রিজিক পুড়ে ছাই: গুলশানে ডিএনসিসি মার্কেটে আগুনে পুড়লো ২১১ দোকান by মারুফ কিবরিয়া
by মারুফ কিবরিয়া, জিয়া চৌধুরী ও পিয়াস সরকারঃ
সবুজ শাক-সবজি পুড়ে কালো ছাই, অঙ্গার হয়েছে ভুট্টার মোচা থেকে জ্যান্ত
মাছও। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গলে ধাতব নানা তৈজসপত্রও ধারণ করেছে
বিবর্ণ রূপ। শুধু কি মালামাল? আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি
করপোরেশন (ডিএনসিসি) কাঁচাবাজার ও কিচেন মার্কেটের ২১১ দোকান মালিকের
স্বপ্নও। শনিবার ভোর পৌনে ছয়টার দিকে মার্কেটটিতে আগুন লাগে। পরে ফায়ার
সার্ভিসের ২০টি ইউনিট গিয়ে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিচেন মার্কেটের পাশের গুলশান শপিং সেন্টারের বেশ
কয়েকটি দোকানও। তবে, আগুনে কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও পুড়ে গেছে ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানের মালামাল। এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আগুনে পুড়ে ছাই
হয়েছিল মার্কেটটি।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, ধার-কর্জ করে ব্যবসায়ীরা গত দুই বছরে ফের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন।
এরমধ্যেই আবার আগুনের হানায় তাদের সামনে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেল। আগুনে প্রাণহানি না হলেও বেঁচে থাকার সম্বল পুড়ে যাওয়ায় সেখানে অনেক ব্যবসায়ীকে ডুকরে কাঁদতে দেখা যায়। পোড়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ চোখের পানি ফেলেছেন নীরবে। ডিএনসিসির নিয়ন্ত্রণে থাকা টিনশেড মার্কেটটির একেবারে পুরোটাই এখন ধ্বংসস্তূপ। অথচ ২০১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি আগুন লাগার পর আবারো কেন এমন আগুন লাগলো সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থারগুলোর গাফিলতি ও পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকারও অভিযোগ করেছেন তারা। সেবার আগুন লাগার পর গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় চালানো এক জরিপে ডিএনসিসি মার্কেটকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গতকাল সরজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায় আগুনে কম ক্ষতি হওয়া বিভিন্ন মালামাল সরাতে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা। ব্যবসায়ীদের বাইরেও অনেকে মার্কেট থেকে এসব পণ্য সরিয়ে সামনে নিলামে তোলেন। আশেপাশের অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষজন কিনে নেন তৈজসপত্রসহ গৃহস্থালি নানা পণ্য।
গতকাল বিকাল পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন ব্যবসায়ী তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে তথ্য দিয়েছেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বেশির ভাগ দোকানে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন। এ ছাড়া, অনেক বড় দোকান ও একাধিক দোকান মালিক ব্যবসায়ীর ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে যায়। আবার কয়েকজন ব্যবসায়ীর দোকানে কোটি টাকার উপরে মালামাল ছিল বলে জানিয়েছেন। আগুনে সবমিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। সরজমিন মার্কেটটি ঘুরে দেখা যায় উত্তর পাশের সামনের দিকের দোকানগুলোর কাঠামো কিছুটা ঠিক থাকলেও ভেতরের সব মালামাল পুড়ে গেছে। সামনে থাকা গুলশান শপিং সেন্টারের দক্ষিণ পাশের বেশ কয়েকটি দোকানও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দোকানগুলোর সামনের দিকে থাকা মালামাল পুড়ে গেলেও ভেতরে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। মার্কেটের ভেতরে গেলে চোখে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ, কোনো দোকানের কাঠামো নেই। আগুনে সব ভেঙে পড়েছে। শুধু ছাদের কয়েকটি টিন আছে, সেগুলোও আগুনে বেঁকে তামাটে বর্ণ নিয়েছে। মার্কেটের মাঝের একটি দোকান থেকে মূলত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী।
শাহীন জেনারেল স্টোরে অন্যতম স্বত্বাধিকারী আকাশ মানবজমিনকে জানান তার দোকানে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল খাদ্যপণ্য, গুঁড়োদুধ ও মুদি সামগ্রী। তিনি বলেন, মাঝের সারির ‘শাহীন পান বিতান’ নামে একটি দোকান থেকে আগুন ছড়িয়েছে। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শাহীন পান বিতানের সামনে গিয়ে দেখা যায় আগুনে পুরো দোকান ছারখার। আশেপাশের কয়েকটি দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। মার্কেটের দক্ষিণ দিকে থাকা কাঁচাবাজারও আগুন থেকে রেহাই পায়নি। এখানকার ৩০টি দোকানের ফল, সবজি, মাছ ও ডিম আগুনে পুড়ে যায়। খুব ভোরে আগুন লাগায় কাঁচাবাজার ছাড়া আর অন্য অংশের ব্যবসায়ীরা মার্কেটে ছিলেন না। ভোরবেলা কাঁচাবাজার নিয়ে এসে সকাল থেকে কেনাকাটা করতে হয় বলে কয়েকজন দোকানি রাতে সেখানে থাকেন। তবে আগুন লাগার পর তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। এদের একজন লিটন জানান, তিনি মার্কেটটিতে সবজির দোকান চালাতেন। অন্য সব দোকানিদের মতো তিনিও কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখানে ব্যবসা করতেন।
আগুনে সব পুড়ে যাওয়ায় তার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বলেও জানান তিনি। অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাদের হতাশা ও ক্ষোভের কথা টের পাওয়া যায়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ও গাফিলতির কারণে দোকান মালিক সমিতি এবং সিটি করপোরেশনকে দায়ী করেন তারা। আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ধারদেনা করে এখানে একটা দোকানে বিনিয়োগ করি। নিয়মিত সব ট্যাক্স, খাজনাও দেই। তবে আমাদের নিরাপত্তার কথা কেন চিন্তা করা হয় না। পরিবার-স্বজনদের নিয়ে এখন পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একজনের জোর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কাছে গিয়ে দেখা গেল এক ব্যবসায়ী টুলে বসে কিছুক্ষণ পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তার সঙ্গে থাকা একজন নারী বারবার তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কথা বলে জানা গেল, মোহাম্মদ ইউসুফ নামে এ ব্যবসায়ীর ছয়টি দোকান পুরোপুরি পুড়ে গেছে। একটি দোকান নিজের হলেও বাকি পাঁচটি দোকান ভাড়ায় চালাতেন ইউসুফ। যেখানে কাজ করতেন ১১ জন।
শুক্রবার রাত সাড়ে দশটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড্ডার বাসায় যান। তখনো সবকিছু ঠিকঠাকই রেখে গিয়েছিলেন। শনিবার সকালে আবার এসে দোকান খোলার কথা ছিল। অথচ শনিবার ভোরবেলা লাগা আগুনে তার ছয়টি দোকানই পুড়ে যায়। এসব দোকানে প্রায় কোটি টাকার মালামাল ছিল বলে দাবি তার। তবে শুধু এবারই নয় ২০১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি ডিএনসিসি মার্কেটের ভয়াবহ আগুনেও প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল ইউসুফ ও তার দুই ভাইয়ের। তার বড় ভাইয়েরা ১৯৯২ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করলেও তিনি ২০০০ সালে তাদের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেন। ২০১৭ সালের আগুনের পর আবার নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিলেও এবারের আগুনের পর কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তার উত্তর জানা নেই ইউসুফের কাছে। তবে, দ্রুত সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দোকানগুলো পুনঃনির্মাণ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান অশ্রুসজল নয়নে। ডিএনসিসি কাঁচাবাজার ও কিচেন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দীন মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম জানান, দ্রুত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এদিকে, ২০১৭ সালে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকার স্থাপনাগুলোর অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ করে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধের সক্ষমতা যাচাইয়ে ভবনগুলোর ভূগর্ভস্থ জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও প্রয়োজনীয় লিফটের উপস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আর অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার অধিক প্রস্তুতি আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘সন্তোষজনক’ বলে চিহ্নিত করে দেয় সংস্থাটি। ফায়ার সার্ভিসের মূল্যায়নে গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাণিজ্যিক ভবনগুলোর মধ্যে ৪৬টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে দ্রুত সময়ে অগ্নি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে সংস্থাটি। যার মধ্যে গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটটিকেও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভবন ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের একাধিকবার চিঠিও দেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই সেগুলো কার্যকর করেনি।