শ্রমবাজারে নারী ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা by জোবাইদা নাসরীন |
আমেরিকার কর্মক্ষেত্রগুলোতে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই নারীকর্মীরা সংখ্যার দিক থেকে পুরুষকর্মীদের ছাড়িয়ে যাবেন। কয়েকটি ধনী দেশে পেশাজীবী নারীরা এরই মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ওইসিডির (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট সংখ্যার দিক থেকে নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে। আমেরিকাতে ২০১১ সালের মধ্যে ছেলেদের চেয়ে ২৬ লাখ বেশি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের দেশগুলো নারীকর্মী নিয়োগে বিশ্বে প্রথম দিকে রয়েছে। এসব দেশে কর্মজীবী নারীদের সবচেয়ে কম সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। (সূত্র: দি ইকোনমিস্ট) ধনী দেশগুলোর কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই অগ্রগতির খবর নিঃসন্দেহে আমাদেরও আশাবাদী করে। বাংলাদেশকে ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে হলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। কিছুদিন আগেও গৃহস্থালির মতো একঘেয়েমির কাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। নারীর জন্য শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজই রাখা হতো পাবলিক পরিসরে। মনে করা হতো, বিয়ে ও সন্তান হওয়ার পর নারী তার ক্যারিয়ার ছেড়ে দেবে। এসব চিন্তায় কম-বেশি পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি নারী উত্পাদনমূলক নানা কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। শুধু চ্যালেঞ্জিং কাজেই নয়, চ্যালেঞ্জিং অনেক সিদ্ধান্তও আসছে নারীদের কাছ থেকে। এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এখনো অনেকটাই অসম্পূর্ণ। সমস্যা রয়ে গেছে অনেক।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও তা এখনো বেশ কম। বর্তমান সরকারের আমলে মন্ত্রিসভাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান পেয়েছে নারীরা। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছে তারা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ২০০৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সব মিলে মাত্র ২৬ শতাংশ নারী অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক। গার্মেন্টসশিল্পে অনেক বেশি নারীর সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক কাজের সম্পৃক্ততার এ হারকে বাড়াতে সহায়তা করেছে। যদিও এ দেশে বেতন-কাঠামোতেও অনেকাংশে রয়েছে বৈষম্য। ঘরে-বাইরে নারীর অবৈতনিক শ্রম এখানে যুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রমবাজারের বিভিন্ন খাতে নারীর আগমন গত ১০ বছরে নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে। তবে প্রতিবছর শ্রমবাজার থেকে নারীর ফিরে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক। নারীদের একটি বৃহত্ অংশ শ্রমবাজার থেকে বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ে, যার বেশির ভাগেরই কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। শুধু পারিবারিক ও সামাজিক মতাদর্শই নয়, শ্রমবাজার নারীর জন্য এখনো সব দিক থেকে অনুকূল নয় বলে নারীর এই বিপরীতমুখী যাত্রা। এখন অনেক চাকরির বিজ্ঞাপনে নারীদের আবেদন জানাতে উত্সাহিত করে ‘ওমেন আর এনকারেজড টু অ্যাপ্লাই’ লেখা থাকলেও নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রগুলো খুব ‘এনকারেজিং’ থাকে না। বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বহু নারী অনেক জায়গাতেই টিকে থাকতে পারে না; তারা বাধ্য হয় তাদের জায়গা ছেড়ে দিতে। ফলে আমাদের চাকরির বাজারে নারীর আগমন যেমন বাড়ছে, তেমনি এখান থেকে নারীর ঝরে পড়ার হারও নেহাত কম নয়।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে চাকরির বাজার থেকে নারীর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ, চাকরিজীবী মায়েদের জন্য কর্মক্ষেত্রে পরিবারবান্ধব অবস্থা না থাকা। অনেক চাকরিজীবী মা শুধু ডে কেয়ার সেন্টার থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কম বেতনেও কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। খোদ আমেরিকার অনেক জায়গাতেই সন্তানহীন নারীর আয় অনেক বেশি, কিন্তু যাদের সন্তান আছে, সেসব নারী অপেক্ষাকৃত কম উপার্জন করে (সূত্র: দি ইকোনমিস্ট)। এ বিষয়গুলো চিন্তা করে সুইডেন ও জার্মানির ৯০ শতাংশেরও বেশি কোম্পানি সুবিধামতো কর্মসময় করেছে। তারা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে, যাতে কর্মক্ষেত্রে নারীকর্মীর প্রয়োজনগুলো মেটানো যায়।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টারের দাবি দীর্ঘদিনের। পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, অসম বেতন এবং যাতায়াতের সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নারীর জন্য পুরোপুরি নিরাপদ ও অনুকূল কর্মক্ষেত্র করা যায়নি। এমনকি অনেক বড় গার্মেন্টস কারখানা এবং অফিসেও নারীর জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়নি। দেশে এখন অনেক নারীই পরিবার ও সমাজের নানা বাধা জয় করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও সেখানে বিরাজমান সমস্যার কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এসব বিষয়ের প্রতি এখনই নজর না দিলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের কাজ অনেক কঠিন হবে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর তৃতীয়টি হলো নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষের সমতা বিধান। শ্রমবাজারকে নারীর জন্য অনুকূল করতে না পারলে কোনোভাবেই এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
প্রতিবছর কত নারী শ্রমবাজারে, শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করছে, কোন স্তরের পদে কাজ করছে, এর পাশাপাশি কত নারী এই শ্রমবাজার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে, এগুলোর সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে থাকা প্রয়োজন। শুধু তথ্যই নয়, নারীর জন্য অনুকূল কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সরকারকেই আগে উদ্যোগ নিতে হবে। ২০১৫ সালের আর বেশি দেরি নেই। তাই বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হওয়ার সময় এখনই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। কিছুদিন আগেও গৃহস্থালির মতো একঘেয়েমির কাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। নারীর জন্য শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজই রাখা হতো পাবলিক পরিসরে। মনে করা হতো, বিয়ে ও সন্তান হওয়ার পর নারী তার ক্যারিয়ার ছেড়ে দেবে। এসব চিন্তায় কম-বেশি পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি নারী উত্পাদনমূলক নানা কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। শুধু চ্যালেঞ্জিং কাজেই নয়, চ্যালেঞ্জিং অনেক সিদ্ধান্তও আসছে নারীদের কাছ থেকে। এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এখনো অনেকটাই অসম্পূর্ণ। সমস্যা রয়ে গেছে অনেক।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও তা এখনো বেশ কম। বর্তমান সরকারের আমলে মন্ত্রিসভাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান পেয়েছে নারীরা। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছে তারা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ২০০৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সব মিলে মাত্র ২৬ শতাংশ নারী অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক। গার্মেন্টসশিল্পে অনেক বেশি নারীর সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক কাজের সম্পৃক্ততার এ হারকে বাড়াতে সহায়তা করেছে। যদিও এ দেশে বেতন-কাঠামোতেও অনেকাংশে রয়েছে বৈষম্য। ঘরে-বাইরে নারীর অবৈতনিক শ্রম এখানে যুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রমবাজারের বিভিন্ন খাতে নারীর আগমন গত ১০ বছরে নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে। তবে প্রতিবছর শ্রমবাজার থেকে নারীর ফিরে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক। নারীদের একটি বৃহত্ অংশ শ্রমবাজার থেকে বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ে, যার বেশির ভাগেরই কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। শুধু পারিবারিক ও সামাজিক মতাদর্শই নয়, শ্রমবাজার নারীর জন্য এখনো সব দিক থেকে অনুকূল নয় বলে নারীর এই বিপরীতমুখী যাত্রা। এখন অনেক চাকরির বিজ্ঞাপনে নারীদের আবেদন জানাতে উত্সাহিত করে ‘ওমেন আর এনকারেজড টু অ্যাপ্লাই’ লেখা থাকলেও নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রগুলো খুব ‘এনকারেজিং’ থাকে না। বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বহু নারী অনেক জায়গাতেই টিকে থাকতে পারে না; তারা বাধ্য হয় তাদের জায়গা ছেড়ে দিতে। ফলে আমাদের চাকরির বাজারে নারীর আগমন যেমন বাড়ছে, তেমনি এখান থেকে নারীর ঝরে পড়ার হারও নেহাত কম নয়।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে চাকরির বাজার থেকে নারীর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ, চাকরিজীবী মায়েদের জন্য কর্মক্ষেত্রে পরিবারবান্ধব অবস্থা না থাকা। অনেক চাকরিজীবী মা শুধু ডে কেয়ার সেন্টার থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কম বেতনেও কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। খোদ আমেরিকার অনেক জায়গাতেই সন্তানহীন নারীর আয় অনেক বেশি, কিন্তু যাদের সন্তান আছে, সেসব নারী অপেক্ষাকৃত কম উপার্জন করে (সূত্র: দি ইকোনমিস্ট)। এ বিষয়গুলো চিন্তা করে সুইডেন ও জার্মানির ৯০ শতাংশেরও বেশি কোম্পানি সুবিধামতো কর্মসময় করেছে। তারা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে, যাতে কর্মক্ষেত্রে নারীকর্মীর প্রয়োজনগুলো মেটানো যায়।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টারের দাবি দীর্ঘদিনের। পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, অসম বেতন এবং যাতায়াতের সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নারীর জন্য পুরোপুরি নিরাপদ ও অনুকূল কর্মক্ষেত্র করা যায়নি। এমনকি অনেক বড় গার্মেন্টস কারখানা এবং অফিসেও নারীর জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়নি। দেশে এখন অনেক নারীই পরিবার ও সমাজের নানা বাধা জয় করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও সেখানে বিরাজমান সমস্যার কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এসব বিষয়ের প্রতি এখনই নজর না দিলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের কাজ অনেক কঠিন হবে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর তৃতীয়টি হলো নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষের সমতা বিধান। শ্রমবাজারকে নারীর জন্য অনুকূল করতে না পারলে কোনোভাবেই এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
প্রতিবছর কত নারী শ্রমবাজারে, শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করছে, কোন স্তরের পদে কাজ করছে, এর পাশাপাশি কত নারী এই শ্রমবাজার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে, এগুলোর সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে থাকা প্রয়োজন। শুধু তথ্যই নয়, নারীর জন্য অনুকূল কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সরকারকেই আগে উদ্যোগ নিতে হবে। ২০১৫ সালের আর বেশি দেরি নেই। তাই বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হওয়ার সময় এখনই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments