শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জীবনীশক্তি বলে আছে কি কিছু?
আমাদের
দেশের বাস্তবতায় সব যে স্বপ্নের মতো হয়ে যাবে তেমন আশা করব না। তবে
একেবারে আশা করবই বা না কেন! দেশ তো আর আগের মতো নেই। দৃশ্যমান জায়গা থেকেই
বলব অনেক এগিয়েছে দেশ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে।
শীতলক্ষ্যা পারের মানুষ আমরা। পাকিস্তান আমলে আর বাংলাদেশ পর্বেরও অনেক বছর
দেখতাম খেয়া পারাপারের মাঝির পরনে থাকত পুরনো মলিন লুঙ্গি আর আধছেঁড়া
গেঞ্জি। অনেকদিন পর নদী পার হতে গিয়ে বিস্ময়ে তাকাই। ছেঁড়া গেঞ্জি মাঝিদের
পরনে নেই আর। ধোপদুরস্ত পোশাক। হাতে ঘড়ি, পকেটে মুঠোফোন। মুখাবয়বে
দারিদ্র্যক্লিষ্টতার ছবি খুঁজে পেলাম না। আমাদের ছেলেবেলায় ঈদ এলে নতুন
পোশাক পাওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হতো। অনেকে প্রশ্ন করত এবার কী ঈদে পোশাক
পেয়েছ? এখন প্রশ্ন করে তোমার ক’সেট হল? জানতাম কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এ
দেশে। উৎপন্ন ফসলে সাংবৎসরের খাবার জুটত না। পাট ছাড়া রফতানি বলতে কিছু ছিল
না। সবই আমদানি করতে হতো। ভাবতাম ‘আহা অমন দেশ যদি হতো, আমরাও নানা জিনিস
রফতানি করতে পারতাম!’ সে স্বপ্নও অপূর্ণ থাকেনি। অনেক শিল্পকারখানা তৈরি
হয়েছে এ দেশে। আমাদের রফতানি পণ্যের তালিকাও বড় হচ্ছে প্রতিদিন। বিশ্বের
অনেক দেশ আমাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। নিজ
সামর্থ্যে পদ্মা সেতু করার সাহসও আমরা দেখাতে পারছি।
এমন একটি বাস্তবতায়
যদি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতো, রাজনীতি দূরদর্শী ও দেশপ্রেমআশ্রয়ী হতো
এবং রাষ্ট্র শিক্ষার উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা বাজেটকে সবচেয়ে বড়
বিনিয়োগ বিবেচনা করত, তবে দেশের এগিয়ে যাওয়াটা হতো অনেক বেশি গতিশীল।
কিন্তু বাস্তবতা দেখে আমাদের মনে হয় এ দেশের রাজনীতি তাৎক্ষণিক ঔজ্জ্বল্য
দেখিয়ে সবার চোখ ঝলসে দিতেই বেশি আগ্রহী। ভিত্তিমূলে উন্নয়নের শক্ত পিলার
প্রথিত করতে আগ্রহী নয়। সবকিছুতে রাজনীতিকরণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে হতাশা
তৈরির কারণও ঘটছে প্রতিনিয়ত। এখন নতুন করে এ স্বপ্নটি খুব দেখি- দেশের
বর্তমান অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়া অবস্থায় যদি শিক্ষা ক্ষেত্রটিকে রাজনৈতিক
লাভালাভের দৃষ্টিতে না দেখার সিদ্ধান্ত হতো! রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া
শিক্ষাঙ্গন স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারত! শিক্ষাঙ্গনের দক্ষ, মেধাবীরা যদি
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করতে পারতেন তবে শিক্ষা
ক্ষেত্র অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিশীল হতে পারত। তবে এ স্বপ্নপূরণের জন্য
রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালকরা যদি বিশ্বাস করতে
পারেন প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশ-জাতির অগ্রগতির কাণ্ডারি হতে পারে, তবেই
যৌক্তিক নীতি প্রণয়ন সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায়
কাগুজে শিক্ষানীতি হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে শিক্ষার
কোনো নীতি আমরা দেখতে পারছি না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে প্রাইমারি
শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, সেখানে আমাদের দেশে সবচেয়ে দুর্বল
অবস্থানে প্রাথমিক শিক্ষা। উচ্চশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের দায়িত্ব