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, ধার-কর্জ করে ব্যবসায়ীরা গত দুই বছরে ফের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন।
এরমধ্যেই আবার আগুনের হানায় তাদের সামনে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেল। আগুনে প্রাণহানি না হলেও বেঁচে থাকার সম্বল পুড়ে যাওয়ায় সেখানে অনেক ব্যবসায়ীকে ডুকরে কাঁদতে দেখা যায়। পোড়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ চোখের পানি ফেলেছেন নীরবে। ডিএনসিসির নিয়ন্ত্রণে থাকা টিনশেড মার্কেটটির একেবারে পুরোটাই এখন ধ্বংসস্তূপ। অথচ ২০১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি আগুন লাগার পর আবারো কেন এমন আগুন লাগলো সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থারগুলোর গাফিলতি ও পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকারও অভিযোগ করেছেন তারা। সেবার আগুন লাগার পর গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় চালানো এক জরিপে ডিএনসিসি মার্কেটকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গতকাল সরজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায় আগুনে কম ক্ষতি হওয়া বিভিন্ন মালামাল সরাতে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা। ব্যবসায়ীদের বাইরেও অনেকে মার্কেট থেকে এসব পণ্য সরিয়ে সামনে নিলামে তোলেন। আশেপাশের অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষজন কিনে নেন তৈজসপত্রসহ গৃহস্থালি নানা পণ্য।
গতকাল বিকাল পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন ব্যবসায়ী তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে তথ্য দিয়েছেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বেশির ভাগ দোকানে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন। এ ছাড়া, অনেক বড় দোকান ও একাধিক দোকান মালিক ব্যবসায়ীর ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে যায়। আবার কয়েকজন ব্যবসায়ীর দোকানে কোটি টাকার উপরে মালামাল ছিল বলে জানিয়েছেন। আগুনে সবমিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। সরজমিন মার্কেটটি ঘুরে দেখা যায় উত্তর পাশের সামনের দিকের দোকানগুলোর কাঠামো কিছুটা ঠিক থাকলেও ভেতরের সব মালামাল পুড়ে গেছে। সামনে থাকা গুলশান শপিং সেন্টারের দক্ষিণ পাশের বেশ কয়েকটি দোকানও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দোকানগুলোর সামনের দিকে থাকা মালামাল পুড়ে গেলেও ভেতরে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। মার্কেটের ভেতরে গেলে চোখে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ, কোনো দোকানের কাঠামো নেই। আগুনে সব ভেঙে পড়েছে। শুধু ছাদের কয়েকটি টিন আছে, সেগুলোও আগুনে বেঁকে তামাটে বর্ণ নিয়েছে। মার্কেটের মাঝের একটি দোকান থেকে মূলত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী।
শাহীন জেনারেল স্টোরে অন্যতম স্বত্বাধিকারী আকাশ মানবজমিনকে জানান তার দোকানে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল খাদ্যপণ্য, গুঁড়োদুধ ও মুদি সামগ্রী। তিনি বলেন, মাঝের সারির ‘শাহীন পান বিতান’ নামে একটি দোকান থেকে আগুন ছড়িয়েছে। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শাহীন পান বিতানের সামনে গিয়ে দেখা যায় আগুনে পুরো দোকান ছারখার। আশেপাশের কয়েকটি দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। মার্কেটের দক্ষিণ দিকে থাকা কাঁচাবাজারও আগুন থেকে রেহাই পায়নি। এখানকার ৩০টি দোকানের ফল, সবজি, মাছ ও ডিম আগুনে পুড়ে যায়। খুব ভোরে আগুন লাগায় কাঁচাবাজার ছাড়া আর অন্য অংশের ব্যবসায়ীরা মার্কেটে ছিলেন না। ভোরবেলা কাঁচাবাজার নিয়ে এসে সকাল থেকে কেনাকাটা করতে হয় বলে কয়েকজন দোকানি রাতে সেখানে থাকেন। তবে আগুন লাগার পর তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। এদের একজন লিটন জানান, তিনি মার্কেটটিতে সবজির দোকান চালাতেন। অন্য সব দোকানিদের মতো তিনিও কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখানে ব্যবসা করতেন।
