কাশ্মির সংঘাতের বলি সীমান্তবাসী: আতঙ্কে কেবল মানুষ নয়, কেঁপে ওঠে ঘরের দরজা-জানালাও
যে
সীমান্তরেখায় বিভক্ত হয়ে কাশ্মির চিরবৈরী দুই দেশের অংশ হয়েছে; সেখানে
ভারতীয় অংশের শেষ গ্রাম সিলিকোট। চলমান সংঘাতের ধারাবাহিকতায় গত ২৭
ফেব্রুয়ারি (বুধবার) উরিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ শুরু হলে এর
কবলে পড়ে সেখানকার সবথেকে উত্তর অংশে অবস্থিত গ্রামটি। পাশের গ্রাম
বালাকোটের বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী ইয়াকুব ফিরে যান সেই ২০০১ সালে। সে বছর
সীমান্তের ওপার থেকে ধেয়ে আসা এরকম একটি গোলা আঘাত হেনেছিল তার নিজের
শরীরে। ঘটনাস্থলেই পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। হারিয়েছিলেন চেতনা। রক্তে ভরে
গিয়েছিল মুখ। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন, পঙ্গুত্ব তার
জীবনসঙ্গী হয়েছে। সঙ্গে হারিয়েছেন কানে শোনার সক্ষমতা।
মাঝখানে ১৮ বছরের ব্যবধান রেখে ২০০১ সালের সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন যেন ২০১৯ সালে এসে জেগে উঠেছে নতুন করে। আবারও পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে চলমান ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’য় বলি নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারের সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রনায়কেরা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছে, ছড়াচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের ভীতি, মানুষ তখন ক্রমাগত সংশয়ী হয়ে উঠছে তাদের নিজেদের অস্তিত্বের সুরক্ষা নিয়ে। সীমান্তবাসীর ভাষ্য, আতঙ্কে কেবল মানুষ নয়, কেঁপে ওঠে ঘরের দরজা-জানালাও। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে সামান্য ব্যবধান নিয়ে তারা খুঁজে ফেরেন নিরাপদ আশ্রয়। নিজ ভূমিতেই বাস করেন পরবাসীর জীবন।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম সিলাকোট ও বালকোটজুড়ে বিরাজ করছে নীরব আতঙ্ক। মৃত্যুভয় তাড়া করছে গ্রামবাসীকে। ইয়াকুব আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখানকার বাসিন্দা হওয়ার মানে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। দুই পক্ষের অস্ত্রের ছায়ার মধ্যে আমাদের বসবাস। মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যেতে পারি। এখন গোলাবর্ষণ হলেও আমি কোনও শব্দ পাই না। কেবলই তাকিয়ে দেখতে থাকি।’
২০১৭ সালে সেনাঘাঁটিতে জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ১৭ ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো উরি। পুলওয়ামায় জঙ্গি গোষ্ঠীটির একই ধরনের হামলার পর গত কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা বেড়েছে। ইয়াকুবের আবাস বালাকোট গ্রামটি সিলিকোটের সঙ্গে লাগোয়া। গ্রাম থেকে যেমন পাহাড়ের ওপরের তুষারপাত দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় ভারত-পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতি। পাঁচ সন্তানের বাবা ইয়াকুব বলেন, ‘ গত রাতে রান্না হলেও আতঙ্কে তা মুখে তুলতে পারিনি আমরা। বাড়ির সবাই ভয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে গোলাগুলি হয়তো আরও বাড়বে। বিষয়টা আমাদের দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে মিশে গেছে। ধারাবাহিক গোলাগুলি আমাদের জন্য নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু এবার যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কী হবে?’
সিলিকোটে মোটামুটি ২০টি পরিবারের বসবাস। বালকোটে রয়েছে সাতশ’ পরিবার। বিরোধপূর্ণ অঞ্চলকে দুইভাগ করা নাল্লাহ হাজী পীর নদীর পারে গ্রাম দুটির অবস্থান। অন্যদের উদ্বেগও ইয়াকুবের থেকে আলাদা না। ‘অসুস্থরাই বিপদে পড়ে। আমরা সারাটা জীবনই যুদ্ধের মধ্যে কাটালাম’- বলেন আবদুল কাইয়ুম নামের এক ব্যক্তি।
২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান হামলার ধারাবাহিকতায় পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) সকালে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয় আকাশে। সেই আকাশের নিচে থাকেন যারা, সেসব সীমান্তবাসী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে জীবন শঙ্কার আতঙ্কে। সিলাকোট আর বালাকোটের মানুষেরা এক জায়গায় জড়ো হয় পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে। উঠে আসে বিভিন্ন মতামত। কারও কারও প্রশ্ন ছিল, বসতভিটা ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা।
মোহাম্মদ সিদ্দিক নামে এক শ্রমিক জানান, গ্রামের সবাই জামাকাপড়সহ প্রয়োজনীয় নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী গুছিয়ে রেখেছে। তবে যাওয়ার মতো কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের কথাও জানা নেই তাদের। ‘সবাই বলছে গোলাগুলি বাড়বে... ১৯৯০-এর দশকেরও আগে থেকে আমরা একই পরিস্থিতিতে আছি। প্রত্যেকবার আমাদের কাছে সবথেকে জরুরি প্রশ্ন হয়ে ওঠে, জীবন বাঁচাতে আমরা যাবো কোথায়?’
আন্তঃসীমান্ত সংঘাত বন্ধে ২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে দিল্লি-ইসলামাবাদ। দুই দেশের মানুষের হতাহতের পরিসংখ্যানই বলে দেয় চুক্তি কতোটা মানা হয়েছে। সিদ্দিক বলেন, তিন দশক ধরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বলি হচ্ছে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলো।
গৃহবধূ মেহমুদার ঘরে দুই শিশু সন্তান। একজনের বয়স চার, অন্যজন দশ বছর বয়সী। মেহমুদা জানান, মঙ্গলবার থেকেই আকাশে চক্কর দিচ্ছিলো সামরিক বিমান। তখনই ভয় পেতে শুরু করেন তারা। রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছে সেনাবাহিনী। ‘আমরা সীমান্তে থাকি, ছোট একটা গোলা ছোড়া হলেও তা আমাদের লাগতে পারে। এই উত্তেজনায় আমাদের বাড়ির দেয়াল, জানালা, দরজা সবই ভয় পেতে শুরু করে। ধেয়ে আসা গোলা থেকে কিছুই রক্ষা পাবে না’।
নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গোলাবর্ষণের সময়ে জরুরি আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনও বাঙ্কার নেই তাদের। কাইয়ুম নামের এক বাসিন্দা জানান, তার মেয়ে নিরাপদ কোথাও যেতে চায়। মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কাপড়চোপড় পরে নিরাপদ গন্তব্যের আশায় বসে আছে সে।
কারগিল যুদ্ধের স্মৃতি এখনও জাগ্রত গ্রামবাসীর মনে। সেই সময়ের আন্তঃসীমান্ত গোলাবর্ষণে ভয়াবহ ক্ষতির কবলে পড়ে তাদের বাড়িঘর। উরিতে বহু মানুষের প্রাণ আর সম্পদের হানি ঘটে। গ্রামের আরেক বাসিন্দা আপেক্ষ করেন, ‘অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই হয়ে গেছে বিকলাঙ্গ। আমাদের কেউ মনে রাখেনি। আল্লাহর দয়ায় আমরা বেঁচে আছি।’
বালাকোটে ছোট একটি মুদি দোকানের মালিক ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, বাংকার নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে জীবন শঙ্কা নিত্যসঙ্গী হয়েছে তাদের। ‘গোলাবর্ষণের কারণে আমাদের বাড়িতে ফাটল তৈরি হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য আমাদের বাংকার নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এমনকি যদি অন্য পরিবারের সঙ্গে বাংকার ভাগাভাগি করতে হয়, আমরা তাতেও রাজি, কিন্তু আমরা মরতে চাই না।’
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের ভয়ঙ্কর গোলাগুলির মুখে পড়েছিল উরির বাসিন্দারা। ফারুক স্মৃতি থেকে সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে আনেন। জানান, গোলায় তার ঘরের সামনে থাকা দুই চাকার যানটিতে আগুন ধরে যায়। একটি স্কুল ছিল গ্রামবাসীর চারদিনের আশ্রয়স্থল।
স্থানীয়রা বলছেন, ১৯৯৮ সালেই সীমান্তবর্তী গ্রাম সিলিকোট, বালাকোট, চুরান্দা, ঘারকোট, কালগাই, হাতলাঙ্গা, ওরুসা, গাওয়ালতলা ও বাতগারা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বিপুলসংখ্যক বাসিন্দা। আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময়ে ভয়ে কাঁপছিলেন ৭০ বছরের মিরা বেগম। তিনি জানান, তার সন্তানরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। তার পরিবারেরও কোনও নিরাপত্তা নেই। ‘আমরা কি এই দেশের নাগরিক নই? কেউ কেন আমাদের দিকে তাকায় না? বাড়িতে গুলি আর বোমা পড়তে শুরু করলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা পালাতে থাকি। ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আমরা কাঁদতে থাকি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে একবারে তুলে নিলেই পারে।’ কান্নামিশ্রিত হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে মিরা বলেন, তার ছেলেমেয়েরা চায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বারামুল্লায় তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে চলে যেতে। মিরা বলেন, বারবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কষ্টকর।
এবারের সংঘাত শুরুর পর বাড়িঘরে তালা দিয়ে সিলাকোট ও বালাকোটের বহু বাসিন্দা চলে গেছেন নিরাপত্তার উদ্দেশে। থেকে যাওয়া অল্প কিছু মানুষের একজন আফরোজা (৩৫)। উরি শহরের একটি স্কুলভবনে আশ্রয় নিয়েছেন আফরোজার মতো অনেকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘুম আসে না। এটা কোনও জীবন না। আমরা বাড়িতে থাকতে চাই। আমার দুই ছেলেমেয়ে। তারা কোনও দিন শান্তি দেখতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। দুই দেশ পরস্পরের দিকে গুলি ছোড়ে আর মাঝখানে আমরা মরি।’
নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি ভারতের সবচেয়ে বড় শহর উরি। ভারতের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটিটি এই শহরেই। পাকিস্তানের সঙ্গে আস্থা তৈরিতে দুই দেশের কাশ্মিরের মধ্যে চলাচলকারী বাস সার্ভিস ও আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য পরিচালিত হয় এই শহর থেকেই। তবে এসব পদক্ষেপ সেখানে শান্তি ফেরাতে পারেনি। গত ৩০ বছরে বদলায়নি কিছুই। ‘আমাদের শহরেই আমরা ঘরহীন বোধ করি’-বলেন শতবর্ষী জুনি বেগম।
মাঝখানে ১৮ বছরের ব্যবধান রেখে ২০০১ সালের সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন যেন ২০১৯ সালে এসে জেগে উঠেছে নতুন করে। আবারও পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে চলমান ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’য় বলি নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারের সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রনায়কেরা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছে, ছড়াচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের ভীতি, মানুষ তখন ক্রমাগত সংশয়ী হয়ে উঠছে তাদের নিজেদের অস্তিত্বের সুরক্ষা নিয়ে। সীমান্তবাসীর ভাষ্য, আতঙ্কে কেবল মানুষ নয়, কেঁপে ওঠে ঘরের দরজা-জানালাও। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে সামান্য ব্যবধান নিয়ে তারা খুঁজে ফেরেন নিরাপদ আশ্রয়। নিজ ভূমিতেই বাস করেন পরবাসীর জীবন।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম সিলাকোট ও বালকোটজুড়ে বিরাজ করছে নীরব আতঙ্ক। মৃত্যুভয় তাড়া করছে গ্রামবাসীকে। ইয়াকুব আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখানকার বাসিন্দা হওয়ার মানে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। দুই পক্ষের অস্ত্রের ছায়ার মধ্যে আমাদের বসবাস। মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যেতে পারি। এখন গোলাবর্ষণ হলেও আমি কোনও শব্দ পাই না। কেবলই তাকিয়ে দেখতে থাকি।’
২০১৭ সালে সেনাঘাঁটিতে জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ১৭ ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো উরি। পুলওয়ামায় জঙ্গি গোষ্ঠীটির একই ধরনের হামলার পর গত কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা বেড়েছে। ইয়াকুবের আবাস বালাকোট গ্রামটি সিলিকোটের সঙ্গে লাগোয়া। গ্রাম থেকে যেমন পাহাড়ের ওপরের তুষারপাত দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় ভারত-পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতি। পাঁচ সন্তানের বাবা ইয়াকুব বলেন, ‘ গত রাতে রান্না হলেও আতঙ্কে তা মুখে তুলতে পারিনি আমরা। বাড়ির সবাই ভয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে গোলাগুলি হয়তো আরও বাড়বে। বিষয়টা আমাদের দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে মিশে গেছে। ধারাবাহিক গোলাগুলি আমাদের জন্য নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু এবার যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কী হবে?’
সিলিকোটে মোটামুটি ২০টি পরিবারের বসবাস। বালকোটে রয়েছে সাতশ’ পরিবার। বিরোধপূর্ণ অঞ্চলকে দুইভাগ করা নাল্লাহ হাজী পীর নদীর পারে গ্রাম দুটির অবস্থান। অন্যদের উদ্বেগও ইয়াকুবের থেকে আলাদা না। ‘অসুস্থরাই বিপদে পড়ে। আমরা সারাটা জীবনই যুদ্ধের মধ্যে কাটালাম’- বলেন আবদুল কাইয়ুম নামের এক ব্যক্তি।
২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান হামলার ধারাবাহিকতায় পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) সকালে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয় আকাশে। সেই আকাশের নিচে থাকেন যারা, সেসব সীমান্তবাসী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে জীবন শঙ্কার আতঙ্কে। সিলাকোট আর বালাকোটের মানুষেরা এক জায়গায় জড়ো হয় পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে। উঠে আসে বিভিন্ন মতামত। কারও কারও প্রশ্ন ছিল, বসতভিটা ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা।
মোহাম্মদ সিদ্দিক নামে এক শ্রমিক জানান, গ্রামের সবাই জামাকাপড়সহ প্রয়োজনীয় নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী গুছিয়ে রেখেছে। তবে যাওয়ার মতো কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের কথাও জানা নেই তাদের। ‘সবাই বলছে গোলাগুলি বাড়বে... ১৯৯০-এর দশকেরও আগে থেকে আমরা একই পরিস্থিতিতে আছি। প্রত্যেকবার আমাদের কাছে সবথেকে জরুরি প্রশ্ন হয়ে ওঠে, জীবন বাঁচাতে আমরা যাবো কোথায়?’
আন্তঃসীমান্ত সংঘাত বন্ধে ২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে দিল্লি-ইসলামাবাদ। দুই দেশের মানুষের হতাহতের পরিসংখ্যানই বলে দেয় চুক্তি কতোটা মানা হয়েছে। সিদ্দিক বলেন, তিন দশক ধরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বলি হচ্ছে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলো।
গৃহবধূ মেহমুদার ঘরে দুই শিশু সন্তান। একজনের বয়স চার, অন্যজন দশ বছর বয়সী। মেহমুদা জানান, মঙ্গলবার থেকেই আকাশে চক্কর দিচ্ছিলো সামরিক বিমান। তখনই ভয় পেতে শুরু করেন তারা। রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছে সেনাবাহিনী। ‘আমরা সীমান্তে থাকি, ছোট একটা গোলা ছোড়া হলেও তা আমাদের লাগতে পারে। এই উত্তেজনায় আমাদের বাড়ির দেয়াল, জানালা, দরজা সবই ভয় পেতে শুরু করে। ধেয়ে আসা গোলা থেকে কিছুই রক্ষা পাবে না’।
নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গোলাবর্ষণের সময়ে জরুরি আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনও বাঙ্কার নেই তাদের। কাইয়ুম নামের এক বাসিন্দা জানান, তার মেয়ে নিরাপদ কোথাও যেতে চায়। মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কাপড়চোপড় পরে নিরাপদ গন্তব্যের আশায় বসে আছে সে।
কারগিল যুদ্ধের স্মৃতি এখনও জাগ্রত গ্রামবাসীর মনে। সেই সময়ের আন্তঃসীমান্ত গোলাবর্ষণে ভয়াবহ ক্ষতির কবলে পড়ে তাদের বাড়িঘর। উরিতে বহু মানুষের প্রাণ আর সম্পদের হানি ঘটে। গ্রামের আরেক বাসিন্দা আপেক্ষ করেন, ‘অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই হয়ে গেছে বিকলাঙ্গ। আমাদের কেউ মনে রাখেনি। আল্লাহর দয়ায় আমরা বেঁচে আছি।’
বালাকোটে ছোট একটি মুদি দোকানের মালিক ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, বাংকার নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে জীবন শঙ্কা নিত্যসঙ্গী হয়েছে তাদের। ‘গোলাবর্ষণের কারণে আমাদের বাড়িতে ফাটল তৈরি হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য আমাদের বাংকার নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এমনকি যদি অন্য পরিবারের সঙ্গে বাংকার ভাগাভাগি করতে হয়, আমরা তাতেও রাজি, কিন্তু আমরা মরতে চাই না।’
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের ভয়ঙ্কর গোলাগুলির মুখে পড়েছিল উরির বাসিন্দারা। ফারুক স্মৃতি থেকে সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে আনেন। জানান, গোলায় তার ঘরের সামনে থাকা দুই চাকার যানটিতে আগুন ধরে যায়। একটি স্কুল ছিল গ্রামবাসীর চারদিনের আশ্রয়স্থল।
স্থানীয়রা বলছেন, ১৯৯৮ সালেই সীমান্তবর্তী গ্রাম সিলিকোট, বালাকোট, চুরান্দা, ঘারকোট, কালগাই, হাতলাঙ্গা, ওরুসা, গাওয়ালতলা ও বাতগারা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বিপুলসংখ্যক বাসিন্দা। আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময়ে ভয়ে কাঁপছিলেন ৭০ বছরের মিরা বেগম। তিনি জানান, তার সন্তানরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। তার পরিবারেরও কোনও নিরাপত্তা নেই। ‘আমরা কি এই দেশের নাগরিক নই? কেউ কেন আমাদের দিকে তাকায় না? বাড়িতে গুলি আর বোমা পড়তে শুরু করলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা পালাতে থাকি। ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আমরা কাঁদতে থাকি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে একবারে তুলে নিলেই পারে।’ কান্নামিশ্রিত হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে মিরা বলেন, তার ছেলেমেয়েরা চায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বারামুল্লায় তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে চলে যেতে। মিরা বলেন, বারবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কষ্টকর।
এবারের সংঘাত শুরুর পর বাড়িঘরে তালা দিয়ে সিলাকোট ও বালাকোটের বহু বাসিন্দা চলে গেছেন নিরাপত্তার উদ্দেশে। থেকে যাওয়া অল্প কিছু মানুষের একজন আফরোজা (৩৫)। উরি শহরের একটি স্কুলভবনে আশ্রয় নিয়েছেন আফরোজার মতো অনেকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘুম আসে না। এটা কোনও জীবন না। আমরা বাড়িতে থাকতে চাই। আমার দুই ছেলেমেয়ে। তারা কোনও দিন শান্তি দেখতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। দুই দেশ পরস্পরের দিকে গুলি ছোড়ে আর মাঝখানে আমরা মরি।’
নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি ভারতের সবচেয়ে বড় শহর উরি। ভারতের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটিটি এই শহরেই। পাকিস্তানের সঙ্গে আস্থা তৈরিতে দুই দেশের কাশ্মিরের মধ্যে চলাচলকারী বাস সার্ভিস ও আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য পরিচালিত হয় এই শহর থেকেই। তবে এসব পদক্ষেপ সেখানে শান্তি ফেরাতে পারেনি। গত ৩০ বছরে বদলায়নি কিছুই। ‘আমাদের শহরেই আমরা ঘরহীন বোধ করি’-বলেন শতবর্ষী জুনি বেগম।
No comments