ্বিতীয় শীর্ষে। রাস্তায় ভয়াবহ যানজট। গ্রীষ্ম না আসতেই ঘন ঘন লোডশেডিং। ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ। বাড়ছে মশার উপদ্রব। সেসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সংসদে জনগণের অভাব-অভিযোগ, সমস্যা-সংকট নিয়ে কথা হয় না। জনপ্রতিনিধিরা ব্যতিব্যস্ত মৃত নেতাদের মুরদাবাদ ও জিন্দাবাদে।
গত ৩৯ বছরে বাংলাদেশে কোনো উন্নতি হয়নি তা বলব না। উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। রাজনীতিকদের ভাগ্যের বদল হয়েছে। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ভাগ্যের বদল হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের বদল হয়েছে। ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। যাঁরা আগে গলি-ঘুপচিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন, তাঁরা গুলশান-বনানীর আলিশান বাড়িতে উঠে গেছেন। কিন্তু ভাগ্যের বদল হয়নি সাধারণ মানুষের। এখনো তাঁরা খোলা বাজার থেকে ২২ টাকা কেজি চাল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ান, জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হন। তৈরি পোশাক কারখানায় দৈনিক ১০/১২ ঘন্টা শ্রম দিয়েও নিয়মিত বেতন পাননা। দারিদ্র্য কমাতে সরকারি-বেসরকারি এত উদ্যোগ-আয়োজন, এত সভা-সেমিনার, দাতাদের এত ঋণ-অনুদান; তার পরও দেশের শতকরা ৪০ ভাগ লোক মনবেতর জীবন যাপন করছে। জনসংখ্যার অর্ধেক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিশুদের বড় অংশ বেঁচে থাকার জন্য শ্রম দিতে বাধ্য হয়। গ্রামগঞ্জে ফতোয়াবাজির শিকার হচ্ছেন অসংখ্য নারী। এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
নেতা-নেত্রীরা বর্তমান নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা অতীত চর্চায় জীবন ও রাজনীতির অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। শুনেছি, ভূত নাকি পেছনের দিকে হাঁটে, আমাদের নেতা-নেত্রীদের অবস্থাও তা-ই। মীমাংসিত বিষয় নিয়ে তাঁরা ঝগড়া-ফ্যাসাদে আনন্দ পান। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেওয়ার এবং দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এ ঝগড়াটি ব্যক্তিগত বা দলীয় পর্যায়ে সীমিত থাকলে আমজনতার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন রাষ্ট্রকে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তখনই ঝামেলা বাধে। এক পক্ষ নাম বদলে মরিয়া হয়ে ওঠে, অন্য পক্ষ সেই বদল ঠেকাতে মাঠে নামে। নাম নিয়ে এত কাদা ছোড়াছুড়ি অন্য কোনো দেশে হয় বলে জানা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের স্থপতি, সে ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন, তাও অস্বীকার করা যাবে না। তাই বলে যত্রতত্র তাঁর নাম ব্যবহার করতে হবে কেন? এতে কি তাঁর মর্যাদা বাড়ে না কমে? একটি সাফারি পার্কের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থপতির নাম যুক্ত করারই বা কী যুক্তি থাকতে পারে? জিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে বিএনপি একটি খারাপ নজির স্থাপন করেছিল, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারও সবকিছু থেকে জিয়ার নাম মুছে দিয়ে সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়ার তুলনা হতে পারে না। সেই তুলনা যারা করেন নিঃসন্দেহে তারা মতলববাজ। কিন্তু এও মানতে হবে ২৮ বছর পর জিয়া বিমানবন্দরের নাম বদলানো ঠিক হয়নি। স্পিকার বলেছেন, দুই দলই সওয়াব কামাচ্ছে। আসলে তারা সওয়াব কামাচ্ছে না, নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছে। মওদুদ আহমদের দাবি অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে বা পরের যে কোন নির্বাচনে যদি ক্ষমতায় এসে তাঁরা নাম বদলের প্রতিশোধ নেন, তখন কী হবে? জিয়াউর রহমানের যতই দোষ থাকুক, এরশাদের চেয়ে খারাপ লোক তিনি নন। জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছেন। এ অভিযোগ অসত্যনয়। তবে ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের অন্যতম হোতা সৈয়দ ফারুক রহমানকেদেশে এনে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার কাজটি করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমানে মহাজোট সরকারের শরিক ও ডিজিটাল বাংলাদেশের সহযাত্রী। এখানে সুবিধা না তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গেই জোট বাধতেন। ক্ষমতার রাজনীতি কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় বলা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির আমলে দুই থেকে আড়াই শ প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করা হয়েছিল। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম তারা বদল করেছে সিদ্ধান্ত নিয়ে, আরবাকিগুলো করেছে গায়ের জোরে। যেমন—বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, চট্টগ্রাম এম এ হান্নান বিমানবন্দর, জলযান এসটি শহীদ শেখ কামাল, জলযান এসটি শেখ জামাল, জলযান এসটি শেখ রাসেল, এসটি শহীদ সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, চন্দ্রিমা উদ্যান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি, শহীদ এম মনসুর আলী অডিটরিয়াম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র, শেখ ফজলুল হক স্মৃতি মিলনায়তনের নাম বদলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলকও তারা তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। অন্যদিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়াম, সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়াম ইত্যাদির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে সিদ্ধান্ত নিয়ে। এসব সিদ্ধান্তের পেছনে ব্যক্তি ও দলীয় বিদ্বেষ যেমন কাজ করেছে, তেমনি কাজ করেছে নগদ নারায়ণও। প্রতিটি নামফলক বদলাতে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। নতুন করে সাইনবোর্ড লেখানো হয়েছে, প্যাড ছাপাতে হয়েছে, মনোগ্রাম বদলাতে হয়েছে। এ নাম বদলের মাহাত্ম্য ফাঁস করে দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কর্মরত এক বন্ধু। তিনি জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যে রাতারাতি লিমিটেড কোম্পানি করা হলো, তাতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন না এলেও নতুন নামফলক ও প্যাড-সিল-মনোগ্রামের ঠিকাদারি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে একটি শ্রেণী। ১৯৭২ সাল থেকে পুলিশের যে মনোগ্রাম চালু ছিল, বিএনপি নেতাদের হঠাত্ মনে হলো—এতে মান-ইজ্জত আর থাকে না। মনোগ্রামে নৌকা থাকলে যদি পুলিশের জাতীয়তাবাদী চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়! হায়রে সংকীর্ণ রাজনীতি। তবে পুলিশের মনোগ্রাম বদলের পেছনে যেমন নৌকাবিদ্বেষ ছিল তেমনি ডান্ডি ডায়িংকে ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিয়ে উপরি আয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার ভৈরবে মেঘনা সেতুর নামকরণ করেছিল মক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে। তারা কাজটি শেষ করে যেতে পারেনি। সেতু উদ্বোধন হয় বিএনপি আমলে এবং যথারীতি নাম বদল করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে তার প্রতিবাদও হয়। জবাবে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, কোথাকার কোন নজরুল ইসলাম, তাঁর নামে সেতুর নাম রাখতে হবে কেন? সাইফুর রহমান মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে গিবত গাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু যে কথাটি বলা প্রয়োজন—বাংলাদেশের ইতিহাসে সৈয়দ নজরুল ইসলামের যে স্থান, অর্থমন্ত্রী হিসাবে রেকর্ড সৃষ্টিকারী সাইফুর রহমান কখনোই তার ধারে কাছে যেতে পারবেন না।
বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম বদল করে বিএনপি খারাপ নজির স্থাপন করেছিল। অওয়ামী লীগকেও একই কাজ করতে হবে কেন? জনগনকে যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের খোয়াব দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তাদের অতীত আশ্রয়ী হলে চলেনা, দৃষ্টি সামনে রাখতে হয়।
নাম বদল নিয়ে এর আগেও লিখেছি। তবে এবারে পুরনো কথা এড়িয়ে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছি। আশা করতে চাই, এ বিষয়ে এটাই শেষ লেখা হবে। নাম বদল নিয়ে ভবিষ্যতে লিখতে হবেনা। আর সরকারের যদি সুমতি না হয় তা হলে আবারও লিখতে হবে। বার বার গাইতে হবে পুরনো গীত।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.