নেয়ার কথা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়। কিন্তু প্রচলিত বেতন কাঠামোয় মেধাবী
গ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়েরা বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকুরে আর নিদেনপক্ষে ব্যাংকের
অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
শিক্ষকতা অনেক বেশি সম্মানের এবং আকর্ষণীয়। প্রাইমারি বিদ্যালয়ে অনেক
পিএইচডি ডিগ্রিধারীও পাওয়া যাচ্ছে। আর আমাদের দেশে প্রায় বিনা বেতন ও
স্বল্পবেতনে চাকরি করা স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন
করে। আমি ভাবি, এসব শিক্ষক দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ ছেলেমেয়েদের পড়ানোর
দায়িত্ব নিয়েছেন।
সংবিধান অনুযায়ী এদের পড়ার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব
সরকারের। তাহলে সরকারি, বেসরকারি, এমপিও নন-এমপিও এসব নানা ধারায় রেখে
বৈষম্য তৈরি করে একটি অংশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারকে সংকুচিত করে
ফেলা হচ্ছে কীভাবে? প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যে ধারায় এগোচ্ছে,
তাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে বই বিতরণ আর এ উপলক্ষে বই
উৎসব করা ছাড়া বড় কোনো সাফল্য দেখাতে পেরেছে বা পারছে বলে আমাদের মনে হয়
না। ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল চুরি আর ডিজিটাল জালিয়াতির মোকাবেলা করার
মতো সক্ষমতা দেখাতে পারছে না মন্ত্রণালয়। তাই সব পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের
রেকর্ডে বাংলাদেশ সম্ভবত গিনিসবুকে নাম লেখাতে সমর্থ হবে। আবার পাবলিক
পরীক্ষা প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে প্রশ্নফাঁস আর নকলকেও
ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থী পর্যন্ত। নকল প্রতিরোধ বলব না, তবে এড়াতে
নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু ফাঁসকারীরা হাঁটছে যেন দু’পা
আগে। শেষ পর্যন্ত এবার এসএসসিতে সব বোর্ডের পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হয়েছে অভিন্ন প্রশ্নে। শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীর হলে প্রবেশ
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে কতটা ফল দিয়েছে জানি না। হয়ে যাওয়া দুটি
পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। পত্রিকা সূত্রে পাওয়া তথ্যে
অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে এখনও অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
কিন্তু একটা প্রতিক্রিয়া তো পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী এবার প্রশ্ন
ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় কতটা অসহায় অবস্থায় আছে, এ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। তবে
আমাদের কাছে কষ্টের বিষয় এটি যে, দৈবাৎ এক-দুটি ঘটনা নয়- বছরের পর বছর
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা একের পর এক ঘটে যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানরা কিছু
করতে না পারলেও স্বপদে বহাল থাকতে পারছেন। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আর
শিক্ষার অবস্থা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেও সরকার বা রাষ্ট্রের যেন তেমন একটা
যায় আসে না। ভেতরে ক্যান্সার ছড়িয়ে দিয়ে বাইরে উন্নয়নের ঝলমলে স্যুট পরে
কতক্ষণ জাতিকে সতেজ রাখা যাবে!
