যেভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে উপবন by ইমাদ উদ দীন ও আলাউদ্দিন কবির
অতিরিক্ত
দুটিসহ ১৭টি কোচ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটছিল উপবন এক্সপ্রেস। সিলেট
স্টেশন ছেড়ে মাইজগাঁও-এ যাত্রা বিরতি দিয়ে কুলাউড়ার উদ্দেশে যাচ্ছিল।
বরমচাল স্টেশন থেকে ২০০ মিটার সামনে যেতেই বিকট শব্দ করে ট্রেনের পিছনের
বগিটি সেতু থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। আরো তিনটি বগি লাইন থেকে ছিটকে পাশের
জমিতে পড়ে। রেল লাইনে কাত হয়ে পড়ে আরো দুটি বগি। লাইনচ্যুত ছয়টি বগিতে কয়েক
শ’ যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনায় পড়ার পর যাত্রীদের চিৎকার আর বাঁচার আকুতিতে
ঘটনাস্থলে ছুটে যান আশপাশের গ্রামের মানুষ। প্রাথমিক উদ্ধার কাজ চলার সময়ই
ট্রেন থেকে চার জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
আহত দেড় শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গুরুতর আহতদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অন্তত ৪০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। টানা ছয় দিন ঢাকার সঙ্গে সিলেটের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল ট্রেনগুলো। উপবন দুর্ঘটনায় পড়ায় সিলেটের সঙ্গে সড়ক পথের পাশাপাশি রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েন লাখো মানুষ। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, দ্রুত উদ্ধার কাজ চলায় এবং ভেঙে যাওয়া সেতুর নিচে পানি কম থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
রাত তখন প্রায় পৌনে ১২টা। যথা নিয়মেই শোনা যাচ্ছিল ট্রেন চলার শব্দ। স্থানীয় ইসলামাবাদ, নন্দনগর, মহলাল, খাদিমপাড়াসহ আশপাশের গ্রামবাসী অনেকেই তখন ঘুমে। আবার কেউ কেউ নিচ্ছিলেন ঘুমের প্রস্তুতি। বরমচাল রেলস্টশন সংলগ্ন কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে ফিরছিলেন নিজ বাড়িতে। ওই ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রত্যক্ষ করছিলেন তাদের চিরচেনা উপবন ট্রেনটির অচেনা দ্রুতগতি আর সাইরেন। হঠাৎ এমন দ্রুতগতি আর বিদঘুটে শব্দ শোনে তখন অনেকেরই মনে শঙ্কা জাগে। কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গেই পেছনের বগিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ধোঁয়ার কুণ্ডলি। বগিটি ব্রিজ থেকে ছিটকে পড়ে নিচের খালে। পর পর আরো পাঁচটি বগির তিনটি কাত হয়ে পড়ে যায় জমিতে। লাইনে কাত হয়ে পড়ে বাকি দুটি। বাতাসেই ভেসে আসে ট্রেনের যাত্রীদের গগনবিদারী চিৎকার। অন্ধকারের মধ্যে মানুষের বাঁচার আকুতি শুনে ছুটে আসতে থাকেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ১১টি ইউনিটসহ পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাত্রীদের উদ্ধার কাজ শুরু করে। খবর পেয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্থানীয় পিকআপ ভ্যান ও লেগুনা মালিক সমিতির লোকজনও তাদের গাড়ি দিয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি নিয়েও ছুটে যান অনেকে। সময়ের ব্যবধানে দুর্ঘটনার খবর চাউর হলে কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা বরমচাল ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের বাসিন্দাসহ পুরো উপজেলার লোকজন দ্রুত ছুটতে থাকেন ঘটনাস্থলে। মধ্যরাতে পাহাড়ি এলাকায় প্রচণ্ড অন্ধকারের মধ্যে মুঠোফোনের আলো ও টর্চ লাইট জ্বালিয়ে শ’ শ’ মানুষ আহতদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। গভীর রাতেও ব্রাহ্মণবাজার সিলেট সড়কে যাত্রীসহ দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধারে সহায়তাকারী লোকজন ও যানবাহনের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। ইসলামাবাদ গ্রামের মো. জহির আলী, মো. জয়নাল আবেদীন, নন্দনগর গ্রামের নুরুল আমিন চৌধুরী তপু, মহলাল গ্রামের পারভেজ আহমদ, আহসান মিরাজসহ অনেকেই জানান দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই তাদের বাড়ি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা হঠাৎ বড়ছড়া ব্রিজের পাশে ট্রেনের বিকট শব্দ শোনতে পান। ভয়াবহ দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখে ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয়রা।
