ধন পাপাশ্রিত: সামন্ততন্ত্রের জমিদার ও গণতন্ত্রের ভূমিদার -সহজিয়া কড়চা BY সৈয়দ আবুল মকসুদ
ধন পাপাশ্রিত। আমার মতো অজ্ঞানীর কথা নয়। আড়াই হাজার বছর আগের কোনো ভারতীয় মুনি-ঋষির কথা। অঢেল ধন শুধু পাপের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব বলে আগের দিনের মহামানবেরা মনে করতেন। তাঁরা আরও মনে করতেন, অর্জিত ধনসম্পদ তার মালিককে প্ররোচিত করে নানা রকম অনাচার ও পাপকাজে।
অত দূরের প্রাচ্যের মনীষীর কথা যদি অগ্রাহ্যও করি, ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী ফরাসি দার্শনিক মঁশিয়ে প্রুদোর কথা ফেলে দিই কীভাবে? তিনি বলেছেন, প্রপার্টি ইজ থেফ্ট—বিত্তবৈভব ও ভূসম্পত্তি হলো চুরির ফসল। যাদের কম আছে তাদের থেকে অপহরণ না করে, অবৈধ উপায়ে ছিনিয়ে না নিয়ে, অন্যকে শোষণ না করে কারও পক্ষে বিত্তবান হওয়া সম্ভব নয়। সেটা ১৭৯৩ সালে মহামাননীয় কর্নওয়ালিশের সময় যেমন সত্য ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশেও সমান সত্য। ১৯৫০ সালে জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণার আগে এ দেশে ছিল পুরোপুরি অর্থাত্ নির্ভেজাল সামন্ততন্ত্র। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা আছি গণতন্ত্রের নামে এমন এক ছদ্মবেশী সামন্ততান্ত্রিক অবস্থায়, যার পাপগুলোকে চট করে ওপর থেকে দেখে বোঝা যায় না।
আজ সম্পদে সয়লাব বাংলাদেশ—সাত কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা সত্ত্বেও। সনাতন সামন্তবাদী সমাজে আমরা দেখেছি গরুর হাট বসতে। বিশ্বায়ন-পরবর্তী নবসামন্তবাদী সমাজে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে বসছে গাড়ির হাট। ১৯৬৯ সালে ঢাকার দোকানে খেলনা গাড়ি যত বিক্রি হয়েছে, ২০০৯ সালে প্রতিদিন তার দশ গুণ বেশি বিক্রি হয় বিলাসবহুল মোটরগাড়ি। যারা সবেমাত্র ধন আহরণের পথে নেমেছে, তারা শোরুমের নতুন গাড়িতে হাত দিতে পারছে না; সিএনজি নিয়ে শুক্রবারে ছুটছে শেরেবাংলা নগরে গাড়ির হাটে। বউ এবং বাপের বাড়ির লোকেরা বায়না ধরেছে—গাড়ি চাই। সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড ছাড়া গত্যন্তর নেই। সুতরাং কোরবানির ঈদের আগে গরু ও ডিপ ফ্রিজ কেনার আগেই একটা গাড়ি চাই। ঠিকাদারের বিলটা আটকে দিতে পারলে লাখখানেক পাওয়া যাবে। নতুন দলীয় পরিচয় নিয়ে যে বড় কর্তা এসেছেন, তাঁর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। প্রথম দিন শ্রমিক-কর্মচারীরা এই স্লোগানসহ তাঁকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। সুতরাং গাড়ির হাটের ক্রেতা হওয়ায় আর অসুবিধা নেই।
সেদিন এক ক্ষুদ্র সরকারি কর্মকর্তা পৌনে ১১টার সময় অফিসে ঢুকে বাঁ-হাত কানে লাগিয়ে মোবাইল ফোনে খুব জোরে জোরে কথা বলছিলেন এবং ডানহাতে রুমালে কপাল ও গলার ঘাম মুছছিলেন। বয়স্ক পিয়ন লোকটি বলছিলেন, উনি গাড়ি কেনার আগে পৌনে এক ঘণ্টা লেট করতেন, গাড়ি কেনার পর থেকে দেড় ঘণ্টা লেট করছেন। দোষ তাঁকে মোটেই দেওয়া যাবে না। তাঁর গাড়ি যদি রাস্তায় যানজটে আটকে থাকে তাঁর কী করার আছে? তিনি গাড়ির মালিক। এরপর থেকে গাড়ি তাঁকে অফিসে নিয়ে আসলে আসবেন, না আসলে আসবেন না। বেতনের চেক পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
২০০৯ সালে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে কয়টি করে আমদানি করা নতুন গাড়ি খালাস হয়, সে হিসাব থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু ঢাকায় শোরুম থেকে কত গাড়ি বিক্রি হয় তার হিসাব সম্ভবত কোথাও নেই। তা ছাড়া প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় কত গাড়ি চলাচল করে তার হিসাব বিআরটিএ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে বিপুল বিত্তের বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটছে—গাড়ি তার মধ্যে একটি উপাদান মাত্র।
১৯০৯ সালে ঢাকার রাস্তায় কী পরিমাণ প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করত? কেউ বলতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি অনেক তথ্যবিশারদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরাও পারেননি। তারপর অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম: কুড়ি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ঢাকায় প্রাইভেট মোটরগাড়ি ছিল দুটি। একটি ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর, দ্বিতীয়টি সৈয়দ আওলাদ হোসেনের। তিন মাইল লম্বা এক মাইল প্রস্থ শহরে সুপরিসর রাস্তা ছিল মাত্র দুটি: ইসলামপুর ও নবাবপুর রোড। নবাব বাহাদুর বা সৈয়দ সাহেব যেদিন বাড়ি থেকে বের হতেন দুই পাশের বাড়িঘর ও রাস্তার লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত গাড়ির দিকে—বাপরে, টম্টমের তিন গুণ বেশি দ্রুত গতিতে ছুটে চলে!
আজ কোনো ওভারব্রিজ বা কোনো উঁচু জায়গা থেকে অনেকে তাকিয়ে দেখে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির স্রোত। লাল পিঁপড়া বা শুঁয়োপোকার মতো তিড়তিড় করে এগোচ্ছে গাড়ির অন্তহীন লাইন। গাড়ি বাংলাদেশে তৈরি হয় না। অন্য দেশ থেকে ডলার দিয়ে কিনে আনতে হয়। গাড়ি চালানোর জন্য যে জ্বালানি সেই ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনও বিদেশ থেকে আনতে হয়। গাড়ির সিটকভার থেকে ভেতরে যেসব শোপিস শোভা পায়, তাও বাংলাদেশে তৈরি নয়—খাঁটি বিদেশি।
ঢাকা শহরের প্রথম দুই গাড়িঅলাই ছিলেন জমিদার অর্থাত্ জমিদারি ছিল তাঁদের আয়ের একমাত্র উত্স। প্রজাদের কাছ থেকে পেতেন খাজনা। সেটা সম্ভবত শোষণ বা পাপের পথেই আহরিত হতো। কিন্তু জমির মালিকানা ছিল প্রজার। প্রজার জমি তাঁরা কখনোই জবরদখল করতেন না। আভিজাত্য প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হতো গাড়ির। তাই প্রয়োজন না হলেও গাড়িতে তাঁদের চড়তে হতো, কারণ তাঁরা নবাব বা জমিদার। তবে স্বীকার করতেই হবে, ব্যক্তিজীবনে মানুষ হিসেবে নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ আওলাদ হোসেন ছিলেন সত্যিকারের শরিফ, ন্যায়পরায়ণ ও জনদরদি।
আজ সাবেকী সামন্ত্রতন্ত্র নেই, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্র সেকালের সামন্ত্রতন্ত্রের বাপ। আজ প্রত্যেকেই জমিদার হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আজ গণতন্ত্র আর গাড়িতে দেশ একাকার। উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী অফিসার ও অন্যান্য কর্মকর্তার জন্য আমদানি হচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ি। কর্মস্থান যেখানেই হোক, তাঁরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরকারি গাড়িতে ঘুরে বেড়াবেন ঢাকা শহরেই নবাব সলিমুল্লাহর মতো। কারণ আজ সবাই নবাব। একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, ঢাকার রাস্তার জিপ-জাতীয় গাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ ঢাকার বাইরের সরকারি কর্মকর্তাদের। ঢাকার এক শ কিলোমিটারের মধ্যে একটি বড় সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে বলেছেন, তাঁর কলেজের ৪৫ জন মহিলা শিক্ষকের সবাই ঢাকায় থাকেন, তাঁদের স্বামী-সন্তানরা ঢাকায়, তাঁদের অধিকাংশের গাড়ি আছে, কিন্তু তাঁরা সপ্তাহে একদিনের বেশি কলেজে আসেন না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাদের বন্ধু, সম্ভবত এখনো তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। কিন্তু তাঁর কলেজগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকের গাড়ি আছে। যদি তিনি যেতে চান তা হলে আমি তাঁকে ওই কলেজে নিয়ে যেতে পারি, যেখানে তাঁর ৪৫ জন নারী শিক্ষক ঢাকা থেকে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস নেন না, বেতনটা নেন। ঢাকার রাস্তা আর বাড়িঘর, ফ্ল্যাট প্রভৃতি এমনিতেই গাড়ি আর মানুষে ভরে যায়নি। বলতে ইচ্ছা হয়: কর্মস্থান হোক যথাতথা বসবাস হোক ঢাকায়।
জমিদারদের কথা বাদ দিয়ে এখন একালের ভূমিদারদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। যদিও সেটা অর্থশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়। ওসব পর্যন্ত আমার বিদ্যার দৌড় নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়া বেশির ভাগ দেশে বেশি দিন গণতন্ত্র কার্যকর ছিল না। বেসামরিক শাসকরা প্রথমে স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন। মানুষ জাতীয়তাবাদী নেতাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতে থাকে। অগণতান্ত্রিক শক্তি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। কয়েক বছরের মধ্যেই বহু দেশে সামরিক শাসন আসে। সেসব দেশের মধ্যে পাকিস্তান একটি। আমরাও একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। কাজেই সামরিক শাসন আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি।
পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও সামরিকতন্ত্রের সূচনা মার্কিন সহযোগিতায়। পাকিস্তানে দুইবার এবং বাংলাদেশে দুইবার সামরিক শাসকদের জামিনদার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। মধ্যরাতে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকদের বাধাবিঘ্ন দূর করে তাঁদের ক্ষমতা সংহত করার প্রতিশ্রুতি ছিল আমেরিকার পুঁজিবাদীদের। তাতে বাংলাদেশে অতি দ্রুত একটি ভুয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হয়। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় থেকে দেশে একটি বড় মুত্সুদ্দি-দালালশ্রেণী গড়ে ওঠে। দেশে শিল্পপুঁজি নয়, বণিকপুঁজি তৈরি হয়। ওই শ্রেণীটি দেশে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার চেয়ে নানা রকম আন্তর্জাতিক চোরাচালান, মাদক ব্যবসা সোনাদানা পাচার, গরিব মানুষ ও রাষ্ট্রের ভূসম্পত্তি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে প্রায় রাতারাতি অকল্পনীয় ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ এখন সত্যি সত্যি সোনার বাংলা, কারণ এখানে সোনার চেয়েও ভূমির মূল্য বেশি। ভূমিকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালের পর এক বিত্তশালী চক্র গড়ে উঠেছে। ওই চক্রের মধ্যে সব দলের ও সব রকম রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষই আছে। এদের ধন ১০০ ভাগ পাপাশ্রিত, এদের সম্পদ, দার্শনিক প্রুদোর ভাষায়, ১০০ ভাগ চুরির মাল বা চৌর্যবৃত্তির ফসল।
নানা রকম দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থাত্ সরকারি মদদে দ্রুত সম্পদশালী হয়েছে অনেকে। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, সাধারণ দুর্বল মানুষের জায়গাজমি লুণ্ঠিত হয়েছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। আগের দিনের জমিদারদের জমিদারি সরকারের কাছ থেকে কিনতে হতো, এ কালের ভূমিদারদের মাস্তানদের আনুকূল্যে প্রায় বিনামূল্যে জমি জোগাড় হয়ে যায় এবং তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অর্জিত হয় বিপুল অর্থ।
সনাতন সামন্ত যুগেও সামন্তপ্রভুদের হাতে ধন পুঞ্জীভূত হতো পাপের পথে, কিন্তু আধুনিক সামন্তবাদী-গণতন্ত্রের যুগে ধনসম্পদ নবযুগের নবাব ও ভূমিদারদের হাতে সঞ্চিত হচ্ছে পাপের পথেও, চুরির মাধ্যমেও। চুপিচুপি চুরিও নয়, প্রকাশ্য লুণ্ঠন। জলাশয় ও জনপদ উজাড় হচ্ছে রাতারাতি। নবযুগের নবাবদের ও গণতন্ত্রের ভূমিদারদের দর্প বীরের মতো। তারা
দুনিয়াকে বা ধরাকে মনে করেন সরা বা মাটির হাঁড়ির ঢাকনা। অর্থাত্ যা খুশি তা-ই করে টিকে যাওয়া সম্ভব।
এই উপমহাদেশে জাতীয় বুর্জোয়ারা অর্থাত্ অপর্যাপ্ত ধনসম্পদশালীরা পরাধীন যুগে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা শুধু নয়, জাতীয়তাবাদী-আন্দোলন-সংগ্রামেও ভূমিকা রেখেছেন। জামশেদজি টাটা ছোট থেকে বড়, বড় থেকে বড়তর হয়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদী ধারায় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রেখে। জামশেদজির দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার পেছনে খরচের একটি তালিকা আমি কোথাও দেখেছিলাম। সেকালের অঙ্কটা বলে লাভ নেই, হিসাব করে দেখেছি, এখনকার টাকায় তা ৫০ টাকার মতো। একালের অতি অল্প সময়ে হয়ে ওঠা ধনকুবেরের এক দিনের খাওয়া খরচের টাকায় টাটাজির দিব্যি মাস দুয়েক চলে যেতে পারত। বলিষ্ঠ মানবিক মূল্যবোধ ছিল তাঁদের। বিত্তের আস্ফাালন ছিল না। ব্যবসার বাইরে জনকল্যাণমূলক কাজকে প্রাধান্য দিতেন।
ভারতে জামশেদজি একা ছিলেন না। বিড়লা, গোয়েঙ্কা, ডালমিয়াদের সবারই একটি বুর্জোয়া মূল্যবোধ ছিল এবং আজও আছে। বুর্জোয়াসুলভ আভিজাত্য তাঁরা রক্ষা করেছেন খুব যত্নের সঙ্গে। পাকিস্তানে আদমজি, ইস্পাহানি, বাওয়ানি ও তাঁদের শ্রেণীর শিল্পপতিদের ন্যূনতম আভিজাত্যবোধ ও মূল্যবোধ ছিল। তাঁদের সামাজিক আচার-আচরণ একটি স্তরের নিচে কস্মিনকালেও নামতে দিতেন না। কোনোক্রমেই নিজেদের মর্যাদা তাঁরা ক্ষুণ্ন হতে দিতেন না। পুঁজিবাদী উত্পাদনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেই তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতেন। অন্য কোনো ব্যাপারে তাঁরা মাথা ঘামাতেন না বা মাতব্বরি করা পছন্দ করতেন না। সত্যিকারের শিল্পপতি ও বুর্জোয়াদের সেটাই চরিত্র। নোংরা হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়। জাতীয় বুর্জোয়াদের ধনসম্পদও যে পাপাশ্রিত নয়—তা বলব না, কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম পাপ তাঁদের স্পর্শ করে। ভূমিদারদের পাপ পরিমাপযোগ্য নয়।
জাতীয় বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণী ও মুত্সুদ্দি পুঁজির লুম্পেন শ্রেণীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বর্তমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি আর লুম্পেন শ্রেণী এক অনঢ় মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে।
অসুস্থ দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সুযোগে কেউ কেউ যেকোনো উপায়ে সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে, মধ্যবিত্তকে রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠতে উত্সাহিত করছে। বাস্তবিক পক্ষেই তারা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার পথ তৈরি করছে। আগের দিনের সামন্ত যুগের জমিদারদের সঙ্গেও শাসকদের একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, বর্তমান বাংলাদেশি গণতন্ত্রে ভূমিদারদের সঙ্গে যদি রাজনীতিক ও শাসকশ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি রাজনীতিবিদদেরই। ওই অঢেল সম্পদশালী ও ভূমিদারদের তাতে বিশেষ ক্ষতি হবে না। যেকোনো বড় সংকটে দেশ থেকে তারা পালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু বিপদে ফেলে যাবে রাজনীতিকদের। যেমনটি ঘটেছিল ২৮ পৌষের (১১ জানুয়ারি ২০০৭) পরে। পাপাশ্রিত ধনসম্পদের মালিকদের কম পৃষ্ঠপোষকতা তারেক রহমান দেননি। সবচেয়ে বড় আঘাতটা লাগল তারেক রহমানেরই, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্যদের নয়। সুতরাং গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতির স্বার্থে মুত্সুদ্দি পুঁজিপতিদের সঙ্গে সত্ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের বন্ধুত্ব নয়, দূরত্ব রক্ষা করাই সুবুদ্ধির কাজ। সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনীতিকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অত দূরের প্রাচ্যের মনীষীর কথা যদি অগ্রাহ্যও করি, ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী ফরাসি দার্শনিক মঁশিয়ে প্রুদোর কথা ফেলে দিই কীভাবে? তিনি বলেছেন, প্রপার্টি ইজ থেফ্ট—বিত্তবৈভব ও ভূসম্পত্তি হলো চুরির ফসল। যাদের কম আছে তাদের থেকে অপহরণ না করে, অবৈধ উপায়ে ছিনিয়ে না নিয়ে, অন্যকে শোষণ না করে কারও পক্ষে বিত্তবান হওয়া সম্ভব নয়। সেটা ১৭৯৩ সালে মহামাননীয় কর্নওয়ালিশের সময় যেমন সত্য ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশেও সমান সত্য। ১৯৫০ সালে জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণার আগে এ দেশে ছিল পুরোপুরি অর্থাত্ নির্ভেজাল সামন্ততন্ত্র। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা আছি গণতন্ত্রের নামে এমন এক ছদ্মবেশী সামন্ততান্ত্রিক অবস্থায়, যার পাপগুলোকে চট করে ওপর থেকে দেখে বোঝা যায় না।
আজ সম্পদে সয়লাব বাংলাদেশ—সাত কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা সত্ত্বেও। সনাতন সামন্তবাদী সমাজে আমরা দেখেছি গরুর হাট বসতে। বিশ্বায়ন-পরবর্তী নবসামন্তবাদী সমাজে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে বসছে গাড়ির হাট। ১৯৬৯ সালে ঢাকার দোকানে খেলনা গাড়ি যত বিক্রি হয়েছে, ২০০৯ সালে প্রতিদিন তার দশ গুণ বেশি বিক্রি হয় বিলাসবহুল মোটরগাড়ি। যারা সবেমাত্র ধন আহরণের পথে নেমেছে, তারা শোরুমের নতুন গাড়িতে হাত দিতে পারছে না; সিএনজি নিয়ে শুক্রবারে ছুটছে শেরেবাংলা নগরে গাড়ির হাটে। বউ এবং বাপের বাড়ির লোকেরা বায়না ধরেছে—গাড়ি চাই। সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড ছাড়া গত্যন্তর নেই। সুতরাং কোরবানির ঈদের আগে গরু ও ডিপ ফ্রিজ কেনার আগেই একটা গাড়ি চাই। ঠিকাদারের বিলটা আটকে দিতে পারলে লাখখানেক পাওয়া যাবে। নতুন দলীয় পরিচয় নিয়ে যে বড় কর্তা এসেছেন, তাঁর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। প্রথম দিন শ্রমিক-কর্মচারীরা এই স্লোগানসহ তাঁকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। সুতরাং গাড়ির হাটের ক্রেতা হওয়ায় আর অসুবিধা নেই।
সেদিন এক ক্ষুদ্র সরকারি কর্মকর্তা পৌনে ১১টার সময় অফিসে ঢুকে বাঁ-হাত কানে লাগিয়ে মোবাইল ফোনে খুব জোরে জোরে কথা বলছিলেন এবং ডানহাতে রুমালে কপাল ও গলার ঘাম মুছছিলেন। বয়স্ক পিয়ন লোকটি বলছিলেন, উনি গাড়ি কেনার আগে পৌনে এক ঘণ্টা লেট করতেন, গাড়ি কেনার পর থেকে দেড় ঘণ্টা লেট করছেন। দোষ তাঁকে মোটেই দেওয়া যাবে না। তাঁর গাড়ি যদি রাস্তায় যানজটে আটকে থাকে তাঁর কী করার আছে? তিনি গাড়ির মালিক। এরপর থেকে গাড়ি তাঁকে অফিসে নিয়ে আসলে আসবেন, না আসলে আসবেন না। বেতনের চেক পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
২০০৯ সালে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে কয়টি করে আমদানি করা নতুন গাড়ি খালাস হয়, সে হিসাব থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু ঢাকায় শোরুম থেকে কত গাড়ি বিক্রি হয় তার হিসাব সম্ভবত কোথাও নেই। তা ছাড়া প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় কত গাড়ি চলাচল করে তার হিসাব বিআরটিএ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে বিপুল বিত্তের বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটছে—গাড়ি তার মধ্যে একটি উপাদান মাত্র।
১৯০৯ সালে ঢাকার রাস্তায় কী পরিমাণ প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করত? কেউ বলতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি অনেক তথ্যবিশারদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরাও পারেননি। তারপর অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম: কুড়ি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ঢাকায় প্রাইভেট মোটরগাড়ি ছিল দুটি। একটি ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর, দ্বিতীয়টি সৈয়দ আওলাদ হোসেনের। তিন মাইল লম্বা এক মাইল প্রস্থ শহরে সুপরিসর রাস্তা ছিল মাত্র দুটি: ইসলামপুর ও নবাবপুর রোড। নবাব বাহাদুর বা সৈয়দ সাহেব যেদিন বাড়ি থেকে বের হতেন দুই পাশের বাড়িঘর ও রাস্তার লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত গাড়ির দিকে—বাপরে, টম্টমের তিন গুণ বেশি দ্রুত গতিতে ছুটে চলে!
