প্রতিশোধ নয়, প্রতিকার -বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার by মশিউল আলম
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা হত্যা করতে গিয়েছিলেন, তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ সেই মুহূর্তে তাঁরা এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্রের ভাষায়।
পরে সেই উত্তর অনূদিত হয় রাজনৈতিক ভাষায়: বাংলাদেশ এক স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্তি পেল। ১৫ আগস্ট জাতীয় ‘নাজাত দিবস’। একদলীয় শাসনের অবসান ঘটল, বহুদলীয় গণতন্ত্রের রাস্তা গেল খুলে। বাকশালি স্বৈরশাসন ও তার নেতার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করার জন্য সেই রক্তাক্ত কালরাত্রি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, ওই রক্তগঙ্গার প্রয়োজন ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সে ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছিলেন, তাঁরা সদর্পে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
তারপর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। বহুবর্ণিল বহুদল হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের পথে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি। এবড়োথেবড়ো পথে বহু কসরত করে সেদিকে এগোনোর চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ‘প্রয়োজনীয়তা’ বা ‘যৌক্তিকতা’র প্রচারণা ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া যখন চলছে, তখন কিছু সংবাদমাধ্যমে সেই সব পুরোনো প্রচারণা আবার ফিরে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের আবেদন খারিজ করে রায় ঘোষণার পর দৃশ্যত কেউ সে রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, তাঁরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কয়েকটি সংবাদপত্র রায় সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বললেও এমন সব প্রচারণা চালাচ্ছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সেই সব পুরোনো যুক্তিই তুলে ধরতে চাইছে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরশাসক ছিলেন, তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে চারটি ছাড়া দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন, একদলীয় বাকশাল গঠন করেছিলেন, রক্ষীবাহিনীকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন দায়মুক্তির আইন করে, দেশ পরিচালনায় তাঁর ব্যর্থতা ছিল সীমাহীন ইত্যাদি। এসব প্রচারণা চালানো হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের আপিল আবেদনের শুনানি চলেছে। সেই সময়ের বিদেশি পত্রপত্রিকায় ‘মুজিবের পতন’ নিয়ে নেতিবাচক ধরনের এবং খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি সমর্থনসূচক যেসব সংবাদ, মন্তব্য ইত্যাদি ছাপা হয়েছিল, সেগুলো সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে ছেপেছে একটি দৈনিক। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে ওই পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন খবরে ও মন্তব্যে।
মুজিববিরোধী এই সব প্রচারণায় নতুন কিছুই নেই। আছে বরং সেই পুরোনো মানসিকতারই পরিচয়। সেটা হলো, মুজিব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা এবং যাঁরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁদের ওপর বীরত্বের গুণ আরোপ করা। এ ধরনের সাংবাদিকতার পেছনে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল রয়েছে, আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে তা যে অচল, তা ওই রাজনীতিকেরা উপলব্ধি করেন কি না, ভেবে স্থির করতে পারি না। কিন্তু এটা তো দেখতে পাচ্ছি, কোনো রাজনৈতিক মহলের পক্ষেই আজ আর সেদিনের মতো প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয় ‘পনেরই আগস্টের নায়কেরা’ বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যাঁরা ইনডেমনিটি আইন করে হত্যাকারীদের বিচারের পথ দীর্ঘকাল বন্ধ রেখেছিলেন, উল্টো লোভনীয় নানা চাকরি ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছিলেন, বিদেশ থেকে ডেকে এনে রাজনৈতিক দল গঠন করিয়ে, এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও প্রার্থী বানিয়েছিলেন—সেই রাজনীতিকেরা মুখে মুখে আদালতের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাঁদের মনের মধ্যে কী আছে? সেখানে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? কোনো শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটেছে? তাঁরা কি আজ আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভুল-ত্রুটি-ব্যর্থতা যত যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য ছিল না, হতে পারে না? একই যুক্তিতে আজ তাঁদের এটাও কি উপলব্ধি করা উচিত নয়, খন্দকার মোশতাক আহমদের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করা, স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি-পদোন্নতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পুরস্কৃত করা কোনো নৈতিক বিচারেই সংগত হয়নি? প্রকাশ্যে না হোক, অন্তত আপন মনে তাঁরা যদি উপলব্ধি ও স্বীকার করেন যে, সেসবই ছিল ভুল, অন্যায় করা হয়েছিল, তাহলে কি তাঁরা নৈতিক বা রাজনৈতিক—কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? নাকি তার ফলে দেশের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বৈরিতা, অনাস্থা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্রপরায়ণতা লাঘব হতে পারে?
