সো-হোয়াট, তাতে হয়েছেটা কী by এবিএম মূসা
সীতাকুণ্ডে আবারও হাজার-হাজার গাছ কেটে ফেলেছে মিলিত সন্ত্রাসীরা। মিলিত মানে, অন্য যেকোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে মতান্তর থাকলেও একটি স্থানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মনে হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ। সীতাকুণ্ডে তাঁরা একটি ‘জাতীয় ঐক্যের’ নিদর্শন স্থাপন করেছেন। সংসদে পাশাপাশি বসেন না তাঁদের নেতারা, যদিও একসঙ্গে বেতন-ভাতা আদায় করেন। শুনছি, স্পিকারের সুপারিশে গাড়িও সমানভাবে বণ্টন করা হবে। শুধু গাছ কাটা আর টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে কোনো ‘মতদ্বৈধতা’ নেই। এই অদ্ভুত সহাবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে টেলিফোন করলেন শাহজাহান কবির। লক্ষ্মীপুরবাসী কবির এমন অনেক ব্যাপারে তাঁর প্রিয় দলীয় সরকারের কর্মকাণ্ডের খবর পড়ে টেলিভিশনে ছবি দেখে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ও আশাহত হয়ে প্রায়ই টেলিফোন করেন। তাঁর প্রশ্ন ‘এসব কী হচ্ছে?’ আমি লঘুভাবে জবাব দিই, হয়েছেটা কী? অথবা হলেই বা কী? ‘সো-হোয়াট?’ তার ক্রুদ্ধ উত্তরটি প্রতিবেদনটির সমাপ্তিতে জানাব।
একই কথা বলেছিলাম একটি সেমিনারে। অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য প্রতিবছর সাংবাদিক তথা প্রতিবেদককে পুরস্কার দিয়ে থাকে টিআইবি তথা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। কয়েক সপ্তাহ আগে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গত বছরের শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদকদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনাপত্র পেশ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। পূর্বনির্ধারিত কার্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আমাকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আলোচনাকালে আমি বলেছিলাম, ‘এত যে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তাতে হয়েছেটা কী? কার কী আসে যায়।’ মতিউর রহমান নিজেও স্বীকার করেছেন, তাঁর উপাত্তপত্রে বলেছেন, রিপোর্টগুলো পরে হারিয়ে যায়। প্রথম আলোতেই পূর্ণ পৃষ্ঠা একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রায় শখানেক পুল বছরের পর বছর অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তাঁর পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে অনেকদিন আগে। তারপরও পুলগুলোর নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে কি-না তা তো জানা গেল না, পত্রিকার প্রতিবেদকও পরে কিছু জানাননি। মতিউর রহমান সাংবাদিকতার ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, ‘ফলোআপ কোথায়?’ রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর কী হলো, তা কেন প্রতিবেদক জানালেন না। প্রশ্নটির জবাব বস্তুত সম্পাদকেরই দেওয়ার কথা। যাই হোক, বিজ্ঞ সম্পাদক জানেন, যাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়ভার যাঁদের তাঁরা উত্তর বা কৈফিয়ত দেওয়ার, কী হলো জানানোর ধার ধারেন না।