প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধ নিয়ে যে হযবরল অবস্থা
রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও দায়িত্ববানদের কথা শুনলেই বোঝা যায়। কখনও
বলা হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসে কতিপয় অসাধু শিক্ষক দায়ী। কখনও কোচিং সেন্টার
দায়ী। আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে থাকে। মন্ত্রীর
ব্যক্তিগত সহকারী অপকর্মের দায়ে গ্রেফতার হন। প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত কোনো কোনো
সরকারি কর্মকর্তা এর আগেও গ্রেফতার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি
পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের নাম চলে এসেছে। ফলে
দেখা যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসের সিন্ডিকেটের শেকড়-বাকড় অনেক দূর ছড়ানো। এই
শেকড়ে কি দায়িত্ববানরাও জড়িয়ে পড়েছেন, না শেকড় ছোঁয়ার সক্ষমতা নেই? আমাদের
মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম প্রধান বাধা নোট-গাইড আর কোচিং ব্যবসা। বছরের পর
বছর ধরে শুনছি সরকার এসব বন্ধ করতে যাচ্ছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর কোনো
প্রতিফলন নেই। মন্ত্রণালয়ের ভেতরের সর্ষেতে যে ভূত আছে তারাই নাকি এসব
কার্যকর না করার ব্যবস্থা রেখে দিয়েছে। তাই এত হইচইয়ের পরও নোট-গাইড আর
কোচিং সেন্টার সদম্ভে বহাল রয়েছে। এদের টাকার কাছে পরাভব মানছে সব ঘোষণা।
বলা হয়েছিল এবারের এসএসসি পরীক্ষার তিন দিন আগে থেকে সব কোচিং সেন্টার বন্ধ
থাকবে। তা হলে তো মেনেই নেয়া হল- প্রশ্ন ফাঁসের চারণ ক্ষেত্র কোচিং
সেন্টার। তাহলে বছরের পর বছর এগুলো চলছে কেমন করে? কে জানে কী মধু আছে
এখানে! তবে সাধারণ অভিভাবক বন্দিত্বের জালে আটকে পড়ে যে সরকারের প্রতি
ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তা কি নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় রাখেন? আমার একজন পরিচিত
ভদ্রলোক জানালেন তার ড্রাইভার কষ্টে হলেও দুই ছেলেকে ঢাকার এক স্কুলে
পড়াচ্ছেন। দুঃখ করে বলছেন, প্রতি বিষয়ে দুই সেট করে গাইড কিনতে বাধ্য
হচ্ছেন তিনি। স্কুল বাধ্য করছে এক প্রকাশকের গাইড বই কিনতে আর কোচিং
সেন্টার বাধ্য করছে অন্য প্রকাশকের গাইড বই কিনতে। উভয়কে সন্তুষ্ট না রাখতে
পারলে ছেলে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসবের কারণ গাইড বইয়ের প্রকাশকরা স্কুল ও
কোচিং সেন্টারের শিক্ষকদের চড়া দামে কিনে নেন।
তাই চুক্তি অনুযায়ী
ছাত্রছাত্রীদের প্রেসক্রিপশন দিতে হচ্ছে আর পকেট কাটা যাচ্ছে অভিভাবকদের।
এই ক্ষমতাধর প্রকাশকরা একই কায়দায় অনেক দূর পর্যন্ত নিশ্চয়ই যেতে পারেন।
ফলে নানা হম্বিতম্বির পরও বন্ধ হচ্ছে না গাইড প্রকাশ আর বন্ধ করা যাচ্ছে না
কোচিং ব্যবসা। এসব বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন রাখতে হয়, কোন দিক থেকে শিক্ষা
মন্ত্রণালয় তাদের সাফল্য দাবি করতে পারবে? বেসরকারি স্কুল ও কলেজে নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা থাকে। নষ্ট রাজনীতি এখানেও
সক্রিয়। নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ হতে পারছে না অনেক
ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে প্রধান যোগ্যতা। এখানে সুস্থ ধারায় স্কুল
আর কলেজগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনও ভূমিকা রেখেছে আমরা
মনে করতে পারব না। রাজনীতিকরণের প্রকোপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘুণপোকা ধরেছে
অনেককাল থেকেই। এখানে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, না ইউজিসি কেউ কোনো ভূমিকা
রাখেনি। ভিসি নিয়োগ থেকে শিক্ষক নিয়োগ সব ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রক রাজনীতি। এসব
বাস্তবতায় জ্ঞানচর্চা আর জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমাগতভাবে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। দুর্ভাগ্য আমাদের এই যে,
যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবান, তারা অতিকথন কমিয়ে দিয়ে নির্মোহভাবে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। শিক্ষাকে
রাজনীতির সংকীর্ণ গলিপথ থেকে মুক্ত করতে পারতেন তারা, তাহলে আমরা একটি
সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারতাম। এ দেশে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর
হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো সুরাহা হয় না; তাই অগত্যা তাকেই কষ্ট দিতে হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে সব গোপন-পুরনো ঘা কিন্তু আবার দগদগে হয়ে ওঠে। শিক্ষার
ভালোমন্দের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন এ দেশের অধিকাংশ
মানুষ। ব্যর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন জীবনীশক্তি যদি প্রধানমন্ত্রী দিতে
পারেন, তবেই বোধহয় মুক্তি।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
No comments