সাত ফাঁসির আসামির ‘আত্মসমর্পণ’- নেপথ্যে বাণিজ্য by হারুন আল রশীদ
পাবনায় গত এপ্রিলে চরমপন্থীদের জমা দেওয়া অস্ত্র |
স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী গত এপ্রিলে জয়পুরহাট জেলার ৮০ জন ‘চরমপন্থী’
আত্মসমর্পণ করেছেন। তালিকাভুক্ত সাতজন ফাঁসির আসামি, যাঁরা কারাবন্দী অথবা
পলাতক। আছেন সন্ত্রাসী আর মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের নেতা আবার জেলা
স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাও।
স্থানীয় পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, আদতে এঁদের কেউ চরমপন্থী নন। তালিকাভুক্ত কয়েকজন বলেছেন, চরমপন্থী সেজে আত্মসমর্পণ করলে ঝুটঝামেলা থাকবে না, টাকা পাওয়া যাবে—এই লোভ তাঁদের দেখিয়েছিলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের দুই নেতা। প্রথমজনই চরমপন্থী নেতা পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই নেতারা ‘আর্থিক প্রণোদনা’র বখরা নিতে তাঁদের চরমপন্থী সাজিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তালিকাটি ধরে প্রথম আলো সরেজমিন অনুসন্ধান করেছে। এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন জয়পুরহাটের বিভিন্ন স্তরের পুলিশ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে।
যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, তালিকার অন্তত ২২ জন ছাত্রদল, যুবদল বা বিএনপির নেতা-কর্মী। বাদবাকি প্রায় সবাই যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগ করেন, যাঁদের বেশ কয়েকজন অতীতে বিএনপি-জামায়াতের ঘরে ছিলেন।
আত্মসমর্পণের ইতিবৃত্ত
চরমপন্থী আন্দোলনে দীর্ঘকাল যুক্ত একজন রাজনৈতিক নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল লাল পতাকা) এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য চরমপন্থার সূচনা করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তরে নওগাঁ পর্যন্ত তাদের তৎপরতা ছিল। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের কাছে তাদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পণ করেছিল।
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল ১৬ জেলার ৫৯৫ জন চরমপন্থী পাবনার শহীদ আমিন উদ্দীন স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁদের মধ্যেই জয়পুরহাটের ৮০ জনের নাম ছিল। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে সরকার প্রত্যেক আত্মসমর্পণকারীকে ১ লাখ এবং দলনেতাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় কারাবন্দীদের সম্পর্কে কিছু বলা নেই। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে তাঁকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার কথা। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, আত্মসমর্পণের পর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা কারাবন্দী ছিলেন, তাঁদের আত্মসমর্পণস্থলে হাজির করা হয়নি।
আত্মসমর্পণ পরিকল্পনার কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছিল এপ্রিলের গোড়ায়। মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
জেলা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেন, আইনগতভাবে চরমপন্থীদের তালিকা তৈরি পুলিশের কাজ। কিন্তু তাঁরা শুধু কাগজপত্রে সই করেছেন। পুলিশ সুপার (এসপি) রশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জানামতে, জয়পুরহাটে কোনো চরমপন্থী বা চরমপন্থীদের সংগঠন নেই। তা সত্ত্বেও আমরা ৭১ জনের একটি তালিকা পেয়েছি। সেটাই পাবনায় পাঠানো হয়েছে।’
তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পাবনায় গোয়েন্দা সংস্থাটি ৮০ জনের তালিকা জমা দেয়। তখনই ফাঁসির আসামিসহ কয়েকজনের নাম ঢোকানো হয়।
জয়পুরহাটের তালিকায় সমস্যার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন। তবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চরমপন্থীদের এই তালিকা পুলিশ করেনি। এটি করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেই তালিকা অনুযায়ী চরমপন্থীরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।’
