বড় করুণ সেই পরিবর্তন by শেগুফ্তা তাবাস্সুম আহমেদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২৩/বি বাড়িটির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় একদিন হঠাত্ বাবা মাকে বলেন, ‘দেখো, একটা প্রজাপতি।’ মা দেখে বললেন, ‘এটা তো মরা।’ বাবা প্রজাপতিটিকে টবের একটি ফুলগাছে সযত্নে রেখে দিয়ে বললেন, ‘এর প্রাণ রক্ষা করা যাবে।’
আরেকটি ঘটনা। টিকাটুলিতে আমার নানাবাড়ির উঠানে একদিন একটি চিল ধপাস করে এসে পড়ল। সবাই তো ভয়ে অস্থির। বাবা বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে চিলটির গায়ে পানির ছিটা দিলেন। কিছুক্ষণ পর ঠিকই চিলটি নড়েচড়ে উঠল এবং আস্তে আস্তে উড়ে গেল তার গন্তব্যে।
আমার বাবা, যিনি একটি প্রজাপতি ও পাখির কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না, তাঁকে কিনা লোমহর্ষকভাবে হত্যা করা হলো!
সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার শিক্ষা গ্রহণ। ১৯৬৮ সালে ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ থেকে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে শীর্ষস্থান লাভ করেছেন। ১৯৬৯ সালে তত্কালীন অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে (ওজিডিসি) যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। নতুন কিছু আবিষ্কার ও জ্ঞান বণ্টনের স্পৃহা নিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৫ সালে ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস এবং ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি করেন। তিনি জার্মান ভাষায় দক্ষ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে জার্মান ভাষা শেখাতেন তিনি। ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফ্যাকালটি অব লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্সের। প্রতিটি দায়িত্বের ক্ষেত্রে বাবা যে জিনিসটি কখনো ত্যাগ করেনি, তা হলো সততা এবং নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই বাবা তাঁর একজন ছাত্রের (পরে সহকর্মী) হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
গরিব ও অসহায় ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বাবা খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন। সব সময় তিনি গরিব অসহায় শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাবার হত্যাকারী মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন ছিলেন গরিব ছাত্র। তিনি ভূগোল বিভাগের শিক্ষক সেলিমা খাতুনের আত্মীয় ছিলেন। তবে তাঁর পালক পুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন মহিউদ্দিন। সেলিমা খাতুনের বাসা ছিল ৮ নম্বর বিল্ডিংয়ে; আমাদের ১ নম্বর বিল্ডিংয়ে। বাবা সব সময় চাইতেন, মহিউদ্দিন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক। কিন্তু মহিউদ্দিন আমার সেই বাবাকে খুন করে একজন খুনি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২৩/বি, বাড়িটির (যে বাসায় বাবা খুন হন) ল্যান্ডফোনে আমার মা এখনো ফোন করেন প্রতিদিন। বাবার মতো নিরীহ একজন মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মা বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিভাগের কাজ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাবার কাছে। মা আমাদের দুটি ভাই-বোনকে আগলে রাখতেন। বাবা সেই বিভাগের একজন শিক্ষকের হাতে খুন হয়েছেন।
বাবার লাশ খুঁজে পাওয়ার পর শুরু হয় মায়ের নতুন ভোগান্তি। একজন বিধবা আমাদের সমাজে এমনিতেই নানাভাবে অসহায়ত্বের শিকার হন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা। সবচেয়ে হতাশাজনক ছিল তখনকার উপাচার্যের আচরণ। তিনি আমাদের পরিবারের কোনো ধরনের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। বাবার পেনশন ও ইনস্যুরেন্সের টাকা নিয়েও শুরু হয় ভোগান্তি। আজও তা শেষ হয়নি।
৩০ বছরে তিলে তিলে গড়া সংসারের একটি জিনিসও এখন মায়ের কাছে নেই। সে সব জিনিস ২৩/বি, বাড়িটিতে পড়ে আছে। কিছু জিনিস চুরি হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো আমাদের সেখানে যাওয়ার মতো নিরাপত্তা দিতে পারছে না!
আমার ভাইয়ের বরাবর একটি অভিযোগ ছিল, বাবা তাঁর কনভোকেশনে যেতে পারেননি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে। আমার কনভোকেশনেও বাবা আসতে পারবেন না। কারণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাঁকে হত্যা করেছেন। এই সব বোঝার মতো বোধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে কি?
আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার ভাইয়ের বয়স যা, ১৯৭১ সালে সেই বয়সের ছেলেরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, অস্ত্র ধরেছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আইনের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। আইনের শরণাপন্ন হয়ে অসম্পূর্ণ বিচার পেয়েছি।
২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে পড়লেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ জীবনের কথা তো কখনো কল্পনাও করিনি। শুধু বাবা নয়, সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি। যেকোনো কাজে আটকে গেলে মনে হয়, ইস! যদি বাবা থাকত, তাহলে কত ভালো হতো। বাবা ছাড়া চারটি বছর কী বেদনাদায়ক, মর্মান্তিকভাবে কাটালাম। কষ্টে বুক ফেটে যায়, যখন ভাবি সততাই তাঁর মৃত্যুর কারণ।
আমার বাবার অসংখ্য শিক্ষার্থী-সহকর্মী, যাঁরা বাবার হত্যার পর নানাভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। সঙ্গে একটা অনুরোধ, আপনাদের আমার বাবা অনেক বেশি ভালোবাসতেন। আপনারাই পারেন আপনাদের প্রিয় শিক্ষক ও সহকর্মীর স্মৃতি ধরে রাখতে।
চারটি বছর বাবা অধ্যাপক ড. তাহের আহমেদের অনুপস্থিতি আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবনচিত্র পাল্টে দিয়েছে। শুধু বলি, বড় করুণ সেই পরিবর্তন।
শেগুফ্তা তাবাস্সুম আহমেদ
অধ্যাপক তাহের আহমেদের মেয়ে
আরেকটি ঘটনা। টিকাটুলিতে আমার নানাবাড়ির উঠানে একদিন একটি চিল ধপাস করে এসে পড়ল। সবাই তো ভয়ে অস্থির। বাবা বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে চিলটির গায়ে পানির ছিটা দিলেন। কিছুক্ষণ পর ঠিকই চিলটি নড়েচড়ে উঠল এবং আস্তে আস্তে উড়ে গেল তার গন্তব্যে।
আমার বাবা, যিনি একটি প্রজাপতি ও পাখির কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না, তাঁকে কিনা লোমহর্ষকভাবে হত্যা করা হলো!
সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার শিক্ষা গ্রহণ। ১৯৬৮ সালে ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ থেকে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে শীর্ষস্থান লাভ করেছেন। ১৯৬৯ সালে তত্কালীন অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে (ওজিডিসি) যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। নতুন কিছু আবিষ্কার ও জ্ঞান বণ্টনের স্পৃহা নিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৫ সালে ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস এবং ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি করেন। তিনি জার্মান ভাষায় দক্ষ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে জার্মান ভাষা শেখাতেন তিনি। ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফ্যাকালটি অব লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্সের। প্রতিটি দায়িত্বের ক্ষেত্রে বাবা যে জিনিসটি কখনো ত্যাগ করেনি, তা হলো সততা এবং নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই বাবা তাঁর একজন ছাত্রের (পরে সহকর্মী) হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
গরিব ও অসহায় ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বাবা খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন। সব সময় তিনি গরিব অসহায় শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাবার হত্যাকারী মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন ছিলেন গরিব ছাত্র। তিনি ভূগোল বিভাগের শিক্ষক সেলিমা খাতুনের আত্মীয় ছিলেন। তবে তাঁর পালক পুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন মহিউদ্দিন। সেলিমা খাতুনের বাসা ছিল ৮ নম্বর বিল্ডিংয়ে; আমাদের ১ নম্বর বিল্ডিংয়ে। বাবা সব সময় চাইতেন, মহিউদ্দিন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক। কিন্তু মহিউদ্দিন আমার সেই বাবাকে খুন করে একজন খুনি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২৩/বি, বাড়িটির (যে বাসায় বাবা খুন হন) ল্যান্ডফোনে আমার মা এখনো ফোন করেন প্রতিদিন। বাবার মতো নিরীহ একজন মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মা বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিভাগের কাজ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাবার কাছে। মা আমাদের দুটি ভাই-বোনকে আগলে রাখতেন। বাবা সেই বিভাগের একজন শিক্ষকের হাতে খুন হয়েছেন।
বাবার লাশ খুঁজে পাওয়ার পর শুরু হয় মায়ের নতুন ভোগান্তি। একজন বিধবা আমাদের সমাজে এমনিতেই নানাভাবে অসহায়ত্বের শিকার হন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা। সবচেয়ে হতাশাজনক ছিল তখনকার উপাচার্যের আচরণ। তিনি আমাদের পরিবারের কোনো ধরনের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। বাবার পেনশন ও ইনস্যুরেন্সের টাকা নিয়েও শুরু হয় ভোগান্তি। আজও তা শেষ হয়নি।
৩০ বছরে তিলে তিলে গড়া সংসারের একটি জিনিসও এখন মায়ের কাছে নেই। সে সব জিনিস ২৩/বি, বাড়িটিতে পড়ে আছে। কিছু জিনিস চুরি হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো আমাদের সেখানে যাওয়ার মতো নিরাপত্তা দিতে পারছে না!
আমার ভাইয়ের বরাবর একটি অভিযোগ ছিল, বাবা তাঁর কনভোকেশনে যেতে পারেননি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে। আমার কনভোকেশনেও বাবা আসতে পারবেন না। কারণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাঁকে হত্যা করেছেন। এই সব বোঝার মতো বোধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে কি?
আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার ভাইয়ের বয়স যা, ১৯৭১ সালে সেই বয়সের ছেলেরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, অস্ত্র ধরেছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আইনের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। আইনের শরণাপন্ন হয়ে অসম্পূর্ণ বিচার পেয়েছি।
২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে পড়লেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ জীবনের কথা তো কখনো কল্পনাও করিনি। শুধু বাবা নয়, সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি। যেকোনো কাজে আটকে গেলে মনে হয়, ইস! যদি বাবা থাকত, তাহলে কত ভালো হতো। বাবা ছাড়া চারটি বছর কী বেদনাদায়ক, মর্মান্তিকভাবে কাটালাম। কষ্টে বুক ফেটে যায়, যখন ভাবি সততাই তাঁর মৃত্যুর কারণ।
আমার বাবার অসংখ্য শিক্ষার্থী-সহকর্মী, যাঁরা বাবার হত্যার পর নানাভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। সঙ্গে একটা অনুরোধ, আপনাদের আমার বাবা অনেক বেশি ভালোবাসতেন। আপনারাই পারেন আপনাদের প্রিয় শিক্ষক ও সহকর্মীর স্মৃতি ধরে রাখতে।
চারটি বছর বাবা অধ্যাপক ড. তাহের আহমেদের অনুপস্থিতি আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবনচিত্র পাল্টে দিয়েছে। শুধু বলি, বড় করুণ সেই পরিবর্তন।
শেগুফ্তা তাবাস্সুম আহমেদ
অধ্যাপক তাহের আহমেদের মেয়ে
No comments