এক কিংবদন্তির নীরব প্রস্থান
বাংলাদেশি
সংগীতের যেদিকটায় তাকান, খুঁজে পাওয়া যাবে একজন শাহনাজ রহমতউল্লাহকে। পাঁচ
দশকেরও বেশি সময় ধরে গানে গানে সুবাস ছড়িয়েছেন তিনি। প্রতিনিয়ত গান
পিপাসুদের আত্মার খোরাক জুগিয়েছেন। সব বয়সী শ্রোতারাই কিংবদন্তি এই শিল্পীর
গান-সুরে অবগাহন করেন। দেশাত্মবোধক গান, গজল, প্রেমের গান, বিরহের গান,
উর্দু —সব ধরনের গানে তিনি অনন্য। দেশের সংগীতের কিংবদন্তি এই গায়িকা
কিশোরী বয়সেই জানান দিয়েছিলেন তাঁর সংগীত প্রতিভার। কিংবদন্তি এই শিল্পীর
স্বামী মেজর (অব.) আবুল বাশার রহমতউল্লাহর ভাষায়, গান গেয়ে মানুষকে
কাঁদানোর ক্ষমতাও ছিল শাহনাজের, যা খুব কম শিল্পীরই থাকে। দেশের
সংগীতাঙ্গনে পাঁচ দশকের রাজত্ব শেষে কিংবদন্তি শিল্পীর প্রস্থানটা একেবারেই
নীরবে হয়েছে।
শনিবার মধ্যরাতে শাহনাজ রহমতউল্লাহর মৃত্যু খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পরিবারের পক্ষ থেকেও তাড়া ছিল দ্রুত সমাহিত করার। কানাডা আর যুক্তরাজ্যে থাকা ছেলে-মেয়েকে তাঁদের মায়ের মৃত্যুর খবর রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সন্তানদের দেশে ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যাবে, তাই দেরি করেনি। পুরো বিষয়গুলো হয়েছে শাহনাজ রহমতউল্লাহর একান্ত চাওয়ার কারণে। তিনি কখনোই চাননি মৃত্যুর পর মরদেহ যেন বেশি সময় ধরে পড়ে না থাকে। স্ত্রীর কথা স্বামী ও পরিবারের অন্যরা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করে গেছেন।
পরিচিতিজনদের অনেকেই বলতে চেয়েছিলেন, একজন শাহনাজ রহমতউল্লাহ এ দেশের সম্পদ। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া উচিত, শহীদ মিনারে নেওয়া উচিত। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা উচিত। কিন্তু মৃত্যুর পর যেটা এই কিংবদন্তি মোটেও চাননি, তা পরিবারের কেউ করতে যাননি। এমনকি বনানীর সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইলেও পরিবার সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
কণ্ঠের স্বকীয়তায় বাংলাদেশি শিল্পীদের মধ্যে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ৫০ বছরের গানের জগতে দাপুটে বিচরণ করা এই শিল্পী হঠাৎ করেই গানের জীবন থেকে নিজেকে আড়াল করে নেন। ২০০৮ সালের পর একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। বারিধারার পার্ক রোডের বাড়ির ছাড়ে শখের বাগানে সময় কেটে যেত তাঁর। তবে খুব কাছের সহশিল্পী ও শুভাকাঙক্ষীদের বাসায় মাঝে মধ্যে কিছু ঘরোয়া আয়োজনে তাঁর উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল।
কথায় কথায় একবার কিংবদন্তি এই শিল্পী বলেছিলেন, ৫-৬ বছর বয়সেই নাকি তিনি গুণগুণ করে গান গাইতেন। বিষয়টি বাবা এম ফজলুল হকের নজরে এসেছিল। নয় বছর বয়সে বড় বোনকে গানের তালিম দিতে বাসায় ওস্তাদ মুনীর হোসেন আসতেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহর ভাষায়, ভিকারুন্নিসা স্কুলের শিক্ষার্থী তাঁর এই বড় বোন তুখোড় মেধাবী সংগীতশিল্পী ছিলেন। বোন তালিম নেওয়ার সময় পাশে বসে থাকতেন তিনি। এই বোনটি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শাহনাজ রহমতউল্লাহ সেই ছোট্ট বয়সে বেতারেও গাইতেন। খেলাঘরেও গান শিখেছেন। ওই সময়টায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশের আরেক বরেণ্য গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁরা নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। ছোট্ট বয়সে পরিণত কণ্ঠের কারণে ওস্তাদের পাশাপাশি অন্য অনেকের প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন তিনি।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ ১৯৬২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী। তাঁর মতে, বাবাই মনে করেছিলেন, গান গাইলে তিনি বেশ ভালো করতে পারবেন। তাই তো বাবা এম ফজলুল হকের উৎসাহে মা আসিয়া হক তাকে ওস্তাদ রেখে গান শেখানো শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী গজল সম্রাট মেহদী হাসানের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের মাধ্যমে তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই গজল সম্রাটের সাহচর্য পান।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে দেশাত্মবোধক গানে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক কণ্ঠস্বর হিসেবে দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। শুধু শ্রোতা নয়, পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মাঝেও তাঁর গাওয়া গানগুলো আজও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই শিল্পীর আসল নাম শাহনাজ বেগম হলেও পরবর্তীতে শাহনাজ রহমতউল্লাহ হিসেবেই জনপ্রিয়তা পান। বরেণ্য এ শিল্পী শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে। এর বাইরেও শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে অসংখ্য কালজয়ী গান। দেশের গান এবং চলচ্চিত্রের গানে তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’-এর মতো তুমুল জনপ্রিয় গান গেয়েছেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া চারটি গান জায়গা করে নেয়। শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া অসংখ্য রোমান্টিক গানের মধ্যে ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি’ ইত্যাদি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
দীর্ঘ সংগীতজীবনের এই সময়ে শাহনাজ রহমতউল্লাহর চারটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। প্রথমটি ছিল প্রণব ঘোষের সুরে ‘বারটি বছর পরে’, তারপর প্রকাশিত হয় আলাউদ্দীন আলীর সুরে ‘শুধু কি আমার ভুল’। গানের জীবনে ৫০ বছর পূর্তির পর থেকে পেশাদারভাবে গান গাওয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৭৩ সালে শাহনাজ রহমতউল্লাহ সেনা কর্মকর্তা আবুল বাশার রহমতউল্লাহকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। মেয়ে নাহিদ রহমতুল্লাহ থাকেন লন্ডনে। আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমতুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় থাকেন। অসংখ্য-অগণিত শ্রোতা-ভক্তদের অমোঘ ভালোবাসা ছাড়াও তার প্রাপ্ত পুরস্কার-সম্মাননার তালিকাটাও বেশ লম্বা। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালে রাষ্ট্র তাঁকে সম্মানিত করেছে একুশে পদকে ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এ ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই সংগীতশিল্পী।
সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা বলেন, ‘কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ মরে গিয়ে জানিয়ে দিলেন উনি ছিলেন, উনি আছেন, উনি থাকবেন। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান যে শাহনাজ রহমতউল্লাহ একান্তই আমাদের ছিলেন। সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী এবং শাহনাজ রহমতউল্লাহ মিলে যে অনবদ্য সৃষ্টির যৌথ অধ্যায় ছিল, তা সত্যি সত্যিই ভীষণ মৌলিক। তাঁর গানের প্রক্ষেপণ, উপস্থাপন, তাঁর কণ্ঠের ট্রিমেলো, রেজোন্যান্স, শব্দচয়ন, সর্বোপরি তাঁর বিশেষায়িত অন্যরকম কণ্ঠ তাঁর প্রতিটি গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ গান কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার গবেষণা বলে ওনার গান প্রথমে গান হয়ে জন্ম নিয়ে তারপর কবিতা হয়ে উড়ে উড়ে সাহিত্যে ছড়িয়ে যায়। যেমন “সেই চেনা মুখ কত দিন দেখিনি” এই লাইনটি দিয়ে তার সুরের মাধুরীর ওপর ভিত্তি করে একজন ঔপন্যাসিক একটি উপন্যাস লেখার প্লট পেয়ে যাবেন।’
বাংলা গানের কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ দেশাত্মবোধক এই গানটি ১৯৭০ সালের মার্চে লেখেন তিনি। তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বঞ্চনা-দুর্দশা আর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ছন্দময় করে গানটি তৈরি করে বাঙালির হৃদয়ে জাগরণ তুলেছিলেন তিনি। আর এই গানে কণ্ঠ দেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। প্রিয় শিল্পীর শেষ বিদায়ের আগে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শাহনাজ রহমতউল্লাহর বারিধারার বাসায় এসেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তখন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘একজন বড় মাপের শিল্পী শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকা পালন করেন। আজকে যদি ভারতের দিকে তাকাই দেখবেন, লতা মুঙ্গেশকরের নাম বললেই সারা বিশ্ব তাঁকে একনামে চেনেন। পাকিস্তানের নুরজাহানের নাম বললে সারা পৃথিবী একনামে তাঁকে চেনে। তেমনি বাংলাদেশের কিছু শিল্পী আছেন যাদের নাম বললে সারা পৃথিবীর মানুষ চিনবে। শাহনাজ রহমতউল্লাহ তাঁদেরই একজন। সংগীত জগতে বাংলা গানের দূত ছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। তিনি বাংলা গানের প্রথম সারির প্রতিনিধি। শিল্পীরা তৃপ্তির জন্য কাজ করেন, খ্যাতির জন্য নয়। শাহনাজ রহমতউল্লাহকে যতটুকু জেনেছি, তিনিও তৃপ্তির জন্য গান করেছেন, খ্যাতির জন্য নয়।’
শাহনাজ রহমতউল্লাহর বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন বাংলাদেশের গুণী সুরকার, সংগীত পরিচালক, সংগীতজ্ঞ ও শব্দসৈনিক। বিবিসির জরিপে যে ২০টি বাংলা গান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে এর মধ্যে তিনটি গান “জয় বাংলা বাংলার জয়”, “একবার যেতে দে না” এবং “একতারা তুই দেশের কথা” তাঁর সুর করা। আর ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় ছিল৷ সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সুদর্শন নায়ক ও সংগীতশিল্পী। তিনি চিরসবুজ নায়ক হিসেবে পরিচিত। আশির দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
শনিবার মধ্যরাতে শাহনাজ রহমতউল্লাহর মৃত্যু খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পরিবারের পক্ষ থেকেও তাড়া ছিল দ্রুত সমাহিত করার। কানাডা আর যুক্তরাজ্যে থাকা ছেলে-মেয়েকে তাঁদের মায়ের মৃত্যুর খবর রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সন্তানদের দেশে ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যাবে, তাই দেরি করেনি। পুরো বিষয়গুলো হয়েছে শাহনাজ রহমতউল্লাহর একান্ত চাওয়ার কারণে। তিনি কখনোই চাননি মৃত্যুর পর মরদেহ যেন বেশি সময় ধরে পড়ে না থাকে। স্ত্রীর কথা স্বামী ও পরিবারের অন্যরা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করে গেছেন।
পরিচিতিজনদের অনেকেই বলতে চেয়েছিলেন, একজন শাহনাজ রহমতউল্লাহ এ দেশের সম্পদ। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া উচিত, শহীদ মিনারে নেওয়া উচিত। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা উচিত। কিন্তু মৃত্যুর পর যেটা এই কিংবদন্তি মোটেও চাননি, তা পরিবারের কেউ করতে যাননি। এমনকি বনানীর সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইলেও পরিবার সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
কণ্ঠের স্বকীয়তায় বাংলাদেশি শিল্পীদের মধ্যে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ৫০ বছরের গানের জগতে দাপুটে বিচরণ করা এই শিল্পী হঠাৎ করেই গানের জীবন থেকে নিজেকে আড়াল করে নেন। ২০০৮ সালের পর একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। বারিধারার পার্ক রোডের বাড়ির ছাড়ে শখের বাগানে সময় কেটে যেত তাঁর। তবে খুব কাছের সহশিল্পী ও শুভাকাঙক্ষীদের বাসায় মাঝে মধ্যে কিছু ঘরোয়া আয়োজনে তাঁর উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল।
কথায় কথায় একবার কিংবদন্তি এই শিল্পী বলেছিলেন, ৫-৬ বছর বয়সেই নাকি তিনি গুণগুণ করে গান গাইতেন। বিষয়টি বাবা এম ফজলুল হকের নজরে এসেছিল। নয় বছর বয়সে বড় বোনকে গানের তালিম দিতে বাসায় ওস্তাদ মুনীর হোসেন আসতেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহর ভাষায়, ভিকারুন্নিসা স্কুলের শিক্ষার্থী তাঁর এই বড় বোন তুখোড় মেধাবী সংগীতশিল্পী ছিলেন। বোন তালিম নেওয়ার সময় পাশে বসে থাকতেন তিনি। এই বোনটি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শাহনাজ রহমতউল্লাহ সেই ছোট্ট বয়সে বেতারেও গাইতেন। খেলাঘরেও গান শিখেছেন। ওই সময়টায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশের আরেক বরেণ্য গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁরা নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। ছোট্ট বয়সে পরিণত কণ্ঠের কারণে ওস্তাদের পাশাপাশি অন্য অনেকের প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন তিনি।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ ১৯৬২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী। তাঁর মতে, বাবাই মনে করেছিলেন, গান গাইলে তিনি বেশ ভালো করতে পারবেন। তাই তো বাবা এম ফজলুল হকের উৎসাহে মা আসিয়া হক তাকে ওস্তাদ রেখে গান শেখানো শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী গজল সম্রাট মেহদী হাসানের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের মাধ্যমে তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই গজল সম্রাটের সাহচর্য পান।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে দেশাত্মবোধক গানে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক কণ্ঠস্বর হিসেবে দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। শুধু শ্রোতা নয়, পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মাঝেও তাঁর গাওয়া গানগুলো আজও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই শিল্পীর আসল নাম শাহনাজ বেগম হলেও পরবর্তীতে শাহনাজ রহমতউল্লাহ হিসেবেই জনপ্রিয়তা পান। বরেণ্য এ শিল্পী শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে। এর বাইরেও শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে অসংখ্য কালজয়ী গান। দেশের গান এবং চলচ্চিত্রের গানে তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’-এর মতো তুমুল জনপ্রিয় গান গেয়েছেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া চারটি গান জায়গা করে নেয়। শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া অসংখ্য রোমান্টিক গানের মধ্যে ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি’ ইত্যাদি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
দীর্ঘ সংগীতজীবনের এই সময়ে শাহনাজ রহমতউল্লাহর চারটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। প্রথমটি ছিল প্রণব ঘোষের সুরে ‘বারটি বছর পরে’, তারপর প্রকাশিত হয় আলাউদ্দীন আলীর সুরে ‘শুধু কি আমার ভুল’। গানের জীবনে ৫০ বছর পূর্তির পর থেকে পেশাদারভাবে গান গাওয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৭৩ সালে শাহনাজ রহমতউল্লাহ সেনা কর্মকর্তা আবুল বাশার রহমতউল্লাহকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। মেয়ে নাহিদ রহমতুল্লাহ থাকেন লন্ডনে। আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমতুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় থাকেন। অসংখ্য-অগণিত শ্রোতা-ভক্তদের অমোঘ ভালোবাসা ছাড়াও তার প্রাপ্ত পুরস্কার-সম্মাননার তালিকাটাও বেশ লম্বা। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালে রাষ্ট্র তাঁকে সম্মানিত করেছে একুশে পদকে ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এ ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই সংগীতশিল্পী।
সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা বলেন, ‘কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ মরে গিয়ে জানিয়ে দিলেন উনি ছিলেন, উনি আছেন, উনি থাকবেন। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান যে শাহনাজ রহমতউল্লাহ একান্তই আমাদের ছিলেন। সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী এবং শাহনাজ রহমতউল্লাহ মিলে যে অনবদ্য সৃষ্টির যৌথ অধ্যায় ছিল, তা সত্যি সত্যিই ভীষণ মৌলিক। তাঁর গানের প্রক্ষেপণ, উপস্থাপন, তাঁর কণ্ঠের ট্রিমেলো, রেজোন্যান্স, শব্দচয়ন, সর্বোপরি তাঁর বিশেষায়িত অন্যরকম কণ্ঠ তাঁর প্রতিটি গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ গান কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার গবেষণা বলে ওনার গান প্রথমে গান হয়ে জন্ম নিয়ে তারপর কবিতা হয়ে উড়ে উড়ে সাহিত্যে ছড়িয়ে যায়। যেমন “সেই চেনা মুখ কত দিন দেখিনি” এই লাইনটি দিয়ে তার সুরের মাধুরীর ওপর ভিত্তি করে একজন ঔপন্যাসিক একটি উপন্যাস লেখার প্লট পেয়ে যাবেন।’
বাংলা গানের কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ দেশাত্মবোধক এই গানটি ১৯৭০ সালের মার্চে লেখেন তিনি। তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বঞ্চনা-দুর্দশা আর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ছন্দময় করে গানটি তৈরি করে বাঙালির হৃদয়ে জাগরণ তুলেছিলেন তিনি। আর এই গানে কণ্ঠ দেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। প্রিয় শিল্পীর শেষ বিদায়ের আগে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শাহনাজ রহমতউল্লাহর বারিধারার বাসায় এসেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তখন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘একজন বড় মাপের শিল্পী শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকা পালন করেন। আজকে যদি ভারতের দিকে তাকাই দেখবেন, লতা মুঙ্গেশকরের নাম বললেই সারা বিশ্ব তাঁকে একনামে চেনেন। পাকিস্তানের নুরজাহানের নাম বললে সারা পৃথিবী একনামে তাঁকে চেনে। তেমনি বাংলাদেশের কিছু শিল্পী আছেন যাদের নাম বললে সারা পৃথিবীর মানুষ চিনবে। শাহনাজ রহমতউল্লাহ তাঁদেরই একজন। সংগীত জগতে বাংলা গানের দূত ছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। তিনি বাংলা গানের প্রথম সারির প্রতিনিধি। শিল্পীরা তৃপ্তির জন্য কাজ করেন, খ্যাতির জন্য নয়। শাহনাজ রহমতউল্লাহকে যতটুকু জেনেছি, তিনিও তৃপ্তির জন্য গান করেছেন, খ্যাতির জন্য নয়।’
শাহনাজ রহমতউল্লাহর বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন বাংলাদেশের গুণী সুরকার, সংগীত পরিচালক, সংগীতজ্ঞ ও শব্দসৈনিক। বিবিসির জরিপে যে ২০টি বাংলা গান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে এর মধ্যে তিনটি গান “জয় বাংলা বাংলার জয়”, “একবার যেতে দে না” এবং “একতারা তুই দেশের কথা” তাঁর সুর করা। আর ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় ছিল৷ সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সুদর্শন নায়ক ও সংগীতশিল্পী। তিনি চিরসবুজ নায়ক হিসেবে পরিচিত। আশির দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
No comments