মন্ত্রী বলেন, এ আত্মসমর্পণের নীতি বা প্রক্রিয়ার কিছুই তাঁর জানা নেই। তবে কারও নামে মামলা থাকলে অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। এপ্রিলের গোড়ায় পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের পর মামলা-মোকদ্দমা খতিয়ে দেখে পুনর্বাসন করানো হবে।
ফাঁসির দণ্ড, খুনের আসামি
জয়পুরহাট পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রথম তালিকায় সাত ফাঁসির আসামির নাম ছিল না। তাঁরা হচ্ছেন সদর উপজেলার বম্বু ইউনিয়নের ওয়াজেদ আলী, আবু হাসান (ওয়াজেদের ছেলে), মহির উদ্দিন, চৈতন্য, সাফাদুল ইসলাম, আনিছুর রহমান ও মন্টু মিয়া।
যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সদর থানা বলেছে, উচ্চ আদালতে তাঁদের আপিল মামলা চলছে। মন্টু মিয়া আগাগোড়া পলাতক, বাকিরা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। তাঁরা সবাই ইউনিয়ন বিএনপির নেতা ছিলেন।
আসামি ওয়াজেদ আলীর ছেলে জুয়েল রানা বলেন, ‘বাবা কখনো চরমপন্থী ছিলেন কি না, তা জানি না। এলাকার বড় ভাই মাহবুব আলম পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করেছেন।’
একই হত্যা মামলায় মাহবুব আলম যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন। তিনি এখন জামিনে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নামে অনেক মামলা আছে। সরকারি দলের লোকজন বলেছেন, চরমপন্থী সেজে আত্মসমর্পণ করলে মামলা থেকে খালাস পাওয়া যাবে। সে জন্য আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।’
আত্মসমর্পণকারীরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত।
এ জেলায় কখনো চরমপন্থী ছিল না।
তালিকায় অন্তত নয়জন হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি আছেন। তাঁদের মধ্যে আসলাম হোসেন এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে সুপরিচিত। রাজীব হোসেনের নামে হত্যাসহ ডজনখানেক মামলা আছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত সেবা কুমার দাসের নামে একটি হত্যাসহ ছয়টি মামলা আছে।
পুলিশের নথি বলছে, তালিকাভুক্ত অন্তত ছয়জন চরমপন্থী আদতে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল হোসেনের নামে ১৭টি মামলা আছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চরমপন্থী হোক বা না হোক, ফাঁসির আসামিসহ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত অথবা বাতিল করার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলে সেখানেই এর ফয়সালা হবে। সব শেষে থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ।
তালিকার নেপথ্যে
পাবনায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ১৬ জেলার ১৬ চরমপন্থী নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জয়পুরহাটে নেতৃত্ব দেন রমজান আলী, নেতা হিসেবে যিনি প্রণোদনার টাকা পান ১০ লাখ। কিন্তু এই রমজান আবার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও বহাল আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা রয়েছে।
এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, রমজান একসময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এস এম সোলায়মান আলীর মোটরসাইকেলচালক ছিলেন। তিনি শহরের মাস্টারপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সভাপতিও বটে।
জয়পুরহাট পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র নন্দলাল পার্শি আওয়ামী লীগ জেলা কমিটির সদস্য। আত্মসমর্পণকারী কয়েকজন বলেন, তিনিও লোকজন গোছানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাটির লোকজনেরও সম্পৃক্ততা ছিল।
নন্দলাল পার্শি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকায় চরমপন্থী নেই। কিন্তু রমজান তাঁকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারদলীয় লোকজনকে ছোটখাটো মামলা থেকে অব্যাহতি দেবে, আর্থিক সহায়তা দেবে। নন্দলাল তাই তালিকায় কিছু ছেলের নাম দিয়েছেন। রমজান আলী অবশ্য এ বিষয়ে ‘ভালো-মন্দ’ কোনো কথাই বলতে রাজি হননি।
রমজানের ভাই সেলিম বাবুর নামে একাধিক অস্ত্র মামলা আছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা থেকে রেহাই পেতে আরও তো অনেক ছেলে চরমপন্থী সেজেছে। সুতরাং তালিকায় আমার নাম থাকলে সমস্যা কী?’
রোমানুর রহমান জেলা যুবলীগের সদস্য। তাঁর নামে একটি হত্যা মামলা আছে। এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী রোমানুর বলেন, রমজান ও নন্দলাল পার্শির পরামর্শে তিনি তালিকায় নাম দেন। কিন্তু পাবনায় যাওয়ার পর জানতে পারেন তিনি ‘চরমপন্থী’। রোমান বলেন, পুরো তালিকাই ভুয়া।
তালিকাভুক্ত অন্তত দুই ব্যক্তির নামে থানায় কোনো মামলা নেই। তাঁদের একজন হচ্ছেন মুক্তা বিশ্বাস, যিনি নন্দলাল পার্শির ভাগনে। অন্যজন নুরুজ্জামান বাবু, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী।
ভাগনের ব্যাপারে নন্দলাল বলেন, মুক্তা রমজানের বন্ধু হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছেন। আর নুরুজ্জামান বাবু বলেন, ‘আমার নেতা রমজান তালিকায় নাম দিয়েছেন। বলেছেন এক লাখ টাকা পাওয়া যাবে। তাই রাজি হয়েছি।’
টাকার জন্য চরমপন্থী সেজেছেন? নুরুজ্জামান বলেন, ‘কী করব! কষ্টে আছি, টাকার যে খুব দরকার।’
কাদামাটির মানুষ
জেলা নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, সন্ত্রাসীদের ছাড় দেওয়ার এই অভিনব প্রক্রিয়া সভাপতি ও সাংসদ সামছুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান আলীর সমর্থনপুষ্ট। সাংসদ অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সোলায়মান আলীও বলেছেন, তিনি বিশেষ কিছু জানেন না।
জয়পুরহাটের কথিত চরমপন্থীরা আত্মসমর্পণ করেন কাদামাটি সংগঠনের নেতা-সদস্য হিসেবে। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এটি একটি নামসর্বস্ব রাতারাতি ভুঁইফোড় ভুয়া সংগঠন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম হাক্কানীও বলেন, ‘এই জেলায় এলেমাটি, বেলেমাটি, কাদামাটি, দোআঁশ মাটি—সবই আছে। কিন্তু কাদামাটি নামের কোনো চরমপন্থী সংগঠনের নাম কোনোকালে শুনিনি।’
ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জয়পুরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক কয়েক যুগ ধরে বাম রাজনীতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনিও একই কথা বলেন। আর বলেন, তাঁর জানামতে জয়পুরহাটে কখনো চরমপন্থীদের তৎপরতা ছিল না।
স্থানীয় পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, আদতে এঁদের কেউ চরমপন্থী নন। তালিকাভুক্ত কয়েকজন বলেছেন, চরমপন্থী সেজে আত্মসমর্পণ করলে ঝুটঝামেলা থাকবে না, টাকা পাওয়া যাবে—এই লোভ তাঁদের দেখিয়েছিলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের দুই নেতা। প্রথমজনই চরমপন্থী নেতা পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই নেতারা ‘আর্থিক প্রণোদনা’র বখরা নিতে তাঁদের চরমপন্থী সাজিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তালিকাটি ধরে প্রথম আলো সরেজমিন অনুসন্ধান করেছে। এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন জয়পুরহাটের বিভিন্ন স্তরের পুলিশ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে।
যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, তালিকার অন্তত ২২ জন ছাত্রদল, যুবদল বা বিএনপির নেতা-কর্মী। বাদবাকি প্রায় সবাই যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগ করেন, যাঁদের বেশ কয়েকজন অতীতে বিএনপি-জামায়াতের ঘরে ছিলেন।
আত্মসমর্পণের ইতিবৃত্ত
চরমপন্থী আন্দোলনে দীর্ঘকাল যুক্ত একজন রাজনৈতিক নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল লাল পতাকা) এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য চরমপন্থার সূচনা করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তরে নওগাঁ পর্যন্ত তাদের তৎপরতা ছিল। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের কাছে তাদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পণ করেছিল।
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল ১৬ জেলার ৫৯৫ জন চরমপন্থী পাবনার শহীদ আমিন উদ্দীন স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁদের মধ্যেই জয়পুরহাটের ৮০ জনের নাম ছিল। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে সরকার প্রত্যেক আত্মসমর্পণকারীকে ১ লাখ এবং দলনেতাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় কারাবন্দীদের সম্পর্কে কিছু বলা নেই। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে তাঁকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার কথা। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, আত্মসমর্পণের পর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা কারাবন্দী ছিলেন, তাঁদের আত্মসমর্পণস্থলে হাজির করা হয়নি।
আত্মসমর্পণ পরিকল্পনার কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছিল এপ্রিলের গোড়ায়। মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
জেলা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেন, আইনগতভাবে চরমপন্থীদের তালিকা তৈরি পুলিশের কাজ। কিন্তু তাঁরা শুধু কাগজপত্রে সই করেছেন। পুলিশ সুপার (এসপি) রশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জানামতে, জয়পুরহাটে কোনো চরমপন্থী বা চরমপন্থীদের সংগঠন নেই। তা সত্ত্বেও আমরা ৭১ জনের একটি তালিকা পেয়েছি। সেটাই পাবনায় পাঠানো হয়েছে।’
তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পাবনায় গোয়েন্দা সংস্থাটি ৮০ জনের তালিকা জমা দেয়। তখনই ফাঁসির আসামিসহ কয়েকজনের নাম ঢোকানো হয়।
জয়পুরহাটের তালিকায় সমস্যার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন। তবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চরমপন্থীদের এই তালিকা পুলিশ করেনি। এটি করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেই তালিকা অনুযায়ী চরমপন্থীরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।’
মন্ত্রী বলেন, এ আত্মসমর্পণের নীতি বা প্রক্রিয়ার কিছুই তাঁর জানা নেই। তবে কারও নামে মামলা থাকলে অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। এপ্রিলের গোড়ায় পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের পর মামলা-মোকদ্দমা খতিয়ে দেখে পুনর্বাসন করানো হবে।
ফাঁসির দণ্ড, খুনের আসামি
জয়পুরহাট পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রথম তালিকায় সাত ফাঁসির আসামির নাম ছিল না। তাঁরা হচ্ছেন সদর উপজেলার বম্বু ইউনিয়নের ওয়াজেদ আলী, আবু হাসান (ওয়াজেদের ছেলে), মহির উদ্দিন, চৈতন্য, সাফাদুল ইসলাম, আনিছুর রহমান ও মন্টু মিয়া।
যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সদর থানা বলেছে, উচ্চ আদালতে তাঁদের আপিল মামলা চলছে। মন্টু মিয়া আগাগোড়া পলাতক, বাকিরা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। তাঁরা সবাই ইউনিয়ন বিএনপির নেতা ছিলেন।
আসামি ওয়াজেদ আলীর ছেলে জুয়েল রানা বলেন, ‘বাবা কখনো চরমপন্থী ছিলেন কি না, তা জানি না। এলাকার বড় ভাই মাহবুব আলম পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করেছেন।’
একই হত্যা মামলায় মাহবুব আলম যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন। তিনি এখন জামিনে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নামে অনেক মামলা আছে। সরকারি দলের লোকজন বলেছেন, চরমপন্থী সেজে আত্মসমর্পণ করলে মামলা থেকে খালাস পাওয়া যাবে। সে জন্য আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।’
আত্মসমর্পণকারীরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত।
এ জেলায় কখনো চরমপন্থী ছিল না।
তালিকায় অন্তত নয়জন হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি আছেন। তাঁদের মধ্যে আসলাম হোসেন এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে সুপরিচিত। রাজীব হোসেনের নামে হত্যাসহ ডজনখানেক মামলা আছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত সেবা কুমার দাসের নামে একটি হত্যাসহ ছয়টি মামলা আছে।
পুলিশের নথি বলছে, তালিকাভুক্ত অন্তত ছয়জন চরমপন্থী আদতে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল হোসেনের নামে ১৭টি মামলা আছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চরমপন্থী হোক বা না হোক, ফাঁসির আসামিসহ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত অথবা বাতিল করার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলে সেখানেই এর ফয়সালা হবে। সব শেষে থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ।
