৩০ সহকর্মী নিয়ে বকুলের বেঁচে ফেরা -ভাইয়ের বর্ণনায় সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত
বনানীর
এফ আর টাওয়ার। এ টাওয়ারের ১০ তলায় ছিল বকুলের অফিস। বকুল যেখানে বসতেন ঠিক
তার নিচেই ছিল ৯ তলার কিচেন। দুপুর বেলা, সবাই তখন কর্মব্যস্ত। ঠিক ওই সময়
বকুল হইচই শুনতে পান। তিনি ওঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে তা দেখার চেষ্টা
করেন। নিচের দিকে রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখেন ভবন ঘিরে মানুষের ভিড়। নিচের
ফ্লোরে আগুনও দেখতে পান।
সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যান। কিন্তু ঘন ধোঁয়ার কারণে আর সম্ভব হয়নি। ফিরে যান ভেতরেই। তারপর শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি। কিছু সময়ের ব্যবধান মাত্র। এরপরও বকুল মাথা ঠান্ডা রেখেছেন। কীভাবে? সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন বকুলের ভাই প্রবাসী ফরিদ আহমেদ। এ নিয়ে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
ফরিদ আহমদের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো-
‘তোমাদের দেশে আগুন লেগেছে। জানো নাকি?’ অফিসে ঢুকেই আমার এক সার্বিয়ান সহকর্মী আমাকে বললো। সে দেরি করে অফিসে এসেছে। বেলা তখন এগারোটা। ‘নাতো। কোথায়?’ আমি বলি। ‘বড় একটা বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। আল জাজিরায় দেখাচ্ছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তোমাদের দেশেতো কয়দিন আগেও আগুন লেগেছিল, তাই না। প্রেটি ব্যাড।’
ওর কথায় সমর্থন জানাই আমি। চট করে ডেইলি স্টার খুলে ঢাকার অবস্থাটা জেনে নিই। দেখি বনানীর একটা টাওয়ারে আগুন লেগেছে। মন খারাপ করতে গিয়েও করি না। তার বদলে কাজে ডুবে যাই আমি। বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই, চিন্তা-টিন্তা না করাটাই ভালো।
গত কিছুদিন ধরে ভয়ঙ্কর ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে আমার। ভোর না হতেই কাজের দিকে দৌড় দেই। বাসায় ফিরি রাত সেই এগারোটায়। দুনিয়াদারীর কী হচ্ছে, কিছুই জানি না বলতে গেলে আমি।
স্পর্শকাতর তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয় বলে অফিসে আমরা ফোন ব্যবহার করতে পারি না। এমনকি ডেস্কের উপরেও ফোন রাখা নিষিদ্ধ। আমি ড্রয়ারের মধ্যে ফোনটাকে রাখি। মাঝে মাঝে ড্রয়ার খুলে চুপি চুপি দেখি কোনো মেসেজ আছে কিনা।
বিকাল চারটার দিকে দেখি আন্না মেসেজ করেছে আমাকে। ‘আগুনের হাত থেকে বকুল কোনো মতে বেঁচে গেছে। ওদের অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে।’
বকুল আমার ছোট ভাই। এক ঝটকায় ফোনটা হাতে নিয়েই বাইরে চলে আসি আমি। বকুলকে ফোন দেই। ওকে পাই না। ঢাকায় তখন অনেক রাত। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। বকুলকে না পেয়ে ওর স্ত্রী নোভাকে মেসেজ দেই আমি। নোভার কাছ থেকেও কোনো উত্তর পাই না। রাত নয়টার দিকে অফিস থেকে বের হয়েই আবার কল দেই। তখনও ফোন ধরে না কেউ। আমি ক্রমাগত ফোন দিয়ে যেতে থাকি। সাড়ে নয়টার দিকে ঘুম জড়ানো গলায় ফোন ধরে বকুল। ওর কাছ থেকে পুরো বিবরণ শুনি।
বকুলের অফিস দশ তলায়। ওদের বেশ কয়েকটা অফিস রয়েছে ওই বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলায়। সে অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার। আগুন লেগেছিল নয় তলার কিচেনে। ওটা বকুলের রুমের ঠিক নিচেই। হইচই শুনে সে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে নিচে তাকায়। দেখে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছে নিচে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে আগুনও দেখতে পায় সে। দ্রুত গিয়ে অফিসের সবাইকে খবর দেয়। আমার চাচাতো ভাই রঞ্জুও এই কোম্পানির সিএফও। তার অফিস দুই তিনটা বিল্ডিং পরে অন্য একটা বিল্ডিংয়ে। আগুন লাগার খবর পেয়ে রঞ্জু ততক্ষণে বিল্ডিংয়ের নিচে চলে এসেছে। ওখান থেকে সে বকুলকে ফোন করে বলছে, ‘আট আর নয় তলায় আগুন লেগেছে। ফায়ার ব্রিগেড এসেছে। কিন্তু কাজ শুরু করতে দেরি হবে। তুই অফিসের সবাইকে নিয়ে ছাদের দিকে চলে যা।
অফিসের মেইন দরজা খুলে দুই চারজন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় উপরে কিংবা নিচের দিকে যাবার জন্য। কিন্তু পুরো সিঁড়ি তখন ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ওই ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে কারো পক্ষেই কোনো দিকে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই ফিরে আসে অফিসের ভিতরে।
সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব হবে না ভেবে চার-পাঁচজন বাদে সবাইকে নিয়ে অফিসের অন্য-প্রান্তে চলে যায় বকুল। এই চার-পাঁচজন গিয়ে আশ্রয় নেয় বোর্ড-রুমে। বোর্ড-রুমের দরজা আটকে রাখলে ধোঁয়া ঢুকবে না এই যুক্তি দিয়ে সেখানে ঢুকে যায় তারা। এর মধ্যে একজন মহিলাও ছিল।
অফিসের অন্য প্রান্তে ওদের একটা বাথরুম আছে। এই বাথরুমে জানালা কাঁচের। তবে কাঁচের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিলও রয়েছে। জানালার গা-ঘেঁষেই পাশের বিল্ডিং। সেই বিল্ডিংয়ে-ও একটা জানালা আছে। যদিও সেটা পুরোপুরি এই জানালার মুখোমুখি না। কিন্তু ভাঙতে পারলে এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে চলে যাওয়া সম্ভব।
স্ট্যান্ড ফ্যানের স্ট্যান্ড দিয়ে সেই গ্রিল ভাঙার নির্দেশনা দেয় সে। কয়েকজন তরুণ কর্মচারী বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। ‘এ দিয়ে এই গ্রিল ভাঙা সম্ভব না ভাইয়া।’ হতাশ কণ্ঠে বলে তারা। বকুল হাল ছাড়তে রাজি হয় না। ‘নিশ্চয় ভাঙা যাবে। ভাঙতে হবেই। নইলে সবার আগুনে পুড়ে মরা লাগবে।’
ক্রমাগত গ্রিলে আঘাত করা শুরু হয় আবার। কাজ হয় এতে ভেঙে যায় গ্রিল। লোহার একটা টুকরো দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়েরও কাঁচ ভাঙা হয়। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ভিন্ন জিনিস। ওই জানালাতেও গ্রিল দেয়া। ওদের হাতের ফ্যানের স্ট্যান্ড বা লোহার টুকরো দিয়ে ওখানে শক্ত করে আঘাত করা সম্ভব হচ্ছে না। আগুন লেগেছে দেখে ওই বিল্ডিংয়ের লোকজনও ভয়ে নেমে গেছে। চিৎকার করে ডাকাডাকি করেও কেউ আসে না।