আগুনে সব পুড়ে যাওয়ায় তার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বলেও জানান তিনি। অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাদের হতাশা ও ক্ষোভের কথা টের পাওয়া যায়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ও গাফিলতির কারণে দোকান মালিক সমিতি এবং সিটি করপোরেশনকে দায়ী করেন তারা। আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ধারদেনা করে এখানে একটা দোকানে বিনিয়োগ করি। নিয়মিত সব ট্যাক্স, খাজনাও দেই। তবে আমাদের নিরাপত্তার কথা কেন চিন্তা করা হয় না। পরিবার-স্বজনদের নিয়ে এখন পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একজনের জোর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কাছে গিয়ে দেখা গেল এক ব্যবসায়ী টুলে বসে কিছুক্ষণ পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তার সঙ্গে থাকা একজন নারী বারবার তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কথা বলে জানা গেল, মোহাম্মদ ইউসুফ নামে এ ব্যবসায়ীর ছয়টি দোকান পুরোপুরি পুড়ে গেছে। একটি দোকান নিজের হলেও বাকি পাঁচটি দোকান ভাড়ায় চালাতেন ইউসুফ। যেখানে কাজ করতেন ১১ জন।
শুক্রবার রাত সাড়ে দশটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড্ডার বাসায় যান। তখনো সবকিছু ঠিকঠাকই রেখে গিয়েছিলেন। শনিবার সকালে আবার এসে দোকান খোলার কথা ছিল। অথচ শনিবার ভোরবেলা লাগা আগুনে তার ছয়টি দোকানই পুড়ে যায়। এসব দোকানে প্রায় কোটি টাকার মালামাল ছিল বলে দাবি তার। তবে শুধু এবারই নয় ২০১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি ডিএনসিসি মার্কেটের ভয়াবহ আগুনেও প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল ইউসুফ ও তার দুই ভাইয়ের। তার বড় ভাইয়েরা ১৯৯২ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করলেও তিনি ২০০০ সালে তাদের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেন। ২০১৭ সালের আগুনের পর আবার নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিলেও এবারের আগুনের পর কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তার উত্তর জানা নেই ইউসুফের কাছে। তবে, দ্রুত সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দোকানগুলো পুনঃনির্মাণ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান অশ্রুসজল নয়নে। ডিএনসিসি কাঁচাবাজার ও কিচেন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দীন মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম জানান, দ্রুত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এদিকে, ২০১৭ সালে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকার স্থাপনাগুলোর অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ করে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধের সক্ষমতা যাচাইয়ে ভবনগুলোর ভূগর্ভস্থ জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও প্রয়োজনীয় লিফটের উপস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আর অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার অধিক প্রস্তুতি আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘সন্তোষজনক’ বলে চিহ্নিত করে দেয় সংস্থাটি। ফায়ার সার্ভিসের মূল্যায়নে গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাণিজ্যিক ভবনগুলোর মধ্যে ৪৬টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে দ্রুত সময়ে অগ্নি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে সংস্থাটি। যার মধ্যে গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটটিকেও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভবন ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের একাধিকবার চিঠিও দেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই সেগুলো কার্যকর করেনি।
No comments