অবিকশিত গণতন্ত্র, আইনের শাসন সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব ইত্যাদি নানা কারণে অপরাধ, বিচার, দণ্ড ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের সমাজে স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি এখনো বেশ লক্ষণীয়। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সিরাজুর রহমান দৈনিক নয়া দিগন্তে গত ২৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার, রায় ইত্যাদি নিয়ে এক নিবন্ধ লিখেছেন। নানা ঘটনা ও প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মোদ্দা যে বক্তব্যটি তিনি হাজির করেছেন সেটা হলো, শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেন (বা আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছেন)। আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী এখন কী করবেন সে রায় নিয়ে? এ কথা কি তাঁর মনে হচ্ছে যে দয়া, ক্ষমা এবং অনুকম্পাহীন বিচার প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতারই নামান্তর? সত্যি কি তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনীতি করেছেন? প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন?’
সিরাজুর রহমান তাঁর ওই লেখার প্রারম্ভিক অংশের কিছু পরের দিকে উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের গোড়ার দিকে বিবিসির এক ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘তিনি রাজনীতিকে ঘৃণা করেন, কিন্তু পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়েছেন। আমি সেই রেকর্ডিং থামিয়ে দিয়েছিলাম, শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম, বিবিসি থেকে সে কথা প্রচার করা তাঁর রাজনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। বুঝতে পেরেছিলাম, সে পরামর্শের জন্য হাসিনা আমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। পরে শুনেছিলাম অন্য কোথাও তিনি বলেছেন, তাঁর পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ কাঁদেনি, সে জন্য তিনি তাঁদের শাস্তি দিতে চান।’
বর্ষীয়ান সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের এসব কথার সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তবে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তিনি বলতে চাইছেন, শেখ হাসিনা তাঁর সেই কথিত প্রতিশোধপরায়ণতাই চরিতার্থ করছেন। কিন্তু একটি সত্য সিরাজুর রহমানের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে: ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা তাঁর পিতার হত্যাকারীদের ধরে ধরে টপাটপ ফাঁসিতে লটকাননি। বিশেষ কোনো ট্রাইব্যুনাল বসাননি, সংক্ষিপ্ত বিচারের উদ্যোগ নেননি। সাধারণ আইনে স্বাভাবিক পন্থায় বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেটা করতে গিয়ে বিচার-প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হয়েছে। তারপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার-প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিলম্বিত বিচারের ভাগ্যে যোগ হয়েছে আরও সাত (৫+২) বছরের বিলম্ব। এবার আওয়ামী লীগ আবার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাভাবিক বিচার-প্রক্রিয়ার পথের বাধাগুলো সরিয়ে নিয়েছে; ২৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে আপিল বিভাগের এক বিশেষ বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেছেন। এরপর আসামিদের ক্ষমাপ্রার্থনার সুযোগ রয়েছে—সব আইনি-প্রক্রিয়াই যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে। হত্যাকারী যদি আইনানুগ পন্থায় বিচারের মাধ্যমে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ড পান, তবে সেটাকে প্রতিশোধ বলা যায় না, সেটা কৃত অপরাধের আইনি প্রতিকার। এ ছাড়া অন্যায়-অপরাধের আর কী প্রতিকার থাকতে পারে?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডিত আসামিদের দণ্ড কমিয়ে প্রাণদণ্ড এড়ানোর জন্য। সিরাজুর রহমানও আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার দৃষ্টান্ত টেনে বলতে চেয়েছেন, তাঁদের ফাঁসি দেওয়া ঠিক হবে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবতাবোধের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে এ ধরনের অনুরোধ জানিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ বড় অদ্ভুত দেশ: এই দেশে জেলখানার মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হেফাজতেও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না বলে আইন জারি করা হয়েছে। এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা যদি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন, রাষ্ট্রপতি তাঁদের দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন, তাহলে কে নিশ্চয়তা দিতে পারে চার বছরের মাথায় অন্য এক সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁরা ফুলের মালা গলায় পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবেন না?
জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশ ইতিহাসের ও চলমান সময়ের অশুভ পাকচক্র থেকে বেরতে পারবে না। সে জন্য প্রয়োজন বৈরিতা-বিভেদের অবসান। যাঁরা ভুল, অন্যায়, অপরাধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনুশোচনা না জাগলে বৈরিতার অবসান কী করে সম্ভব? আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর শুধু দণ্ডিত আসামিদের নয়, তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল বা তাঁদের প্রণোদক রাজনৈতিক শক্তিরও এই উপলব্ধিতে পৌঁছা উচিত।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
পরে সেই উত্তর অনূদিত হয় রাজনৈতিক ভাষায়: বাংলাদেশ এক স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্তি পেল। ১৫ আগস্ট জাতীয় ‘নাজাত দিবস’। একদলীয় শাসনের অবসান ঘটল, বহুদলীয় গণতন্ত্রের রাস্তা গেল খুলে। বাকশালি স্বৈরশাসন ও তার নেতার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করার জন্য সেই রক্তাক্ত কালরাত্রি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, ওই রক্তগঙ্গার প্রয়োজন ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সে ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছিলেন, তাঁরা সদর্পে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
তারপর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। বহুবর্ণিল বহুদল হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের পথে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি। এবড়োথেবড়ো পথে বহু কসরত করে সেদিকে এগোনোর চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ‘প্রয়োজনীয়তা’ বা ‘যৌক্তিকতা’র প্রচারণা ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া যখন চলছে, তখন কিছু সংবাদমাধ্যমে সেই সব পুরোনো প্রচারণা আবার ফিরে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের আবেদন খারিজ করে রায় ঘোষণার পর দৃশ্যত কেউ সে রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, তাঁরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কয়েকটি সংবাদপত্র রায় সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বললেও এমন সব প্রচারণা চালাচ্ছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সেই সব পুরোনো যুক্তিই তুলে ধরতে চাইছে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরশাসক ছিলেন, তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে চারটি ছাড়া দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন, একদলীয় বাকশাল গঠন করেছিলেন, রক্ষীবাহিনীকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন দায়মুক্তির আইন করে, দেশ পরিচালনায় তাঁর ব্যর্থতা ছিল সীমাহীন ইত্যাদি। এসব প্রচারণা চালানো হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের আপিল আবেদনের শুনানি চলেছে। সেই সময়ের বিদেশি পত্রপত্রিকায় ‘মুজিবের পতন’ নিয়ে নেতিবাচক ধরনের এবং খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি সমর্থনসূচক যেসব সংবাদ, মন্তব্য ইত্যাদি ছাপা হয়েছিল, সেগুলো সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে ছেপেছে একটি দৈনিক। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে ওই পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন খবরে ও মন্তব্যে।
মুজিববিরোধী এই সব প্রচারণায় নতুন কিছুই নেই। আছে বরং সেই পুরোনো মানসিকতারই পরিচয়। সেটা হলো, মুজিব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা এবং যাঁরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁদের ওপর বীরত্বের গুণ আরোপ করা। এ ধরনের সাংবাদিকতার পেছনে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল রয়েছে, আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে তা যে অচল, তা ওই রাজনীতিকেরা উপলব্ধি করেন কি না, ভেবে স্থির করতে পারি না। কিন্তু এটা তো দেখতে পাচ্ছি, কোনো রাজনৈতিক মহলের পক্ষেই আজ আর সেদিনের মতো প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয় ‘পনেরই আগস্টের নায়কেরা’ বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যাঁরা ইনডেমনিটি আইন করে হত্যাকারীদের বিচারের পথ দীর্ঘকাল বন্ধ রেখেছিলেন, উল্টো লোভনীয় নানা চাকরি ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছিলেন, বিদেশ থেকে ডেকে এনে রাজনৈতিক দল গঠন করিয়ে, এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও প্রার্থী বানিয়েছিলেন—সেই রাজনীতিকেরা মুখে মুখে আদালতের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাঁদের মনের মধ্যে কী আছে? সেখানে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? কোনো শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটেছে? তাঁরা কি আজ আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভুল-ত্রুটি-ব্যর্থতা যত যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য ছিল না, হতে পারে না? একই যুক্তিতে আজ তাঁদের এটাও কি উপলব্ধি করা উচিত নয়, খন্দকার মোশতাক আহমদের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করা, স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি-পদোন্নতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পুরস্কৃত করা কোনো নৈতিক বিচারেই সংগত হয়নি? প্রকাশ্যে না হোক, অন্তত আপন মনে তাঁরা যদি উপলব্ধি ও স্বীকার করেন যে, সেসবই ছিল ভুল, অন্যায় করা হয়েছিল, তাহলে কি তাঁরা নৈতিক বা রাজনৈতিক—কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? নাকি তার ফলে দেশের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বৈরিতা, অনাস্থা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্রপরায়ণতা লাঘব হতে পারে?
অবিকশিত গণতন্ত্র, আইনের শাসন সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব ইত্যাদি নানা কারণে অপরাধ, বিচার, দণ্ড ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের সমাজে স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি এখনো বেশ লক্ষণীয়। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সিরাজুর রহমান দৈনিক নয়া দিগন্তে গত ২৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার, রায় ইত্যাদি নিয়ে এক নিবন্ধ লিখেছেন। নানা ঘটনা ও প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মোদ্দা যে বক্তব্যটি তিনি হাজির করেছেন সেটা হলো, শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেন (বা আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছেন)। আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী এখন কী করবেন সে রায় নিয়ে? এ কথা কি তাঁর মনে হচ্ছে যে দয়া, ক্ষমা এবং অনুকম্পাহীন বিচার প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতারই নামান্তর? সত্যি কি তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনীতি করেছেন? প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন?’
সিরাজুর রহমান তাঁর ওই লেখার প্রারম্ভিক অংশের কিছু পরের দিকে উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের গোড়ার দিকে বিবিসির এক ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘তিনি রাজনীতিকে ঘৃণা করেন, কিন্তু পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়েছেন। আমি সেই রেকর্ডিং থামিয়ে দিয়েছিলাম, শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম, বিবিসি থেকে সে কথা প্রচার করা তাঁর রাজনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। বুঝতে পেরেছিলাম, সে পরামর্শের জন্য হাসিনা আমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। পরে শুনেছিলাম অন্য কোথাও তিনি বলেছেন, তাঁর পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ কাঁদেনি, সে জন্য তিনি তাঁদের শাস্তি দিতে চান।’
বর্ষীয়ান সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের এসব কথার সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তবে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তিনি বলতে চাইছেন, শেখ হাসিনা তাঁর সেই কথিত প্রতিশোধপরায়ণতাই চরিতার্থ করছেন। কিন্তু একটি সত্য সিরাজুর রহমানের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে: ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা তাঁর পিতার হত্যাকারীদের ধরে ধরে টপাটপ ফাঁসিতে লটকাননি। বিশেষ কোনো ট্রাইব্যুনাল বসাননি, সংক্ষিপ্ত বিচারের উদ্যোগ নেননি। সাধারণ আইনে স্বাভাবিক পন্থায় বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেটা করতে গিয়ে বিচার-প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হয়েছে। তারপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার-প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিলম্বিত বিচারের ভাগ্যে যোগ হয়েছে আরও সাত (৫+২) বছরের বিলম্ব। এবার আওয়ামী লীগ আবার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাভাবিক বিচার-প্রক্রিয়ার পথের বাধাগুলো সরিয়ে নিয়েছে; ২৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে আপিল বিভাগের এক বিশেষ বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেছেন। এরপর আসামিদের ক্ষমাপ্রার্থনার সুযোগ রয়েছে—সব আইনি-প্রক্রিয়াই যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে। হত্যাকারী যদি আইনানুগ পন্থায় বিচারের মাধ্যমে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ড পান, তবে সেটাকে প্রতিশোধ বলা যায় না, সেটা কৃত অপরাধের আইনি প্রতিকার। এ ছাড়া অন্যায়-অপরাধের আর কী প্রতিকার থাকতে পারে?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডিত আসামিদের দণ্ড কমিয়ে প্রাণদণ্ড এড়ানোর জন্য। সিরাজুর রহমানও আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার দৃষ্টান্ত টেনে বলতে চেয়েছেন, তাঁদের ফাঁসি দেওয়া ঠিক হবে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবতাবোধের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে এ ধরনের অনুরোধ জানিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ বড় অদ্ভুত দেশ: এই দেশে জেলখানার মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হেফাজতেও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না বলে আইন জারি করা হয়েছে। এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা যদি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন, রাষ্ট্রপতি তাঁদের দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন, তাহলে কে নিশ্চয়তা দিতে পারে চার বছরের মাথায় অন্য এক সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁরা ফুলের মালা গলায় পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবেন না?
জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশ ইতিহাসের ও চলমান সময়ের অশুভ পাকচক্র থেকে বেরতে পারবে না। সে জন্য প্রয়োজন বৈরিতা-বিভেদের অবসান। যাঁরা ভুল, অন্যায়, অপরাধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনুশোচনা না জাগলে বৈরিতার অবসান কী করে সম্ভব? আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর শুধু দণ্ডিত আসামিদের নয়, তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল বা তাঁদের প্রণোদক রাজনৈতিক শক্তিরও এই উপলব্ধিতে পৌঁছা উচিত।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments