‘মেগা বাঁধ’ ঘিরে চীন-দিল্লি উত্তেজনা by রিতু শর্মা
মেগা ড্যামটি সাংপোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চীন যে সিরিজ বাঁধ তৈরি করেছে এটি তার সম্প্রসারিত অংশ। চীনের ‘মাদার অব অল ড্যামস’-এর কারণে নদী প্রবাহ বাধা পেতে পারে এবং বর্ষাকালে কৃত্রিম বন্যা দেখা দিতে পারে। গোটা পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন ভারত, এজন্য অরুণাচলের সিয়াং জেলার সিয়াং নদীতে ১১ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে। বাঁধের নকশায় বর্ষাকালে ৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি পানির একটি ‘বাফার স্টোরেজ’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি একটি রিজার্ভ হিসেবে কাজ করবে, যখন পানির প্রবাহ হ্রাস পাবে বা চীন হঠাৎ পানি ছেড়ে দিলে অরুণাচল ও আসামের নিম্নধারার অঞ্চলগুলোর জন্য বাফার হিসেবে কাজ করবে। প্রস্তাবিত বাঁধের লক্ষ্য হলো একটি নদী প্রধান রাজ্য হিসাবে ভারতের পানিবন্টন অধিকারকে শক্তিশালী করা।
ভারতের আশঙ্কা অমূলক নয়। ২০২১ সালে চীন পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই তিন সপ্তাহের জন্য মেকং নদীর পানি প্রবাহ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ লাইন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নদী প্রবাহকে দৃশ্যতভাবে হ্রাস করা হয়েছিল। এটি কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নদীর পাশে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। ২০১৯ সালে মেকং নদীর উপরিভাগে অবস্থিত চীনের বাঁধগুলো রেকর্ড পরিমাণ পানি ধরে রেখেছে, এমনকি আর্দ্র মৌসুমে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হলেও এই বাঁধ পানি ধরে রেখে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। ফলস্বরূপ, নিম্নধারার দেশগুলো আর্দ্র মৌসুমে খরার সম্মুখীন হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম সবচেয়ে গুরুতর এবং দীর্ঘায়িত খরার সম্মুখীন হয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কৃষকরা ফসল হারিয়েছে, মাছের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং জলাশয়ের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখন ইয়ারলুং সাংপো বিশ্বের বৃহত্তম ট্রান্সন্যাশনাল নদী ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে এর উৎস। হিমালয় হয়ে দক্ষিণ তিব্বতজুড়ে ২৯০০ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে এই নদী প্রবাহিত হয়। এটি আসাম ও অরুণাচল প্রদেশের (যা চীন দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করে) মধ্য দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে, সেখানে এটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত।
সিয়াং ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদী। ২০১৭ সালে সিয়াং-এর পানি কালো হয়ে গিয়েছিল এবং পানীয়ের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করে মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষতি করেছিল। এর জন্য ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে চীনকে দায়ী করেছেন। তা সত্ত্বেও চীন এই অভিযোগগুলো অতিরঞ্জিত বলে উড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে চীন নিচের দিকে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। রিপাবলিক অব কোরিয়ার দক্ষিণ পার্লি পলিসি ইনিশিয়েটিভের উপদেষ্টা নীরজ সিং মানহাস ইউরো এশিয়ান টাইমসকে বলেছেন, চীন ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পানিকে ব্যবহার করতে পারে। সম্ভাব্যভাবে সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন বা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানির স্তরকে হেরফের করে ভারত ও বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে চীন।
নীরজ সিং মানহাসের মতে, প্রধান নদীগুলোর পানি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে নিম্নধারার দেশগুলোর সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে চীন নিজের ভূমিকা খাটাতে পারে। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান মোতাবেক এর বেশিরভাগ পানি চীন থেকে প্রবাহিত নদী থেকে উদ্ভূত, যার জেরে ভারত অসুবিধার সম্মুখীন। ভারত তার কৃষি ও পানি সুরক্ষার জন্য উজানের প্রবাহের উপর নির্ভরশীল, আর তাই চীনের কাছ থেকে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভারত। মানহাস সিয়াং-এ বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারতের সাম্প্রতিক প্রস্তাবকে কৌশল হিসেবে দেখেন মানহাস। তিনি মনে করেন, পানির অধিকার নিশ্চিত করতে এবং চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন আপার সিয়াং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করবে ভারত।
কেন্দ্রীয় সরকারের থিঙ্ক ট্যাংক নীতি আয়োগ দ্বারা ২০১৭ সালে বাঁধ নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিলো-এটি ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসহ দেশের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে। এনএইচপিসি সিয়াং নদীর তীরে তিনটি স্থান নির্বাচন করেছে। উগেং, ডিত্তে ডিমে ও পারং-এই এলাকায় বাঁধটি সম্ভব কিনা তা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বাঁধের সম্ভাব্য ব্যয় এবং এই এলাকায় এটি নির্মাণ করা যাবে কিনা তা মূল্যায়ন করা হয়েছে। সমীক্ষার সময় শিলা পৃষ্ঠের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য ২০০ মিটার গভীর গর্ত খনন করা হয়েছে। তবে বাঁধটি স্থানীয় জনগণের যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে।
হিমালয়ে পানি যুদ্ধ
ইয়ারলুং সাংপো তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আসামে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে প্রবাহিত এবং তারপর বাংলাদেশের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মেশে। এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ নদী, যা গড়ে ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় বয়ে চলেছে। গত কয়েক বছর ধরে চীন জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে গ্রেট বেন্ড নামে পরিচিত নদীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রস্তাবিত মেগা বাঁধটি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাঁধের স্থানটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের বিতর্কিত সীমান্তের কাছে হিমালয়ের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে নদীটি ইউটার্ন নেয়। এখানে ভারতের দিকে গতিপথ পরিবর্তন করার আগে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে নদীর উচ্চতা ২৭০০মিটার নেমে গেছে। চীন দাবি করছে, ২০৩০ সালের আগে কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্য করার লক্ষ্য নিয়ে তিব্বতের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও পানির ঘাটতি পরিচালনা করার জন্য এই প্রকল্পটি তৈরি করা হচ্ছে।
কিন্তু বাঁধ নির্মাণও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ২০১৬ সালে ভারত-চীন সীমান্তের কাছে তিব্বতে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র উপনদী জিয়াবুকু নদীর প্রবাহে বাধা দেয় চীন। লালহো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে নদীর গতিপথ বাধা পায়। এটি এমন এক সময়ে ঘটেছিলো, যখন ভারত উরি হামলার পর পাকিস্তানের সাথে সিন্ধু পানিবন্টন চুক্তির পর্যালোচনার কথা ভাবছিল।
একটি গবেষণাপত্রে মানহাস ও ড. রাহুল এম. লাড দাবি করেছেন, এই প্রবণতাটি আন্তঃসীমান্ত পানি সম্পদের সম্ভাব্য ‘অস্ত্রীকরণ’কে নির্দেশ করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যেখানে বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে, সেখানেও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ভারতের সঙ্গে ডোকলাম অচলাবস্থার পর পূর্বের চুক্তি সত্ত্বেও চীন হঠাৎ ব্রহ্মপুত্র নদের জন্য জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য শেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছে। বিপরীতে চীনের কাছ থেকে নিরবচ্ছিন্ন তথ্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। চীনের এই আচরণ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পানি সম্পদকে ব্যবহারের অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করে।
লেখক: রিতু শর্মা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ে লিখেছেন। তিনি জার্মানির এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কনফ্লিক্ট স্টাডিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব পিস-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সূত্র: ইউরেশিয়ান টাইমস
No comments