এর মধ্যে রঞ্জু আবার ফোন দেয়। ছাদে যাওয়ার কথা বলে। বকুল বলে, ছাদে যাওয়া সম্ভব না এই ধোঁয়ার মধ্যে। আপনি বরং পাশের বিল্ডিংয়ে লোক পাঠান। আমরা এপাশে জানালা ভেঙেছি। কিন্তু ওপাশেরটা ভাঙতে পারছি না। রঞ্জু সঙ্গে সঙ্গেই চার-পাঁচজনকে পাঠায় পাশের বিল্ডিংয়ে। কিন্তু তারা খালি হাতে এসেছে। গ্রিল ভাঙার কিছু সঙ্গে নেই। এপাশ থেকে লোহার রড দেয়া হয় ওদের কাছে। সেটা দিয়ে গ্রিল ভাঙার বহুক্ষণ চেষ্টা করে তারা। কিন্তু কিছুতেই গ্রিল ভাঙে না। একপর্যায়ে গিয়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তারা। ‘এই গ্রিল ভাঙা সম্ভব নয়।’
বকুল চাপ দেয় ওদের। ‘চেষ্টা করে যান। অবশ্যই ভাঙবে। এতগুলো মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছে, হাল ছেড়েন না।’
ওর কথা শুনে আবারও গ্রিলের ওপরে আঘাত হানতে থাকে তারা। হঠাৎ করে একটা গ্রিল ভেঙে যায়। এক দেড় ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। এটা দেখে প্রবল উৎসাহে দ্বিতীয়টার ওপর আঘাত হানতে থাকে তারা। এটা ভাঙতেও বেশি সময় লাগে না। মানুষ ঢোকার মতো জায়গা তৈরি হয়ে যায়। এখান দিয়ে বের হয়ে পা এগিয়ে দেয় একেকজন আর অন্যপাশ থেকে ধরে তাদের পাশে বিল্ডিং এ নিয়ে যাওয়া হয়।
এর মধ্যে ফায়ার ব্রিগেডের লোকও চলে এসেছে। বকুল ওদের বোর্ড- রুমে আশ্রয় নেয়া চার-পাঁচজনের দলের কথা বলে। তাদের উদ্ধার করার জন্য অনুরোধ জানায়। ফায়ার ব্রিগেডের লোক এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে যেতে শুরুতে অস্বীকার করে। কিন্তু ওদের চাপাচাপিতে রাজি হয়। গিয়ে দেখে, সেই মানুষগুলো বাথরুমের কাছে এসে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মহিলাটা পুরোপুরিই অজ্ঞান। সবাইকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয়।
বিল্ডিংয়ে থাকা অবস্থাতেই বকুল নোভাকে কল দিয়েছিল। বলেছিল আটকা পড়েছে সে। বিল্ডিং এর নিচে এসে আবার কল দিয়ে জানায়, সে বের হতে পেরেছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চার্জ শেষ হয়ে যায় ওর ফোনের। নোভা ওকে কল করে না পেয়ে ভেবে নিয়েছে বকুল তাকে মিথ্যা কথা বলেছে। আসলে বিল্ডিংয়ে আটকে গিয়েছে সে। উন্মত্ত অবস্থায় সে নিজেও রওনা দিয়ে দিয়েছে বনানীর দিকে। তার বোনকেও বলেছে বনানীর দিকে যেতে। বোন তার আগেই চলে এসেছে বনানীতে। তিনি এসে দেখেন এক লোক আগুনের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে পাইপ ধরে ধরে নামছিল। কিন্তু, হাত ফসকে পড়ে গিয়েছে। লম্বা ধরনের মানুষ আর গায়ের শার্ট দেখে দূর থেকে দেখে তার মনে হয়েছে বকুল বোধ হয় পড়ে গিয়েছে বিল্ডিং থেকে। তিনি নোভাকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইয়ার মতো শার্ট গায়ে লম্বা একটা লোক পড়ে গেছে দশ তলা থেকে। ভাইয়াই কিনা বুঝতে পারছি না।’
শুধু নোভা একা না। আমার ভাই-বোনেরাও তখন সবাই অস্থির, উদ্বিগ্ন। ভাই-ভাগ্নেরা যে যেখানে আছে সবাই তখন বনানীর দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে। বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি।
নিজের ভাই বলে বলছি না। এই ভয়াবহ আগুন থেকে সে শুধু নিজে বাঁচেনি, বুদ্ধি করে ঠান্ডা মাথায় তার অফিসের প্রায় তিরিশ জন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে আজ।
