জায়গা প্রস্তুত না করে রাসায়নিক উচ্ছেদ
- • উচ্ছেদ করা কারখানা–গুদামগুলোর যাওয়ার জায়গা নেই।
- • অন্য এলাকায় ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
- • পুরান ঢাকা থেকে এই কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে হবে।
- • যাতে নতুন ঝুঁকি তৈরি না হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।
- • চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারির আগুনে অন্তত ৭১ জনের মৃত্যু।
সরিয়ে
নেওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা না করেই পুরান ঢাকার রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের
কারখানা বা গুদামের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের
(ডিএসসিসি) উদ্যোগে গঠিত টাস্কফোর্স। রাসায়নিকের গুদামগুলো সাময়িকভাবে
সরিয়ে নিতে শিল্প মন্ত্রণালয় যে দুটি স্থান ঠিক করেছে, সে দুটির একটিতে এখন
অবৈধভাবে প্রায় ৪০০ দরিদ্র পরিবারের বাস, অন্যটিতে ট্রাকস্ট্যান্ড। আর
প্লাস্টিকের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
ফলে এখন উচ্ছেদ করা কারখানা বা গুদামগুলোর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে যত্রতত্র কারখানা বা গুদাম গড়ে তুললে নতুন করে অন্য সব এলাকায় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, পুরান ঢাকা থেকে এসব কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে হবে। তবে সেগুলো যাতে নতুন ঝুঁকি তৈরি না করে, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।
পুরান ঢাকার চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় অন্তত ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকায় অভিযান শুরু করে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। চার দিনের অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬৩টি স্থাপনার সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অভিযানে গিয়ে দুই দিন এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়েন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
এর আগে ২০১০ সালের জুনে পুরান ঢাকার নিমতলীতে আরেক ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে রাসায়নিক পল্লি এবং প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নিতে প্লাস্টিকশিল্প নগর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আট বছরে রাসায়নিক পল্লির ক্ষেত্রে শুধু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্লাস্টিকশিল্প নগরের শুধু জমি অধিগ্রহণ–প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে।
এই অবস্থায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় জানায়, পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদামগুলো ঢাকার শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরকারি কারখানার অব্যবহৃত জমিতে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে প্রায় ১২ একর জমিতে ছাউনি নির্মাণ করে দেবে শিল্প মন্ত্রণালয়। আর ছয় মাসের মধ্য তৈরি হবে রাসায়নিক শিল্পনগর।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ছাউনি নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি তৈরির জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনকে (বিএসইসি)। সংস্থা দুটি জানিয়েছে, তারা ডিপিপি তৈরি করছে, যা দু-এক দিনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এরপর তা পাঠাবে পরিকল্পনা কমিশনে। কমিশন প্রকল্প অনুমোদন দিলে দরপত্র আহ্বান অথবা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ছাউনি নির্মাণের কাজ দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে বেশ কিছু সময় লাগতে পারে।
এরই মধ্যে গতকাল সোমবারও পুরান ঢাকায় অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর মালিকদের বলা হচ্ছে, রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিলে আবার সংযোগ দেওয়া হবে। ভবনগুলোর বেশির ভাগই যেহেতু আবাসিক, সেহেতু সেবা সংযোগ চালুর জন্য হলেও গুদাম সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
গুদামগুলো কোথায় যাচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন বলেন, যে যেখানে পারছে, সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেরানীগঞ্জ, কেউ গাজীপুর, কেউ টঙ্গী, কেউ মোহাম্মদপুর, কেউ মুগদা, কেউ ধানমন্ডি নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখছে। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত জায়গায় না যাওয়ায় ঝুঁকি কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। পুরান ঢাকা নিরাপদ করতে সরকারের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই না। কিন্তু যৌক্তিক কাজ করা হোক।’ রাসায়নিক সরিয়ে যেখানে নেওয়া হচ্ছে, সেখানেই স্থানীয় মাস্তানেরা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে এবং পুলিশও বাধা দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় এখন যেসব গুদাম উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা আমাদের আওতার বাইরে। সেখানে আমাদের লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। রাসায়নিকগুলো সরকার নির্ধারিত জায়গায় চলে যাবে।’ অপরিকল্পিতভাবে সরে গেলে নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই হবে। গত ১০-১৫ বছরে কিছু ব্যবসায়ী নিজেরা জমি কিনে কেরানীগঞ্জে গেছে। সেখানেও দোকানপাট, বাড়িঘর হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় যদি এসব কারখানা ও গুদাম কোনো পরিকল্পিত জায়গায় নিয়ে যায়, তাহলে সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরান ঢাকায় এখন রাসায়নিক ব্যবসা করেন ১ হাজার ২০০ ব্যবসায়ী। রাসায়নিকের ধরন আছে প্রায় ৫ হাজার রকমের। এ ছাড়া প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম রয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। অবশ্য ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে সিটি করপোরেশনের ভেতরে কোথাও নেওয়া হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা এখন কেরানীগঞ্জের খালি জায়গায় নিজস্ব উদ্যোগে বা দলগত উদ্যোগে তাঁদের পণ্য রাখবেন। তাঁদের সাময়িকভাবে ও স্থায়ীভাবে জায়গা দিতে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
টঙ্গীতে বসতি, উজালায় ট্রাকস্ট্যান্ড
টাস্কফোর্সের উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগের দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয় পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম অস্থায়ীভাবে শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়ার কথা জানায়। কত দিনে জায়গা দুটিতে ছাউনি তৈরি হবে, তা জানতে ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব মোহাম্মদ আবদুল হালিমকে কয়েক দফা ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্পসচিব তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে দ্রুত সময়ের কথা বলেছিলেন। দিনক্ষণ বলেননি।
শিল্প মন্ত্রণালয় যে দুটি জায়গার কথা বলেছিল, তার একটি গাজীপুরের টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বিএসইসির ছয় একর জমি। গতকাল গিয়ে প্রথম আলোর গাজীপুর সংবাদদাতা সেখানে বসতবাড়ি, দোকানপাট, পুকুর, গ্যারেজ, গুদামসহ ছোট ছোট কারখানা দেখতে পান। স্থানীয় ব্যক্তিদের হিসাবে, বিএসইসির ওই জমিতে প্রায় ৪০০ পরিবার বসবাস করে। তারা সবাই দরিদ্র। বস্তিঘরগুলোর ভাড়া দেড়–দুই হাজার টাকা। কেউ নিজে ঘর করে থাকছেন। কেউ একাধিক ঘর করে অন্যদের ভাড়া দিচ্ছেন।
চারটি ঘর ও একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক মো. শাহিন বলেন, প্রথমে তাঁর একটা ঘর ছিল। পরে ঋণ নিয়ে বাকিগুলো করেছেন। ঘর করতে কারও অনুমতি নিতে হয় কি না জানতে চাইলে তিনি কথা এড়িয়ে যান।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা চিঠি পেয়েছি। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে এখানকার সকল অবৈধ দখলদারকে নোটিশ দেওয়াসহ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমরা উচ্ছেদ অভিযান করব।’
শিল্প মন্ত্রণালয় কদমতলী থানার শ্যামপুর মৌজায় বিসিআইসির মালিকানাধীন উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির ৬ দশমিক ১৭ একর জায়গায় রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছে। ম্যাচ কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সেখানে গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক দেখতে পান, কারখানা প্রাঙ্গণের একটি অংশে ট্রাকস্ট্যান্ড ও গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। একটি দোতলা ভবন আছে, যেটিতে আনসার সদস্যরা বাস করেন।
জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন আগে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কারখানাটি ঘুরে গেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্যসচিব (নগরায়ণ ও সুশাসন) ইকবাল হাবিব বলেন, ‘২৯টি দাহ্য রাসায়নিকের বিষয়ে কোনো ধরনের টলারেন্স (সহিষ্ণুতা) দেখানোর সুযোগ নেই। আমরা দেখছি, ২৯ টির বাইরেও বিভিন্ন রাসায়নিক এবং অন্যান্য পণ্যেও একই ধরনের শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে। এটা বোধ হয় ঠিক না। এগুলো সরাতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা দরকার।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি রাসায়নিকগুলো যত্রতত্র সরিয়ে নেন, সেটার মানে হলো, আপনি আগুন সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলেন।
ফলে এখন উচ্ছেদ করা কারখানা বা গুদামগুলোর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে যত্রতত্র কারখানা বা গুদাম গড়ে তুললে নতুন করে অন্য সব এলাকায় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, পুরান ঢাকা থেকে এসব কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে হবে। তবে সেগুলো যাতে নতুন ঝুঁকি তৈরি না করে, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।
পুরান ঢাকার চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় অন্তত ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকায় অভিযান শুরু করে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। চার দিনের অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬৩টি স্থাপনার সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অভিযানে গিয়ে দুই দিন এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়েন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
এর আগে ২০১০ সালের জুনে পুরান ঢাকার নিমতলীতে আরেক ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে রাসায়নিক পল্লি এবং প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নিতে প্লাস্টিকশিল্প নগর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আট বছরে রাসায়নিক পল্লির ক্ষেত্রে শুধু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্লাস্টিকশিল্প নগরের শুধু জমি অধিগ্রহণ–প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে।
এই অবস্থায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় জানায়, পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদামগুলো ঢাকার শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরকারি কারখানার অব্যবহৃত জমিতে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে প্রায় ১২ একর জমিতে ছাউনি নির্মাণ করে দেবে শিল্প মন্ত্রণালয়। আর ছয় মাসের মধ্য তৈরি হবে রাসায়নিক শিল্পনগর।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ছাউনি নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি তৈরির জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনকে (বিএসইসি)। সংস্থা দুটি জানিয়েছে, তারা ডিপিপি তৈরি করছে, যা দু-এক দিনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এরপর তা পাঠাবে পরিকল্পনা কমিশনে। কমিশন প্রকল্প অনুমোদন দিলে দরপত্র আহ্বান অথবা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ছাউনি নির্মাণের কাজ দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে বেশ কিছু সময় লাগতে পারে।
এরই মধ্যে গতকাল সোমবারও পুরান ঢাকায় অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর মালিকদের বলা হচ্ছে, রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিলে আবার সংযোগ দেওয়া হবে। ভবনগুলোর বেশির ভাগই যেহেতু আবাসিক, সেহেতু সেবা সংযোগ চালুর জন্য হলেও গুদাম সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
গুদামগুলো কোথায় যাচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন বলেন, যে যেখানে পারছে, সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেরানীগঞ্জ, কেউ গাজীপুর, কেউ টঙ্গী, কেউ মোহাম্মদপুর, কেউ মুগদা, কেউ ধানমন্ডি নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখছে। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত জায়গায় না যাওয়ায় ঝুঁকি কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। পুরান ঢাকা নিরাপদ করতে সরকারের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই না। কিন্তু যৌক্তিক কাজ করা হোক।’ রাসায়নিক সরিয়ে যেখানে নেওয়া হচ্ছে, সেখানেই স্থানীয় মাস্তানেরা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে এবং পুলিশও বাধা দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় এখন যেসব গুদাম উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা আমাদের আওতার বাইরে। সেখানে আমাদের লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। রাসায়নিকগুলো সরকার নির্ধারিত জায়গায় চলে যাবে।’ অপরিকল্পিতভাবে সরে গেলে নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই হবে। গত ১০-১৫ বছরে কিছু ব্যবসায়ী নিজেরা জমি কিনে কেরানীগঞ্জে গেছে। সেখানেও দোকানপাট, বাড়িঘর হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় যদি এসব কারখানা ও গুদাম কোনো পরিকল্পিত জায়গায় নিয়ে যায়, তাহলে সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরান ঢাকায় এখন রাসায়নিক ব্যবসা করেন ১ হাজার ২০০ ব্যবসায়ী। রাসায়নিকের ধরন আছে প্রায় ৫ হাজার রকমের। এ ছাড়া প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম রয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। অবশ্য ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে সিটি করপোরেশনের ভেতরে কোথাও নেওয়া হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা এখন কেরানীগঞ্জের খালি জায়গায় নিজস্ব উদ্যোগে বা দলগত উদ্যোগে তাঁদের পণ্য রাখবেন। তাঁদের সাময়িকভাবে ও স্থায়ীভাবে জায়গা দিতে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
টঙ্গীতে বসতি, উজালায় ট্রাকস্ট্যান্ড
টাস্কফোর্সের উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগের দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয় পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম অস্থায়ীভাবে শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়ার কথা জানায়। কত দিনে জায়গা দুটিতে ছাউনি তৈরি হবে, তা জানতে ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব মোহাম্মদ আবদুল হালিমকে কয়েক দফা ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্পসচিব তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে দ্রুত সময়ের কথা বলেছিলেন। দিনক্ষণ বলেননি।
শিল্প মন্ত্রণালয় যে দুটি জায়গার কথা বলেছিল, তার একটি গাজীপুরের টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বিএসইসির ছয় একর জমি। গতকাল গিয়ে প্রথম আলোর গাজীপুর সংবাদদাতা সেখানে বসতবাড়ি, দোকানপাট, পুকুর, গ্যারেজ, গুদামসহ ছোট ছোট কারখানা দেখতে পান। স্থানীয় ব্যক্তিদের হিসাবে, বিএসইসির ওই জমিতে প্রায় ৪০০ পরিবার বসবাস করে। তারা সবাই দরিদ্র। বস্তিঘরগুলোর ভাড়া দেড়–দুই হাজার টাকা। কেউ নিজে ঘর করে থাকছেন। কেউ একাধিক ঘর করে অন্যদের ভাড়া দিচ্ছেন।
চারটি ঘর ও একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক মো. শাহিন বলেন, প্রথমে তাঁর একটা ঘর ছিল। পরে ঋণ নিয়ে বাকিগুলো করেছেন। ঘর করতে কারও অনুমতি নিতে হয় কি না জানতে চাইলে তিনি কথা এড়িয়ে যান।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা চিঠি পেয়েছি। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে এখানকার সকল অবৈধ দখলদারকে নোটিশ দেওয়াসহ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমরা উচ্ছেদ অভিযান করব।’
শিল্প মন্ত্রণালয় কদমতলী থানার শ্যামপুর মৌজায় বিসিআইসির মালিকানাধীন উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির ৬ দশমিক ১৭ একর জায়গায় রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছে। ম্যাচ কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সেখানে গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক দেখতে পান, কারখানা প্রাঙ্গণের একটি অংশে ট্রাকস্ট্যান্ড ও গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। একটি দোতলা ভবন আছে, যেটিতে আনসার সদস্যরা বাস করেন।
জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন আগে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কারখানাটি ঘুরে গেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্যসচিব (নগরায়ণ ও সুশাসন) ইকবাল হাবিব বলেন, ‘২৯টি দাহ্য রাসায়নিকের বিষয়ে কোনো ধরনের টলারেন্স (সহিষ্ণুতা) দেখানোর সুযোগ নেই। আমরা দেখছি, ২৯ টির বাইরেও বিভিন্ন রাসায়নিক এবং অন্যান্য পণ্যেও একই ধরনের শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে। এটা বোধ হয় ঠিক না। এগুলো সরাতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা দরকার।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি রাসায়নিকগুলো যত্রতত্র সরিয়ে নেন, সেটার মানে হলো, আপনি আগুন সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলেন।
No comments