ডাকসু নির্বাচন: প্রচার যুদ্ধে প্রার্থীরা- আচরণবিধির তোয়াক্কা করছে না ছাত্রলীগ
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে
রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু হয়েছে। রোববার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা
প্রকাশের পর থেকেই জোরালোভাবে প্রচারণা শুরু করেছেন প্রার্থীরা। ছাত্রলীগ,
ছাত্রদল, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী, বামজোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী, স্বতন্ত্র
জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী,
বাংলাদেশ ছাত্র মুক্তিজোট নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়। তবে আনুষ্ঠানিক
প্রচারণার শুরুতে আবারো আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন ছাত্রলীগ। আচরণবিধিতে রঙিন
ব্যানারের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও রঙিন ব্যানার টানিয়ে নির্বাচনী সভা করেছে
ছাত্র সংগঠনটি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, রঙিন ব্যানার ব্যবহার আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে গতকাল সকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে প্রার্থী, ভোটারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
এসময় তিনি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে জানান। একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ডাকসু নির্বাচন আনার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ভিসি আখতারুজ্জামান। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চান।
প্রচারযুদ্ধে প্রার্থীরা: আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছে প্রার্থীরা। গতকাল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ভোটারদের কাছে ছুটে গেছেন প্রার্থী ও সমর্থকেরা। লিফলেট হাতে তুলে দিয়ে ভোট দিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচিত হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার। সকাল থেকেই এ প্রচারণা শুরু হয়। সকাল সকাল প্রচারণা শুরু করেন বামজোট থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা লিটন নন্দীর নেতৃত্বে বামজোটের প্রার্থীরা। টিএসসি, কলা ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, এফবিএসসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালান তিনি। এসময় তিনি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
একই সময়ে প্রচারণা চালিয়েছেন স্বতন্ত্র জোট ও কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা। এসময় তারা ভোটারদের কাছে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচনী ইশতেহার শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন স্বতন্ত্র জোটের প্রার্থীরা। সকাল ১১টায় ভিসির ভাষণের পর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালিয়েছে অন্য প্রার্থীরাও। কার্জন হল, টিএসসি ও বিভিন্ন বাসে প্রচারণা চালিয়েছেন জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান। তিনি বলেন, সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালিয়েছি। ভালোই সাড়া পাচ্ছি। তবে হলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নিয়ে এখনো আগ্রহ তৈরি হয়নি।
আমরা তাদের সে বিষয়েও সচেতন করার চেষ্টা করেছি। সবাইকে হল আইডি কার্ড নবায়ন করে ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করছি। অনেকের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে। আমরা সাহস দিয়েছি, যেন তারা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্র আসে। তবে ভিসির আজকের বক্তব্যে আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা আশা করছিলাম তিনি ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু তিনি সে সম্পর্কে কোনো বক্তব্য রাখেননি। আসিফুর রহমান বলেন, তিনি সবদিক থেকেই ভালোই সাড়া পাচ্ছেন এবং নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। গতকালও তাকে কবি সুফিয়া কামাল হলের স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা মধুতে সংবাদ সম্মেলন করে সমর্থন দিয়েছেন বলে জানান স্বতন্ত্র এ জিএস প্রার্থী। এদিকে গতকাল দুপুরে কলা ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, এফবিএস, টিএসসি এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। ছাত্রলীগের প্যানেলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সাদ বিন কাদের চৌধুরী (সাদী) বলেন, ‘আমি সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছি।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। তারা বলছেন, আমার ক্লিন ইমেজের কারণে ডাকসু নির্বাচনে তারা আমার পাশে থাকবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ইশতেহার নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি না। আমি প্রচরণার সময় বলেছি- আপনাদের সমস্যাই আমার ইশতেহার। অতিরঞ্জিত কোনো বক্তব্য আমি দেবো না। বিষয়টি ভোটাররা ভালোভাবেই নিয়েছে।’ ছাত্রলীগের প্যানেল হলে হলেও নির্বাচনী সভা শুরু করেছে। গত রোববার রাতে বঙ্গবন্ধু ও বিজয় একাত্তর হলে তারা প্রচারণা চালিয়েছে। গতকালও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল ও কবি জসীম উদ্্দীন হলে প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
রঙিন ব্যানারে ফের আচরণবিধি লঙ্ঘন ছাত্রলীগের: ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করেই যাচ্ছে ছাত্রলীগ। রঙিন পোস্টার দেয়ালে টানিয়ে বিতর্কিত হওয়ার পর এবার এবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকে হলগুলোতে করা নির্বাচনী সভায় ব্যবহার করা হচ্ছে রঙিন ব্যানার। এছাড়াও দেয়ালে বা খুঁটিতে পোস্টার সাঁটানো নিষিদ্ধ হলেও তা মানছে না ছাত্রলীগ। রঙিন ব্যানারের ব্যবহার ও দেয়ালে বা খুঁটিতে পোস্টার সাঁটানো ডাকসু আচরণ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন নির্বাচনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, নির্বাচনে রঙিন কোনো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না। এটি আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি প্রক্টরের দায়িত্ব তিনি বিষয়টি দেখবেন। গত রোববার রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে নির্বাচনী সভা করে ছাত্রলীগ। এসময় ছাত্রলীগ তাদের প্যানেলের সব প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সভায় ছাত্রলীগ যে ব্যানার ব্যবহার করে তা ছিল রঙিন ডিজিটাল ব্যানার। বিষয়টি নিয়ে তখনো অন্য অনেক প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সোমবার বিকালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে নির্বাচনী সভা করে ছাত্রলীগ। সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে রঙিন ডিজিটাল ব্যানার। ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৬ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী নিজের সাদাকালো ছবি ছাড়া লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে অন্য কারও ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না।
লিফলেট ছাপানো ও বিলি করা যাবে। ৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় অবস্থিত কোনো প্রকার স্থাপনা, দেয়াল, যানবাহন, বেড়া, গাছপালা, বিদ্যুুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা অন্য কোনো দণ্ডায়মান বস্তুতে লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগানো যাবে না। শাস্তি হিসেবে আচরণবিধির ১৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ ও তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রয়োজনবোধে স্বপ্রণোদিতভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও ডাকসুতে ভিপি পদে লড়া রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ডাকসুতে জিএস পদে লড়া গোলাম রাব্বানীকে ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
ডাকসুতে বামজোটের হয়ে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উম্মে হাবিবা বেনজীর বলেন, শুরু থেকেই ছাত্রলীগ আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে। মনোনয়ন কেনা থেকে শুরু করে রঙিন পোস্টার দেয়ালে টানানো এখন আবার নির্বাচনী সভায়ও রঙিন ব্যানারের ব্যবহার। কিন্তু প্রশাসন আমরা বলার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। এর থেকে প্রমাণ হয় কাদের জন্য এ নির্বাচন। কাদের জিতাতে এ নির্বাচন। আমরা ছাত্রলীগের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেব। এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- ভিসি: গতকাল সকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ছাত্রছাত্রী, প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে ডাকসু সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন-২০১৯ সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এসময় দুই প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রার্থী হিসেবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। সকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করছেন। প্রার্থীরা অবাধে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনী সব কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ভিসি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্রভূমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্ম-সংস্কৃতির মতাদর্শের এক বিরাট পরিবার। পরস্পরের মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই গণতন্ত্রের মূল দর্শন। গঠিত কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত ও সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন আচরণবিধি ২০১৯ কার্যকর রয়েছে।
এ আচরণবিধি যথাযথভাবে পালন করা সংশ্লিষ্ট সবার নৈতিক দায়িত্ব। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরের শিক্ষার্থীসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রী ও সংগঠনসমূহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাশীলতায় গণতান্ত্রিক আচরণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমি সেজন্য আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে, প্রত্যাশা করব, তাদের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা যেন সব সময়ে অব্যাহত থাকে। তিনি বলেন, ভিন্ন মতাদর্শ একটি সমাজের সৌন্দর্য। আর ভিন্ন মতাদর্শ টিকে থাকতে পারে একমাত্র উদারনৈতিক, মানবিক ও অসাম্প্র্রদায়িক সমাজে।
এরূপ সমাজে উগ্রতা, কট্টরবাদিতা পরাজিত হয়; আর মানবিক ও উদার মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সুমহান ঐতিহ্য সমুন্নত থাকবে-এই আমাদের আহ্বান। তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পাসে বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল পরিবেশ যাতে কোনোক্রমেই বিঘ্নিত না হয় সে-বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ করে প্রক্টরিয়াল টিম সতর্ক থাকবে। নির্বাচনের দিন এবং এর আগে ও পরে প্রক্টরিয়াল টিমকে বিশেষ সহয়তা প্রদানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, রঙিন ব্যানার ব্যবহার আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে গতকাল সকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে প্রার্থী, ভোটারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
এসময় তিনি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে জানান। একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ডাকসু নির্বাচন আনার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ভিসি আখতারুজ্জামান। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চান।
প্রচারযুদ্ধে প্রার্থীরা: আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছে প্রার্থীরা। গতকাল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ভোটারদের কাছে ছুটে গেছেন প্রার্থী ও সমর্থকেরা। লিফলেট হাতে তুলে দিয়ে ভোট দিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচিত হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার। সকাল থেকেই এ প্রচারণা শুরু হয়। সকাল সকাল প্রচারণা শুরু করেন বামজোট থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা লিটন নন্দীর নেতৃত্বে বামজোটের প্রার্থীরা। টিএসসি, কলা ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, এফবিএসসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালান তিনি। এসময় তিনি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
একই সময়ে প্রচারণা চালিয়েছেন স্বতন্ত্র জোট ও কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা। এসময় তারা ভোটারদের কাছে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচনী ইশতেহার শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন স্বতন্ত্র জোটের প্রার্থীরা। সকাল ১১টায় ভিসির ভাষণের পর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালিয়েছে অন্য প্রার্থীরাও। কার্জন হল, টিএসসি ও বিভিন্ন বাসে প্রচারণা চালিয়েছেন জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান। তিনি বলেন, সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচারণা চালিয়েছি। ভালোই সাড়া পাচ্ছি। তবে হলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নিয়ে এখনো আগ্রহ তৈরি হয়নি।
আমরা তাদের সে বিষয়েও সচেতন করার চেষ্টা করেছি। সবাইকে হল আইডি কার্ড নবায়ন করে ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করছি। অনেকের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে। আমরা সাহস দিয়েছি, যেন তারা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্র আসে। তবে ভিসির আজকের বক্তব্যে আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা আশা করছিলাম তিনি ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু তিনি সে সম্পর্কে কোনো বক্তব্য রাখেননি। আসিফুর রহমান বলেন, তিনি সবদিক থেকেই ভালোই সাড়া পাচ্ছেন এবং নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। গতকালও তাকে কবি সুফিয়া কামাল হলের স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা মধুতে সংবাদ সম্মেলন করে সমর্থন দিয়েছেন বলে জানান স্বতন্ত্র এ জিএস প্রার্থী। এদিকে গতকাল দুপুরে কলা ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, এফবিএস, টিএসসি এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। ছাত্রলীগের প্যানেলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সাদ বিন কাদের চৌধুরী (সাদী) বলেন, ‘আমি সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছি।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। তারা বলছেন, আমার ক্লিন ইমেজের কারণে ডাকসু নির্বাচনে তারা আমার পাশে থাকবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ইশতেহার নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি না। আমি প্রচরণার সময় বলেছি- আপনাদের সমস্যাই আমার ইশতেহার। অতিরঞ্জিত কোনো বক্তব্য আমি দেবো না। বিষয়টি ভোটাররা ভালোভাবেই নিয়েছে।’ ছাত্রলীগের প্যানেল হলে হলেও নির্বাচনী সভা শুরু করেছে। গত রোববার রাতে বঙ্গবন্ধু ও বিজয় একাত্তর হলে তারা প্রচারণা চালিয়েছে। গতকালও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল ও কবি জসীম উদ্্দীন হলে প্রচারণা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
রঙিন ব্যানারে ফের আচরণবিধি লঙ্ঘন ছাত্রলীগের: ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করেই যাচ্ছে ছাত্রলীগ। রঙিন পোস্টার দেয়ালে টানিয়ে বিতর্কিত হওয়ার পর এবার এবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকে হলগুলোতে করা নির্বাচনী সভায় ব্যবহার করা হচ্ছে রঙিন ব্যানার। এছাড়াও দেয়ালে বা খুঁটিতে পোস্টার সাঁটানো নিষিদ্ধ হলেও তা মানছে না ছাত্রলীগ। রঙিন ব্যানারের ব্যবহার ও দেয়ালে বা খুঁটিতে পোস্টার সাঁটানো ডাকসু আচরণ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন নির্বাচনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, নির্বাচনে রঙিন কোনো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না। এটি আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি প্রক্টরের দায়িত্ব তিনি বিষয়টি দেখবেন। গত রোববার রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে নির্বাচনী সভা করে ছাত্রলীগ। এসময় ছাত্রলীগ তাদের প্যানেলের সব প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সভায় ছাত্রলীগ যে ব্যানার ব্যবহার করে তা ছিল রঙিন ডিজিটাল ব্যানার। বিষয়টি নিয়ে তখনো অন্য অনেক প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সোমবার বিকালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে নির্বাচনী সভা করে ছাত্রলীগ। সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে রঙিন ডিজিটাল ব্যানার। ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৬ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী নিজের সাদাকালো ছবি ছাড়া লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে অন্য কারও ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না।
লিফলেট ছাপানো ও বিলি করা যাবে। ৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় অবস্থিত কোনো প্রকার স্থাপনা, দেয়াল, যানবাহন, বেড়া, গাছপালা, বিদ্যুুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা অন্য কোনো দণ্ডায়মান বস্তুতে লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগানো যাবে না। শাস্তি হিসেবে আচরণবিধির ১৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ ও তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রয়োজনবোধে স্বপ্রণোদিতভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও ডাকসুতে ভিপি পদে লড়া রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ডাকসুতে জিএস পদে লড়া গোলাম রাব্বানীকে ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
ডাকসুতে বামজোটের হয়ে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উম্মে হাবিবা বেনজীর বলেন, শুরু থেকেই ছাত্রলীগ আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে। মনোনয়ন কেনা থেকে শুরু করে রঙিন পোস্টার দেয়ালে টানানো এখন আবার নির্বাচনী সভায়ও রঙিন ব্যানারের ব্যবহার। কিন্তু প্রশাসন আমরা বলার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। এর থেকে প্রমাণ হয় কাদের জন্য এ নির্বাচন। কাদের জিতাতে এ নির্বাচন। আমরা ছাত্রলীগের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেব। এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- ভিসি: গতকাল সকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ছাত্রছাত্রী, প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে ডাকসু সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন-২০১৯ সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এসময় দুই প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রার্থী হিসেবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। সকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করছেন। প্রার্থীরা অবাধে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনী সব কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ভিসি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্রভূমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্ম-সংস্কৃতির মতাদর্শের এক বিরাট পরিবার। পরস্পরের মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই গণতন্ত্রের মূল দর্শন। গঠিত কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত ও সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন আচরণবিধি ২০১৯ কার্যকর রয়েছে।
এ আচরণবিধি যথাযথভাবে পালন করা সংশ্লিষ্ট সবার নৈতিক দায়িত্ব। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরের শিক্ষার্থীসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রী ও সংগঠনসমূহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাশীলতায় গণতান্ত্রিক আচরণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমি সেজন্য আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে, প্রত্যাশা করব, তাদের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা যেন সব সময়ে অব্যাহত থাকে। তিনি বলেন, ভিন্ন মতাদর্শ একটি সমাজের সৌন্দর্য। আর ভিন্ন মতাদর্শ টিকে থাকতে পারে একমাত্র উদারনৈতিক, মানবিক ও অসাম্প্র্রদায়িক সমাজে।
এরূপ সমাজে উগ্রতা, কট্টরবাদিতা পরাজিত হয়; আর মানবিক ও উদার মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সুমহান ঐতিহ্য সমুন্নত থাকবে-এই আমাদের আহ্বান। তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পাসে বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল পরিবেশ যাতে কোনোক্রমেই বিঘ্নিত না হয় সে-বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ করে প্রক্টরিয়াল টিম সতর্ক থাকবে। নির্বাচনের দিন এবং এর আগে ও পরে প্রক্টরিয়াল টিমকে বিশেষ সহয়তা প্রদানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।
No comments