রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আততায়ী -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্র্যান্ড রাসেল ছিলেন দুর্মুখ প্রকৃতির ও দুঃসাহসী। কাউকে প্রশংসা করার চেয়ে কঠোর সমালোচনা করায়ই ছিলেন অভ্যস্ত। তিনি তাঁর হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফিতে আড়াই হাজার বছরের পাশ্চাত্য দার্শনিকদের অনেকেরই শক্ত সমালোচনা করেছেন। কিন্তু হল্যান্ডের সতের শতকের ইহুদি দার্শনিক বারুচ স্পিনোজার তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। স্পিনোজা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি শুরুতেই লিখেছেন, ‘স্পিনোজা ইজ দ্য নোবলেস্ট অ্যান্ড মোস্ট লাভএবল অব দ্য গ্রেট ফিলসফার্স’ অর্থাত্ মস্তবড় দার্শনিকদের মধ্যে মহত্তম ও সবচেয়ে ভালোবাসার যোগ্য।
ইহুদি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হন স্পিনোজা। তাঁকে তাঁর যুক্তিবাদী দার্শনিক বক্তব্যের জন্য হত্যা করারও চেষ্টা করা হয়। মারতে না পেরে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। আমস্টারডাম ও হেগেতে নির্জন জীবনযাপন করতেন। টাকাপয়সায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। চশমা মেরামত করে যে সামান্য আয় হতো, তাতে চলে যেত। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে ১৭৭৭ সালে তিনি মারা যান।
তত্ত্ববিদ্যা বা ম্যাটাফিজিকসই তাঁর মূল বিষয়, তবে স্পিনোজা একজন মস্তবড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁর ট্র্যাকটাটাস থিওলজিকো-পলিটিকাস বাইবেলের সমালোচনা ও রাজনৈতিক তত্ত্ববিষয়ক বই। ট্র্যাকটাটাস পলিটিকাস-এ শুধু রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। উদার রাজনৈতিক নীতির তিনি ছিলেন আপসহীন প্রবক্তা। তবে স্পিনোজার তুলনাহীন কীর্তি তার Ethics বা নীতিদর্শন। তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হয়। ইহুদি যাজকরা মনে করতেন, তিনি নিরীশ্বরবাদী। মানুষ তার জৈবিক প্রবৃত্তি ও পরিবেশের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে কীভাবে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবে, সেটাই ছিল তাঁর প্রধান আলোচ্য বিষয়। স্পিনোজার অভিমত, আবেগ মানুষকে দাসে পরিণত করে এবং বুদ্ধি ও যুক্তি মানুষকে সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত ও আনন্দময় জীবনযাপনে সহায়তা করে। জৈবিক আবেগকে বশে আনাই মানুষের কর্তব্য। অর্থহীন আবেগ একজন মানুষ ও একটি জনগোষ্ঠীকে শেষ করে দিতে পারে—তাদের অগ্রগতির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে।
নিজের বাড়ির বাইরে স্পিনোজা কোথাও বিশেষ যাননি। সুতরাং বাংলায় এসে বাঙালিদের মধ্যে বসবাস করার কোনো অভিজ্ঞতা থাকার প্রশ্নই আসে না। বঙ্গের কোথাও এসে থাকলে তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন, অতিরিক্ত আবেগের ফলে একটি জনগোষ্ঠীর কী দশা হতে পারে। ’৭৫-এর পনেরোই আগস্টের হত্যাযজ্ঞের আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। কেউ তাদের পিটিয়ে মারেনি, আদালতের বিচারেই তাদের ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় আমাদের গণমাধ্যম ও একশ্রেণীর মানুষ যে আচরণ করেছে তা স্বাভাবিক নয়।
দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে: ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ছিল উত্সবের আমেজ। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের চোখমুখ ছিল উচ্ছল। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা দপ্তরে আসামাত্রই কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে কোলাকুলি ও করমর্দন করেছেন। মন্ত্রীদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় কর্মকর্তাদের ডেকে এ ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সবারই চোখেমুখে ছিল তৃপ্তির ছাপ। এ উপলক্ষে সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে সরকারসমর্থক সাজার প্রতিযোগিতা ছিল লক্ষণীয়। সরকারসমর্থক কর্মচারীরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আনন্দমিছিল করেছেন। জোহরের নামাজের পর অনেকে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।’ [দৈনিক ডেসটিনি]
শুকরিয়া আদায় করেই যে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা অফিসের কাজে মনোযোগ দিয়েছেন, তা নয়। আনন্দ প্রকাশ করতে ‘অনেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই অফিস ত্যাগ করেছেন।’ একা একা আনন্দ প্রকাশ করায় অনেকেই তৃপ্তি পাননি, দেড়টা বাজার আগেই অনেকে চলে গেছেন বাড়ি। শুক্র ও শনিবার ছুটি থাকায় সপরিবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য অথবা আনন্দ প্রকাশের জন্য অনেকে দুপুরেই সচিবালয় থেকে সোজা চলে গেছেন বাস টার্মিনালে। রোববার দুপুরের আগে আনন্দ-ফুর্তি করে যে তাঁরা ঢাকা ফিরবেন সে সম্ভাবনা আদৌ নেই।
একশো বছর পর যদি কোনোদিন এই বাংলায় সত্যিকারের জ্ঞানবিভাসিত আলোকযুগের সূচনা হয়, তখন আর্কাইভসের শেলফ থেকে এখনকার পত্রপত্রিকার ফাইল নিয়ে গবেষণা হবে। ঘাঁটাঘাঁটি করা হবে ১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট থেকে পরবর্তী বছরগুলোর খবরের কাগজ। সেই অনাগত গবেষকরা নোট নিতে গিয়ে ভাববেন: একটি দেশের ১৪ কোটি মানুষ গয়রহ কতটা কপট, শঠ, অবিশ্বাসী, সুবিধাবাদী ও প্রবঞ্চক ছিল। হিতার্থীর সঙ্গেও প্রবঞ্চনা করতে তাদের দ্বিধা হতো না। সামান্য জাগতিক সুবিধার আশায় দীর্ঘদিনের বন্ধুর পাশ থেকে আলগোছে সরে যেতে তাদের বিবেকে বাধত না।
১৯৭২-৭৫-এর সরকারের কাছ থেকে অঢেল সুবিধা নিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা সরকারি-আধাসরকারি কর্মকর্তা ও বিদ্বানদের মধ্যে অগণিত। তাঁদের অনেকে আজ পরলোকে। আমরা তাঁদের চিনতাম। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তাঁদের আমরা দেখেছি টিভি স্টুডিওতে, সেমিনার কক্ষে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, বাংলা একাডেমী চত্বরে, রমনা বটমূলে এবং মাঝেমধ্যেই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো সমিতি-সংগঠন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে সংস্থাপন সচিব বা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে কোনো স্মারকলিপি দিয়েছেন তা শুনিনি। ফাঁসিতে আনন্দ প্রকাশের পরিমাণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যেই বেশি। ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরই তত্পরতা ছিল বেশি।
কোনো কোনো কলাম লেখক মুজিব হত্যার সঙ্গে গান্ধী হত্যার তুলনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো দুটি ঘটনাই এক রকম হয় না। কিছু মিল থাকে, অমিলের পরিমাণই বেশি। গান্ধী হত্যার বিচার এবং মুজিব হত্যার বিচারও এক রকমভাবে হয়নি। দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল শুধু ওইটুকু যে, দুটিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং মুজিব-গান্ধী উভয়েই তাঁদের দেশের স্বাধীনতার শীর্ষ নেতা। গান্ধী হত্যার বিচার শেষ হয় কয়েক মাসের মধ্যে। তাঁর আততায়ী নাথুরাম গডসের ফাঁসি হয় ১৯৪৯ সালে। মুজিবের আততায়ীদের ফাঁসি হলো ৩৫ বছর পর। এই ৩৫ বছর তাঁরা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের সরকার ও অন্য দেশের সরকারের সীমাহীন আতিথিয়েতায় জীবনকে উপভোগ করেছেন।
গান্ধীর জীবন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকে তাঁর হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকারীদের সম্পর্কেও কিছু পড়াশোনা করতে হয়। নাথুরাম গডসের ওপর বহু বই বেরিয়েছে। বিশ্লেষণমূলক বইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট। ভারতের বিদ্বানদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আর আমাদের খবরের কাগজের লেখকদের কাজের মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল। তাঁরা গান্ধীর ঘাতককে কখনোই তুই-তোকারি করেননি। তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কেন তাঁরা গান্ধীর মতো একজন নিষ্পাপ মানুষকে গুলি করে হত্যা করলেন।
ভারতের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদ আশীষ নন্দীর লেখা আমি বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখেছি। আমি জানি না, পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচারক, আইনজীবী এবং ওই বিষয়ের লেখকেরা তপন ঘোষের দ্য গান্ধী মার্ডার ট্রায়াল, রবার্ট পেইনের লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব মহাত্মা গান্ধী, এরিখ এরিখসনের গান্ধী’স ট্রুথ, জি ডি খোসনার দ্য মার্ডার অব মহাত্মা, আশীষ নন্দীর এট দ্য এডজ অব সাইকোলজি এবং নন্দীর প্রবন্ধ ‘ইনভাইটেশন টু আ বিহেডিং: আ সাইকোলজিস্ট’স গাইড টু অ্যাসোসিয়েশন ইন দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড’ প্রভৃতি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন কি না। তবে অনেকেই যে করেননি তা তাঁদের বয়ান থেকে বোঝা যায়।
পনেরোই আগস্টের রক্তপাতের পরপর Quest সাময়িকীতে আশীষ নন্দী তাঁর প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তা তাঁর নিজের বাংলা তর্জমায় এ রকম:
‘সব রাজনৈতিক হত্যাই একটা যৌথ ঘোষণাপত্রের মতো, ঘাতক ও তার শিকার যুক্তভাবে এই বিবৃতি রচনা করে। কোনো সময় এই যৌথ কর্মসূচির পরিণতি প্রকাশে সময় লাগে, কোনো সময় তা তাত্ক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই একজন ব্যক্তির কাজ হতে পারে না। এমনকি হত্যাকারী মানসিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় একা সব কাজ করলেও বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তির প্রতিনিধি হয়ে সেই কাজ করে। এই শক্তি তাঁকে তাঁর শিকার ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত করে।’
রবার্ট পেইনও মনে করেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে গান্ধী ও তাঁর অনুগত অথচ গুপ্ত-ঘাতকেরা ছাড়াও গান্ধীর রক্ষাকর্তা ভারতীয় পুলিশ ও তার গুপ্তচর শাখা, আমলাতন্ত্র এবং গান্ধীর অতি বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’
গান্ধীর গবেষকেরা গান্ধীর এবং তাঁর আততায়ীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। গডসে বলেছেন, তিনি যা করেছেন এবং ‘তাঁর যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার জন্যই করা হয়েছে।’ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ নাথুরাম গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২৯-৩০) অব্যবহিত পরে হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সক্রিয় সদস্য হন। অর্থাত্ দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দেন। পনেরোই আগস্টের খলনায়কেরাও সবাই কমবেশি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং দেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন।
কোনো সাধারণ খুনি গান্ধীকে হত্যা করতে পারত না, তার হাত কাঁপত, বুক কাঁপত। তাঁর খুনিও রাজনৈতিক ব্যক্তি। গোপাল গডসে তার গান্ধী হত্যা আনি মে নামক মারাঠি ভাষায় লেখা গ্রন্থে নাথুরাম গডসের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবে:
‘জাতির পিতা হিসেবে দায়িত্ব পালনে গান্ধী ব্যর্থ। কার্যত তিনি পাকিস্তানের পিতায় পরিগণিত হয়েছেন। শুধু এ কারণেই ভারতমাতার সন্তান হিসেবে তথাকথিত জাতির পিতার জীবন শেষ করা আমার দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। তিনি আমাদের মাতৃভূমি খণ্ডনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন।’
অর্থাত্ বিষয়টি রাজনৈতিক—ব্যক্তিগত শত্রুতার নয়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে দৃশ্যমান আততায়ীর চেয়ে অদৃশ্য আততায়ীর সংখ্যা বহু গুণ বেশি এবং তাঁরাই প্রবল। গান্ধীকে যাঁরা হত্যা করেন এবং যাঁরা সেই হত্যার পরিকল্পনাকারী, যেমন—নারায়ণ আপ্তে বা বিষ্ণু কারকার গান্ধীর ব্যক্তিগত শত্রু ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা হত্যা করেছেন তাঁদের দু-একজন ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের ওপর বিরূপ থাকতে পারেন, কিন্তু ওই বিরূপতাটুকুর জন্য কেউ কারও প্রাণনাশ করে না। ১৫ আগস্ট ভোররাতে যারা ৩২ নম্বরে গিয়েছিল তারা ভাড়াটে ‘বিদ্রোহী’, যাদের হাতে অস্ত্র ছিল তারা মজুর, ষড়যন্ত্রকারীরা কেউ আসেনি। তারা ছিল দূরে—বহু দূরে—নিরাপদ দূরত্বে। আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে, সেদিনের ষড়যন্ত্র বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তারাই এবং মোশতাক, ঠাকুর ও তিন বাহিনীর প্রধান পনেরোই আগস্ট সকাল ১০টায় শাহবাগে বেতারকেন্দ্রে না গিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে অথবা গণভবনে যেতেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতেন, যেমন এখন করছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে সবার আগে গণভবনে যেতেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
পঁয়ত্রিশ বছর ধরে অব্যাহতভাবে বলা হচ্ছে যে, পনেরই আগস্ট রক্তপাত ঘটিয়েছে সেনাবাহিনীর নিচের পর্যায়ের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অথবা চাকরিচ্যুত অফিসার। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত একটিও নেই যে, নিচের স্তরের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তার নির্দেশ নতমস্তকে গোটা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, সচিবরা ৮১ দিন ধরে পালন করছেন। ঘাতকদের কাজে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সায় না থাকলে পনের মিনিটের মধ্যে বিদ্রোহীদের ইহজগত্ ত্যাগ করতে হতো। তাদের লাশ পনেরোই আগস্ট সকালে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে পড়ে থাকত, সেদিন জেনারেলরা সুবোধ বালকের মতো চাকরিচ্যুত সেই মেজরদের কথায় ওঠাবসা করেছেন। বঙ্গভবনে একত্রে খানাপিনা করেছেন। ভাড়াটে ঘাতকদের লম্ফঝম্ফ করতে দেখা গেলেও, তাদের দেশি ও বিদেশি প্রভুরা মুখোশ পরে ছিলেন অথবা ছিলেন পর্দার পেছনে।
সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও বিরক্তিকর সত্য হচ্ছে, পনেরোই আগস্টের রক্তপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রধানত আওয়ামী লীগ এবং আংশিক সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফফর)। তা ছাড়া প্রায় সব দক্ষিণপন্থী, ইসলামপন্থী ও চীনপন্থী উগ্র বাম দলগুলোর নেতারা উপকৃত হন। তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতার স্বাদ পান। পনেরই আগস্ট পটপরিবর্তন না ঘটলে তাঁরা কোনোদিন ক্ষমতার রাজনীতির ধারে-কাছে আসতে পারতেন না। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অভ্যুত্থানে উত্থান ঘটল পাকিস্তানপন্থীদের।
আজ যত আনন্দ, সুখ, মিষ্টি বিতরণ, জুতা নিক্ষেপ বা খুনিদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হোক না কেন, নির্মম সত্য হলো—শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না গেলে কোনো দিনই মুজিব হত্যার বিচার হতো না। জিয়া ও এরশাদ করেননি, কোনোকালেই করতেন না। কারণ, পনেরোই আগস্টের কুশীলবদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল আত্মার পরম সখার। তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন ফাঁসিওয়ালাদের কল্যাণে। বুধবার রাতে যাঁরা ফাঁসিতে ঝুললেন তাঁদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল অনেকটা দেবর-ভাবির। কোনো ভাবি চাইতে পারেন না যে, তাঁর দেবররা খুনের আসামি হয়ে বিচারের মুখোমুখি হোক এবং তাঁরা ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে উঠুক।
ফাঁসি হওয়া মানুষগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকার কথা তখনকার তিন বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের। পনেরোই আগস্ট খুলে যায় তাঁদের জীবনের নতুন দরজা। তাঁরা পেশাজীবী থেকে পদোন্নতি পান দেশের শাসক বা মালিকে। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বা হিটলারের জেনারেলদের যে প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি, আমাদের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের তা ঘটেছে। রাজধানীর ডিওএইচএস বা নিউ ডিওএইচএস মহল্লায় গেলে তা বোঝা যায়। সিভিল অফিসারদের প্রসন্ন ভাগ্যের কথা না বলাই ভালো।
সাধারণ খুনের মামলা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একেবারেই এক জিনিস নয়। একজন সাধারণ মানুষ যখন খুন হয়, তখন মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে শেষ হয়ে যায়। একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক যখন নিহত হন তখন তিনি শারীরিকভাবে শেষ হলেও তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। কিন্তু নিহত হওয়ার পর যখন তাঁর কর্মের অবমূল্যায়ন করা হয় বা তাঁর অবদান অস্বীকার করা হয়, তখন তাঁকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়। এভাবে দেখলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা বারবার হত্যা করেছে। ১৯৭৭ সালে আমি কোনো রকমে সংবাদ-এ লিখেছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা সম্ভব, কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলা যায় না, কারণ তাঁর প্রাণ মৃত্যুহীন।’
দুঃখের বিষয়, তাঁর অতিভক্তরা অথবা সুবিধাবাদী ভক্তরাও তাঁকে হত্যা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আত্মীয়স্বজনের ওপর যদি এখন, এতদিন পরে, হামলা হয়; তাঁদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো হয়, তা হবে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য খুবই ক্ষতিকর। একটি পরিণতবুদ্ধি জাতির কর্তব্য তার প্রধান নেতাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে মানুষের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখা। আতিশয্যে আদৌ কাউকে মহিমান্বিত করা যায় না। প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা থেকে তিনি যেন বঞ্চিত না হন সেদিকে তাঁর অনুসারীদের দৃষ্টি রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধুর দৃশ্যমান আততায়ীদের আমরা চিনি। কিন্তু তাঁর অগণিত অদৃশ্য আততায়ী সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা যেন তাঁকে পুনর্বার হত্যা করার সুযোগ না পায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ইহুদি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হন স্পিনোজা। তাঁকে তাঁর যুক্তিবাদী দার্শনিক বক্তব্যের জন্য হত্যা করারও চেষ্টা করা হয়। মারতে না পেরে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। আমস্টারডাম ও হেগেতে নির্জন জীবনযাপন করতেন। টাকাপয়সায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। চশমা মেরামত করে যে সামান্য আয় হতো, তাতে চলে যেত। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে ১৭৭৭ সালে তিনি মারা যান।
তত্ত্ববিদ্যা বা ম্যাটাফিজিকসই তাঁর মূল বিষয়, তবে স্পিনোজা একজন মস্তবড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁর ট্র্যাকটাটাস থিওলজিকো-পলিটিকাস বাইবেলের সমালোচনা ও রাজনৈতিক তত্ত্ববিষয়ক বই। ট্র্যাকটাটাস পলিটিকাস-এ শুধু রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। উদার রাজনৈতিক নীতির তিনি ছিলেন আপসহীন প্রবক্তা। তবে স্পিনোজার তুলনাহীন কীর্তি তার Ethics বা নীতিদর্শন। তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হয়। ইহুদি যাজকরা মনে করতেন, তিনি নিরীশ্বরবাদী। মানুষ তার জৈবিক প্রবৃত্তি ও পরিবেশের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে কীভাবে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবে, সেটাই ছিল তাঁর প্রধান আলোচ্য বিষয়। স্পিনোজার অভিমত, আবেগ মানুষকে দাসে পরিণত করে এবং বুদ্ধি ও যুক্তি মানুষকে সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত ও আনন্দময় জীবনযাপনে সহায়তা করে। জৈবিক আবেগকে বশে আনাই মানুষের কর্তব্য। অর্থহীন আবেগ একজন মানুষ ও একটি জনগোষ্ঠীকে শেষ করে দিতে পারে—তাদের অগ্রগতির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে।
নিজের বাড়ির বাইরে স্পিনোজা কোথাও বিশেষ যাননি। সুতরাং বাংলায় এসে বাঙালিদের মধ্যে বসবাস করার কোনো অভিজ্ঞতা থাকার প্রশ্নই আসে না। বঙ্গের কোথাও এসে থাকলে তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন, অতিরিক্ত আবেগের ফলে একটি জনগোষ্ঠীর কী দশা হতে পারে। ’৭৫-এর পনেরোই আগস্টের হত্যাযজ্ঞের আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। কেউ তাদের পিটিয়ে মারেনি, আদালতের বিচারেই তাদের ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় আমাদের গণমাধ্যম ও একশ্রেণীর মানুষ যে আচরণ করেছে তা স্বাভাবিক নয়।
দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে: ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ছিল উত্সবের আমেজ। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের চোখমুখ ছিল উচ্ছল। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা দপ্তরে আসামাত্রই কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে কোলাকুলি ও করমর্দন করেছেন। মন্ত্রীদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় কর্মকর্তাদের ডেকে এ ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সবারই চোখেমুখে ছিল তৃপ্তির ছাপ। এ উপলক্ষে সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে সরকারসমর্থক সাজার প্রতিযোগিতা ছিল লক্ষণীয়। সরকারসমর্থক কর্মচারীরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আনন্দমিছিল করেছেন। জোহরের নামাজের পর অনেকে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।’ [দৈনিক ডেসটিনি]
শুকরিয়া আদায় করেই যে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা অফিসের কাজে মনোযোগ দিয়েছেন, তা নয়। আনন্দ প্রকাশ করতে ‘অনেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই অফিস ত্যাগ করেছেন।’ একা একা আনন্দ প্রকাশ করায় অনেকেই তৃপ্তি পাননি, দেড়টা বাজার আগেই অনেকে চলে গেছেন বাড়ি। শুক্র ও শনিবার ছুটি থাকায় সপরিবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য অথবা আনন্দ প্রকাশের জন্য অনেকে দুপুরেই সচিবালয় থেকে সোজা চলে গেছেন বাস টার্মিনালে। রোববার দুপুরের আগে আনন্দ-ফুর্তি করে যে তাঁরা ঢাকা ফিরবেন সে সম্ভাবনা আদৌ নেই।
একশো বছর পর যদি কোনোদিন এই বাংলায় সত্যিকারের জ্ঞানবিভাসিত আলোকযুগের সূচনা হয়, তখন আর্কাইভসের শেলফ থেকে এখনকার পত্রপত্রিকার ফাইল নিয়ে গবেষণা হবে। ঘাঁটাঘাঁটি করা হবে ১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট থেকে পরবর্তী বছরগুলোর খবরের কাগজ। সেই অনাগত গবেষকরা নোট নিতে গিয়ে ভাববেন: একটি দেশের ১৪ কোটি মানুষ গয়রহ কতটা কপট, শঠ, অবিশ্বাসী, সুবিধাবাদী ও প্রবঞ্চক ছিল। হিতার্থীর সঙ্গেও প্রবঞ্চনা করতে তাদের দ্বিধা হতো না। সামান্য জাগতিক সুবিধার আশায় দীর্ঘদিনের বন্ধুর পাশ থেকে আলগোছে সরে যেতে তাদের বিবেকে বাধত না।
১৯৭২-৭৫-এর সরকারের কাছ থেকে অঢেল সুবিধা নিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা সরকারি-আধাসরকারি কর্মকর্তা ও বিদ্বানদের মধ্যে অগণিত। তাঁদের অনেকে আজ পরলোকে। আমরা তাঁদের চিনতাম। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তাঁদের আমরা দেখেছি টিভি স্টুডিওতে, সেমিনার কক্ষে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, বাংলা একাডেমী চত্বরে, রমনা বটমূলে এবং মাঝেমধ্যেই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো সমিতি-সংগঠন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে সংস্থাপন সচিব বা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে কোনো স্মারকলিপি দিয়েছেন তা শুনিনি। ফাঁসিতে আনন্দ প্রকাশের পরিমাণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যেই বেশি। ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরই তত্পরতা ছিল বেশি।
কোনো কোনো কলাম লেখক মুজিব হত্যার সঙ্গে গান্ধী হত্যার তুলনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো দুটি ঘটনাই এক রকম হয় না। কিছু মিল থাকে, অমিলের পরিমাণই বেশি। গান্ধী হত্যার বিচার এবং মুজিব হত্যার বিচারও এক রকমভাবে হয়নি। দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল শুধু ওইটুকু যে, দুটিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং মুজিব-গান্ধী উভয়েই তাঁদের দেশের স্বাধীনতার শীর্ষ নেতা। গান্ধী হত্যার বিচার শেষ হয় কয়েক মাসের মধ্যে। তাঁর আততায়ী নাথুরাম গডসের ফাঁসি হয় ১৯৪৯ সালে। মুজিবের আততায়ীদের ফাঁসি হলো ৩৫ বছর পর। এই ৩৫ বছর তাঁরা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের সরকার ও অন্য দেশের সরকারের সীমাহীন আতিথিয়েতায় জীবনকে উপভোগ করেছেন।
গান্ধীর জীবন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকে তাঁর হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকারীদের সম্পর্কেও কিছু পড়াশোনা করতে হয়। নাথুরাম গডসের ওপর বহু বই বেরিয়েছে। বিশ্লেষণমূলক বইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট। ভারতের বিদ্বানদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আর আমাদের খবরের কাগজের লেখকদের কাজের মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল। তাঁরা গান্ধীর ঘাতককে কখনোই তুই-তোকারি করেননি। তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কেন তাঁরা গান্ধীর মতো একজন নিষ্পাপ মানুষকে গুলি করে হত্যা করলেন।
ভারতের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদ আশীষ নন্দীর লেখা আমি বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখেছি। আমি জানি না, পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচারক, আইনজীবী এবং ওই বিষয়ের লেখকেরা তপন ঘোষের দ্য গান্ধী মার্ডার ট্রায়াল, রবার্ট পেইনের লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব মহাত্মা গান্ধী, এরিখ এরিখসনের গান্ধী’স ট্রুথ, জি ডি খোসনার দ্য মার্ডার অব মহাত্মা, আশীষ নন্দীর এট দ্য এডজ অব সাইকোলজি এবং নন্দীর প্রবন্ধ ‘ইনভাইটেশন টু আ বিহেডিং: আ সাইকোলজিস্ট’স গাইড টু অ্যাসোসিয়েশন ইন দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড’ প্রভৃতি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন কি না। তবে অনেকেই যে করেননি তা তাঁদের বয়ান থেকে বোঝা যায়।
পনেরোই আগস্টের রক্তপাতের পরপর Quest সাময়িকীতে আশীষ নন্দী তাঁর প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তা তাঁর নিজের বাংলা তর্জমায় এ রকম:
‘সব রাজনৈতিক হত্যাই একটা যৌথ ঘোষণাপত্রের মতো, ঘাতক ও তার শিকার যুক্তভাবে এই বিবৃতি রচনা করে। কোনো সময় এই যৌথ কর্মসূচির পরিণতি প্রকাশে সময় লাগে, কোনো সময় তা তাত্ক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই একজন ব্যক্তির কাজ হতে পারে না। এমনকি হত্যাকারী মানসিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় একা সব কাজ করলেও বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তির প্রতিনিধি হয়ে সেই কাজ করে। এই শক্তি তাঁকে তাঁর শিকার ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত করে।’
রবার্ট পেইনও মনে করেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে গান্ধী ও তাঁর অনুগত অথচ গুপ্ত-ঘাতকেরা ছাড়াও গান্ধীর রক্ষাকর্তা ভারতীয় পুলিশ ও তার গুপ্তচর শাখা, আমলাতন্ত্র এবং গান্ধীর অতি বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’
গান্ধীর গবেষকেরা গান্ধীর এবং তাঁর আততায়ীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। গডসে বলেছেন, তিনি যা করেছেন এবং ‘তাঁর যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার জন্যই করা হয়েছে।’ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ নাথুরাম গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২৯-৩০) অব্যবহিত পরে হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সক্রিয় সদস্য হন। অর্থাত্ দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দেন। পনেরোই আগস্টের খলনায়কেরাও সবাই কমবেশি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং দেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন।
কোনো সাধারণ খুনি গান্ধীকে হত্যা করতে পারত না, তার হাত কাঁপত, বুক কাঁপত। তাঁর খুনিও রাজনৈতিক ব্যক্তি। গোপাল গডসে তার গান্ধী হত্যা আনি মে নামক মারাঠি ভাষায় লেখা গ্রন্থে নাথুরাম গডসের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবে:
‘জাতির পিতা হিসেবে দায়িত্ব পালনে গান্ধী ব্যর্থ। কার্যত তিনি পাকিস্তানের পিতায় পরিগণিত হয়েছেন। শুধু এ কারণেই ভারতমাতার সন্তান হিসেবে তথাকথিত জাতির পিতার জীবন শেষ করা আমার দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। তিনি আমাদের মাতৃভূমি খণ্ডনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন।’
অর্থাত্ বিষয়টি রাজনৈতিক—ব্যক্তিগত শত্রুতার নয়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে দৃশ্যমান আততায়ীর চেয়ে অদৃশ্য আততায়ীর সংখ্যা বহু গুণ বেশি এবং তাঁরাই প্রবল। গান্ধীকে যাঁরা হত্যা করেন এবং যাঁরা সেই হত্যার পরিকল্পনাকারী, যেমন—নারায়ণ আপ্তে বা বিষ্ণু কারকার গান্ধীর ব্যক্তিগত শত্রু ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা হত্যা করেছেন তাঁদের দু-একজন ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের ওপর বিরূপ থাকতে পারেন, কিন্তু ওই বিরূপতাটুকুর জন্য কেউ কারও প্রাণনাশ করে না। ১৫ আগস্ট ভোররাতে যারা ৩২ নম্বরে গিয়েছিল তারা ভাড়াটে ‘বিদ্রোহী’, যাদের হাতে অস্ত্র ছিল তারা মজুর, ষড়যন্ত্রকারীরা কেউ আসেনি। তারা ছিল দূরে—বহু দূরে—নিরাপদ দূরত্বে। আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে, সেদিনের ষড়যন্ত্র বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তারাই এবং মোশতাক, ঠাকুর ও তিন বাহিনীর প্রধান পনেরোই আগস্ট সকাল ১০টায় শাহবাগে বেতারকেন্দ্রে না গিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে অথবা গণভবনে যেতেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতেন, যেমন এখন করছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে সবার আগে গণভবনে যেতেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
পঁয়ত্রিশ বছর ধরে অব্যাহতভাবে বলা হচ্ছে যে, পনেরই আগস্ট রক্তপাত ঘটিয়েছে সেনাবাহিনীর নিচের পর্যায়ের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অথবা চাকরিচ্যুত অফিসার। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত একটিও নেই যে, নিচের স্তরের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তার নির্দেশ নতমস্তকে গোটা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, সচিবরা ৮১ দিন ধরে পালন করছেন। ঘাতকদের কাজে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সায় না থাকলে পনের মিনিটের মধ্যে বিদ্রোহীদের ইহজগত্ ত্যাগ করতে হতো। তাদের লাশ পনেরোই আগস্ট সকালে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে পড়ে থাকত, সেদিন জেনারেলরা সুবোধ বালকের মতো চাকরিচ্যুত সেই মেজরদের কথায় ওঠাবসা করেছেন। বঙ্গভবনে একত্রে খানাপিনা করেছেন। ভাড়াটে ঘাতকদের লম্ফঝম্ফ করতে দেখা গেলেও, তাদের দেশি ও বিদেশি প্রভুরা মুখোশ পরে ছিলেন অথবা ছিলেন পর্দার পেছনে।
সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও বিরক্তিকর সত্য হচ্ছে, পনেরোই আগস্টের রক্তপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রধানত আওয়ামী লীগ এবং আংশিক সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফফর)। তা ছাড়া প্রায় সব দক্ষিণপন্থী, ইসলামপন্থী ও চীনপন্থী উগ্র বাম দলগুলোর নেতারা উপকৃত হন। তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতার স্বাদ পান। পনেরই আগস্ট পটপরিবর্তন না ঘটলে তাঁরা কোনোদিন ক্ষমতার রাজনীতির ধারে-কাছে আসতে পারতেন না। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অভ্যুত্থানে উত্থান ঘটল পাকিস্তানপন্থীদের।
আজ যত আনন্দ, সুখ, মিষ্টি বিতরণ, জুতা নিক্ষেপ বা খুনিদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হোক না কেন, নির্মম সত্য হলো—শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না গেলে কোনো দিনই মুজিব হত্যার বিচার হতো না। জিয়া ও এরশাদ করেননি, কোনোকালেই করতেন না। কারণ, পনেরোই আগস্টের কুশীলবদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল আত্মার পরম সখার। তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন ফাঁসিওয়ালাদের কল্যাণে। বুধবার রাতে যাঁরা ফাঁসিতে ঝুললেন তাঁদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল অনেকটা দেবর-ভাবির। কোনো ভাবি চাইতে পারেন না যে, তাঁর দেবররা খুনের আসামি হয়ে বিচারের মুখোমুখি হোক এবং তাঁরা ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে উঠুক।
ফাঁসি হওয়া মানুষগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকার কথা তখনকার তিন বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের। পনেরোই আগস্ট খুলে যায় তাঁদের জীবনের নতুন দরজা। তাঁরা পেশাজীবী থেকে পদোন্নতি পান দেশের শাসক বা মালিকে। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বা হিটলারের জেনারেলদের যে প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি, আমাদের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের তা ঘটেছে। রাজধানীর ডিওএইচএস বা নিউ ডিওএইচএস মহল্লায় গেলে তা বোঝা যায়। সিভিল অফিসারদের প্রসন্ন ভাগ্যের কথা না বলাই ভালো।
সাধারণ খুনের মামলা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একেবারেই এক জিনিস নয়। একজন সাধারণ মানুষ যখন খুন হয়, তখন মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে শেষ হয়ে যায়। একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক যখন নিহত হন তখন তিনি শারীরিকভাবে শেষ হলেও তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। কিন্তু নিহত হওয়ার পর যখন তাঁর কর্মের অবমূল্যায়ন করা হয় বা তাঁর অবদান অস্বীকার করা হয়, তখন তাঁকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়। এভাবে দেখলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা বারবার হত্যা করেছে। ১৯৭৭ সালে আমি কোনো রকমে সংবাদ-এ লিখেছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা সম্ভব, কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলা যায় না, কারণ তাঁর প্রাণ মৃত্যুহীন।’
দুঃখের বিষয়, তাঁর অতিভক্তরা অথবা সুবিধাবাদী ভক্তরাও তাঁকে হত্যা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আত্মীয়স্বজনের ওপর যদি এখন, এতদিন পরে, হামলা হয়; তাঁদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো হয়, তা হবে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য খুবই ক্ষতিকর। একটি পরিণতবুদ্ধি জাতির কর্তব্য তার প্রধান নেতাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে মানুষের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখা। আতিশয্যে আদৌ কাউকে মহিমান্বিত করা যায় না। প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা থেকে তিনি যেন বঞ্চিত না হন সেদিকে তাঁর অনুসারীদের দৃষ্টি রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধুর দৃশ্যমান আততায়ীদের আমরা চিনি। কিন্তু তাঁর অগণিত অদৃশ্য আততায়ী সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা যেন তাঁকে পুনর্বার হত্যা করার সুযোগ না পায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments