এরশাদ নাটক
নাটক!
নাটক!! নাটক!!! জমে উঠেছে দেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির রূপকার এইচ এম
এরশাদের জাতীয় পার্টিতে নাটক। এইচ এম এরশাদ পরিচালিত, রওশন এরশাদ
নির্দেশিত, রুহুল আমিন হাওলাদার প্রযোজিত, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রচিত এই
নাটকে সর্বশেষ বলি জিএম কাদের। সম্পত্তি লিখে দেয়ার মতোই ‘উইল’-এর মাধ্যমে
জাতীয় পার্টির মালিকানা পাওয়া জিএম কাদের হঠাৎ সবকিছু খোয়ালেন!
কো-চেয়ারম্যান ও সংসদ উপনেতা দুই পদ থেকেই তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। বিরোধী
দলের উপনেতা পদে রওশনকে নেয়া হয়েছে; এখন রুহুল আমিন হাওলাদারকে
‘কো-চেয়ারম্যান’ নাকি মশিউর রহমান রাঙাকে সরিয়ে দিয়ে ‘মহাসচিব’ পদে পুনরায়
বসানো হয় দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন দলের নেতাকর্মীরা। জানতে চাইলে নাম প্রকাশ
না করার শর্তে জাপার এক নেতা বলেন, স্যার (এরশাদ) এসব করেই নিজেকে মিডিয়ার
খবরে রাখার চেষ্টা করছেন। ফুয়েল পেলেই উনি বদলে যান। কখন কোন রূপ ধারণ
করেন বলা মুশকিল।
এরশাদকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দু’ধারি ছুরির মতো। দল থেকে কেউ বাদ গেলে এদের লাভ, নতুন যোগ দিলেও লাভ। কেন্দ্র থেকে শুরু করে পদ বেচাবিক্রি, তৃর্ণমূলের কমিটি, নির্বাচনে মনোনয়ন, এরশাদের নাম করে প্রশাসনে বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নেয়া, প্রশাসনে নিয়োগ বদলি বাণিজ্য সবকিছুই এরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের তোয়াজ করেই দলের নেতৃত্ব ধরে রাখতে হয়। যা রুহুল আমিন হাওলাদার করেন। কিন্তু জিএম কাদের এই কৌশল পাত্তাই দেন না। এতে কাদেরের সঙ্গে নেতাদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। দেশের রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের পিলে চমকানো এই ‘এরশাদ নাটক’ কখন কে উপরে উঠেন, আর কে নিচে নামেন কেউ জানেন না। সবকিছুই নির্ভর করে পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা ক্ষমতার ওপর। সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ কখন কার মাথায় ছাতা ধরবেন, কার মাথা কেটে ফেলবেন, কাকে কড়া রৌদ্রে দাঁড় করে রাখবেন আর কাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তা তিনিও জানেন না। ঠিক করে দেয় সিন্ডিকেট। তবে আজ যাকে ছুঁড়ে ফেলছেন তিনিই কালই তাকে প্রমোশন দিয়ে পার্টিতে ফিরে আনতেও পারেন। জাপার নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সময় তিনি ‘এই নাটক’ বেশি করেন। তখন টাকার ছড়াছড়ি থাকে। অন্যসময় টাকা-পয়সার গন্ধ পেলেও করেন। এক সময় লেদারের গন্ধ পেলেই এসব করতেন। এখন টাকার গন্ধ পেলেই বহিষ্কার-তিরস্কার-পদায়ন-বর্জন এসব করেন।
এরশাদ এখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। কোথাও গেলে হুইল চেয়ার তার সঙ্গী হয়। দলের মহাসচিব এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে ‘ভুল চিকিৎসার’ কারণে তার এই পরিণতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ‘অসুস্থতার নাটক’ করেছেন। এবারের নির্বাচনের সময় সত্যিকারের অসুস্থ হন। ২০ মার্চ ৯০তম জন্মদিন পালন করেন এরশাদ। তিনি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘হয়তো এটাই আমার জীবদ্দশায় শেষ বক্তৃতা’। এর পরের দিন বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ ছোট ভাই জিএম কাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের ফ্লাটে দেখা করতে গেলে তাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, ‘তুমি দলকে ভালো চালাচ্ছো। তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে ভুল করিনি’। পরের দিনই ব্যর্থতার অভিযোগে পার্টির কো-চেয়ারম্যানে পদ থেকে কাদেরকে অব্যাহতি দেন। সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদ বলেন, ব্যর্থতার কারণে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। তবে ওই বার্তায় তিনি বলেন, সংসদের বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্বে জিএম কাদের থাকবে কিনা তা পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা না করে পরের দিনই সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা পদ থেকেও কাদেরকে সরিয়ে দেন। সে পদে বসান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। তিনি দশম সংসদে এরশাদকে ল্যাং মেরে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। দলের নেতারা জানান, সংরক্ষিত নারী আসনে যে চারজন এমপি হয়েছেন তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থের লেনদেন হয়েছে। আবার সিংগাপুরে সিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে প্রথম দফা যে চারজনের নাম ঘোষণা করেন তাদের কাছ থেকেও ‘লেনদেন’ হয়।