তালিকার নেপথ্যে
পাবনায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ১৬ জেলার ১৬ চরমপন্থী নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জয়পুরহাটে নেতৃত্ব দেন রমজান আলী, নেতা হিসেবে যিনি প্রণোদনার টাকা পান ১০ লাখ। কিন্তু এই রমজান আবার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও বহাল আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা রয়েছে।
এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, রমজান একসময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এস এম সোলায়মান আলীর মোটরসাইকেলচালক ছিলেন। তিনি শহরের মাস্টারপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সভাপতিও বটে।
জয়পুরহাট পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র নন্দলাল পার্শি আওয়ামী লীগ জেলা কমিটির সদস্য। আত্মসমর্পণকারী কয়েকজন বলেন, তিনিও লোকজন গোছানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাটির লোকজনেরও সম্পৃক্ততা ছিল।
নন্দলাল পার্শি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকায় চরমপন্থী নেই। কিন্তু রমজান তাঁকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারদলীয় লোকজনকে ছোটখাটো মামলা থেকে অব্যাহতি দেবে, আর্থিক সহায়তা দেবে। নন্দলাল তাই তালিকায় কিছু ছেলের নাম দিয়েছেন। রমজান আলী অবশ্য এ বিষয়ে ‘ভালো-মন্দ’ কোনো কথাই বলতে রাজি হননি।
রমজানের ভাই সেলিম বাবুর নামে একাধিক অস্ত্র মামলা আছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা থেকে রেহাই পেতে আরও তো অনেক ছেলে চরমপন্থী সেজেছে। সুতরাং তালিকায় আমার নাম থাকলে সমস্যা কী?’
রোমানুর রহমান জেলা যুবলীগের সদস্য। তাঁর নামে একটি হত্যা মামলা আছে। এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী রোমানুর বলেন, রমজান ও নন্দলাল পার্শির পরামর্শে তিনি তালিকায় নাম দেন। কিন্তু পাবনায় যাওয়ার পর জানতে পারেন তিনি ‘চরমপন্থী’। রোমান বলেন, পুরো তালিকাই ভুয়া।
তালিকাভুক্ত অন্তত দুই ব্যক্তির নামে থানায় কোনো মামলা নেই। তাঁদের একজন হচ্ছেন মুক্তা বিশ্বাস, যিনি নন্দলাল পার্শির ভাগনে। অন্যজন নুরুজ্জামান বাবু, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী।
ভাগনের ব্যাপারে নন্দলাল বলেন, মুক্তা রমজানের বন্ধু হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছেন। আর নুরুজ্জামান বাবু বলেন, ‘আমার নেতা রমজান তালিকায় নাম দিয়েছেন। বলেছেন এক লাখ টাকা পাওয়া যাবে। তাই রাজি হয়েছি।’
টাকার জন্য চরমপন্থী সেজেছেন? নুরুজ্জামান বলেন, ‘কী করব! কষ্টে আছি, টাকার যে খুব দরকার।’
কাদামাটির মানুষ
জেলা নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, সন্ত্রাসীদের ছাড় দেওয়ার এই অভিনব প্রক্রিয়া সভাপতি ও সাংসদ সামছুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান আলীর সমর্থনপুষ্ট। সাংসদ অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সোলায়মান আলীও বলেছেন, তিনি বিশেষ কিছু জানেন না।
জয়পুরহাটের কথিত চরমপন্থীরা আত্মসমর্পণ করেন কাদামাটি সংগঠনের নেতা-সদস্য হিসেবে। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এটি একটি নামসর্বস্ব রাতারাতি ভুঁইফোড় ভুয়া সংগঠন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম হাক্কানীও বলেন, ‘এই জেলায় এলেমাটি, বেলেমাটি, কাদামাটি, দোআঁশ মাটি—সবই আছে। কিন্তু কাদামাটি নামের কোনো চরমপন্থী সংগঠনের নাম কোনোকালে শুনিনি।’
ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জয়পুরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক কয়েক যুগ ধরে বাম রাজনীতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনিও একই কথা বলেন। আর বলেন, তাঁর জানামতে জয়পুরহাটে কখনো চরমপন্থীদের তৎপরতা ছিল না।
No comments