আমার সংক্ষিপ্ত ভাষণে মতিউর রহমানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেছিলাম, ফলোআপের দরকার হয় কখন? পত্রিকার রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্দশা লাঘবে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের তথা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। এ ছাড়া পুল অসমাপ্ত রাখার পরও বরাদ্দ অর্থ আত্মসাত্কারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি-না সে নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন দেখা দেয়, তার উত্তরও তাঁরাই দেবেন, এমনটিই তো সবাই ভাবেন। উত্তর নেই, মানে তাঁদের তথা সরকারের কোনো জবাবদিহি নেই। স্বল্প সময়ের আলোচনায় আমি মতিউর রহমানকে বলতে পারিনি, ‘আসলে তারপর আর কিস্যু হয়নি।’ যাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনগণের অভাব-অভিযোগ, ক্ষোভ-সমালোচনা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, তাঁরা তা পড়েন না। অথবা পড়লেও গ্রাহ্য করেন না। ভাবেন ‘তাতে হয়েছেটা কী?’ সীতাকুণ্ডের বনরাজি ধ্বংস করার প্রাক্কালে একই ধরনের একটি প্রতিবেদন কয়েক মাস আগে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল, এই খবর পড়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষুব্ধ হওয়াই সার। মদদদাতা তাঁর দলীয় সাংসদ ও কাঠুরে বাহিনী বহালতবিয়তে আছেন! প্রধানমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছেন, তাতে হয়েছেটা কী, সো-হোয়াট? তাঁর বলার আছে বলেছেন, আমরা শুনেছি, অতঃপর যা করার করে চলেছি। আবার কাটছি, আবার হুঁশিয়ারি শুনব। তারপর দুই-চারটে যেগুলো আছে সেগুলো কাটব এবং কাটছি।
প্রসঙ্গত, আমার নিজের বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির প্রতিক্রিয়াটি কী হয় তাও বলতে হয়। উল্লেখ করেছি, কুষ্টিয়া থেকে আমার একজন পাঠকও পত্রযোগে জানতে চেয়েছেন, ‘আপনি যে এত লেখালেখি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনার মাঝেও কিছু হিতোপদেশ দেন তারপরও তাদের পরবর্তী কার্যক্রমে তার আছর দেখতে পাই না কেন?’ তিনি সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রশ্নটিই ভিন্ন ভাষায় করেছেন, ‘তারপর কী হলো?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে বলেছি, একবার পুলগুলোর কথা আলোকচিত্র সহকারে প্রকাশিত হয়েছে, তারপর আর কী হতে পারত। পুলগুলো মেরামত হয়েছে, পুলখেকোর কাছ থেকে খেসারত আদায় করা হয়েছে, অর্থাত্ এমনটিই তো হওয়ার কথা। আমার ধারণা, ‘সেসব কিস্যু হয়নি, না হলেও বা কী করার আছে? পুল নির্মাণের অতীত-বর্তমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃত্বধারীরা ভাবেন, পত্রিকায় যখন ছাপা হয়েছে, নতুন একটি সুযোগ এসেছে। নতুন করে পুলের টেন্ডার হবে। তবে এবার এলাকার নিজ দলীয় কোনো কর্মীকে দিয়ে কীভাবে সেতু-সম্পর্কীয় টাকা পাইয়ে দেওয়া যায়, মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে সেই খোঁজ নিতে হবে।’
সেতু নিয়ে পাঠকের প্রশ্নের জবাবে একটি গল্প মনে পড়ছে। অতীতের সেই কাহিনী ছিল, দুর্নীতিতে সেরা খেতাবপ্রাপ্ত একটি দেশের রাষ্ট্রপতি গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশে। স্বাগতিক দেশের রাষ্ট্রপতির নিজস্ব বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ দেখে অতিথি অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, এত টাকা কোথায় পেলেন?’ রাষ্ট্রপতি মেহমানকে জানালা দিয়ে দেখালেন দূরের নদীর ওপর বিশাল সেতু। বললেন, ‘টেন পারসেন্ট, মানে সেতু বাবদ ব্যয়ের হাজারো কোটি টাকার মাত্র দশ শতাংশ নিয়েছেন।’ কিছুদিন পর পাল্টা নিমন্ত্রণে এলেন পূর্বোল্লিখিত রাষ্ট্রপতি। দেখেন তাঁর প্রাসাদের চেয়েও অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসী প্রাসাদ এই রাষ্ট্রপতির। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই বিশাল প্রাসাদ বানালেন কীভাবে?’ নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি মেহমানকে জানালা দিয়ে দূরের একটি নদী দেখিয়ে বললেন, ‘ব্রিজটি দেখছেন?’ মেহমান রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘না তো, সেটি কোথায়?’ গৃহকর্তা রাষ্ট্রপতি মুচকি হেসে নিজ প্রাসাদের চারদিক দেখিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন না? হানড্রেড পারসেন্ট।’
আমার ক্ষুব্ধ পাঠককে গল্পটি শুনিয়ে বললাম, ‘আমরা যা লিখি, যাঁদের উদ্দেশে লিখি, তাঁরা তা পড়েন না। পড়লেও বোঝেন না। বুঝলেও গ্রাহ্য করেন না। কারণ সেই টেন বা হানড্রেড পারসেন্ট।’ টিআইবি সেমিনারে একটি ইংরেজি প্রবচনের উদ্ধৃতিও দিয়েছিলাম, ‘লেট দি ডগস বার্ক, দি ক্যারাভান উইল পাস-অন, রাস্তায় কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেই বা কী? আমার পথে আমি যাব, আগামী আরও চার বছর তো বটে।’ সব বিরূপ আলোচনা ও সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের অনেকের মনোভাব এমনটি মনে হয় না কী? তাই তো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে বৈঠক হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া হয় না। কারণ, হয়তো সেই ‘টেন অথবা ফিফটি পারসেন্ট।’ ক্ষেত্রবিশেষে ‘হানড্রেড পারসেন্ট হতে পারে।’ আবার এমনও মনে হতে পারে, ‘পাবলিক মেমোরি ইজ শর্ট। জনমত পদ্মপাতার জল, ডাল-তেলের দাম, যানজটের দুর্ভোগ, ঈদে বাড়ি যাওয়ার ভোগান্তি, দু’দিনের ব্যাপার, ভুলতে কতক্ষণ! সো-হোয়াট, যে যা বলিস ভাই, আমার পারসেন্টেজ চাই।’
সেমিনারে আমার তির্যক মন্তব্যে স্নেহভাজন তথ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, ‘মূসা ভাই, প্রতিদিন সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবগুলো পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়েন। বিশেষ করে আপনাদের কয়েকজনের মন্তব্য-প্রতিবেদন কলামগুলোতে প্রতিফলিত বক্তব্য-মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমি দেখা করতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পড়েছি কিনা।’ মন্ত্রী মহোদয়কে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি, তাই বলা হলো না, ‘পড়েছেন তো বুঝলাম, তারপর কী হয়? যে সব অনুসন্ধানী রিপোর্ট, মতামত, জনগণের দুর্দশার বিবরণ, তাঁর মন্ত্রীদের উল্টো-সিধে অতিকথনের কাহিনী পড়ে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়?’ জবাবে তিনি হয়তো প্রত্যুত্তরে বলতে পারতেন, ‘এ তো আপনি সরাসরি তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারেন।’ তাঁকে বলিনি, আমার একটি টেলিভিশন চ্যানেল পাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্নটি করেছি বৈকি। কী উত্তর পেয়েছি, অতি নিজস্ব ব্যাপার, তাই লিখলাম না। মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় বিশ্বাস করলাম। প্রধানমন্ত্রী পড়েন, ক্ষুব্ধ হন, তারপর নেতাকর্মীদের হুমকি দেন, ‘আর সহ্য করা হবে না।’ আমার পাঠককে প্রধানমন্ত্রীর হুমকির কথা শোনাতে তিনি বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বললেন, সেই ‘আর’ কবে আসবে?
