আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস-সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও প্রতিবন্ধিতা by দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার
সারা পৃথিবীর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য ৩ ডিসেম্বর একটি তাত্পর্যপূর্ণ দিন। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ থেকে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে প্রতিবছর নানা আয়োজনে বিশ্বব্যাপী দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় একীভূতকরণ: বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন’। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সব পর্যায়ে ‘প্রতিবন্ধিতা’ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সুনিশ্চিত করার প্রয়াসে তাদের মূলধারায় একীভূতকরণ। আর এর মাধ্যমেই সমাজে বসবাসকারী সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তাদের যথাযোগ্য মানবাধিকার উপভোগের ও সমান অংশগ্রহণের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করা গেছে।
২০০০ সালে ১৫৬টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের ‘মিলেনিয়াম ডিক্লারেশন’ থেকে প্রণীত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এমডিজি) আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। পৃথিবীর দরিদ্রতম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদার কথা মাথায় রেখেই আটটি মূল লক্ষ্য এবং ১৮টি নির্ধারক চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সারা বিশ্বের মানুষ একযোগে কাজ করবে—এটাই এমডিজির মূল প্রেরণা ছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজকে একই প্লাটফর্মে এসে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ও শিক্ষা বিস্তারে একটি জোটবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করা গেছে। কিন্তু এমডিজি সংশ্লিষ্ট নীতিমালা, কার্যক্রম, মূল্যায়ন ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে সম্পৃক্ত করা না হলে লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জিত হবে না। এ বিষয়টি খোদ জাতিসংঘই বুঝতে পেরেছে।
পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ ব্যক্তি প্রতিবন্ধী এবং বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মোট ২০ শতাংশ এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের দারিদ্র্যকে ‘জাদুঘরে’ পাঠানোর প্রয়াসের মাঝখানে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। পৃথিবীর বহু দেশে শুধু প্রতিবন্ধিতার কারণে অনেক মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানে জোর করে রাখা হচ্ছে—এটি ব্যক্তির ‘চলাচলের স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বীয় সমাজে বাস করার অধিকার’কে খর্ব করছে।
স্পষ্টতই বোঝা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের একীভূতকরণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করা সম্ভব। কারণ এত বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও অংশগ্রহণের সুযোগকে অগ্রাহ্য করে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু ইত্যাদি রোধ করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশের দুটি গবেষণার কথাই এখানে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যাক: বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, ১৯৯৬-৯৭ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে তিন শতাংশ এবং ১০ বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধী। এ সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সিএসআইডি পরিচালিত একটি গবেষণায় (ESTEEM, ২০০২) দেখা গেছে, এ দেশের মোট প্রতিবন্ধী শিশুর মাত্র ১১ শতাংশ কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করে; এদের মধ্যে মাত্র আট শতাংশ প্রাথমিক স্তরের। এদের ঝরে পড়ার হারটাও আশঙ্কাজনক। এই চিত্র দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়, ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্তত দ্বিতীয় লক্ষ্যটি অর্জনই বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য কতটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত দেশের কথা তাই আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া এমডিজির তৃতীয় লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্রটা এ রকম যে, প্রতিবন্ধী বালিকা ও নারীদের মধ্যে মাত্র ৩.২১ শতাংশ কোনো পূর্ণকালীন আয়সৃজনী কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাকিরা তাদের পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে বেঁচে থাকছে মাত্র (সিএসআইডি, ২০০২)। আমরা যেখানে সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়েদের ক্ষমতায়নই নিশ্চিত করতে পারছি না সেখানে এই বিশালসংখ্যক প্রতিবন্ধী মেয়ে বা নারীদের ক্ষমতায়নের পথ কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে সেটাও চিন্তা করার সময় এসেছে। নয়তো এমন কোনো একদিন আসতে পারে, প্রতিবন্ধীদের সম-অধিকার ও ক্ষমতায়নকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় যুক্ত না করার ফলে পৃথিবীতে নুতন এক অসমতার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।
তাহলে কীভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গকে এমডিজির সঙ্গে একীভূত করা যাবে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত অনুসারে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা উল্লেখ করা যায়:
এমডিজি পরিপূর্ণভাবে অর্জন করতে হলে এর মৌলিক প্রক্রিয়ার সব স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ ও কার্যকর একীভূতকরণ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
চলমান লক্ষ্যমাত্রার কাঠামো, উপকরণ ও কার্যপ্রণালীর মধ্যে প্রতিবন্ধীদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এমডিজির মধ্যে প্রতিবন্ধিতা-সংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সবচেয়ে বড় বাধা হলো প্রতিবন্ধিতাসংক্রান্ত তথ্যঘাটতি। বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে এমডিজির চলমান পর্যায়ের মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ করা যেতে পারলেও তা যথেষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। তাই ২০১০ সালে এমডিজির যে রিভিউ হতে যাচ্ছে, সেখানে ‘প্রতিবন্ধিতা’বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র শাখা তৈরি করতে হবে, যার দ্বারা সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাকে মূল স্রোতে আনার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে এবং তার স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদি ফলাফল পর্যালোচনা করতে হবে।
প্রতিবন্ধিতাকে এমডিজির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের (Stakeholder) মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ‘রিসোর্স গ্রুপ’ গঠন করা যেতে পারে, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটির ধারাবাহিক সংলাপ এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে উপযুক্ত সহায়তা দিতে পারে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধীদের একীভূতকরণের মূল হাতিয়ার হতে পারে ‘সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন’ (Community Based Rehabilitation-CBR)। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং স্থানীয় সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা যায়। এই জন্য পরিবার, এলাকাবাসী, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়মহলের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০০৯-এর প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে পর্যালোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অবস্থার উন্নয়ন ও মূল স্রোতে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ শুরু হয়েছে—আমরাও তাতে শামিল হই।
দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
diba_h@yahoo.com, durbasha@gmail.com
২০০০ সালে ১৫৬টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের ‘মিলেনিয়াম ডিক্লারেশন’ থেকে প্রণীত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এমডিজি) আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। পৃথিবীর দরিদ্রতম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদার কথা মাথায় রেখেই আটটি মূল লক্ষ্য এবং ১৮টি নির্ধারক চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সারা বিশ্বের মানুষ একযোগে কাজ করবে—এটাই এমডিজির মূল প্রেরণা ছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজকে একই প্লাটফর্মে এসে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ও শিক্ষা বিস্তারে একটি জোটবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করা গেছে। কিন্তু এমডিজি সংশ্লিষ্ট নীতিমালা, কার্যক্রম, মূল্যায়ন ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে সম্পৃক্ত করা না হলে লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জিত হবে না। এ বিষয়টি খোদ জাতিসংঘই বুঝতে পেরেছে।
পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ ব্যক্তি প্রতিবন্ধী এবং বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মোট ২০ শতাংশ এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের দারিদ্র্যকে ‘জাদুঘরে’ পাঠানোর প্রয়াসের মাঝখানে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। পৃথিবীর বহু দেশে শুধু প্রতিবন্ধিতার কারণে অনেক মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানে জোর করে রাখা হচ্ছে—এটি ব্যক্তির ‘চলাচলের স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বীয় সমাজে বাস করার অধিকার’কে খর্ব করছে।
স্পষ্টতই বোঝা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের একীভূতকরণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করা সম্ভব। কারণ এত বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও অংশগ্রহণের সুযোগকে অগ্রাহ্য করে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু ইত্যাদি রোধ করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশের দুটি গবেষণার কথাই এখানে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যাক: বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, ১৯৯৬-৯৭ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে তিন শতাংশ এবং ১০ বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধী। এ সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সিএসআইডি পরিচালিত একটি গবেষণায় (ESTEEM, ২০০২) দেখা গেছে, এ দেশের মোট প্রতিবন্ধী শিশুর মাত্র ১১ শতাংশ কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করে; এদের মধ্যে মাত্র আট শতাংশ প্রাথমিক স্তরের। এদের ঝরে পড়ার হারটাও আশঙ্কাজনক। এই চিত্র দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়, ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্তত দ্বিতীয় লক্ষ্যটি অর্জনই বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য কতটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত দেশের কথা তাই আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া এমডিজির তৃতীয় লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্রটা এ রকম যে, প্রতিবন্ধী বালিকা ও নারীদের মধ্যে মাত্র ৩.২১ শতাংশ কোনো পূর্ণকালীন আয়সৃজনী কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাকিরা তাদের পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে বেঁচে থাকছে মাত্র (সিএসআইডি, ২০০২)। আমরা যেখানে সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়েদের ক্ষমতায়নই নিশ্চিত করতে পারছি না সেখানে এই বিশালসংখ্যক প্রতিবন্ধী মেয়ে বা নারীদের ক্ষমতায়নের পথ কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে সেটাও চিন্তা করার সময় এসেছে। নয়তো এমন কোনো একদিন আসতে পারে, প্রতিবন্ধীদের সম-অধিকার ও ক্ষমতায়নকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় যুক্ত না করার ফলে পৃথিবীতে নুতন এক অসমতার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।
তাহলে কীভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গকে এমডিজির সঙ্গে একীভূত করা যাবে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত অনুসারে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা উল্লেখ করা যায়:
এমডিজি পরিপূর্ণভাবে অর্জন করতে হলে এর মৌলিক প্রক্রিয়ার সব স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ ও কার্যকর একীভূতকরণ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
চলমান লক্ষ্যমাত্রার কাঠামো, উপকরণ ও কার্যপ্রণালীর মধ্যে প্রতিবন্ধীদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এমডিজির মধ্যে প্রতিবন্ধিতা-সংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সবচেয়ে বড় বাধা হলো প্রতিবন্ধিতাসংক্রান্ত তথ্যঘাটতি। বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে এমডিজির চলমান পর্যায়ের মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ করা যেতে পারলেও তা যথেষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। তাই ২০১০ সালে এমডিজির যে রিভিউ হতে যাচ্ছে, সেখানে ‘প্রতিবন্ধিতা’বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র শাখা তৈরি করতে হবে, যার দ্বারা সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাকে মূল স্রোতে আনার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে এবং তার স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদি ফলাফল পর্যালোচনা করতে হবে।
প্রতিবন্ধিতাকে এমডিজির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের (Stakeholder) মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ‘রিসোর্স গ্রুপ’ গঠন করা যেতে পারে, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটির ধারাবাহিক সংলাপ এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে উপযুক্ত সহায়তা দিতে পারে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধীদের একীভূতকরণের মূল হাতিয়ার হতে পারে ‘সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন’ (Community Based Rehabilitation-CBR)। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং স্থানীয় সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা যায়। এই জন্য পরিবার, এলাকাবাসী, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়মহলের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০০৯-এর প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে পর্যালোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অবস্থার উন্নয়ন ও মূল স্রোতে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ শুরু হয়েছে—আমরাও তাতে শামিল হই।
দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
diba_h@yahoo.com, durbasha@gmail.com
No comments