খরস্রোতা করতোয়া এখন মরা খাল by আনোয়ার পারভেজ
- • নদী দখল করে স্থাপনা গড়ায় সংকুচিত হচ্ছে করতোয়া।
- • ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্যের দূষণে কালো হয়ে গেছে পানি।
- • দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা নদীপারের মানুষের।
- • জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো অক্সজিন নেই নদীতে।
একসময়
খরস্রোতা এই নদীতে নৌকা চলত, জেলেরা মাছ ধরতেন, নৌকাবাইচে মেতে উঠত
নদীপারের মানুষ। নদী ঘিরেই ছিল এখানকার কৃষি, অর্থনীতি, যোগাযোগ ও
সংস্কৃতি।
বগুড়ার ‘হৃৎপিণ্ড’ বলে পরিচিতি সেই করতোয়া এখন দখল-দূষণে শ্রীহীন ও গতিহারা মরা খাল। নদীর জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরি করায় প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে করতোয়া। ময়লা-আবর্জনা, কারখানার তরল বর্জ্য ফেলার করণে দূষণে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে পানি। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা নদীপারের মানুষের। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো অক্সজিনেও নেই নদীতে।
বগুড়া শহরের বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণ আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ করতোয়া। পরিবেশবাদী ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করতোয়ার অবস্থা খুবই নাজুক। উৎসমুখে জলকপাটের (স্লুইসগেট) কারণে অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। এখন পাল্লা দিয়ে চলছে দখল ও দূষণ।
বগুড়ার ডেমাজানি মৎস্যজীবী সমিতির সহসভাপতি নিত্যনন্দ দাস বলেন, দুই যুগ আগেও করতোয়ায় স্রোতোধারা ছিল। নদীতে জাল ফেললেই হরেক প্রজাতির মাছ মিলত। ৩০ বছরে এই নদী থেকে কমপক্ষে ২০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত।
কবি ও প্রাবন্ধিক বজলুল করিম বাহার বলেন, গঙ্গার চেয়েও তিন গুণ বড় ছিল করতোয়া। দখল–দূষণে করতোয়া এখন মরা খাল। করতোয়ার উজান-ভাটি—সবখানেই শত্রু।
দূষণে বিপর্যস্ত করতোয়া
শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ায় করতোয়ার পানিদূষণও সবচেয়ে বেশি বগুড়াতেই। দূষণের শুরু শহরতলির ঠেঙ্গামারায়। এখানে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস নদীতে নানা ধরনের বর্জ্য ফেলে। পিছিয়ে নেই বগুড়া পৌরসভাও। পৌরসভার নালা দিয়ে সারা বছর করতোয়া তরল বর্জ্য পড়ছে, কয়েকটি স্থানের ময়লা-আবর্জনাও নদীতে ফেলছে পৌরসভা। শহরের অদূরে শাজাহানপুর উপজেলায় ভাদাই খাল মিশেছে করতোয়ায়। এই ভাদাই খাল দিয়ে সারা বছর বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য করতোয়ায় পড়ছে। সুবিল খালের তরল বর্জ্যও পড়ছে এই নদীতে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বগুড়া জেলা কমিটির সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, করতোয়ার মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর অন্যতম কারণ শহরের নালা-নর্দমার পানি নদীতে ফেলা।
দখলদারের কবলে করতোয়া
করতোয়া নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে জেলা প্রশাসন দীর্ঘদিন আগে উদ্যোগ নিলেও কোনো ফল আসেনি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় শহর ও শহরতলির বিভিন্ন অংশে করতোয়া নদী দখলকারীর তালিকা তৈরি করে। ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৩৮ জন দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। এর আগে জেলা প্রশাসন ২৭ দখলদার চিহ্নিত করে আরও একটি তালিকা করেছিল। ওই তালিকা ধরে হাতে গোনা দু–একটি স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছিল। তবে সেই অভিযানের পর নদীর জায়গা ফের দখল হয়।
সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে ৩০ দখলদারের একটি আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও নদী কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তা নোটিশ বোর্ড কিংবা শহরের জনবহুল স্থানে টানানো হয়নি। আর পরিবেশবাদীরা এই তালিকাকে অসম্পূর্ণ বলে অভিযোগ তুলেছেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলীমুন রাজীব বলেন, অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় জন্য বড় অঙ্কের তহবিল প্রয়োজন। নতুন তালিকায় পুরোনো অনেক দখলদারের নাম নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই নতুন করে চলছে দখল।
হাইকোর্টের নির্দেশও উপেক্ষিত
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) করতোয়ার দখলদার উচ্ছেদ ও পানির প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখতে ২০১৫ সালের ২২ জুন জেলা প্রশাসকসহ ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নদীতে সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধ এবং দূষণ রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন বগুড়া পৌরসভাকে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির খুলশীতে করতোয়া নদীর উৎসমুখে নির্মিত জলকপাটের পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয় করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাউবোকে নির্দেশ দেন আদালত। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে সমন্বিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চেয়ে জেলা প্রশাসন, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী, বগুড়া পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কয়েক দফা চিঠি পাঠানো হয়েছে।
পাউবোর বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন নদীতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সিএস নকশা অনুযায়ী নদী খনন করা ছাড়াও পানি ধরে রাখার জন্য ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পর্যায়ে রয়েছে। এর মাধ্যমে নদীর উৎসমুখে নতুন করে জলকপাট নির্মাণ ছাড়াও বগুড়া শহরে নদীর দুই তীরে ২৭ কিলোমিটার নালাসহ সড়ক নির্মাণ, তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হবে।
বগুড়ার ‘হৃৎপিণ্ড’ বলে পরিচিতি সেই করতোয়া এখন দখল-দূষণে শ্রীহীন ও গতিহারা মরা খাল। নদীর জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরি করায় প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে করতোয়া। ময়লা-আবর্জনা, কারখানার তরল বর্জ্য ফেলার করণে দূষণে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে পানি। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা নদীপারের মানুষের। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো অক্সজিনেও নেই নদীতে।
বগুড়া শহরের বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণ আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ করতোয়া। পরিবেশবাদী ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করতোয়ার অবস্থা খুবই নাজুক। উৎসমুখে জলকপাটের (স্লুইসগেট) কারণে অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। এখন পাল্লা দিয়ে চলছে দখল ও দূষণ।
বগুড়ার ডেমাজানি মৎস্যজীবী সমিতির সহসভাপতি নিত্যনন্দ দাস বলেন, দুই যুগ আগেও করতোয়ায় স্রোতোধারা ছিল। নদীতে জাল ফেললেই হরেক প্রজাতির মাছ মিলত। ৩০ বছরে এই নদী থেকে কমপক্ষে ২০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত।
কবি ও প্রাবন্ধিক বজলুল করিম বাহার বলেন, গঙ্গার চেয়েও তিন গুণ বড় ছিল করতোয়া। দখল–দূষণে করতোয়া এখন মরা খাল। করতোয়ার উজান-ভাটি—সবখানেই শত্রু।
দূষণে বিপর্যস্ত করতোয়া
শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ায় করতোয়ার পানিদূষণও সবচেয়ে বেশি বগুড়াতেই। দূষণের শুরু শহরতলির ঠেঙ্গামারায়। এখানে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস নদীতে নানা ধরনের বর্জ্য ফেলে। পিছিয়ে নেই বগুড়া পৌরসভাও। পৌরসভার নালা দিয়ে সারা বছর করতোয়া তরল বর্জ্য পড়ছে, কয়েকটি স্থানের ময়লা-আবর্জনাও নদীতে ফেলছে পৌরসভা। শহরের অদূরে শাজাহানপুর উপজেলায় ভাদাই খাল মিশেছে করতোয়ায়। এই ভাদাই খাল দিয়ে সারা বছর বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য করতোয়ায় পড়ছে। সুবিল খালের তরল বর্জ্যও পড়ছে এই নদীতে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বগুড়া জেলা কমিটির সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, করতোয়ার মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর অন্যতম কারণ শহরের নালা-নর্দমার পানি নদীতে ফেলা।
দখলদারের কবলে করতোয়া
করতোয়া নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে জেলা প্রশাসন দীর্ঘদিন আগে উদ্যোগ নিলেও কোনো ফল আসেনি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় শহর ও শহরতলির বিভিন্ন অংশে করতোয়া নদী দখলকারীর তালিকা তৈরি করে। ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৩৮ জন দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। এর আগে জেলা প্রশাসন ২৭ দখলদার চিহ্নিত করে আরও একটি তালিকা করেছিল। ওই তালিকা ধরে হাতে গোনা দু–একটি স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছিল। তবে সেই অভিযানের পর নদীর জায়গা ফের দখল হয়।
সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে ৩০ দখলদারের একটি আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও নদী কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তা নোটিশ বোর্ড কিংবা শহরের জনবহুল স্থানে টানানো হয়নি। আর পরিবেশবাদীরা এই তালিকাকে অসম্পূর্ণ বলে অভিযোগ তুলেছেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলীমুন রাজীব বলেন, অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় জন্য বড় অঙ্কের তহবিল প্রয়োজন। নতুন তালিকায় পুরোনো অনেক দখলদারের নাম নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই নতুন করে চলছে দখল।
হাইকোর্টের নির্দেশও উপেক্ষিত
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) করতোয়ার দখলদার উচ্ছেদ ও পানির প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখতে ২০১৫ সালের ২২ জুন জেলা প্রশাসকসহ ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নদীতে সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধ এবং দূষণ রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন বগুড়া পৌরসভাকে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির খুলশীতে করতোয়া নদীর উৎসমুখে নির্মিত জলকপাটের পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয় করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাউবোকে নির্দেশ দেন আদালত। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে সমন্বিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চেয়ে জেলা প্রশাসন, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী, বগুড়া পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কয়েক দফা চিঠি পাঠানো হয়েছে।
পাউবোর বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন নদীতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সিএস নকশা অনুযায়ী নদী খনন করা ছাড়াও পানি ধরে রাখার জন্য ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পর্যায়ে রয়েছে। এর মাধ্যমে নদীর উৎসমুখে নতুন করে জলকপাট নির্মাণ ছাড়াও বগুড়া শহরে নদীর দুই তীরে ২৭ কিলোমিটার নালাসহ সড়ক নির্মাণ, তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হবে।
No comments