তাই তো, আমি ভাবছি কবে আসবে? দখলবাজি, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিদিনই বিশদ প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। এসব কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট নয়, সঠিক তথ্য পরিবেশন। মন্ত্রী ‘হুঁশিয়ার’ করে দিচ্ছেন, ‘যে দলেরই হোক’ টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। তারপরও প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ‘যেকোনো দলের নয়’ একটি দলেরই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। তবে সীতাকুণ্ডে যেমন ঘটেছে তেমনি অনেক স্থানে এসব কর্মকাণ্ড, কোথাও কোথাও সব দলের চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ-দখলবাজদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘটে থাকে বৈকি। তথ্যমন্ত্রীকে সেদিন সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘প্রধানমন্ত্রী সবই পড়েন, আপনাকে পড়তে বলেন, তা তো বুঝলাম। আপনিও বলেছেন, সবই পড়েন, এই রিপোর্টগুলো পড়ার পর ধমক-ধামক ছাড়া কী করেছেন? তবে একেবারেই কিছু করেন না বলব না। সংবাদপত্রে বৃক্ষ-সন্ত্রাসীদের নাম-পরিচয় ছাপা হয়, মামলা হয় অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের নামে। মন্ত্রী সাড়ম্বরে ভরাট করা নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করেন। ভরাটকারীরা দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে, মন্ত্রী দু’কদম না যেতেই নবউদ্যমে দখলযজ্ঞ পুনরাম্ভ হয়।
পাদটিকা— আমার পাঠকদের ক্রমাগত প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে বলি, ‘এ হচ্ছে, সে হচ্ছে, অতীতেও হয়েছে, এখনো হবে। সো-হোয়াট, তাতে হয়েছেটা কী?’ কুষ্টিয়ার পাঠক ব্যঙ্গাত্মক উত্তর দিলেন, ‘হয়েছেটা কী, চার বছর পরে টের পাবানি।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
একই কথা বলেছিলাম একটি সেমিনারে। অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য প্রতিবছর সাংবাদিক তথা প্রতিবেদককে পুরস্কার দিয়ে থাকে টিআইবি তথা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। কয়েক সপ্তাহ আগে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গত বছরের শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদকদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনাপত্র পেশ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। পূর্বনির্ধারিত কার্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আমাকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আলোচনাকালে আমি বলেছিলাম, ‘এত যে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তাতে হয়েছেটা কী? কার কী আসে যায়।’ মতিউর রহমান নিজেও স্বীকার করেছেন, তাঁর উপাত্তপত্রে বলেছেন, রিপোর্টগুলো পরে হারিয়ে যায়। প্রথম আলোতেই পূর্ণ পৃষ্ঠা একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রায় শখানেক পুল বছরের পর বছর অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তাঁর পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে অনেকদিন আগে। তারপরও পুলগুলোর নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে কি-না তা তো জানা গেল না, পত্রিকার প্রতিবেদকও পরে কিছু জানাননি। মতিউর রহমান সাংবাদিকতার ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, ‘ফলোআপ কোথায়?’ রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর কী হলো, তা কেন প্রতিবেদক জানালেন না। প্রশ্নটির জবাব বস্তুত সম্পাদকেরই দেওয়ার কথা। যাই হোক, বিজ্ঞ সম্পাদক জানেন, যাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়ভার যাঁদের তাঁরা উত্তর বা কৈফিয়ত দেওয়ার, কী হলো জানানোর ধার ধারেন না।
আমার সংক্ষিপ্ত ভাষণে মতিউর রহমানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেছিলাম, ফলোআপের দরকার হয় কখন? পত্রিকার রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্দশা লাঘবে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের তথা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। এ ছাড়া পুল অসমাপ্ত রাখার পরও বরাদ্দ অর্থ আত্মসাত্কারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি-না সে নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন দেখা দেয়, তার উত্তরও তাঁরাই দেবেন, এমনটিই তো সবাই ভাবেন। উত্তর নেই, মানে তাঁদের তথা সরকারের কোনো জবাবদিহি নেই। স্বল্প সময়ের আলোচনায় আমি মতিউর রহমানকে বলতে পারিনি, ‘আসলে তারপর আর কিস্যু হয়নি।’ যাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনগণের অভাব-অভিযোগ, ক্ষোভ-সমালোচনা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, তাঁরা তা পড়েন না। অথবা পড়লেও গ্রাহ্য করেন না। ভাবেন ‘তাতে হয়েছেটা কী?’ সীতাকুণ্ডের বনরাজি ধ্বংস করার প্রাক্কালে একই ধরনের একটি প্রতিবেদন কয়েক মাস আগে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল, এই খবর পড়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষুব্ধ হওয়াই সার। মদদদাতা তাঁর দলীয় সাংসদ ও কাঠুরে বাহিনী বহালতবিয়তে আছেন! প্রধানমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছেন, তাতে হয়েছেটা কী, সো-হোয়াট? তাঁর বলার আছে বলেছেন, আমরা শুনেছি, অতঃপর যা করার করে চলেছি। আবার কাটছি, আবার হুঁশিয়ারি শুনব। তারপর দুই-চারটে যেগুলো আছে সেগুলো কাটব এবং কাটছি।
প্রসঙ্গত, আমার নিজের বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির প্রতিক্রিয়াটি কী হয় তাও বলতে হয়। উল্লেখ করেছি, কুষ্টিয়া থেকে আমার একজন পাঠকও পত্রযোগে জানতে চেয়েছেন, ‘আপনি যে এত লেখালেখি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনার মাঝেও কিছু হিতোপদেশ দেন তারপরও তাদের পরবর্তী কার্যক্রমে তার আছর দেখতে পাই না কেন?’ তিনি সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রশ্নটিই ভিন্ন ভাষায় করেছেন, ‘তারপর কী হলো?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে বলেছি, একবার পুলগুলোর কথা আলোকচিত্র সহকারে প্রকাশিত হয়েছে, তারপর আর কী হতে পারত। পুলগুলো মেরামত হয়েছে, পুলখেকোর কাছ থেকে খেসারত আদায় করা হয়েছে, অর্থাত্ এমনটিই তো হওয়ার কথা। আমার ধারণা, ‘সেসব কিস্যু হয়নি, না হলেও বা কী করার আছে? পুল নির্মাণের অতীত-বর্তমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃত্বধারীরা ভাবেন, পত্রিকায় যখন ছাপা হয়েছে, নতুন একটি সুযোগ এসেছে। নতুন করে পুলের টেন্ডার হবে। তবে এবার এলাকার নিজ দলীয় কোনো কর্মীকে দিয়ে কীভাবে সেতু-সম্পর্কীয় টাকা পাইয়ে দেওয়া যায়, মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে সেই খোঁজ নিতে হবে।’
সেতু নিয়ে পাঠকের প্রশ্নের জবাবে একটি গল্প মনে পড়ছে। অতীতের সেই কাহিনী ছিল, দুর্নীতিতে সেরা খেতাবপ্রাপ্ত একটি দেশের রাষ্ট্রপতি গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশে। স্বাগতিক দেশের রাষ্ট্রপতির নিজস্ব বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ দেখে অতিথি অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, এত টাকা কোথায় পেলেন?’ রাষ্ট্রপতি মেহমানকে জানালা দিয়ে দেখালেন দূরের নদীর ওপর বিশাল সেতু। বললেন, ‘টেন পারসেন্ট, মানে সেতু বাবদ ব্যয়ের হাজারো কোটি টাকার মাত্র দশ শতাংশ নিয়েছেন।’ কিছুদিন পর পাল্টা নিমন্ত্রণে এলেন পূর্বোল্লিখিত রাষ্ট্রপতি। দেখেন তাঁর প্রাসাদের চেয়েও অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসী প্রাসাদ এই রাষ্ট্রপতির। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই বিশাল প্রাসাদ বানালেন কীভাবে?’ নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি মেহমানকে জানালা দিয়ে দূরের একটি নদী দেখিয়ে বললেন, ‘ব্রিজটি দেখছেন?’ মেহমান রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘না তো, সেটি কোথায়?’ গৃহকর্তা রাষ্ট্রপতি মুচকি হেসে নিজ প্রাসাদের চারদিক দেখিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন না? হানড্রেড পারসেন্ট।’