আমরা যারা দেশের বাইরে চলে আসতে পেরেছি, অনেক সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি এই ভেবে যে যাক নিরাপত্তাহীন দেশ ছেড়ে চলে আসতে পেরেছি। আসলেই কি আসা হয়েছে? পরিবার-পরিজন সবাইতো রয়ে গেছে বাংলাদেশেই। নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয়ও তা এড়াতে পারে না, দেশে কিছু হলে তার রেশও আমরা সরাতে পারি না। আগুনের উত্তাপটা ঠিকই গায়ে এসে লাগে। না লেগে উপায়ও নেই যে। লতায়-পাতায় সবাই যে জড়িয়ে আমরা।
সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যান। কিন্তু ঘন ধোঁয়ার কারণে আর সম্ভব হয়নি। ফিরে যান ভেতরেই। তারপর শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি। কিছু সময়ের ব্যবধান মাত্র। এরপরও বকুল মাথা ঠান্ডা রেখেছেন। কীভাবে? সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন বকুলের ভাই প্রবাসী ফরিদ আহমেদ। এ নিয়ে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
ফরিদ আহমদের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো-
‘তোমাদের দেশে আগুন লেগেছে। জানো নাকি?’ অফিসে ঢুকেই আমার এক সার্বিয়ান সহকর্মী আমাকে বললো। সে দেরি করে অফিসে এসেছে। বেলা তখন এগারোটা। ‘নাতো। কোথায়?’ আমি বলি। ‘বড় একটা বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। আল জাজিরায় দেখাচ্ছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তোমাদের দেশেতো কয়দিন আগেও আগুন লেগেছিল, তাই না। প্রেটি ব্যাড।’
ওর কথায় সমর্থন জানাই আমি। চট করে ডেইলি স্টার খুলে ঢাকার অবস্থাটা জেনে নিই। দেখি বনানীর একটা টাওয়ারে আগুন লেগেছে। মন খারাপ করতে গিয়েও করি না। তার বদলে কাজে ডুবে যাই আমি। বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই, চিন্তা-টিন্তা না করাটাই ভালো।
গত কিছুদিন ধরে ভয়ঙ্কর ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে আমার। ভোর না হতেই কাজের দিকে দৌড় দেই। বাসায় ফিরি রাত সেই এগারোটায়। দুনিয়াদারীর কী হচ্ছে, কিছুই জানি না বলতে গেলে আমি।
স্পর্শকাতর তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয় বলে অফিসে আমরা ফোন ব্যবহার করতে পারি না। এমনকি ডেস্কের উপরেও ফোন রাখা নিষিদ্ধ। আমি ড্রয়ারের মধ্যে ফোনটাকে রাখি। মাঝে মাঝে ড্রয়ার খুলে চুপি চুপি দেখি কোনো মেসেজ আছে কিনা।
বিকাল চারটার দিকে দেখি আন্না মেসেজ করেছে আমাকে। ‘আগুনের হাত থেকে বকুল কোনো মতে বেঁচে গেছে। ওদের অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে।’
বকুল আমার ছোট ভাই। এক ঝটকায় ফোনটা হাতে নিয়েই বাইরে চলে আসি আমি। বকুলকে ফোন দেই। ওকে পাই না। ঢাকায় তখন অনেক রাত। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। বকুলকে না পেয়ে ওর স্ত্রী নোভাকে মেসেজ দেই আমি। নোভার কাছ থেকেও কোনো উত্তর পাই না। রাত নয়টার দিকে অফিস থেকে বের হয়েই আবার কল দেই। তখনও ফোন ধরে না কেউ। আমি ক্রমাগত ফোন দিয়ে যেতে থাকি। সাড়ে নয়টার দিকে ঘুম জড়ানো গলায় ফোন ধরে বকুল। ওর কাছ থেকে পুরো বিবরণ শুনি।
বকুলের অফিস দশ তলায়। ওদের বেশ কয়েকটা অফিস রয়েছে ওই বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলায়। সে অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার। আগুন লেগেছিল নয় তলার কিচেনে। ওটা বকুলের রুমের ঠিক নিচেই। হইচই শুনে সে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে নিচে তাকায়। দেখে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছে নিচে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে আগুনও দেখতে পায় সে। দ্রুত গিয়ে অফিসের সবাইকে খবর দেয়। আমার চাচাতো ভাই রঞ্জুও এই কোম্পানির সিএফও। তার অফিস দুই তিনটা বিল্ডিং পরে অন্য একটা বিল্ডিংয়ে। আগুন লাগার খবর পেয়ে রঞ্জু ততক্ষণে বিল্ডিংয়ের নিচে চলে এসেছে। ওখান থেকে সে বকুলকে ফোন করে বলছে, ‘আট আর নয় তলায় আগুন লেগেছে। ফায়ার ব্রিগেড এসেছে। কিন্তু কাজ শুরু করতে দেরি হবে। তুই অফিসের সবাইকে নিয়ে ছাদের দিকে চলে যা।
অফিসের মেইন দরজা খুলে দুই চারজন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় উপরে কিংবা নিচের দিকে যাবার জন্য। কিন্তু পুরো সিঁড়ি তখন ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ওই ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে কারো পক্ষেই কোনো দিকে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই ফিরে আসে অফিসের ভিতরে।
সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব হবে না ভেবে চার-পাঁচজন বাদে সবাইকে নিয়ে অফিসের অন্য-প্রান্তে চলে যায় বকুল। এই চার-পাঁচজন গিয়ে আশ্রয় নেয় বোর্ড-রুমে। বোর্ড-রুমের দরজা আটকে রাখলে ধোঁয়া ঢুকবে না এই যুক্তি দিয়ে সেখানে ঢুকে যায় তারা। এর মধ্যে একজন মহিলাও ছিল।
অফিসের অন্য প্রান্তে ওদের একটা বাথরুম আছে। এই বাথরুমে জানালা কাঁচের। তবে কাঁচের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিলও রয়েছে। জানালার গা-ঘেঁষেই পাশের বিল্ডিং। সেই বিল্ডিংয়ে-ও একটা জানালা আছে। যদিও সেটা পুরোপুরি এই জানালার মুখোমুখি না। কিন্তু ভাঙতে পারলে এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে চলে যাওয়া সম্ভব।
স্ট্যান্ড ফ্যানের স্ট্যান্ড দিয়ে সেই গ্রিল ভাঙার নির্দেশনা দেয় সে। কয়েকজন তরুণ কর্মচারী বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। ‘এ দিয়ে এই গ্রিল ভাঙা সম্ভব না ভাইয়া।’ হতাশ কণ্ঠে বলে তারা। বকুল হাল ছাড়তে রাজি হয় না। ‘নিশ্চয় ভাঙা যাবে। ভাঙতে হবেই। নইলে সবার আগুনে পুড়ে মরা লাগবে।’
ক্রমাগত গ্রিলে আঘাত করা শুরু হয় আবার। কাজ হয় এতে ভেঙে যায় গ্রিল। লোহার একটা টুকরো দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়েরও কাঁচ ভাঙা হয়। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ভিন্ন জিনিস। ওই জানালাতেও গ্রিল দেয়া। ওদের হাতের ফ্যানের স্ট্যান্ড বা লোহার টুকরো দিয়ে ওখানে শক্ত করে আঘাত করা সম্ভব হচ্ছে না। আগুন লেগেছে দেখে ওই বিল্ডিংয়ের লোকজনও ভয়ে নেমে গেছে। চিৎকার করে ডাকাডাকি করেও কেউ আসে না।
এর মধ্যে রঞ্জু আবার ফোন দেয়। ছাদে যাওয়ার কথা বলে। বকুল বলে, ছাদে যাওয়া সম্ভব না এই ধোঁয়ার মধ্যে। আপনি বরং পাশের বিল্ডিংয়ে লোক পাঠান। আমরা এপাশে জানালা ভেঙেছি। কিন্তু ওপাশেরটা ভাঙতে পারছি না। রঞ্জু সঙ্গে সঙ্গেই চার-পাঁচজনকে পাঠায় পাশের বিল্ডিংয়ে। কিন্তু তারা খালি হাতে এসেছে। গ্রিল ভাঙার কিছু সঙ্গে নেই। এপাশ থেকে লোহার রড দেয়া হয় ওদের কাছে। সেটা দিয়ে গ্রিল ভাঙার বহুক্ষণ চেষ্টা করে তারা। কিন্তু কিছুতেই গ্রিল ভাঙে না। একপর্যায়ে গিয়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তারা। ‘এই গ্রিল ভাঙা সম্ভব নয়।’
বকুল চাপ দেয় ওদের। ‘চেষ্টা করে যান। অবশ্যই ভাঙবে। এতগুলো মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছে, হাল ছেড়েন না।’
ওর কথা শুনে আবারও গ্রিলের ওপরে আঘাত হানতে থাকে তারা। হঠাৎ করে একটা গ্রিল ভেঙে যায়। এক দেড় ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। এটা দেখে প্রবল উৎসাহে দ্বিতীয়টার ওপর আঘাত হানতে থাকে তারা। এটা ভাঙতেও বেশি সময় লাগে না। মানুষ ঢোকার মতো জায়গা তৈরি হয়ে যায়। এখান দিয়ে বের হয়ে পা এগিয়ে দেয় একেকজন আর অন্যপাশ থেকে ধরে তাদের পাশে বিল্ডিং এ নিয়ে যাওয়া হয়।
এর মধ্যে ফায়ার ব্রিগেডের লোকও চলে এসেছে। বকুল ওদের বোর্ড- রুমে আশ্রয় নেয়া চার-পাঁচজনের দলের কথা বলে। তাদের উদ্ধার করার জন্য অনুরোধ জানায়। ফায়ার ব্রিগেডের লোক এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে যেতে শুরুতে অস্বীকার করে। কিন্তু ওদের চাপাচাপিতে রাজি হয়। গিয়ে দেখে, সেই মানুষগুলো বাথরুমের কাছে এসে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মহিলাটা পুরোপুরিই অজ্ঞান। সবাইকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয়।
বিল্ডিংয়ে থাকা অবস্থাতেই বকুল নোভাকে কল দিয়েছিল। বলেছিল আটকা পড়েছে সে। বিল্ডিং এর নিচে এসে আবার কল দিয়ে জানায়, সে বের হতে পেরেছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চার্জ শেষ হয়ে যায় ওর ফোনের। নোভা ওকে কল করে না পেয়ে ভেবে নিয়েছে বকুল তাকে মিথ্যা কথা বলেছে। আসলে বিল্ডিংয়ে আটকে গিয়েছে সে। উন্মত্ত অবস্থায় সে নিজেও রওনা দিয়ে দিয়েছে বনানীর দিকে। তার বোনকেও বলেছে বনানীর দিকে যেতে। বোন তার আগেই চলে এসেছে বনানীতে। তিনি এসে দেখেন এক লোক আগুনের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে পাইপ ধরে ধরে নামছিল। কিন্তু, হাত ফসকে পড়ে গিয়েছে। লম্বা ধরনের মানুষ আর গায়ের শার্ট দেখে দূর থেকে দেখে তার মনে হয়েছে বকুল বোধ হয় পড়ে গিয়েছে বিল্ডিং থেকে। তিনি নোভাকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইয়ার মতো শার্ট গায়ে লম্বা একটা লোক পড়ে গেছে দশ তলা থেকে। ভাইয়াই কিনা বুঝতে পারছি না।’
শুধু নোভা একা না। আমার ভাই-বোনেরাও তখন সবাই অস্থির, উদ্বিগ্ন। ভাই-ভাগ্নেরা যে যেখানে আছে সবাই তখন বনানীর দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে। বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি।
নিজের ভাই বলে বলছি না। এই ভয়াবহ আগুন থেকে সে শুধু নিজে বাঁচেনি, বুদ্ধি করে ঠান্ডা মাথায় তার অফিসের প্রায় তিরিশ জন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে আজ।
আমরা যারা দেশের বাইরে চলে আসতে পেরেছি, অনেক সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি এই ভেবে যে যাক নিরাপত্তাহীন দেশ ছেড়ে চলে আসতে পেরেছি। আসলেই কি আসা হয়েছে? পরিবার-পরিজন সবাইতো রয়ে গেছে বাংলাদেশেই। নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয়ও তা এড়াতে পারে না, দেশে কিছু হলে তার রেশও আমরা সরাতে পারি না। আগুনের উত্তাপটা ঠিকই গায়ে এসে লাগে। না লেগে উপায়ও নেই যে। লতায়-পাতায় সবাই যে জড়িয়ে আমরা।
No comments