সূত্র জানায়, জিএম কাদেরকে পদচ্যুতই শেষ নয়; দলের নেতাকর্মীদের জন্য সামনে আরো নাটক অপেক্ষা করছে। এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে কো-চেয়ারমান পদে অথবা আবার মহাসচিব পদে আনা হতে পারে। ২০ মার্চ এরশাদের জন্মদিনে রুহুল আমিন হাওলাদার ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যাননি। আগের রাতে হাওলাদার বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গিয়ে এরশাদকে প্রচুর উপঢৌকন দেন। যা নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা কখনোই করেননি। আর দলের সর্বমহলে নতুন মহাসচিবের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠেনি। আনপ্রেডিক্টেবল এরশাদ ছোটভাই জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান করেন ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি। এই ঘোষণা দেয়ার পর বেঁকে বসেন স্ত্রী রওশন। গৃহবিবাদ ঠেকাতে স্ত্রী রওশন এরশাদকে এক ধাপ উপরে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেন। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দলের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে জাতীয় পার্টিকে জিএম কাদেরের নামে ‘উইল’ করে দেন। তার অবর্তমানে জিএম কাদের দল চালাবেন এ নির্দেশনা দেন। কিন্তু জিএম কাদের দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। বড় ভাই চেয়ারম্যান এই তাঁর পুঁজি। তবে ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হওয়ায় সিন্ডিকেট নেতাদের সঙ্গে তার এমনিতেই দূরত্ব ঘোচেনি।
এরশাদ চার বছর বছর আগে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে জাপার মহাসচিব করেন। কিছুদিন পর বাবলুকে সরিয়ে আবার ওই পদে হাওলাদারকে নিয়ে আসেন। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে এরশাদ নিজের ভাগ্নি মেহেজেবুন নেসা রহমানের বিয়ে দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে আকস্মিকভাবে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় দূর সম্পর্কের ভাগ্নে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে। কিন্তু ক’দিন পর ‘চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী’ পদ সৃষ্টি করে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে সে পদে বসানো হয় রুহুল আমিন হাওলাদারকে। এরশাদের একের পর এক নাটকে জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে কার্যত ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নিবেদিতপ্রাণ ও পরীক্ষিত নেতারা মান মর্যাদা নিয়ে আগেই কেটে পড়েছেন। যারা এখনো রয়েছেন সম্মান রক্ষার্থে তারাও দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। তবে সুবিধাবাদী সিÐিকেট চক্র এখনো এরশাদ নাম ভাঙ্গিয়ে আয়-রোজগার করায় এরশাদকে একের পর এক নাটকে উৎসাহিত করছেন। এজন্যই তৃর্ণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। সংসদ নির্বাচনে ১৭০ জন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী করেন; ভোটের আগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সরকারের সঙ্গে মাত্র ২৬ জন প্রার্থী নিয়ে সমঝোতার ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারেননি। নিজের আসন ধরে রাখার চেষ্টায় ২০ আসন ছেড়ে দেয়ার প্রকল্পে হাওলাদার নিজেই গর্তে পড়ে এমপি হতে পারেননি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলের এমন অবস্থা যে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এবারের উপজেলা নির্বাচনে জাপার দু’জন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জাপার একাধিক নেতা মনে করেন এরশাদ গণবিরোধী অবস্থান এবং সব সময় জনগণের মতামতের বিপক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের তোয়াজ নীতির কৌশল করায় এই দশা হয়েছে। তাঁর কর্মময় জীবনে দেখা যায় ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের মেজর হন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-১৯৭০ সালে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও ১৯৭১-১৯৭২ সালে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি ছুটিতে রংপুর ছিলেন। কালুর ঘাট বেতারে ঘোষণা শুনে সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তিনি পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে দেশে আসেন। তিনি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ৯ বছর ক্ষমতায় থেকে নানা ক্যারিকেচা করে ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন।
’৯০ এ ক্ষমতা হারানোর পর ২২ মামলায় এরশাদ কারাগারে থাকার সময় জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজান চৌধুরীর কারণে জাপা নুতন করে প্রাণ ফিরে পায়। জাতীয় পার্টি গণমুখী রাজনীতি শুরু করলে পঞ্চম ও ৬ষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ ৫টি করে আসনে বিজয়ী হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে কারাগার থেকে বের হয়েই আবার জাতীয় পার্টিকে ‘সুবিধাবাদী’ দলে পরিণত করেন। জনমত ও জনশ্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে হয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব, নয়তো নিজেকে ‘নিরাপদ’ রাখার চেষ্টা করেন। এ জন্যই মিজানুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিষ্টার মওদুদ, কাজী জাফর আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো বটবৃক্ষরা এরশাদকে ত্যাগ করেন। এরশাদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে তার ভেল্কিবাজী ইতিহাসে যায়গা করে দিয়েছে। জাপার নেতাদের মতে এরশাদ দলের নেতাকর্মীদের কাছে গিরগিটির মতোই। কখন তিনি কোন রুপ ধারণ করেন বলা মুশকিল।
জিএম কাদেরকে ব্যর্থতার অভিযোগে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে জেএম কাদের গত শুক্রবার রাতে বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ বৃহস্পতিবার রাতে আমাকে এরশাদ সাহেব বলেছিলন, তুমি (জি এম কাদের) খুব ভালো করছো। আমি (এরশাদ) তো আর বেশি দিন বাচঁবো না, তুমি দলটাকে বাচিঁয়ে রেখো। আমি জানি তুমি পারবে। তবে শনিবার বিকালে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানতে জিএম কাদেরকে একাধিক ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
২২ মার্চ শুক্রবার জিএম কাদেরের অব্যহতির ‘সাংগঠনিক নির্দেশে’ এরশাদ স্বাক্ষর করেন। শনিবার প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করেন জিএম কাদের। তাকে এরশাদ ‘চিন্তা করো না আমি দেখবো’ অভয় দেন। আর মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বলেন, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কাজী ফিরোজ রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, দলের কে কোন পদে থাকবে সেটা এরশাদ সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কেন তাকে সরিয়ে দেয়া হলো সেটা এরশাদ সাহেবই ভালো জানেন। তবে জি এম কাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব নয়। পার্টির কোনো নেতার সঙ্গে দেখা করবেন না কথা বলবেন না তাহলে রাজনীতি কিভাবে হয়? নির্বাচনের আগে বা পড়ে একবারও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা বলেন, এরশাদের নাটক কেবল শুরু; এই নাটক কোথায় গিয়ে ঠেকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এরশাদকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দু’ধারি ছুরির মতো। দল থেকে কেউ বাদ গেলে এদের লাভ, নতুন যোগ দিলেও লাভ। কেন্দ্র থেকে শুরু করে পদ বেচাবিক্রি, তৃর্ণমূলের কমিটি, নির্বাচনে মনোনয়ন, এরশাদের নাম করে প্রশাসনে বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নেয়া, প্রশাসনে নিয়োগ বদলি বাণিজ্য সবকিছুই এরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের তোয়াজ করেই দলের নেতৃত্ব ধরে রাখতে হয়। যা রুহুল আমিন হাওলাদার করেন। কিন্তু জিএম কাদের এই কৌশল পাত্তাই দেন না। এতে কাদেরের সঙ্গে নেতাদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। দেশের রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের পিলে চমকানো এই ‘এরশাদ নাটক’ কখন কে উপরে উঠেন, আর কে নিচে নামেন কেউ জানেন না। সবকিছুই নির্ভর করে পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা ক্ষমতার ওপর। সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ কখন কার মাথায় ছাতা ধরবেন, কার মাথা কেটে ফেলবেন, কাকে কড়া রৌদ্রে দাঁড় করে রাখবেন আর কাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তা তিনিও জানেন না। ঠিক করে দেয় সিন্ডিকেট। তবে আজ যাকে ছুঁড়ে ফেলছেন তিনিই কালই তাকে প্রমোশন দিয়ে পার্টিতে ফিরে আনতেও পারেন। জাপার নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সময় তিনি ‘এই নাটক’ বেশি করেন। তখন টাকার ছড়াছড়ি থাকে। অন্যসময় টাকা-পয়সার গন্ধ পেলেও করেন। এক সময় লেদারের গন্ধ পেলেই এসব করতেন। এখন টাকার গন্ধ পেলেই বহিষ্কার-তিরস্কার-পদায়ন-বর্জন এসব করেন।
এরশাদ এখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। কোথাও গেলে হুইল চেয়ার তার সঙ্গী হয়। দলের মহাসচিব এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে ‘ভুল চিকিৎসার’ কারণে তার এই পরিণতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ‘অসুস্থতার নাটক’ করেছেন। এবারের নির্বাচনের সময় সত্যিকারের অসুস্থ হন। ২০ মার্চ ৯০তম জন্মদিন পালন করেন এরশাদ। তিনি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘হয়তো এটাই আমার জীবদ্দশায় শেষ বক্তৃতা’। এর পরের দিন বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ ছোট ভাই জিএম কাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের ফ্লাটে দেখা করতে গেলে তাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, ‘তুমি দলকে ভালো চালাচ্ছো। তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে ভুল করিনি’। পরের দিনই ব্যর্থতার অভিযোগে পার্টির কো-চেয়ারম্যানে পদ থেকে কাদেরকে অব্যাহতি দেন। সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদ বলেন, ব্যর্থতার কারণে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। তবে ওই বার্তায় তিনি বলেন, সংসদের বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্বে জিএম কাদের থাকবে কিনা তা পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা না করে পরের দিনই সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা পদ থেকেও কাদেরকে সরিয়ে দেন। সে পদে বসান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। তিনি দশম সংসদে এরশাদকে ল্যাং মেরে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। দলের নেতারা জানান, সংরক্ষিত নারী আসনে যে চারজন এমপি হয়েছেন তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থের লেনদেন হয়েছে। আবার সিংগাপুরে সিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে প্রথম দফা যে চারজনের নাম ঘোষণা করেন তাদের কাছ থেকেও ‘লেনদেন’ হয়।
সূত্র জানায়, জিএম কাদেরকে পদচ্যুতই শেষ নয়; দলের নেতাকর্মীদের জন্য সামনে আরো নাটক অপেক্ষা করছে। এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে কো-চেয়ারমান পদে অথবা আবার মহাসচিব পদে আনা হতে পারে। ২০ মার্চ এরশাদের জন্মদিনে রুহুল আমিন হাওলাদার ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যাননি। আগের রাতে হাওলাদার বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গিয়ে এরশাদকে প্রচুর উপঢৌকন দেন। যা নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা কখনোই করেননি। আর দলের সর্বমহলে নতুন মহাসচিবের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠেনি। আনপ্রেডিক্টেবল এরশাদ ছোটভাই জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান করেন ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি। এই ঘোষণা দেয়ার পর বেঁকে বসেন স্ত্রী রওশন। গৃহবিবাদ ঠেকাতে স্ত্রী রওশন এরশাদকে এক ধাপ উপরে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেন। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দলের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে জাতীয় পার্টিকে জিএম কাদেরের নামে ‘উইল’ করে দেন। তার অবর্তমানে জিএম কাদের দল চালাবেন এ নির্দেশনা দেন। কিন্তু জিএম কাদের দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। বড় ভাই চেয়ারম্যান এই তাঁর পুঁজি। তবে ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হওয়ায় সিন্ডিকেট নেতাদের সঙ্গে তার এমনিতেই দূরত্ব ঘোচেনি।
এরশাদ চার বছর বছর আগে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে জাপার মহাসচিব করেন। কিছুদিন পর বাবলুকে সরিয়ে আবার ওই পদে হাওলাদারকে নিয়ে আসেন। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে এরশাদ নিজের ভাগ্নি মেহেজেবুন নেসা রহমানের বিয়ে দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে আকস্মিকভাবে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় দূর সম্পর্কের ভাগ্নে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে। কিন্তু ক’দিন পর ‘চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী’ পদ সৃষ্টি করে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে সে পদে বসানো হয় রুহুল আমিন হাওলাদারকে। এরশাদের একের পর এক নাটকে জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে কার্যত ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নিবেদিতপ্রাণ ও পরীক্ষিত নেতারা মান মর্যাদা নিয়ে আগেই কেটে পড়েছেন। যারা এখনো রয়েছেন সম্মান রক্ষার্থে তারাও দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। তবে সুবিধাবাদী সিÐিকেট চক্র এখনো এরশাদ নাম ভাঙ্গিয়ে আয়-রোজগার করায় এরশাদকে একের পর এক নাটকে উৎসাহিত করছেন। এজন্যই তৃর্ণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। সংসদ নির্বাচনে ১৭০ জন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী করেন; ভোটের আগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সরকারের সঙ্গে মাত্র ২৬ জন প্রার্থী নিয়ে সমঝোতার ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারেননি। নিজের আসন ধরে রাখার চেষ্টায় ২০ আসন ছেড়ে দেয়ার প্রকল্পে হাওলাদার নিজেই গর্তে পড়ে এমপি হতে পারেননি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলের এমন অবস্থা যে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এবারের উপজেলা নির্বাচনে জাপার দু’জন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জাপার একাধিক নেতা মনে করেন এরশাদ গণবিরোধী অবস্থান এবং সব সময় জনগণের মতামতের বিপক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের তোয়াজ নীতির কৌশল করায় এই দশা হয়েছে। তাঁর কর্মময় জীবনে দেখা যায় ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের মেজর হন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-১৯৭০ সালে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও ১৯৭১-১৯৭২ সালে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি ছুটিতে রংপুর ছিলেন। কালুর ঘাট বেতারে ঘোষণা শুনে সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তিনি পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে দেশে আসেন। তিনি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ৯ বছর ক্ষমতায় থেকে নানা ক্যারিকেচা করে ১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন।
’৯০ এ ক্ষমতা হারানোর পর ২২ মামলায় এরশাদ কারাগারে থাকার সময় জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজান চৌধুরীর কারণে জাপা নুতন করে প্রাণ ফিরে পায়। জাতীয় পার্টি গণমুখী রাজনীতি শুরু করলে পঞ্চম ও ৬ষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ ৫টি করে আসনে বিজয়ী হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে কারাগার থেকে বের হয়েই আবার জাতীয় পার্টিকে ‘সুবিধাবাদী’ দলে পরিণত করেন। জনমত ও জনশ্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে হয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব, নয়তো নিজেকে ‘নিরাপদ’ রাখার চেষ্টা করেন। এ জন্যই মিজানুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিষ্টার মওদুদ, কাজী জাফর আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো বটবৃক্ষরা এরশাদকে ত্যাগ করেন। এরশাদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে তার ভেল্কিবাজী ইতিহাসে যায়গা করে দিয়েছে। জাপার নেতাদের মতে এরশাদ দলের নেতাকর্মীদের কাছে গিরগিটির মতোই। কখন তিনি কোন রুপ ধারণ করেন বলা মুশকিল।
জিএম কাদেরকে ব্যর্থতার অভিযোগে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে জেএম কাদের গত শুক্রবার রাতে বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ বৃহস্পতিবার রাতে আমাকে এরশাদ সাহেব বলেছিলন, তুমি (জি এম কাদের) খুব ভালো করছো। আমি (এরশাদ) তো আর বেশি দিন বাচঁবো না, তুমি দলটাকে বাচিঁয়ে রেখো। আমি জানি তুমি পারবে। তবে শনিবার বিকালে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানতে জিএম কাদেরকে একাধিক ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
২২ মার্চ শুক্রবার জিএম কাদেরের অব্যহতির ‘সাংগঠনিক নির্দেশে’ এরশাদ স্বাক্ষর করেন। শনিবার প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করেন জিএম কাদের। তাকে এরশাদ ‘চিন্তা করো না আমি দেখবো’ অভয় দেন। আর মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বলেন, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কাজী ফিরোজ রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, দলের কে কোন পদে থাকবে সেটা এরশাদ সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কেন তাকে সরিয়ে দেয়া হলো সেটা এরশাদ সাহেবই ভালো জানেন। তবে জি এম কাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব নয়। পার্টির কোনো নেতার সঙ্গে দেখা করবেন না কথা বলবেন না তাহলে রাজনীতি কিভাবে হয়? নির্বাচনের আগে বা পড়ে একবারও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা বলেন, এরশাদের নাটক কেবল শুরু; এই নাটক কোথায় গিয়ে ঠেকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
No comments