স্কাউট সদস্য হোসাইন আহমদ, সাব্বির আহমদ, কলেজ শিক্ষার্থী নাঈম আহমদ সুজন, আলতাফ মাহমুদ, ব্যবসায়ী সুলেমান আহমদ, বিমলেন্দু সেন কৃষ্ণ, মিনহাজ উদ্দিন আহমদ কমরু, মোক্তাদির হোসেন মনা বলেন আহত যাত্রীদের কান্নায় ওই এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। নন্দনগর টিকরা গ্রামের আব্দুল মন্নান মনা, কনা মিয়া ও মোতাহের মিয়া বলেন, রাতে আমাদের পরিবারের অনেকেই ঘুমিয়ে ছিলেন হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ছোট বড় সবাই বাইরে বের হয়ে আসে। উপবন ট্রেনের ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. মানিক খান জানান ট্রেনটিতে অন্য দিনের চাইতে একটু বাড়তি চাপ ছিল যাত্রীদের। তাই নিয়মিত ১৫টি বগি থাকলেও আরো ২টি বাড়িয়ে ১৭টি বগি করা হয়েছিল। নন্দনগর গ্রামের ফারুক মিয়াসহ ওই গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, বড়ছড়া ব্রিজের ওপর ও ব্রিজের মুখের রেল স্লিপার, ফিশ্ল প্লেট ও পাতের নাট বল্টু দীর্ঘদিন থেকে নেই বললেই চলে। তাই ট্রেন ওই ব্রিজে উঠলেই বিকট শব্দ হতো। বিষয়টি তারা স্থানীয় রেল স্টেশনের কর্মকর্তাদের জানালেও তারা তা আমলে নেননি। ঘটনাস্থলে আসা ভাটেরা বাজার ও বরমচালের কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান অন্য দিনের চাইতে উপবন ট্রেনটি ওই দিন বেশ দ্রুতগামী ছিল। মনে হচ্ছিল ট্রেনটির বগিগুলো টেনেহিঁচড়ে সামনে এগোচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল। আমাদের সে ভয়ই বাস্তব হলো। তাদের কথার সত্যতা মিলে সরজমিনে।
রাত প্রায় আড়াটার দিকেও ঘটনাস্থলের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উদ্ধারকারী, যাত্রীদের স্বজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সোমবার বিকাল পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায় পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল জোরদার। কুলাউড়া সদর হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালসহ স্থানীয় হাসপাতালেও আহতদের খোঁজ নিতে প্রচণ্ড ভিড়ে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আর গাড়ির সাইরেনে আতঙ্কিত হন গ্রাম-শহরের বাসিন্দারা। কুলাউড়া হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় ওই দুর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের লাশ। আর স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে চলে আহতদের চিকিৎসা। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রেরণ করা হয় মৌলভীবাজার সদর বা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফায়ার সার্ভিসের সিলেট বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, হতাহতের পরিসংখ্যান সঠিক করে বলা না গেলেও ৪জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। আমাদের ১১টি ইউনিটের সদস্যরা এখানে কাজ করেছেন। রোববার রাতেই দুর্ঘটনাকবলিত সব বগিই আমরা সার্চ করে দেখেছি। কোনো বগিতেই আহত কিংবা নিহত কোনো যাত্রীকে পাইনি। তারপরও আমরা ঘটনাস্থলে সোমবার দুপুর পর্যন্ত আরো সার্চ করি।
দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। হঠাৎ এমন দুর্ঘটনায় প্রতিটি স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদেরও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ওই দিনই ভোরে ইঞ্জিনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ১১টি বগি উদ্ধার করে কুলাউড়া স্টেশনে আনা হয়। পরে সাতটি বগি নিয়ে উপবন এক্সপ্রেস ঢাকা পৌঁছে।
সোমবার সকাল ও দুপুরের মধ্যে উদ্ধার হয় ৩টি বগি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খাদে পড়ে যাওয়া অন্য ৩টি বগি উদ্ধার করে রেললাইনটি সচল করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান রেল বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি: সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক জানান ‘ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি ৩ দিনের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ জানাবেন। রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে।’ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, সুজিত কুমার বিশ্বাস ও ময়নুল ইসলাম।
দিনের আলোতেই চালু হবে ট্রেন: রেল সচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, অতিরিক্ত সচিব মুজিবুর রহমান, রেলের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম, রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিলসহ পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে আখাউড়া থেকে রিলিফ ট্রেন এসে কাজ শুরু করেছে। সেতুর সংস্কারকাজ আর বগি উদ্ধারের কাজ শেষ হতে বিকাল হয়ে যাবে। তারপরই হয়তো সিলেটের পথে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করা যাবে। দিনের আলোতেই ওই রেল পথ চালু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নিহতদের পরিচয়: নিহত ৪ যাত্রীর মধ্যে ৩ জন নারী ও একজন পুরুষ। তাদের মধ্যে কুলাউড়া পৌরসভার টিটিডিসি এলাকার বাসিন্দা ও ঠিকাদার আবদুল বারির স্ত্রী মানোয়ারা পারভীন (৪৮) রয়েছেন। নিহত অন্যরা হলেন- সিলেটের মোগলাবাজারের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আবদুল বারির মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০) ও বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানার ভাণ্ডারখোলা গ্রামের আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার (২০)। এরা দু’জন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের নার্সিং ইন্সটিটিউটের ছাত্রী। নিহত পুরুষ যাত্রী মো. কাউছার আহমদ (২৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর উপজেলার ধরমণ্ডল গ্রামের মৃত নুর হোসেনের ছেলে। নিহত ৪ জনেরই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাত্রীদের বর্ণনা: ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সিলেটের ফটোগ্রাফার কে এম এ তাহের। তিনি দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি সিটে বসা, হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক যাত্রী আমার ওপরে পড়েন। বিকট শব্দ ও কান্নার আওয়াজ শুনি। ভাগ্যিস জানালার পাশে ছিলাম ঝুলন্ত বগি থেকে কোনো রকম মাথাটা বের করে পা বাড়ালেই দেখি আমি পানিতে। জাহেদ মিয়া, আলম মিয়া, মাসুদ আহমেদ, তোফায়েল, মিজানুর, আব্দুর রশীদ বলেন, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। কি যেন আমাদেরকে ট্রেনের পিছন দিক দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরই বিকট শব্দের পর আমরা দেখি রেললাইনের পাশের জমিতে পড়ে আছি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গে থাকা শিশু ও মহিলাদের আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কাজে লেগে যাই। পাবনার মো. আল আমিন ও মো. সম্রাট পারভেজ জানান, তারা ১৪ জন মিলে সিলেটে মাজার জিয়ারতে আসেন। সড়কপথ বন্ধ থাকায় তারা ট্রেনের টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দুর্ঘটনার পর ভয়ে তারা ট্রেন থেকে নেমে টিকরা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। মসজিদে রাত কাটান। ভোর ৭টায় তারা সড়ক পথে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
সতর্কতার পরামর্শ বৃটেনের: ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত বৃটিশ নাগরিকদের সতর্ক করেছে বৃটেনের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস। সোমবার দিনের শুরুতে জারি এক সতর্ক বার্তায় বলা হয়- বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারের বরমচাল স্টেশনের কাছাকাছি স্থানে ২৩শে জুন একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে বহু লোক আহত এবং কয়েকজন নিহত হয়েছেন। বৃটিশ সরকারের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই সতর্কতায় আরো বলা হয়- বাংলাদেশে বিস্তৃত তবে অনেক পুরনো রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশে রেল ভ্রমণ অত্যন্ত ধীরগতির। দেশটিতে মাঝেমধ্যেই ট্রেন লাইনচ্যুতি এবং অন্যান্য রেল দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে অনেকে হাতাহত হন, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ গত ২৩শে জুন মৌলভীবাজার জেলার ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনাটি সতর্ক বার্তায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক। মধ্য রাতের ওই ঘটনায় পরদিন সন্ধ্যা অবধি সিলেটের সঙ্গে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বৃটেনের সতর্ক বার্তায় দেশটির নাগরিক যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা ভ্রমণ করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়- কিছু কিছু ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট রয়েছে, যা ভেতর থেকে আটকানো যায়। বিশেষ করে রাতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই কম্পার্টমেন্টের ওই লকগুলো ভালোভাবে আটকাতে হবে।
ট্রেন দুর্ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি: সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণমাধ্যমে প্রেরিত বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পদে পদে যেভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও দায়িত্ব পালনে গাফিলতির মহোৎসব চলছে। এখানে দুর্নীতিবাজরা পুরস্কৃত হচ্ছে, সৎ অফিসাররা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যাত্রীসেবার মান ও ট্রেনের গতি গাণিতিক হারে নিম্নমুখী হচ্ছে। অথচ সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রেলকে গতিশীল করতে প্রায় অর্ধশত যাত্রীবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন করে এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিবৃতিতে দাবি জানানো হয়। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এই রেল দুর্ঘটনায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতিকারী অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটি, ঠিকাদারের দুর্নীতি যারা দায়ী হোক না কেন, জড়িত তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হোক। অন্যথায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সামনে আরো বড় বড় বিপদ আসন্ন বলে বিবৃতিতে সতর্ক করেন তিনি। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, আমরা কথায় কথায় যেকোনো বিষয়ে ভারতের উদাহরণ দিয়ে থাকি, ভারতে হলে এতক্ষণে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। দায়ী ব্যক্তিরাও ছাড় পেতেন না। তিনি এই দুর্ঘটনায় হতাহত প্রতিটি পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ চিকিৎসা সুনিশ্চিত করার দাবি জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক: কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন, এমপি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় মন্ত্রী শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়ে গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। শিগগিরই ব্রিজটি চালু হবে এবং আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে নির্মিত নতুন ব্রিজ উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তা ছাড়া বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে বিমানের অতিরিক্ত ফ্লাইট চালুরও অনুরোধ করেছি।
আহত দেড় শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গুরুতর আহতদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অন্তত ৪০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। টানা ছয় দিন ঢাকার সঙ্গে সিলেটের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল ট্রেনগুলো। উপবন দুর্ঘটনায় পড়ায় সিলেটের সঙ্গে সড়ক পথের পাশাপাশি রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েন লাখো মানুষ। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, দ্রুত উদ্ধার কাজ চলায় এবং ভেঙে যাওয়া সেতুর নিচে পানি কম থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
রাত তখন প্রায় পৌনে ১২টা। যথা নিয়মেই শোনা যাচ্ছিল ট্রেন চলার শব্দ। স্থানীয় ইসলামাবাদ, নন্দনগর, মহলাল, খাদিমপাড়াসহ আশপাশের গ্রামবাসী অনেকেই তখন ঘুমে। আবার কেউ কেউ নিচ্ছিলেন ঘুমের প্রস্তুতি। বরমচাল রেলস্টশন সংলগ্ন কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে ফিরছিলেন নিজ বাড়িতে। ওই ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রত্যক্ষ করছিলেন তাদের চিরচেনা উপবন ট্রেনটির অচেনা দ্রুতগতি আর সাইরেন। হঠাৎ এমন দ্রুতগতি আর বিদঘুটে শব্দ শোনে তখন অনেকেরই মনে শঙ্কা জাগে। কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গেই পেছনের বগিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ধোঁয়ার কুণ্ডলি। বগিটি ব্রিজ থেকে ছিটকে পড়ে নিচের খালে। পর পর আরো পাঁচটি বগির তিনটি কাত হয়ে পড়ে যায় জমিতে। লাইনে কাত হয়ে পড়ে বাকি দুটি। বাতাসেই ভেসে আসে ট্রেনের যাত্রীদের গগনবিদারী চিৎকার। অন্ধকারের মধ্যে মানুষের বাঁচার