প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন: কিছু প্রস্তাব by শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন
১৯ অক্টোবর ২০০৯ ‘পঞ্চম জাতীয় প্রতিবন্ধী সম্মেলনে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন, প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় তাঁর সরকার আইন প্রণয়ন করবে, যাতে প্রতিবন্ধীরা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে সমাজে অবদান রাখতে পারে (প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর, ২০০৯)। তাঁর এই ঘোষণা আমাদের আশ্বস্ত করেছে।
যাঁরা প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে ভাবেন, তাঁরা সব সময়ই এর একটা আইনগত ভিত্তির তাগিদ অনুভব করে থাকেন। এখানে একটি তথ্য সংযুক্ত করতে চাই, বর্তমান সরকারই ১৯৯৬-০১ সময়কালে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ প্রণয়ন করেছিল, যা ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং ১ আগস্ট ২০০১ তারিখ থেকে আইনটি বলবত্ হয়। সবাই ভেবেছিল, প্রতিবন্ধীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তত একটি আইন বলবত্ হলো। বিগত আট বছরে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে।
প্রথমেই দৃষ্টি দিতে চাই বিদ্যমান আইনটির শিরোনামের দিকে। ২০০১ সালে বলবত্ হওয়া আইনটিকে ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন’ বলা হয়েছে। ‘কল্যাণ’ শব্দটি নিয়ে সেই সময়েই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো ভিন্নমত পোষণ করেছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে ‘কল্যাণ’ শব্দটি ঠিক সেই অর্থ বহন না করে অনেকটা সহানুভূতিমূলক একটি মনোভাবের সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই আইনটি নতুন করে তৈরি/সংশোধনী যা-ই করা হোক, নামকরণটা ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী অধিকার আইন’ করাটাই সংগত। বিদ্যমান আইনের ৩ নম্বর ধারায় ‘প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা ও প্রতিবন্ধী চিহ্নিতকরণ’ অংশে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। এখানে প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ‘মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন’ ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের একটি সহজ ব্যাপার বুঝতে হবে যে, ‘প্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’ কখনোই এক বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় এই আইনে ‘প্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক অসুস্থতা’কে গুলিয়ে ফেলাটা মোটেই সমীচীন হয়নি। ২০০১-এর আইনটিতে মোট ছয় ধরনের প্রতিবন্ধিতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখানে আরও কিছু প্রতিবন্ধিতা (শিখন প্রতিবন্ধিতা, অটিজম) যুক্ত করার সময় এসেছে।
আইনটির তফসিল ‘ক’ (ছ) অংশে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কিছু ধারার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো বেশ যুগোপযোগী এবং কার্যকর হলেও কিছু বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেছে। যেমন তফসিল ছ (৫)-এ বলা হয়েছে, ‘হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রযোজ্য স্থানে ঢাল ও বাঁকানো রাস্তা, সিঁড়ি ও র্যাম্প নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করা।’ সরকারি স্থাপনায় সরকার এটা করবে কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে (সিনেমা হল, শপিং কমপ্লেক্স) এই কাঠামো নির্মাণের দায়িত্বটা কার, সেটা নির্দিষ্ট নয়। এই আইনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তফসিল ‘ঘ’ ‘প্রতিবন্ধীগণের শিক্ষা’। শিক্ষার মাধ্যমেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হতে পারবে। তাই শিক্ষার ওপরই বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। মাত্র সাতটি পয়েন্টে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আরও সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করি, আইনটির সংশোধনী বা নতুন আইন প্রণয়নের সময় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। প্রয়োজনে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার পেশাজীবী যাঁরা আছেন, তাঁদেরও সংশ্লিষ্ট করতে হবে। আশার কথা এটাই, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়ায় প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়ে প্রশংসাযোগ্য কিছু কৌশলের উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তা আইনে পরিণত হতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রতিবন্ধীদের জন্য একাধিক আইন প্রচলিত রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য রয়েছে Individual with Disabilities Education Improvement Act (IDEA-2004) এবং তাদের অন্যান্য অধিকারের জন্য আছে Americais with Disabilities Act। এতে করে সুবিধা তা হলো, শিক্ষার মতো ব্যাপক একটি বিষয়কে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একত্রে দেখতে গিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় না। বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য একটি পৃথক আইন করে তাদের শিক্ষাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া (যা শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়ায় উল্লেখ হয়েছে) এবং তাদের স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ, যাতায়াতসুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্য একটি আলাদা আইন করে এই বিষয়গুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া, প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য ‘প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন ফান্ড’ তৈরির বিধান করা যেতে পারে। সেখান থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, অর্থ সহায়তা, বৃত্তি, সহায়ক উপকরণ ক্রয় বা চিকিত্সার জন্য অর্থ প্রদান করা হবে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি ‘প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন নীতিমালা’ প্রণয়ন করা উচিত।
বিদ্যমান আইনটিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়মিত চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট থাকতে হবে যে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই কোটা কত শতাংশ হবে। আমরা মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩ শতাংশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া আইনে সংযুক্ত করতে হবে, চাকরিরত অবস্থায় কেউ প্রতিবন্ধিতার শিকার হলে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা যাবে না। যদি সে তার পদে কাজ করতে সমর্থ না হয়, তবে তাকে অন্য পদে স্থানান্তর করতে হবে; তবে তাকে পূর্ব পদে প্রদত্ত বেতন ও সুবিধার কোনোরূপ হ্রাস করা যাবে না এবং এই প্রতিবন্ধিতার জন্য তাকে পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় প্রণীতব্য আইনটির মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনার জন্য কিছু সুপারিশ উল্লেখ করছি: ১. রাষ্ট্রের অন্য সব সাধারণ নাগরিকদের মতো প্রতিবন্ধীদের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও সম-অধিকার প্রদান করতে হবে। ২. প্রতিবন্ধীদের প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণই আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। ৩. প্রতিবন্ধীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। ৪. রাষ্ট্রীয় বাজেট, যেকোনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কার্যক্রম এবং সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের সংযুক্ত করতে হবে। ৫. সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সুনজর দিতে হবে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি ও পুরস্কার দিয়ে তাদের উত্সাহিত করার বিভিন্ন বিধান থাকতে হবে। ৬. একইভাবে রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিবন্ধীদেরও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। তাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, নীতিমালা, আদেশ, সামাজিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইনটি প্রায় এক দশকের পুরোনো হতে চলল। এখন এর সংশোধন বা নতুন একটি আইন প্রণয়নের সময় এসেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর উপযুক্ত ও যথার্থ কৌশলই হলো পরিবর্তন—যেটা বর্তমান সরকারেরও একটি ঐকান্তিক প্রয়াস। আমরা আশা করতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ২০০১-এর প্রতিবন্ধী আইনটিকে যুগোপযোগী করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
durbasha@gmail.com, diba_h@yahoo.com
যাঁরা প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে ভাবেন, তাঁরা সব সময়ই এর একটা আইনগত ভিত্তির তাগিদ অনুভব করে থাকেন। এখানে একটি তথ্য সংযুক্ত করতে চাই, বর্তমান সরকারই ১৯৯৬-০১ সময়কালে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ প্রণয়ন করেছিল, যা ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং ১ আগস্ট ২০০১ তারিখ থেকে আইনটি বলবত্ হয়। সবাই ভেবেছিল, প্রতিবন্ধীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তত একটি আইন বলবত্ হলো। বিগত আট বছরে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে।
প্রথমেই দৃষ্টি দিতে চাই বিদ্যমান আইনটির শিরোনামের দিকে। ২০০১ সালে বলবত্ হওয়া আইনটিকে ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন’ বলা হয়েছে। ‘কল্যাণ’ শব্দটি নিয়ে সেই সময়েই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো ভিন্নমত পোষণ করেছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে ‘কল্যাণ’ শব্দটি ঠিক সেই অর্থ বহন না করে অনেকটা সহানুভূতিমূলক একটি মনোভাবের সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই আইনটি নতুন করে তৈরি/সংশোধনী যা-ই করা হোক, নামকরণটা ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী অধিকার আইন’ করাটাই সংগত। বিদ্যমান আইনের ৩ নম্বর ধারায় ‘প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা ও প্রতিবন্ধী চিহ্নিতকরণ’ অংশে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। এখানে প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ‘মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন’ ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের একটি সহজ ব্যাপার বুঝতে হবে যে, ‘প্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’ কখনোই এক বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় এই আইনে ‘প্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক অসুস্থতা’কে গুলিয়ে ফেলাটা মোটেই সমীচীন হয়নি। ২০০১-এর আইনটিতে মোট ছয় ধরনের প্রতিবন্ধিতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখানে আরও কিছু প্রতিবন্ধিতা (শিখন প্রতিবন্ধিতা, অটিজম) যুক্ত করার সময় এসেছে।
আইনটির তফসিল ‘ক’ (ছ) অংশে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কিছু ধারার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো বেশ যুগোপযোগী এবং কার্যকর হলেও কিছু বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেছে। যেমন তফসিল ছ (৫)-এ বলা হয়েছে, ‘হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রযোজ্য স্থানে ঢাল ও বাঁকানো রাস্তা, সিঁড়ি ও র্যাম্প নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করা।’ সরকারি স্থাপনায় সরকার এটা করবে কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে (সিনেমা হল, শপিং কমপ্লেক্স) এই কাঠামো নির্মাণের দায়িত্বটা কার, সেটা নির্দিষ্ট নয়। এই আইনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তফসিল ‘ঘ’ ‘প্রতিবন্ধীগণের শিক্ষা’। শিক্ষার মাধ্যমেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হতে পারবে। তাই শিক্ষার ওপরই বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। মাত্র সাতটি পয়েন্টে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আরও সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করি, আইনটির সংশোধনী বা নতুন আইন প্রণয়নের সময় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। প্রয়োজনে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার পেশাজীবী যাঁরা আছেন, তাঁদেরও সংশ্লিষ্ট করতে হবে। আশার কথা এটাই, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়ায় প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়ে প্রশংসাযোগ্য কিছু কৌশলের উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তা আইনে পরিণত হতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রতিবন্ধীদের জন্য একাধিক আইন প্রচলিত রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য রয়েছে Individual with Disabilities Education Improvement Act (IDEA-2004) এবং তাদের অন্যান্য অধিকারের জন্য আছে Americais with Disabilities Act। এতে করে সুবিধা তা হলো, শিক্ষার মতো ব্যাপক একটি বিষয়কে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একত্রে দেখতে গিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় না। বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য একটি পৃথক আইন করে তাদের শিক্ষাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া (যা শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়ায় উল্লেখ হয়েছে) এবং তাদের স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ, যাতায়াতসুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্য একটি আলাদা আইন করে এই বিষয়গুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া, প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য ‘প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন ফান্ড’ তৈরির বিধান করা যেতে পারে। সেখান থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, অর্থ সহায়তা, বৃত্তি, সহায়ক উপকরণ ক্রয় বা চিকিত্সার জন্য অর্থ প্রদান করা হবে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি ‘প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন নীতিমালা’ প্রণয়ন করা উচিত।
বিদ্যমান আইনটিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়মিত চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট থাকতে হবে যে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই কোটা কত শতাংশ হবে। আমরা মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩ শতাংশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া আইনে সংযুক্ত করতে হবে, চাকরিরত অবস্থায় কেউ প্রতিবন্ধিতার শিকার হলে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা যাবে না। যদি সে তার পদে কাজ করতে সমর্থ না হয়, তবে তাকে অন্য পদে স্থানান্তর করতে হবে; তবে তাকে পূর্ব পদে প্রদত্ত বেতন ও সুবিধার কোনোরূপ হ্রাস করা যাবে না এবং এই প্রতিবন্ধিতার জন্য তাকে পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় প্রণীতব্য আইনটির মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনার জন্য কিছু সুপারিশ উল্লেখ করছি: ১. রাষ্ট্রের অন্য সব সাধারণ নাগরিকদের মতো প্রতিবন্ধীদের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও সম-অধিকার প্রদান করতে হবে। ২. প্রতিবন্ধীদের প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণই আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। ৩. প্রতিবন্ধীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। ৪. রাষ্ট্রীয় বাজেট, যেকোনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কার্যক্রম এবং সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের সংযুক্ত করতে হবে। ৫. সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সুনজর দিতে হবে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবদানের স্বীকৃতি ও পুরস্কার দিয়ে তাদের উত্সাহিত করার বিভিন্ন বিধান থাকতে হবে। ৬. একইভাবে রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিবন্ধীদেরও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। তাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, নীতিমালা, আদেশ, সামাজিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইনটি প্রায় এক দশকের পুরোনো হতে চলল। এখন এর সংশোধন বা নতুন একটি আইন প্রণয়নের সময় এসেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর উপযুক্ত ও যথার্থ কৌশলই হলো পরিবর্তন—যেটা বর্তমান সরকারেরও একটি ঐকান্তিক প্রয়াস। আমরা আশা করতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ২০০১-এর প্রতিবন্ধী আইনটিকে যুগোপযোগী করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
durbasha@gmail.com, diba_h@yahoo.com
No comments