আমার ক্ষুব্ধ পাঠককে গল্পটি শুনিয়ে বললাম, ‘আমরা যা লিখি, যাঁদের উদ্দেশে লিখি, তাঁরা তা পড়েন না। পড়লেও বোঝেন না। বুঝলেও গ্রাহ্য করেন না। কারণ সেই টেন বা হানড্রেড পারসেন্ট।’ টিআইবি সেমিনারে একটি ইংরেজি প্রবচনের উদ্ধৃতিও দিয়েছিলাম, ‘লেট দি ডগস বার্ক, দি ক্যারাভান উইল পাস-অন, রাস্তায় কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেই বা কী? আমার পথে আমি যাব, আগামী আরও চার বছর তো বটে।’ সব বিরূপ আলোচনা ও সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের অনেকের মনোভাব এমনটি মনে হয় না কী? তাই তো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে বৈঠক হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া হয় না। কারণ, হয়তো সেই ‘টেন অথবা ফিফটি পারসেন্ট।’ ক্ষেত্রবিশেষে ‘হানড্রেড পারসেন্ট হতে পারে।’ আবার এমনও মনে হতে পারে, ‘পাবলিক মেমোরি ইজ শর্ট। জনমত পদ্মপাতার জল, ডাল-তেলের দাম, যানজটের দুর্ভোগ, ঈদে বাড়ি যাওয়ার ভোগান্তি, দু’দিনের ব্যাপার, ভুলতে কতক্ষণ! সো-হোয়াট, যে যা বলিস ভাই, আমার পারসেন্টেজ চাই।’
সেমিনারে আমার তির্যক মন্তব্যে স্নেহভাজন তথ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, ‘মূসা ভাই, প্রতিদিন সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবগুলো পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়েন। বিশেষ করে আপনাদের কয়েকজনের মন্তব্য-প্রতিবেদন কলামগুলোতে প্রতিফলিত বক্তব্য-মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমি দেখা করতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পড়েছি কিনা।’ মন্ত্রী মহোদয়কে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি, তাই বলা হলো না, ‘পড়েছেন তো বুঝলাম, তারপর কী হয়? যে সব অনুসন্ধানী রিপোর্ট, মতামত, জনগণের দুর্দশার বিবরণ, তাঁর মন্ত্রীদের উল্টো-সিধে অতিকথনের কাহিনী পড়ে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়?’ জবাবে তিনি হয়তো প্রত্যুত্তরে বলতে পারতেন, ‘এ তো আপনি সরাসরি তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারেন।’ তাঁকে বলিনি, আমার একটি টেলিভিশন চ্যানেল পাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্নটি করেছি বৈকি। কী উত্তর পেয়েছি, অতি নিজস্ব ব্যাপার, তাই লিখলাম না। মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় বিশ্বাস করলাম। প্রধানমন্ত্রী পড়েন, ক্ষুব্ধ হন, তারপর নেতাকর্মীদের হুমকি দেন, ‘আর সহ্য করা হবে না।’ আমার পাঠককে প্রধানমন্ত্রীর হুমকির কথা শোনাতে তিনি বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বললেন, সেই ‘আর’ কবে আসবে?
তাই তো, আমি ভাবছি কবে আসবে? দখলবাজি, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিদিনই বিশদ প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। এসব কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট নয়, সঠিক তথ্য পরিবেশন। মন্ত্রী ‘হুঁশিয়ার’ করে দিচ্ছেন, ‘যে দলেরই হোক’ টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। তারপরও প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ‘যেকোনো দলের নয়’ একটি দলেরই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। তবে সীতাকুণ্ডে যেমন ঘটেছে তেমনি অনেক স্থানে এসব কর্মকাণ্ড, কোথাও কোথাও সব দলের চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ-দখলবাজদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘটে থাকে বৈকি। তথ্যমন্ত্রীকে সেদিন সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘প্রধানমন্ত্রী সবই পড়েন, আপনাকে পড়তে বলেন, তা তো বুঝলাম। আপনিও বলেছেন, সবই পড়েন, এই রিপোর্টগুলো পড়ার পর ধমক-ধামক ছাড়া কী করেছেন? তবে একেবারেই কিছু করেন না বলব না। সংবাদপত্রে বৃক্ষ-সন্ত্রাসীদের নাম-পরিচয় ছাপা হয়, মামলা হয় অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের নামে। মন্ত্রী সাড়ম্বরে ভরাট করা নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করেন। ভরাটকারীরা দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে, মন্ত্রী দু’কদম না যেতেই নবউদ্যমে দখলযজ্ঞ পুনরাম্ভ হয়।
পাদটিকা— আমার পাঠকদের ক্রমাগত প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে বলি, ‘এ হচ্ছে, সে হচ্ছে, অতীতেও হয়েছে, এখনো হবে। সো-হোয়াট, তাতে হয়েছেটা কী?’ কুষ্টিয়ার পাঠক ব্যঙ্গাত্মক উত্তর দিলেন, ‘হয়েছেটা কী, চার বছর পরে টের পাবানি।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
No comments