আজ কোনো ওভারব্রিজ বা কোনো উঁচু জায়গা থেকে অনেকে তাকিয়ে দেখে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির স্রোত। লাল পিঁপড়া বা শুঁয়োপোকার মতো তিড়তিড় করে এগোচ্ছে গাড়ির অন্তহীন লাইন। গাড়ি বাংলাদেশে তৈরি হয় না। অন্য দেশ থেকে ডলার দিয়ে কিনে আনতে হয়। গাড়ি চালানোর জন্য যে জ্বালানি সেই ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনও বিদেশ থেকে আনতে হয়। গাড়ির সিটকভার থেকে ভেতরে যেসব শোপিস শোভা পায়, তাও বাংলাদেশে তৈরি নয়—খাঁটি বিদেশি।
ঢাকা শহরের প্রথম দুই গাড়িঅলাই ছিলেন জমিদার অর্থাত্ জমিদারি ছিল তাঁদের আয়ের একমাত্র উত্স। প্রজাদের কাছ থেকে পেতেন খাজনা। সেটা সম্ভবত শোষণ বা পাপের পথেই আহরিত হতো। কিন্তু জমির মালিকানা ছিল প্রজার। প্রজার জমি তাঁরা কখনোই জবরদখল করতেন না। আভিজাত্য প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হতো গাড়ির। তাই প্রয়োজন না হলেও গাড়িতে তাঁদের চড়তে হতো, কারণ তাঁরা নবাব বা জমিদার। তবে স্বীকার করতেই হবে, ব্যক্তিজীবনে মানুষ হিসেবে নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ আওলাদ হোসেন ছিলেন সত্যিকারের শরিফ, ন্যায়পরায়ণ ও জনদরদি।
আজ সাবেকী সামন্ত্রতন্ত্র নেই, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্র সেকালের সামন্ত্রতন্ত্রের বাপ। আজ প্রত্যেকেই জমিদার হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আজ গণতন্ত্র আর গাড়িতে দেশ একাকার। উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী অফিসার ও অন্যান্য কর্মকর্তার জন্য আমদানি হচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ি। কর্মস্থান যেখানেই হোক, তাঁরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরকারি গাড়িতে ঘুরে বেড়াবেন ঢাকা শহরেই নবাব সলিমুল্লাহর মতো। কারণ আজ সবাই নবাব। একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, ঢাকার রাস্তার জিপ-জাতীয় গাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ ঢাকার বাইরের সরকারি কর্মকর্তাদের। ঢাকার এক শ কিলোমিটারের মধ্যে একটি বড় সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে বলেছেন, তাঁর কলেজের ৪৫ জন মহিলা শিক্ষকের সবাই ঢাকায় থাকেন, তাঁদের স্বামী-সন্তানরা ঢাকায়, তাঁদের অধিকাংশের গাড়ি আছে, কিন্তু তাঁরা সপ্তাহে একদিনের বেশি কলেজে আসেন না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাদের বন্ধু, সম্ভবত এখনো তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। কিন্তু তাঁর কলেজগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকের গাড়ি আছে। যদি তিনি যেতে চান তা হলে আমি তাঁকে ওই কলেজে নিয়ে যেতে পারি, যেখানে তাঁর ৪৫ জন নারী শিক্ষক ঢাকা থেকে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস নেন না, বেতনটা নেন। ঢাকার রাস্তা আর বাড়িঘর, ফ্ল্যাট প্রভৃতি এমনিতেই গাড়ি আর মানুষে ভরে যায়নি। বলতে ইচ্ছা হয়: কর্মস্থান হোক যথাতথা বসবাস হোক ঢাকায়।
জমিদারদের কথা বাদ দিয়ে এখন একালের ভূমিদারদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। যদিও সেটা অর্থশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়। ওসব পর্যন্ত আমার বিদ্যার দৌড় নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়া বেশির ভাগ দেশে বেশি দিন গণতন্ত্র কার্যকর ছিল না। বেসামরিক শাসকরা প্রথমে স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন। মানুষ জাতীয়তাবাদী নেতাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতে থাকে। অগণতান্ত্রিক শক্তি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। কয়েক বছরের মধ্যেই বহু দেশে সামরিক শাসন আসে। সেসব দেশের মধ্যে পাকিস্তান একটি। আমরাও একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। কাজেই সামরিক শাসন আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি।
পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও সামরিকতন্ত্রের সূচনা মার্কিন সহযোগিতায়। পাকিস্তানে দুইবার এবং বাংলাদেশে দুইবার সামরিক শাসকদের জামিনদার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। মধ্যরাতে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকদের বাধাবিঘ্ন দূর করে তাঁদের ক্ষমতা সংহত করার প্রতিশ্রুতি ছিল আমেরিকার পুঁজিবাদীদের। তাতে বাংলাদেশে অতি দ্রুত একটি ভুয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হয়। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় থেকে দেশে একটি বড় মুত্সুদ্দি-দালালশ্রেণী গড়ে ওঠে। দেশে শিল্পপুঁজি নয়, বণিকপুঁজি তৈরি হয়। ওই শ্রেণীটি দেশে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার চেয়ে নানা রকম আন্তর্জাতিক চোরাচালান, মাদক ব্যবসা সোনাদানা পাচার, গরিব মানুষ ও রাষ্ট্রের ভূসম্পত্তি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে প্রায় রাতারাতি অকল্পনীয় ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ এখন সত্যি সত্যি সোনার বাংলা, কারণ এখানে সোনার চেয়েও ভূমির মূল্য বেশি। ভূমিকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালের পর এক বিত্তশালী চক্র গড়ে উঠেছে। ওই চক্রের মধ্যে সব দলের ও সব রকম রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষই আছে। এদের ধন ১০০ ভাগ পাপাশ্রিত, এদের সম্পদ, দার্শনিক প্রুদোর ভাষায়, ১০০ ভাগ চুরির মাল বা চৌর্যবৃত্তির ফসল।
নানা রকম দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থাত্ সরকারি মদদে দ্রুত সম্পদশালী হয়েছে অনেকে। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, সাধারণ দুর্বল মানুষের জায়গাজমি লুণ্ঠিত হয়েছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। আগের দিনের জমিদারদের জমিদারি সরকারের কাছ থেকে কিনতে হতো, এ কালের ভূমিদারদের মাস্তানদের আনুকূল্যে প্রায় বিনামূল্যে জমি জোগাড় হয়ে যায় এবং তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অর্জিত হয় বিপুল অর্থ।
সনাতন সামন্ত যুগেও সামন্তপ্রভুদের হাতে ধন পুঞ্জীভূত হতো পাপের পথে, কিন্তু আধুনিক সামন্তবাদী-গণতন্ত্রের যুগে ধনসম্পদ নবযুগের নবাব ও ভূমিদারদের হাতে সঞ্চিত হচ্ছে পাপের পথেও, চুরির মাধ্যমেও। চুপিচুপি চুরিও নয়, প্রকাশ্য লুণ্ঠন। জলাশয় ও জনপদ উজাড় হচ্ছে রাতারাতি। নবযুগের নবাবদের ও গণতন্ত্রের ভূমিদারদের দর্প বীরের মতো। তারা
দুনিয়াকে বা ধরাকে মনে করেন সরা বা মাটির হাঁড়ির ঢাকনা। অর্থাত্ যা খুশি তা-ই করে টিকে যাওয়া সম্ভব।
এই উপমহাদেশে জাতীয় বুর্জোয়ারা অর্থাত্ অপর্যাপ্ত ধনসম্পদশালীরা পরাধীন যুগে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা শুধু নয়, জাতীয়তাবাদী-আন্দোলন-সংগ্রামেও ভূমিকা রেখেছেন। জামশেদজি টাটা ছোট থেকে বড়, বড় থেকে বড়তর হয়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদী ধারায় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রেখে। জামশেদজির দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার পেছনে খরচের একটি তালিকা আমি কোথাও দেখেছিলাম। সেকালের অঙ্কটা বলে লাভ নেই, হিসাব করে দেখেছি, এখনকার টাকায় তা ৫০ টাকার মতো। একালের অতি অল্প সময়ে হয়ে ওঠা ধনকুবেরের এক দিনের খাওয়া খরচের টাকায় টাটাজির দিব্যি মাস দুয়েক চলে যেতে পারত। বলিষ্ঠ মানবিক মূল্যবোধ ছিল তাঁদের। বিত্তের আস্ফাালন ছিল না। ব্যবসার বাইরে জনকল্যাণমূলক কাজকে প্রাধান্য দিতেন।
ভারতে জামশেদজি একা ছিলেন না। বিড়লা, গোয়েঙ্কা, ডালমিয়াদের সবারই একটি বুর্জোয়া মূল্যবোধ ছিল এবং আজও আছে। বুর্জোয়াসুলভ আভিজাত্য তাঁরা রক্ষা করেছেন খুব যত্নের সঙ্গে। পাকিস্তানে আদমজি, ইস্পাহানি, বাওয়ানি ও তাঁদের শ্রেণীর শিল্পপতিদের ন্যূনতম আভিজাত্যবোধ ও মূল্যবোধ ছিল। তাঁদের সামাজিক আচার-আচরণ একটি স্তরের নিচে কস্মিনকালেও নামতে দিতেন না। কোনোক্রমেই নিজেদের মর্যাদা তাঁরা ক্ষুণ্ন হতে দিতেন না। পুঁজিবাদী উত্পাদনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেই তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতেন। অন্য কোনো ব্যাপারে তাঁরা মাথা ঘামাতেন না বা মাতব্বরি করা পছন্দ করতেন না। সত্যিকারের শিল্পপতি ও বুর্জোয়াদের সেটাই চরিত্র। নোংরা হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়। জাতীয় বুর্জোয়াদের ধনসম্পদও যে পাপাশ্রিত নয়—তা বলব না, কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম পাপ তাঁদের স্পর্শ করে। ভূমিদারদের পাপ পরিমাপযোগ্য নয়।
জাতীয় বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণী ও মুত্সুদ্দি পুঁজির লুম্পেন শ্রেণীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বর্তমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি আর লুম্পেন শ্রেণী এক অনঢ় মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে।
অসুস্থ দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সুযোগে কেউ কেউ যেকোনো উপায়ে সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে, মধ্যবিত্তকে রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠতে উত্সাহিত করছে। বাস্তবিক পক্ষেই তারা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার পথ তৈরি করছে। আগের দিনের সামন্ত যুগের জমিদারদের সঙ্গেও শাসকদের একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, বর্তমান বাংলাদেশি গণতন্ত্রে ভূমিদারদের সঙ্গে যদি রাজনীতিক ও শাসকশ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি রাজনীতিবিদদেরই। ওই অঢেল সম্পদশালী ও ভূমিদারদের তাতে বিশেষ ক্ষতি হবে না। যেকোনো বড় সংকটে দেশ থেকে তারা পালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু বিপদে ফেলে যাবে রাজনীতিকদের। যেমনটি ঘটেছিল ২৮ পৌষের (১১ জানুয়ারি ২০০৭) পরে। পাপাশ্রিত ধনসম্পদের মালিকদের কম পৃষ্ঠপোষকতা তারেক রহমান দেননি। সবচেয়ে বড় আঘাতটা লাগল তারেক রহমানেরই, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্যদের নয়। সুতরাং গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতির স্বার্থে মুত্সুদ্দি পুঁজিপতিদের সঙ্গে সত্ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের বন্ধুত্ব নয়, দূরত্ব রক্ষা করাই সুবুদ্ধির কাজ। সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনীতিকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments