মুখোমুখি মেনন-আব্বাস by কাফি কামাল
রাজধানীর
প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল-পল্টন-রমনা-শাহবাগ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ নির্বাচনী আসন।
বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুপ্রিম
কোর্ট, মন্ত্রীপাড়া, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই অভিজাত এ আসন। ২০০৮
সালের নির্বাচনের আগে আসন পুনর্বিন্যাস করে গঠিত ঢাকা ৮ আসনের মোট ভোটার
সংখ্যা দু’লাখ ষাট হাজার। এরাই এবার নির্ধারণ করবেন দুই সুপার হেভিওয়েটের
ভোটযুদ্ধের ফলাফল। একজন ক্ষমতাসীন দল মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির
সভাপতি রাশেদ খান মেনন। যিনি একই সঙ্গে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের
মন্ত্রী। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। অন্যজন বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির
নীতিনির্ধারক ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদ। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র। বিএনপি সরকারের আমলে নানা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী। দুজনই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির বিপরীতমুখী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রভাবশালী নেতা। তবে ভোটের মাঠে আগে তারা কখনও মুখোমুখি হননি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন রাশেদ খান মেনন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মামলা জটিলতার কারণে সেবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মির্জা আব্বাস। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা, ডিসিসির সাবেক মেয়র ও সাবেক এমপি হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছে আব্বাসের শক্ত অবস্থান। অন্যদিকে মেনন পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। ফলে এ আসনে লড়াইটা হবে বাঘের সঙ্গে বাঘের। রাজনীতিতে তারা প্রভাবশালী নেতা হলেও ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান কেমন সে কৌতূহল সারা দেশের মানুষের।
রাজনীতিতে দু’জনেরই রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। রাশেদ খান মেনন পাকিস্তান আমলের কিংবদন্তি তুল্য ছাত্রনেতা। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন। প্রগতিশীল রাজনীতির এ উচ্চকণ্ঠী নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও শিকার হয়েছেন হামলার। দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ১৪ দল গঠনসহ মহাজোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত একদশক ধরে দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করছেন রাশেদ খান মেনন। মন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন সরকারে। অন্যদিকে মির্জা আব্বাস বাংলাদেশের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপির যুবসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুবদল সভাপতি হিসেবে রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা।
তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। রাজনীতি করতে গিয়ে বহুবার হামলা-মামলা ও জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দীর্ঘ দুই বছর কারাভোগ করেছেন। এক যুগ ধরে অব্যাহত মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছেন মির্জা আব্বাস। বারবার কারাভোগ করেছেন। পুলিশের অনুমতি জটিলতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলার কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে ঢাকা-৮ এর একটি বড় অংশ শাহজাহানপুরের স্থায়ী এই বাসিন্দার সাবেক নির্বাচনী এলাকা। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই বিএনপি নেতার আলাদা ইমেজ ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এলাকায়।
দল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও রাশেদ খান মেনন এলাকায় সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চালিয়েছেন আগাম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে রেখেছেন সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। তবে আয়োজন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে না পারলেও খুব বেশি পিছিয়ে নেই মির্জা আব্বাস। বরং স্থানীয় হওয়ায় তার শাহজাহানপুরের বাড়িটি সবসময় সরগরম থাকে নেতাকর্মীদের আনাগোনায়। রাজনীতিতে একরোখা চরিত্রের হলেও কর্মীবান্ধব হিসেবে খ্যাতি আছে মির্জা আব্বাসের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৯, ২০, ২১নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সীমানাপুনর্নির্ধারণের সময় ঢাকা-৬ ও ঢাকা-১০ এর একাংশের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ আসন। এর আগে এ আসনের মতিঝিল ও পল্টন থানার আওতাভুক্ত এলাকা ঢাকা-৬ ও রমনা থানার আওতাভুক্ত এলাকা ঢাকা-১০ আসনের অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো তৎকালীন ঢাকা-৬ আসন থেকে মির্জা আব্বাস এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হারলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন। বিএনপি সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিছুদিন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদেও দায়িত্ব পালন করেন। এই আসনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছে হেরেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে ২০০১ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। পরে তিনি দল ত্যাগ করলে উপনির্বাচনে এ আসনে মোসাদ্দেক আলী ফালু এমপি হন। সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ডা. এইচবিএম ইকবাল। ২০০৮ সালে নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর নতুন সৃষ্ট এ আসনের প্রথম এমপি নির্বাচিত হন রাশেদ খান মেনন। সেবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মেননের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল। দুই ছাত্রনেতার লড়াইয়ে সেবার ৩৩ হাজার ৯৮১ ভোট বেশি পেয়ে জিতেছিলেন মেনন। মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন এবং প্রথমে বিমানমন্ত্রী ও পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অবশ্যই ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম ও ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন।
ঢাকা-৮ আসনে ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার আর মহাজোটের লক্ষ্য অধিকৃত দুর্গ রক্ষা। ক্ষমতায় থাকার সময় এমপি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে এবং তার আগে মেয়র হিসেবে এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন মির্জা আব্বাস। স্থানীয় বিএনপির নেতারা জানান, ঢাকা-৮ আসনের প্রতিটি অলি-গলি, ওয়ার্ড ও থানায় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় রয়েছেন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নেও গুরুত্ব দিয়েছেন রাশেদ খান মেনন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য রাশেদ খান মেননের শান্তিনগরের অফিসে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চলছে কমিটি গঠনের কাজ।
দু’জনকেই ভোটের লড়াইয়ে এগোতে হবে অস্বস্তি নিয়ে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন দলটির ৪ নেতা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল মেননের কাছ থেকে এলাকাবাসীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তেমন সুযোগ-সুবিধা পান না। তাই তারা দলীয় প্রার্থী চেয়েছিল। কিন্তু মহাজোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান রাশেদ খান মেনন। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে এক সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন অন্যরা। এ ছাড়া ঢাকা-৮ আসনের ৯টি ওয়ার্ডের প্রত্যেক কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগের নেতা। তারা সবাই নৌকা প্রতীকের পক্ষে সক্রিয় হলে মাঠে শক্ত অবস্থান পাবেন মেনন। তবে নৌকা প্রতীকে অন্য দলের নেতার জন্য কতটুকু সক্রিয়ভাবে কাজ করবেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা সেটা নিয়ে সংশয় পোষণ করছেন রাজনৈতিক মহল। অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন হাবিব-উন নবী খান সোহেল। তিনি এক সময় মির্জা আব্বাসের সঙ্গে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এবং এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী তরুণ এই নেতার রয়েছে বিপুল সংখ্যক অনুসারী। দুইশ’র বেশি মামলা নিয়ে বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন তিনি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে তাকে ঢাকা-৮ এর বদলে ঢাকা-৯ এর মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু আসন পাল্টানোর প্রতিবাদে তিনি তার সে মনোনয়নপত্র জমা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে একধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে মহানগর বিএনপির সোহেল অনুসারীদের। এখন তাদের নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় করাই হবে মির্জা আব্বাসের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদ। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র। বিএনপি সরকারের আমলে নানা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী। দুজনই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির বিপরীতমুখী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রভাবশালী নেতা। তবে ভোটের মাঠে আগে তারা কখনও মুখোমুখি হননি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন রাশেদ খান মেনন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মামলা জটিলতার কারণে সেবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মির্জা আব্বাস। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা, ডিসিসির সাবেক মেয়র ও সাবেক এমপি হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছে আব্বাসের শক্ত অবস্থান। অন্যদিকে মেনন পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। ফলে এ আসনে লড়াইটা হবে বাঘের সঙ্গে বাঘের। রাজনীতিতে তারা প্রভাবশালী নেতা হলেও ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান কেমন সে কৌতূহল সারা দেশের মানুষের।
রাজনীতিতে দু’জনেরই রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। রাশেদ খান মেনন পাকিস্তান আমলের কিংবদন্তি তুল্য ছাত্রনেতা। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন। প্রগতিশীল রাজনীতির এ উচ্চকণ্ঠী নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও শিকার হয়েছেন হামলার। দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ১৪ দল গঠনসহ মহাজোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত একদশক ধরে দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করছেন রাশেদ খান মেনন। মন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন সরকারে। অন্যদিকে মির্জা আব্বাস বাংলাদেশের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপির যুবসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুবদল সভাপতি হিসেবে রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা।
তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। রাজনীতি করতে গিয়ে বহুবার হামলা-মামলা ও জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দীর্ঘ দুই বছর কারাভোগ করেছেন। এক যুগ ধরে অব্যাহত মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছেন মির্জা আব্বাস। বারবার কারাভোগ করেছেন। পুলিশের অনুমতি জটিলতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলার কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে ঢাকা-৮ এর একটি বড় অংশ শাহজাহানপুরের স্থায়ী এই বাসিন্দার সাবেক নির্বাচনী এলাকা। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই বিএনপি নেতার আলাদা ইমেজ ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এলাকায়।
দল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও রাশেদ খান মেনন এলাকায় সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চালিয়েছেন আগাম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে রেখেছেন সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। তবে আয়োজন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে না পারলেও খুব বেশি পিছিয়ে নেই মির্জা আব্বাস। বরং স্থানীয় হওয়ায় তার শাহজাহানপুরের বাড়িটি সবসময় সরগরম থাকে নেতাকর্মীদের আনাগোনায়। রাজনীতিতে একরোখা চরিত্রের হলেও কর্মীবান্ধব হিসেবে খ্যাতি আছে মির্জা আব্বাসের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৯, ২০, ২১নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সীমানাপুনর্নির্ধারণের সময় ঢাকা-৬ ও ঢাকা-১০ এর একাংশের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ আসন। এর আগে এ আসনের মতিঝিল ও পল্টন থানার আওতাভুক্ত এলাকা ঢাকা-৬ ও রমনা থানার আওতাভুক্ত এলাকা ঢাকা-১০ আসনের অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো তৎকালীন ঢাকা-৬ আসন থেকে মির্জা আব্বাস এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হারলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন। বিএনপি সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিছুদিন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদেও দায়িত্ব পালন করেন। এই আসনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছে হেরেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে ২০০১ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। পরে তিনি দল ত্যাগ করলে উপনির্বাচনে এ আসনে মোসাদ্দেক আলী ফালু এমপি হন। সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ডা. এইচবিএম ইকবাল। ২০০৮ সালে নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর নতুন সৃষ্ট এ আসনের প্রথম এমপি নির্বাচিত হন রাশেদ খান মেনন। সেবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মেননের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল। দুই ছাত্রনেতার লড়াইয়ে সেবার ৩৩ হাজার ৯৮১ ভোট বেশি পেয়ে জিতেছিলেন মেনন। মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন এবং প্রথমে বিমানমন্ত্রী ও পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অবশ্যই ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম ও ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন।
ঢাকা-৮ আসনে ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার আর মহাজোটের লক্ষ্য অধিকৃত দুর্গ রক্ষা। ক্ষমতায় থাকার সময় এমপি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে এবং তার আগে মেয়র হিসেবে এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন মির্জা আব্বাস। স্থানীয় বিএনপির নেতারা জানান, ঢাকা-৮ আসনের প্রতিটি অলি-গলি, ওয়ার্ড ও থানায় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় রয়েছেন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নেও গুরুত্ব দিয়েছেন রাশেদ খান মেনন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য রাশেদ খান মেননের শান্তিনগরের অফিসে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চলছে কমিটি গঠনের কাজ।
দু’জনকেই ভোটের লড়াইয়ে এগোতে হবে অস্বস্তি নিয়ে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন দলটির ৪ নেতা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল মেননের কাছ থেকে এলাকাবাসীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তেমন সুযোগ-সুবিধা পান না। তাই তারা দলীয় প্রার্থী চেয়েছিল। কিন্তু মহাজোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান রাশেদ খান মেনন। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে এক সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন অন্যরা। এ ছাড়া ঢাকা-৮ আসনের ৯টি ওয়ার্ডের প্রত্যেক কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগের নেতা। তারা সবাই নৌকা প্রতীকের পক্ষে সক্রিয় হলে মাঠে শক্ত অবস্থান পাবেন মেনন। তবে নৌকা প্রতীকে অন্য দলের নেতার জন্য কতটুকু সক্রিয়ভাবে কাজ করবেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা সেটা নিয়ে সংশয় পোষণ করছেন রাজনৈতিক মহল। অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন হাবিব-উন নবী খান সোহেল। তিনি এক সময় মির্জা আব্বাসের সঙ্গে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এবং এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী তরুণ এই নেতার রয়েছে বিপুল সংখ্যক অনুসারী। দুইশ’র বেশি মামলা নিয়ে বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন তিনি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে তাকে ঢাকা-৮ এর বদলে ঢাকা-৯ এর মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু আসন পাল্টানোর প্রতিবাদে তিনি তার সে মনোনয়নপত্র জমা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে একধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে মহানগর বিএনপির সোহেল অনুসারীদের। এখন তাদের নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় করাই হবে মির্জা আব্বাসের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
No comments