আকুতি শুনে ছুটে আসতে থাকেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ১১টি ইউনিটসহ পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাত্রীদের উদ্ধার কাজ শুরু করে। খবর পেয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্থানীয় পিকআপ ভ্যান ও লেগুনা মালিক সমিতির লোকজনও তাদের গাড়ি দিয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি নিয়েও ছুটে যান অনেকে। সময়ের ব্যবধানে দুর্ঘটনার খবর চাউর হলে কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা বরমচাল ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের বাসিন্দাসহ পুরো উপজেলার লোকজন দ্রুত ছুটতে থাকেন ঘটনাস্থলে। মধ্যরাতে পাহাড়ি এলাকায় প্রচণ্ড অন্ধকারের মধ্যে মুঠোফোনের আলো ও টর্চ লাইট জ্বালিয়ে শ’ শ’ মানুষ আহতদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। গভীর রাতেও ব্রাহ্মণবাজার সিলেট সড়কে যাত্রীসহ দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধারে সহায়তাকারী লোকজন ও যানবাহনের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। ইসলামাবাদ গ্রামের মো. জহির আলী, মো. জয়নাল আবেদীন, নন্দনগর গ্রামের নুরুল আমিন চৌধুরী তপু, মহলাল গ্রামের পারভেজ আহমদ, আহসান মিরাজসহ অনেকেই জানান দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই তাদের বাড়ি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা হঠাৎ বড়ছড়া ব্রিজের পাশে ট্রেনের বিকট শব্দ শোনতে পান। ভয়াবহ দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখে ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয়রা।
স্কাউট সদস্য হোসাইন আহমদ, সাব্বির আহমদ, কলেজ শিক্ষার্থী নাঈম আহমদ সুজন, আলতাফ মাহমুদ, ব্যবসায়ী সুলেমান আহমদ, বিমলেন্দু সেন কৃষ্ণ, মিনহাজ উদ্দিন আহমদ কমরু, মোক্তাদির হোসেন মনা বলেন আহত যাত্রীদের কান্নায় ওই এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। নন্দনগর টিকরা গ্রামের আব্দুল মন্নান মনা, কনা মিয়া ও মোতাহের মিয়া বলেন, রাতে আমাদের পরিবারের অনেকেই ঘুমিয়ে ছিলেন হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ছোট বড় সবাই বাইরে বের হয়ে আসে। উপবন ট্রেনের ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. মানিক খান জানান ট্রেনটিতে অন্য দিনের চাইতে একটু বাড়তি চাপ ছিল যাত্রীদের। তাই নিয়মিত ১৫টি বগি থাকলেও আরো ২টি বাড়িয়ে ১৭টি বগি করা হয়েছিল। নন্দনগর গ্রামের ফারুক মিয়াসহ ওই গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, বড়ছড়া ব্রিজের ওপর ও ব্রিজের মুখের রেল স্লিপার, ফিশ্ল প্লেট ও পাতের নাট বল্টু দীর্ঘদিন থেকে নেই বললেই চলে। তাই ট্রেন ওই ব্রিজে উঠলেই বিকট শব্দ হতো। বিষয়টি তারা স্থানীয় রেল স্টেশনের কর্মকর্তাদের জানালেও তারা তা আমলে নেননি। ঘটনাস্থলে আসা ভাটেরা বাজার ও বরমচালের কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান অন্য দিনের চাইতে উপবন ট্রেনটি ওই দিন বেশ দ্রুতগামী ছিল। মনে হচ্ছিল ট্রেনটির বগিগুলো টেনেহিঁচড়ে সামনে এগোচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল। আমাদের সে ভয়ই বাস্তব হলো। তাদের কথার সত্যতা মিলে সরজমিনে।
রাত প্রায় আড়াটার দিকেও ঘটনাস্থলের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উদ্ধারকারী, যাত্রীদের স্বজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সোমবার বিকাল পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায় পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল জোরদার। কুলাউড়া সদর হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালসহ স্থানীয় হাসপাতালেও আহতদের খোঁজ নিতে প্রচণ্ড ভিড়ে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আর গাড়ির সাইরেনে আতঙ্কিত হন গ্রাম-শহরের বাসিন্দারা। কুলাউড়া হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় ওই দুর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের লাশ। আর স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে চলে আহতদের চিকিৎসা। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রেরণ করা হয় মৌলভীবাজার সদর বা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফায়ার সার্ভিসের সিলেট বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, হতাহতের পরিসংখ্যান সঠিক করে বলা না গেলেও ৪জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। আমাদের ১১টি ইউনিটের সদস্যরা এখানে কাজ করেছেন। রোববার রাতেই দুর্ঘটনাকবলিত সব বগিই আমরা সার্চ করে দেখেছি। কোনো বগিতেই আহত কিংবা নিহত কোনো যাত্রীকে পাইনি। তারপরও আমরা ঘটনাস্থলে সোমবার দুপুর পর্যন্ত আরো সার্চ করি।
দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। হঠাৎ এমন দুর্ঘটনায় প্রতিটি স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদেরও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ওই দিনই ভোরে ইঞ্জিনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ১১টি বগি উদ্ধার করে কুলাউড়া স্টেশনে আনা হয়। পরে সাতটি বগি নিয়ে উপবন এক্সপ্রেস ঢাকা পৌঁছে।
সোমবার সকাল ও দুপুরের মধ্যে উদ্ধার হয় ৩টি বগি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খাদে পড়ে যাওয়া অন্য ৩টি বগি উদ্ধার করে রেললাইনটি সচল করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান রেল বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি: সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক জানান ‘ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি ৩ দিনের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ জানাবেন। রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে।’ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, সুজিত কুমার বিশ্বাস ও ময়নুল ইসলাম।
দিনের আলোতেই চালু হবে ট্রেন: রেল সচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, অতিরিক্ত সচিব মুজিবুর রহমান, রেলের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম, রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিলসহ পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে আখাউড়া থেকে রিলিফ ট্রেন এসে কাজ শুরু করেছে। সেতুর সংস্কারকাজ আর বগি উদ্ধারের কাজ শেষ হতে বিকাল হয়ে যাবে। তারপরই হয়তো সিলেটের পথে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করা যাবে। দিনের আলোতেই ওই রেল পথ চালু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নিহতদের পরিচয়: নিহত ৪ যাত্রীর মধ্যে ৩ জন নারী ও একজন পুরুষ। তাদের মধ্যে কুলাউড়া পৌরসভার টিটিডিসি এলাকার বাসিন্দা ও ঠিকাদার আবদুল বারির স্ত্রী মানোয়ারা পারভীন (৪৮) রয়েছেন। নিহত অন্যরা হলেন- সিলেটের মোগলাবাজারের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আবদুল বারির মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০) ও বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানার ভাণ্ডারখোলা গ্রামের আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার (২০)। এরা দু’জন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের নার্সিং ইন্সটিটিউটের ছাত্রী। নিহত পুরুষ যাত্রী মো. কাউছার আহমদ (২৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর উপজেলার ধরমণ্ডল গ্রামের মৃত নুর হোসেনের ছেলে। নিহত ৪ জনেরই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাত্রীদের বর্ণনা: ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সিলেটের ফটোগ্রাফার কে এম এ তাহের। তিনি দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি সিটে বসা, হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক যাত্রী আমার ওপরে পড়েন। বিকট শব্দ ও কান্নার আওয়াজ শুনি। ভাগ্যিস জানালার পাশে ছিলাম ঝুলন্ত বগি থেকে কোনো রকম মাথাটা বের করে পা বাড়ালেই দেখি আমি পানিতে। জাহেদ মিয়া, আলম মিয়া, মাসুদ আহমেদ, তোফায়েল, মিজানুর, আব্দুর রশীদ বলেন, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। কি যেন আমাদেরকে ট্রেনের পিছন দিক দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরই বিকট শব্দের পর আমরা দেখি রেললাইনের পাশের জমিতে পড়ে আছি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গে থাকা শিশু ও মহিলাদের আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কাজে লেগে যাই। পাবনার মো. আল আমিন ও মো. সম্রাট পারভেজ জানান, তারা ১৪ জন মিলে সিলেটে মাজার জিয়ারতে আসেন। সড়কপথ বন্ধ থাকায় তারা ট্রেনের টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দুর্ঘটনার পর ভয়ে তারা ট্রেন থেকে নেমে টিকরা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। মসজিদে রাত কাটান। ভোর ৭টায় তারা সড়ক পথে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
সতর্কতার পরামর্শ বৃটেনের: ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত বৃটিশ নাগরিকদের সতর্ক করেছে বৃটেনের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস। সোমবার দিনের শুরুতে জারি এক সতর্ক বার্তায় বলা হয়- বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারের বরমচাল স্টেশনের কাছাকাছি স্থানে ২৩শে জুন একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে বহু লোক আহত এবং কয়েকজন নিহত হয়েছেন। বৃটিশ সরকারের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই সতর্কতায় আরো বলা হয়- বাংলাদেশে বিস্তৃত তবে অনেক পুরনো রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশে রেল ভ্রমণ অত্যন্ত ধীরগতির। দেশটিতে মাঝেমধ্যেই ট্রেন লাইনচ্যুতি এবং অন্যান্য রেল দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে অনেকে হাতাহত হন, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ গত ২৩শে জুন মৌলভীবাজার জেলার ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনাটি সতর্ক বার্তায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক। মধ্য রাতের ওই ঘটনায় পরদিন সন্ধ্যা অবধি সিলেটের সঙ্গে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বৃটেনের সতর্ক বার্তায় দেশটির নাগরিক যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা ভ্রমণ করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়- কিছু কিছু ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট রয়েছে, যা ভেতর থেকে আটকানো যায়। বিশেষ করে রাতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই কম্পার্টমেন্টের ওই লকগুলো ভালোভাবে আটকাতে হবে।
ট্রেন দুর্ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি: সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণমাধ্যমে প্রেরিত বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পদে পদে যেভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও দায়িত্ব পালনে গাফিলতির মহোৎসব চলছে। এখানে দুর্নীতিবাজরা পুরস্কৃত হচ্ছে, সৎ অফিসাররা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যাত্রীসেবার মান ও ট্রেনের গতি গাণিতিক হারে নিম্নমুখী হচ্ছে। অথচ সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রেলকে গতিশীল করতে প্রায় অর্ধশত যাত্রীবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন করে এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিবৃতিতে দাবি জানানো হয়। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এই রেল দুর্ঘটনায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতিকারী অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটি, ঠিকাদারের দুর্নীতি যারা দায়ী হোক না কেন, জড়িত তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হোক। অন্যথায় বাংলাদেশ রেলওয়ের সামনে আরো বড় বড় বিপদ আসন্ন বলে বিবৃতিতে সতর্ক করেন তিনি। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, আমরা কথায় কথায় যেকোনো বিষয়ে ভারতের উদাহরণ দিয়ে থাকি, ভারতে হলে এতক্ষণে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। দায়ী ব্যক্তিরাও ছাড় পেতেন না। তিনি এই দুর্ঘটনায় হতাহত প্রতিটি পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ চিকিৎসা সুনিশ্চিত করার দাবি জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক: কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন, এমপি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় মন্ত্রী শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়ে গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। শিগগিরই ব্রিজটি চালু হবে এবং আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে নির্মিত নতুন ব্রিজ উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তা ছাড়া বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে বিমানের অতিরিক্ত ফ্লাইট চালুরও অনুরোধ করেছি।
No comments