ছাত্ররাজনীতিতে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে by আব্দুল কাইয়ুম
পাকিস্তানের প্রথম যুগের কথা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে, হক-ভাসানির যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। সেই নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দলে দলে নিজ এলাকায় গিয়ে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেছিল। নির্বাচনে বিজয়ের পুরস্কার হিসেবে তারা দাবি করে, পরীক্ষা পেছাতে হবে, কারণ দেশের স্বার্থে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে, আর সে সময় বন্যার কারণে তাদের পড়াশোনা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বললেন, এটা সম্ভব না। ছাত্ররা বলল, নিশ্চয়ই সম্ভব। তারা দলবেঁধে গেল টিকাটুলির কে এম দাশ লেনে যুক্তফ্রন্টের নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বাসায়। সব শুনে তিনি তাদের কিছুটা আশ্বাস দেন। অবশ্য তিনি কখনো নিয়মভঙ্গের পক্ষপাতী ছিলেন না। ছাত্রদের কথা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে তিনি কিছুটা ছাড় দেন। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের তত্কালীন গভর্নর রাজি হলেন না। এদিকে ছাত্ররা প্রতিদিনই ধরনা দিচ্ছে। পরে নতুন গভর্নর এলে শেরেবাংলা ফজলুল হকের কথায় তিনি পরীক্ষা পেছানোর ব্যবস্থা করেন। এ অবস্থায় রেজিস্ট্রার একটা নোটিশ টাঙিয়ে দিয়ে লজ্জা ও অপমানে অফিস ত্যাগ করেন। উপাচার্য ডব্লিউ এ জেনকিনস (১৮৯১-১৯৫৮, যিনি ১৯৫৩-১৯৫৬ কালপর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন) তখন দীর্ঘ ছুটিতে লন্ডনে ছিলেন। যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, কোনো অজুহাতেই যেন পরীক্ষা পেছানো না হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়। অবশ্য তাতেও ছাত্ররা সন্তুষ্ট না, কারণ পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। তখন তারা আবার শেরেবাংলা ফজলুল হকের বাসায় গেল এই দাবি নিয়ে যে, এত কম সময়ে কিছু হবে না। এবার শেরেবাংলা সাংঘাতিক রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘এখনই গিয়া পড়তে বসো, নইলে পিটাইয়া মাথা ফাটাইয়া দিব, রেললাইনও পার হইতে পারবা না!’ তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনটি টিকাটুলি হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে বিস্তৃত ছিল।
আজ সেই অনমনীয় মনোভাবের উপাচার্য নেই, সেই কঠিন মনের রেজিস্ট্রারও নেই আর নেই সেই ধরনের ছাত্রনেতাও, যারা সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে দেনদরবার করে পরীক্ষা পেছানোর চেষ্টা করবে। যদি থাকত তাহলে গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হতে পারত না। হলেও তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হতো এবং পেছন থেকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর ইন্ধন জোগানোর অভিযোগের ভিত্তিতে সেই অভিযুক্ত ছাত্রদেরও গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হতো। এর কোনোটাই হয়নি, কারণ উপাচার্য সরকারি দলের সক্রিয় সমর্থক। সে হিসেবেই তিনি ওই পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
পরীক্ষা পেছানো তো কোনো ব্যাপারই না। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিপক্ষ দল বা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে মারপিট, গোলাগুলি, খুনোখুনি আজ প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১, পাঁচ বছরে পাঁচজন ও পরবর্তী পাঁচ বছরে বিএনপি সরকারের সময় ছয়জন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হানাহানিতে প্রাণ দিয়েছেন। দেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনে প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের রক্তাক্ত হানাহানি কি কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে চলতে দেওয়া যায়?
উপাচার্য যদি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন করতে চান, তাহলে তিনি তা পারবেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আসল ব্যাপার হলো, তাঁদের সে রকম কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ বিভিন্ন হল থেকে প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন শুরু করে। এরপর বিতাড়িত নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে বা তাদের ছাত্রলীগে যোগদানে বাধ্য করে হলে ঢোকার ছাড়পত্র দেয়। অবশ্য তার পরও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী হলে স্থান পায় এই শর্তে যে, তারা ক্ষেত্রবিশেষে ‘ছাত্রলীগের অনুগত ছাত্রদল’ হিসেবে কাজ করবে। গত ১৮ জানুয়ারির সংঘর্ষটি ছিল মূলত ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ বর্তমান ছাত্রদলের সভাপতি একজন অছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম থেকেই অপাঙেক্তয় বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। সুতরাং তিনি মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলে তাঁর ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায়। কিন্তু এর পেছনের ঘটনাটিই আসল তাত্পর্য বহন করে। ধারণা করা হয়, ছাত্রদলের এই নেতা-কর্মীরা হলো সেই ছাত্রদলের নেতা-কর্মী, যাদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথমে বিতাড়িত করে পরে অলিখিত ও অপ্রচারিত শর্তে হলে থাকতে দিয়েছিল। এই ধারণা কতটা সত্য তা অনুসন্ধানের বিষয়। কিন্তু সেদিনের ঘটনায় তাদের ক্ষোভের সংগত কারণ থাকলেও তার সঙ্গে ছাত্রলীগের উসকানি থাকার অভিযোগটি একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গৃহীত ভিডিও চিত্রে যাদের লাঠি-রড-কিরিচ হাতে ছাত্রদলের সভাপতির ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে, তাদের কেউ কেউ ছাত্রলীগের কিছুটা অচেনা কর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে এসব ভিডিও চিত্র নিয়ে তদন্তে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে, তার কারণ কি তাহলে রাজনৈতিক? প্রক্টর মহোদয় যে আহত হলেন, তিনি কি কাউকেই চিনতে পারলেন না? তিনি কেন পরিষ্কার বলছেন না কে কে তাঁদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে?
এ ধরনের ঘটনা শুধু ছাত্রলীগেরই একচেটিয়া ব্যাপার না। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতালাভের পরও একইভাবে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। এমনকি তাদের অনেককে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মারপিট করে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়। তখনো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিল নীরব।
ছাত্র-আন্দোলনে বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে কোনো অছাত্র বা বহিরাগত কেউ ছাত্রনেতা হতে পারতেন না। যদি কালেভদ্রে কেউ হতেন, তাহলে এমন সমালোচনা শুরু হতো যে লজ্জায় তিনি নিজেই বিদায় হতেন।’ অথচ আজকাল বিবাহিত শুধু নয়, সন্তানের বাবারাও তথাকথিত ছাত্রনেতা। আকবর আলি খান ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর সময়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সে সময় ভালো, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা নেতৃত্বে থাকতেন। কারণ ডাকসু ও হল নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় সবাই ভেবে দেখতেন, কে কত মেধাবী। আকবর আলি খান বললেন, ‘নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন না হলে সহিংসতা বন্ধ হবে না।’ এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নির্বাচন হলে ছাত্র-সংগঠনগুলো অন্তত ভোট পাওয়ার জন্য ভালো ও নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসবে এবং সহিংসতা থেকে দূরে থাকবে।
এখানেও সেই দলীয় রাজনীতির কালো ছায়া। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে বাধা দেয় এই অজুহাতে যে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদলকে জিতিয়ে আনা হবে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল একই অভিযোগে ডাকসু নির্বাচন হতে দেয় না। এ অবস্থায় উপাচার্যেরা দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিয়ে চলেছেন।
এটা বলতে কষ্ট হয় যে, মূল দুটি ছাত্র-সংগঠন ও সেই সূত্রে ছাত্র-আন্দোলন এখন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলে ব্যক্তিবিশেষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়সহ যাবতীয় অপকর্মের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বজায় রাখার জন্য এত মারামারি-হানাহানির পেছনে অবৈধ উপায়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগলাভের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। এর সঙ্গে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের দোকানপাট, শপিংমল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ওই এলাকার প্রভাবশালী ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের হাতে তুলে দিতে হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মূল রাজনৈতিক দলগুলো এসব তথাকথিত ছাত্রনেতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় দল ভারী করার অজুহাতে। যদিও, নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী, ছাত্র-সংগঠনগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে, কিন্তু সেটা শুধু খাতা-কলমেই। বাস্তবে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক আদর্শ সব সময়ই ছিল এবং থাকাই স্বাভাবিক। ষাটের দশকের শেষার্ধে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রেখেই আমরা ছাত্র-সংগঠন করেছি, নেতৃত্বও দিয়েছি, কিন্তু কখনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব সময় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে অপছন্দ করে।
এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে সরাসরি বলতে হবে, তারা কোনো ছাত্র-সংগঠনকে সমর্থন দেবে না। তারা যদি হাত না গুটায়, শিক্ষকেরা যদি দলীয় রাজনীতিমুক্ত না থাকেন, উপাচার্য যদি দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকতে না পারেন, তাহলে ছাত্ররাজনীতি খুনোখুনির অশুভ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
আমরা এখানে অধ্যাপক এ জি স্টকের শরণাপন্ন হব। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় বেড়াতে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো মিছিল-স্লোগানসর্বস্ব ছাত্র-আন্দোলন দেখে তিনি বেশ অবাক হন। কারণ স্বাধীন দেশে এ ধরনের বিক্ষোভ অন্তত ছাত্র-অঙ্গনে তিনি আশা করেননি। তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-৪৮’ মুখবন্ধে তিনি লেখেন, ‘আমার মনে হয় প্লেটো তাঁর রিপাবলিকে অন্তত একটি অত্যন্ত ভালো কথা বলেছেন, যখন তিনি ঘোষণা করেছেন, যার যার নিজের কাজটি সাধ্যমতো ভালোভাবে করাই একটি ন্যায়বোধে উদ্বুদ্ধ সমাজের গাঁথুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং সরল চিন্তার বিকাশ। যদি প্রবল চাপে ঘিরে থাকা এই বিশ্বের যেকোনো চাপের মুখে সে নিজেকেই এই উদ্দেশ্যের যেকোনো একটি থেকেও সরিয়ে নেয়, পৃথিবীর আর কোনো প্রতিষ্ঠানই তাহলে এই মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেবে না।’ (মূল গ্রন্থের অনুবাদ, মোবাশ্বেরা খানম, এ জি স্টকের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত)
কথাগুলো সরকার থেকে শুরু করে উপাচার্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ছাত্রনেতৃত্ব পর্যন্ত সবার চোখ খুলে দেওয়া উচিত।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
আজ সেই অনমনীয় মনোভাবের উপাচার্য নেই, সেই কঠিন মনের রেজিস্ট্রারও নেই আর নেই সেই ধরনের ছাত্রনেতাও, যারা সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে দেনদরবার করে পরীক্ষা পেছানোর চেষ্টা করবে। যদি থাকত তাহলে গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হতে পারত না। হলেও তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হতো এবং পেছন থেকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর ইন্ধন জোগানোর অভিযোগের ভিত্তিতে সেই অভিযুক্ত ছাত্রদেরও গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হতো। এর কোনোটাই হয়নি, কারণ উপাচার্য সরকারি দলের সক্রিয় সমর্থক। সে হিসেবেই তিনি ওই পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
পরীক্ষা পেছানো তো কোনো ব্যাপারই না। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিপক্ষ দল বা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে মারপিট, গোলাগুলি, খুনোখুনি আজ প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১, পাঁচ বছরে পাঁচজন ও পরবর্তী পাঁচ বছরে বিএনপি সরকারের সময় ছয়জন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হানাহানিতে প্রাণ দিয়েছেন। দেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনে প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের রক্তাক্ত হানাহানি কি কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে চলতে দেওয়া যায়?
উপাচার্য যদি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন করতে চান, তাহলে তিনি তা পারবেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আসল ব্যাপার হলো, তাঁদের সে রকম কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগ বিভিন্ন হল থেকে প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন শুরু করে। এরপর বিতাড়িত নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে বা তাদের ছাত্রলীগে যোগদানে বাধ্য করে হলে ঢোকার ছাড়পত্র দেয়। অবশ্য তার পরও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী হলে স্থান পায় এই শর্তে যে, তারা ক্ষেত্রবিশেষে ‘ছাত্রলীগের অনুগত ছাত্রদল’ হিসেবে কাজ করবে। গত ১৮ জানুয়ারির সংঘর্ষটি ছিল মূলত ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ বর্তমান ছাত্রদলের সভাপতি একজন অছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম থেকেই অপাঙেক্তয় বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। সুতরাং তিনি মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলে তাঁর ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায়। কিন্তু এর পেছনের ঘটনাটিই আসল তাত্পর্য বহন করে। ধারণা করা হয়, ছাত্রদলের এই নেতা-কর্মীরা হলো সেই ছাত্রদলের নেতা-কর্মী, যাদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথমে বিতাড়িত করে পরে অলিখিত ও অপ্রচারিত শর্তে হলে থাকতে দিয়েছিল। এই ধারণা কতটা সত্য তা অনুসন্ধানের বিষয়। কিন্তু সেদিনের ঘটনায় তাদের ক্ষোভের সংগত কারণ থাকলেও তার সঙ্গে ছাত্রলীগের উসকানি থাকার অভিযোগটি একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গৃহীত ভিডিও চিত্রে যাদের লাঠি-রড-কিরিচ হাতে ছাত্রদলের সভাপতির ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে, তাদের কেউ কেউ ছাত্রলীগের কিছুটা অচেনা কর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে এসব ভিডিও চিত্র নিয়ে তদন্তে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে, তার কারণ কি তাহলে রাজনৈতিক? প্রক্টর মহোদয় যে আহত হলেন, তিনি কি কাউকেই চিনতে পারলেন না? তিনি কেন পরিষ্কার বলছেন না কে কে তাঁদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে?
এ ধরনের ঘটনা শুধু ছাত্রলীগেরই একচেটিয়া ব্যাপার না। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতালাভের পরও একইভাবে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। এমনকি তাদের অনেককে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মারপিট করে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়। তখনো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিল নীরব।
ছাত্র-আন্দোলনে বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে কোনো অছাত্র বা বহিরাগত কেউ ছাত্রনেতা হতে পারতেন না। যদি কালেভদ্রে কেউ হতেন, তাহলে এমন সমালোচনা শুরু হতো যে লজ্জায় তিনি নিজেই বিদায় হতেন।’ অথচ আজকাল বিবাহিত শুধু নয়, সন্তানের বাবারাও তথাকথিত ছাত্রনেতা। আকবর আলি খান ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর সময়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সে সময় ভালো, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা নেতৃত্বে থাকতেন। কারণ ডাকসু ও হল নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় সবাই ভেবে দেখতেন, কে কত মেধাবী। আকবর আলি খান বললেন, ‘নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন না হলে সহিংসতা বন্ধ হবে না।’ এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নির্বাচন হলে ছাত্র-সংগঠনগুলো অন্তত ভোট পাওয়ার জন্য ভালো ও নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসবে এবং সহিংসতা থেকে দূরে থাকবে।
এখানেও সেই দলীয় রাজনীতির কালো ছায়া। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে বাধা দেয় এই অজুহাতে যে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদলকে জিতিয়ে আনা হবে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল একই অভিযোগে ডাকসু নির্বাচন হতে দেয় না। এ অবস্থায় উপাচার্যেরা দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিয়ে চলেছেন।
এটা বলতে কষ্ট হয় যে, মূল দুটি ছাত্র-সংগঠন ও সেই সূত্রে ছাত্র-আন্দোলন এখন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলে ব্যক্তিবিশেষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়সহ যাবতীয় অপকর্মের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বজায় রাখার জন্য এত মারামারি-হানাহানির পেছনে অবৈধ উপায়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগলাভের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। এর সঙ্গে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের দোকানপাট, শপিংমল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ওই এলাকার প্রভাবশালী ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের হাতে তুলে দিতে হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মূল রাজনৈতিক দলগুলো এসব তথাকথিত ছাত্রনেতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় দল ভারী করার অজুহাতে। যদিও, নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী, ছাত্র-সংগঠনগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে, কিন্তু সেটা শুধু খাতা-কলমেই। বাস্তবে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক আদর্শ সব সময়ই ছিল এবং থাকাই স্বাভাবিক। ষাটের দশকের শেষার্ধে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রেখেই আমরা ছাত্র-সংগঠন করেছি, নেতৃত্বও দিয়েছি, কিন্তু কখনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব সময় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে অপছন্দ করে।
এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে সরাসরি বলতে হবে, তারা কোনো ছাত্র-সংগঠনকে সমর্থন দেবে না। তারা যদি হাত না গুটায়, শিক্ষকেরা যদি দলীয় রাজনীতিমুক্ত না থাকেন, উপাচার্য যদি দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকতে না পারেন, তাহলে ছাত্ররাজনীতি খুনোখুনির অশুভ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
আমরা এখানে অধ্যাপক এ জি স্টকের শরণাপন্ন হব। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় বেড়াতে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো মিছিল-স্লোগানসর্বস্ব ছাত্র-আন্দোলন দেখে তিনি বেশ অবাক হন। কারণ স্বাধীন দেশে এ ধরনের বিক্ষোভ অন্তত ছাত্র-অঙ্গনে তিনি আশা করেননি। তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-৪৮’ মুখবন্ধে তিনি লেখেন, ‘আমার মনে হয় প্লেটো তাঁর রিপাবলিকে অন্তত একটি অত্যন্ত ভালো কথা বলেছেন, যখন তিনি ঘোষণা করেছেন, যার যার নিজের কাজটি সাধ্যমতো ভালোভাবে করাই একটি ন্যায়বোধে উদ্বুদ্ধ সমাজের গাঁথুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং সরল চিন্তার বিকাশ। যদি প্রবল চাপে ঘিরে থাকা এই বিশ্বের যেকোনো চাপের মুখে সে নিজেকেই এই উদ্দেশ্যের যেকোনো একটি থেকেও সরিয়ে নেয়, পৃথিবীর আর কোনো প্রতিষ্ঠানই তাহলে এই মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেবে না।’ (মূল গ্রন্থের অনুবাদ, মোবাশ্বেরা খানম, এ জি স্টকের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত)
কথাগুলো সরকার থেকে শুরু করে উপাচার্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ছাত্রনেতৃত্ব পর্যন্ত সবার চোখ খুলে দেওয়া উচিত।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments