বাঞ্ছারামের বাগান -গদ্যকার্টুন by আনিসুল হক
বাঞ্ছারামের বাগান নামে একটা অপূর্ব ছবি আছে, বাংলা ছবি। বাঞ্ছারাম এক ঘাটের মড়া। সাতকুলে তার কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছে তার একটা বাগান। ফুলে-ফলে শোভিত বিশাল বাগান। কত গাছ তাতে। নানা মৌসুমে নানা ফল ফলে সেই বাগানে। বুড়ো বাঞ্ছারাম সেই বাগান পাহারা দেয়। লোভী মানুষেরা তক্কে তক্কে থাকে, কবে মারা যাবে বাঞ্ছারাম। তারা বাগানটা দখল করবে। বাগানের ফল পেড়ে নেবে। তা হয় না। বাঞ্ছারাম মরে না।
সেই রকম একটা বাগানের গল্প এটা। এক গ্রামে এক বুড়োর ছিল একটা ফলের বাগান। বুড়োর আপন কেউ ছিল না। একাই সারা দিন বুড়ো বাগান পাহারা দিত। কিন্তু রাতে যখন সে ঘুমিয়ে পড়ত, চোর এসে বাগান থেকে ফলফলান্তি পেড়ে নিয়ে যেত।
রোজ রোজ কত আর এই চুরি সহ্য করা যায়? বাগানের মালিক গেল পাড়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর সদাশয় মানুষটির কাছে। আমি আমার বাগান রক্ষা করতে চাই। এই বাগানই আমার সব। বাগানই আমার সন্তান। সেই বাগান রোজ রাতে চুরি হয়ে যায়। কী করব?
জ্ঞানী লোক বললেন, তোমাকে একটু পয়সা খরচ করতে হবে। তোমাকে দুটো কুকুর দেব। প্রতিটা কুকুরের দাম এক হাজার টাকা। দুই হাজার টাকা খরচ করো। দুটো কুকুর নিয়ে যাও। ওরা সারা রাত বাগান পাহারা দেবে।
বুড়ো বলল, আমার যা বাগান, তা পাহারা দিতে দুটো কুকুর লাগবে না। একটাতেই হবে। আমি এক হাজার দিচ্ছি।
না বুড়ো, তোমার দুটো কুকুরই লাগবে। একটা বড় কুকুর, আরেকটা ছোট কুকুর। দুই কুকুর দুই জাতের। দুই ধরনের কাজ তার।
বুড়ো বলল, আমি এক হাজার দিচ্ছি। একটা কুকুরই দিন। বড়টা দিন।
বুড়ো বড় কুকুরটা আনল আর বাগানে ছেড়ে দিল।
রাতের বেলা যেই না চোর আসে, অমনি কুকুরটা তেড়ে যায়। দশাসই কুকুর। চোরের পায়ের গোঁড়ালি কামড়ে ধরেছে, লাঠির বাড়ি খেয়েও ছাড়েনি, শেষে গোঁড়ালির মাংস ছিঁড়ে যাওয়ায় পালিয়ে বাঁচল চোর। আর তারা আসে না ওই বাগানে।
বুড়ো খুশি। জ্ঞানী মানুষটিকে বলল, বলেছিলাম কিনা, আমার একটা কুকুরেই হবে।
তিনি বললেন, হলে তো ভালোই।
কয়েক দিন পর। দেখা গেল, কুকুরটা রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। চোরেরা প্রায়ই আসে বাগানে, কুকুরটাকে নীরব দেখে তারা একদিন নেমে পড়ে বাগানে। ঠিকই চুরি করতে সক্ষম হয় বাগানের ফল।
বুড়ো পরদিন সকালে বাগানে গিয়ে হায় হায় করে, নিজের চুল ছেঁড়ে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই হয়। কুকুর ঘুমোয় আর চোর চুরি করে।
বুড়ো আবার গেল জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। ‘এই কুকুরে হবে না। আমাকে ছোট কুকুরটাই দিন।’ বড়টা ফেরত দিয়ে সে নিয়ে এল ছোট কুকুরটা।
ছোট কুকুরটা খুব ঘেউ ঘেউ করে। সারা রাত বাগান আর তার আশপাশের এলাকার সবার ঘুম হারাম। চোরেরাও দেখল, এবার আর সুবিধা করা যাবে না। তারা চুরি থেকে বিরত রইল।
বুড়ো গেল জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। বলল, দেখলেন, একটা কুকুরেই কেমন চলছে আমার। আমি খুব খুশি।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, চললে তো ভালোই। দেখা যাক।
কিছুদিনের মধ্যেই চোরেরা আবিষ্কার করল, ছোট কুকুরটার কামড়ানেভর শক্তি নেই। সে তেড়ে আসে, ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু কামড় তো কামড়, আঁচড়টি পর্যন্ত দেয় না।
চোরেরা ঢুকে গেল বাগানে। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করল। তেড়ে এল। থাবা বা দাঁত বসাল না। নির্বিঘ্নে চুরিকর্ম সেরে চোরেরটা কেটে পড়ল।
এক দিন দুই দিন। বুড়ো গেল আবার সেই বুদ্ধিমান সদাশয় মানুষটার কাছে। কী করব এখন?
তিনি বললেন, দুটো কুকুরই নিতে হবে তোমাকে, বলেছিলাম কিনা।
আরও এক হাজার টাকা দিয়ে বড় কুকুরটাও সঙ্গে করে নিয়ে এল বুড়ো।
এবার দেখা গেল, বড় কুকুরটা ঘুমায়। আর চোর আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট কুকুরটা এমন ঘেউ ঘেউ করে যে বড়টার ঘুম ভেঙে যায়। বড়টা তখন ওঠে, চোরের পেছনে ধাওয়া করে। আর তার ধাওয়া মানে কেবল তেড়ে আসা না, একেবারে মাথা বরাবর ঝাঁপিয়ে পড়া।
এর পর থেকে ওই বাগানে আর চোর আসে না।
এই গল্প আমাকে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনস্থল বেলা সেন্টারে শুনিয়েছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক আইনুন নিশাত। গল্পটি শুনিয়ে তিনি বলেছিলেন, সরকার হলো রাষ্ট্রের আসল চালক। তার ক্ষমতা বেশি, কাজ করলে সে-ই করতে পারে, কিন্তু সে বড় ঘুমায়।
আর এ কারণেই দরকার এনজিও, সুশীল সমাজ, নাগরিক ফোরামের নজরদারির। তাদের আসলে করার ক্ষমতা কম, কিন্তু আওয়াজ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। আর তারা ঘুমোয় না, ঘুমোতে দেয় না। তারা চিত্কার-চেঁচামেচি করলে সরকারের ঘুম ভাঙে এবং সরকার সক্রিয় হয়।
কথাটা আইনুন নিশাত বলছিলেন, কোপেনহেগেন শহরে এনজিও ও পরিবেশবাদী হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদী মিছিল-সমাবেশ আন্দোলন প্রসঙ্গে। এরা মূল দরকষাকষির ঘরে ঢুকতেও পারে না। কিন্তু তাদের চিত্কারটার দরকার আছে। সরকারগুলোকে তাদের কর্তব্যের কথা তারা মনে করিয়ে দেয়।
আমার মনে হয়, কেবল এনজিও বা নাগরিক সমাজ বা প্রতিবাদী জনগোষ্ঠী নয়, সংবাদমাধ্যমেরও একই ভূমিকা। সংবাদমাধ্যমকে তো বলাই হয় ওয়াচডগ। সরকার বা রাজনীতিকেরা বা কোনো প্রতিষ্ঠান কোথাও কোনো ভুল করলে তারা ওয়াচডগের মতো সেটাকে ফলাও করে প্রচার করবে। সরকার ঘুমিয়ে পড়লে তারা জাগিয়ে তুলবে। সরকার যদি না জাগে জনগণকে জাগাবে সংবাদমাধ্যম। জনগণ ঠিকই নেতাদের বুঝিয়ে দেয়, এক মাঘে শীত যায় না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাই যেমন সরকারকে সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হয়, তেমনি সরকারের ঘুম ভাঙানোর জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম, বিবেকবান ও পক্ষপাতহীন নাগরিক সমাজ ও নানা ধরনের বেসরকারি সংগঠন ও ফোরামও দরকার হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
সেই রকম একটা বাগানের গল্প এটা। এক গ্রামে এক বুড়োর ছিল একটা ফলের বাগান। বুড়োর আপন কেউ ছিল না। একাই সারা দিন বুড়ো বাগান পাহারা দিত। কিন্তু রাতে যখন সে ঘুমিয়ে পড়ত, চোর এসে বাগান থেকে ফলফলান্তি পেড়ে নিয়ে যেত।
রোজ রোজ কত আর এই চুরি সহ্য করা যায়? বাগানের মালিক গেল পাড়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর সদাশয় মানুষটির কাছে। আমি আমার বাগান রক্ষা করতে চাই। এই বাগানই আমার সব। বাগানই আমার সন্তান। সেই বাগান রোজ রাতে চুরি হয়ে যায়। কী করব?
জ্ঞানী লোক বললেন, তোমাকে একটু পয়সা খরচ করতে হবে। তোমাকে দুটো কুকুর দেব। প্রতিটা কুকুরের দাম এক হাজার টাকা। দুই হাজার টাকা খরচ করো। দুটো কুকুর নিয়ে যাও। ওরা সারা রাত বাগান পাহারা দেবে।
বুড়ো বলল, আমার যা বাগান, তা পাহারা দিতে দুটো কুকুর লাগবে না। একটাতেই হবে। আমি এক হাজার দিচ্ছি।
না বুড়ো, তোমার দুটো কুকুরই লাগবে। একটা বড় কুকুর, আরেকটা ছোট কুকুর। দুই কুকুর দুই জাতের। দুই ধরনের কাজ তার।
বুড়ো বলল, আমি এক হাজার দিচ্ছি। একটা কুকুরই দিন। বড়টা দিন।
বুড়ো বড় কুকুরটা আনল আর বাগানে ছেড়ে দিল।
রাতের বেলা যেই না চোর আসে, অমনি কুকুরটা তেড়ে যায়। দশাসই কুকুর। চোরের পায়ের গোঁড়ালি কামড়ে ধরেছে, লাঠির বাড়ি খেয়েও ছাড়েনি, শেষে গোঁড়ালির মাংস ছিঁড়ে যাওয়ায় পালিয়ে বাঁচল চোর। আর তারা আসে না ওই বাগানে।
বুড়ো খুশি। জ্ঞানী মানুষটিকে বলল, বলেছিলাম কিনা, আমার একটা কুকুরেই হবে।
তিনি বললেন, হলে তো ভালোই।
কয়েক দিন পর। দেখা গেল, কুকুরটা রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। চোরেরা প্রায়ই আসে বাগানে, কুকুরটাকে নীরব দেখে তারা একদিন নেমে পড়ে বাগানে। ঠিকই চুরি করতে সক্ষম হয় বাগানের ফল।
বুড়ো পরদিন সকালে বাগানে গিয়ে হায় হায় করে, নিজের চুল ছেঁড়ে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই হয়। কুকুর ঘুমোয় আর চোর চুরি করে।
বুড়ো আবার গেল জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। ‘এই কুকুরে হবে না। আমাকে ছোট কুকুরটাই দিন।’ বড়টা ফেরত দিয়ে সে নিয়ে এল ছোট কুকুরটা।
ছোট কুকুরটা খুব ঘেউ ঘেউ করে। সারা রাত বাগান আর তার আশপাশের এলাকার সবার ঘুম হারাম। চোরেরাও দেখল, এবার আর সুবিধা করা যাবে না। তারা চুরি থেকে বিরত রইল।
বুড়ো গেল জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। বলল, দেখলেন, একটা কুকুরেই কেমন চলছে আমার। আমি খুব খুশি।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, চললে তো ভালোই। দেখা যাক।
কিছুদিনের মধ্যেই চোরেরা আবিষ্কার করল, ছোট কুকুরটার কামড়ানেভর শক্তি নেই। সে তেড়ে আসে, ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু কামড় তো কামড়, আঁচড়টি পর্যন্ত দেয় না।
চোরেরা ঢুকে গেল বাগানে। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করল। তেড়ে এল। থাবা বা দাঁত বসাল না। নির্বিঘ্নে চুরিকর্ম সেরে চোরেরটা কেটে পড়ল।
এক দিন দুই দিন। বুড়ো গেল আবার সেই বুদ্ধিমান সদাশয় মানুষটার কাছে। কী করব এখন?
তিনি বললেন, দুটো কুকুরই নিতে হবে তোমাকে, বলেছিলাম কিনা।
আরও এক হাজার টাকা দিয়ে বড় কুকুরটাও সঙ্গে করে নিয়ে এল বুড়ো।
এবার দেখা গেল, বড় কুকুরটা ঘুমায়। আর চোর আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট কুকুরটা এমন ঘেউ ঘেউ করে যে বড়টার ঘুম ভেঙে যায়। বড়টা তখন ওঠে, চোরের পেছনে ধাওয়া করে। আর তার ধাওয়া মানে কেবল তেড়ে আসা না, একেবারে মাথা বরাবর ঝাঁপিয়ে পড়া।
এর পর থেকে ওই বাগানে আর চোর আসে না।
এই গল্প আমাকে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনস্থল বেলা সেন্টারে শুনিয়েছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক আইনুন নিশাত। গল্পটি শুনিয়ে তিনি বলেছিলেন, সরকার হলো রাষ্ট্রের আসল চালক। তার ক্ষমতা বেশি, কাজ করলে সে-ই করতে পারে, কিন্তু সে বড় ঘুমায়।
আর এ কারণেই দরকার এনজিও, সুশীল সমাজ, নাগরিক ফোরামের নজরদারির। তাদের আসলে করার ক্ষমতা কম, কিন্তু আওয়াজ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। আর তারা ঘুমোয় না, ঘুমোতে দেয় না। তারা চিত্কার-চেঁচামেচি করলে সরকারের ঘুম ভাঙে এবং সরকার সক্রিয় হয়।
কথাটা আইনুন নিশাত বলছিলেন, কোপেনহেগেন শহরে এনজিও ও পরিবেশবাদী হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদী মিছিল-সমাবেশ আন্দোলন প্রসঙ্গে। এরা মূল দরকষাকষির ঘরে ঢুকতেও পারে না। কিন্তু তাদের চিত্কারটার দরকার আছে। সরকারগুলোকে তাদের কর্তব্যের কথা তারা মনে করিয়ে দেয়।
আমার মনে হয়, কেবল এনজিও বা নাগরিক সমাজ বা প্রতিবাদী জনগোষ্ঠী নয়, সংবাদমাধ্যমেরও একই ভূমিকা। সংবাদমাধ্যমকে তো বলাই হয় ওয়াচডগ। সরকার বা রাজনীতিকেরা বা কোনো প্রতিষ্ঠান কোথাও কোনো ভুল করলে তারা ওয়াচডগের মতো সেটাকে ফলাও করে প্রচার করবে। সরকার ঘুমিয়ে পড়লে তারা জাগিয়ে তুলবে। সরকার যদি না জাগে জনগণকে জাগাবে সংবাদমাধ্যম। জনগণ ঠিকই নেতাদের বুঝিয়ে দেয়, এক মাঘে শীত যায় না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাই যেমন সরকারকে সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হয়, তেমনি সরকারের ঘুম ভাঙানোর জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম, বিবেকবান ও পক্ষপাতহীন নাগরিক সমাজ ও নানা ধরনের বেসরকারি সংগঠন ও ফোরামও দরকার হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments