আত্মহত্যার মতো সামাজিক ব্যাধি সংক্রমিত হচ্ছে by ড. মাহবুব উল্লাহ্
টেলিভিশনের
পর্দায় ছোট্ট একচিলতে খবর। বড় মর্মন্তুদ এ খবরটি! তরুণী মাহি (নামটি শুনতে
যদি ভুল না করে থাকি) আত্মহত্যা করেছে গলায় ফাঁস দিয়ে। দুঃসহ এ খবরটি টিভি
পর্দায় সম্ভবত এক মিনিটেরও কম সময় ধরে প্রচার করা হয়েছে। আত্মহত্যা করে
মৃত্যুর তিন দিন আগে সে তার আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছিল। অনেক ছবি। ছবিগুলো
ছোট ছোট ফ্রেমে বন্দি। কী জানাতে চেয়েছিল এই তরুণী তার আঁকা ছবিগুলোর
মাধ্যমে? কোনো চিত্র-সমালোচক হয়তো এর পোস্টমর্টেম করবে না। যদি করা হতো
তাহলে হয়তো তার আত্মহত্যার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেত। সংবাদভাষ্যকার
বলেছে, সে বিষণ্ণতায় ভুগছিল। কী সেই বিষণ্ণতা আমরা কেউ জানি না। তবে এটুকু
বুঝতে পারি জীবনের পূর্বাহ্নে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া এক নিদারুণ
খেদের ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। একজন ছবি আঁকিয়ে
যখন জীবনের ইতি টানে তখন বুঝতে হয়, মেয়েটির মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ও
আত্মবিধ্বংসিতার ভয়ানক দ্বন্দ্ব চলছিল। তার এই মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করব?
দায়ী করতে হলে এই সমাজকেই দায়ী করতে হয়। যে সমাজ নর-নারীর কলরবে মুখর, সে
সমাজে এমন বেদনাদায়ক ঘটনা কেন ঘটে? সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন তারা হয়তো বলবেন,
মেয়েটি তার চারপাশের মানুষ ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করছিল। এই
বিচ্ছিন্নতাই তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছে। শত শত মানুষের মধ্যে
জীবনযাপন করেও একজন মানুষ যখন ভাবতে শুরু করে সে বড্ড একা, তার কেউ নেই,
কিছু নেই; তখন বিশাল এক শূন্যতা তাকে গ্রাস করে। যাপিত জীবনকে মনে হয়
অর্থহীন, লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন। এমনই এক সংকটে পড়ে এমন গুণী মেয়েটি
আত্মহত্যা করেছে। এমন সুন্দর ছবি আঁকত যে, তার ছবির সমঝদার কি কেউ ছিল না?
কেউ কি তাকে কোনোদিন প্রশংসা করে বলেনি, তুমি খুব সুন্দর ছবি আঁকো। হয়তো
বলেছে। নইলে ছবি আঁকার প্রেরণা সে কোথায় পেত। আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক
পরিণতি বেছে নেয়ার আগে সে হয়তো ছবির প্রদর্শনী করে জানান দিতে চেয়েছিল,
আমি
অত অবহেলার পাত্রী নই। আমার জীবনের ইতি ঘটাতে পারে, তবুও আমি রেখে যেতে
চাই জীবনের প্রতি আমার ভালোবাসার নিদর্শন। হয়তো তার মধ্যে থাকা জীবনকে
ভালোবাসার শক্তি জীবনকে হনন করার শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল। তাই সে
আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তার এক ঘনিষ্ঠজন টিভি ক্যামেরার সামনে বলেছেন,
তার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। আপনজনরা ভেবেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার ভিন্ন
পরিবেশে তার মনে পরিবর্তন আসবে। বাঁচার তাগিদ সে অনুভব করবে। বোঝাই যাচ্ছে
আপনজনরা তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। তবে ক্যামেরার ফোকাসে ফাঁসির
রজ্জু দেখানোটা আমার কাছে খুবই কষ্টদায়ক মনে হয়েছে। এই দৃশ্যটি কি পরিহার
করা যেত না? খবরের মধ্যে অনেক নিষ্ঠুর সত্য থাকে। সেসব সত্য কি এমন
বিসদৃশভাবে দেখাতে হবে? গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়েও এমন
স্বাধীনতার চর্চা আমার পছন্দ নয়। যা কথায় প্রকাশ করা হয়, তার সচিত্র দৃশ্য
খুবই ভয়াবহ হতে পারে। এমনকি আত্মহত্যা রোগে যারা ভুগছে তাদের আত্মহত্যার
পথটিও বাতলে দিতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী এরিখ ফোম Lonely Crowd-এর কথা বলেছেন।
শত শত মানুষের ভিড়ে মানুষ কী করে একাকী বোধ করতে পারে, এটি এক বিরাট
প্রশ্ন। যে কোনো আধুনিক নগরীর রাজপথে শত-সহস্র মানুষকে হেঁটে চলতে দেখা
যায়। কেউ কারও দিকে দৃষ্টিপাত করে না। সবাই অচেনা। সুতরাং কেউ কারও জন্য
আপনবোধ করে না। আধুনিক শিল্পায়িত নগর সমাজে এ রকম বিচ্ছিন্নতারই উদ্রেক
হয়েছে। মানুষের যূথবদ্ধ জীবন হারিয়ে গেছে। সবাই আপন মনে ছুটছে আপনাপন কাজে।
বিশ্রাম নেই। বিরতি নেই। নিজেকে নিয়ে মানুষ এত ব্যস্ত যে, অন্যের প্রতি
ভ্রূক্ষেপ করে তাকানোরও সময় নেই। সময়ের এত দাম, কেউ কারও দুঃখ-বেদনা ও
দুর্ঘটনায় একটু তাকিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না। একে ‘সময় নষ্ট করা’ বলা কেন?
মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে যদি সময়ের অপচয়ও হয়, তার চেয়ে সময়ের
উত্তম ব্যবহার আর কী হতে পারে। এজন্যই তো ইংরেজ কবি উইলিয়াম হেনরি ডেভিস
বলেছিলেন, What is this life if, full of care/We have no time to stand
and stare. জীবনের এমন গতি, এমন কর্মচাঞ্চল্য কতটুকু কাম্য হতে পারে?
অর্থনীতির ইতিহাস যারা রচনা করেছেন তাদের দৃষ্টিতে ঘড়ির আবিষ্কার
মানবসভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আজকাল আমরা ডিজিটাল ঘড়ি ব্যবহার করি।
মহাশূন্যে বিচরণের জন্য এর চেয়েও অনেক বেশি সূক্ষ্ম ঘড়ির ব্যবহার হয়।
কিন্তু ঘড়ি আবিষ্কারের প্রথমদিকে এমন ঘড়ি ছিল না। ছিল বালুঘড়ি অথবা
সূর্যঘড়ি। স্কুলে পড়ার সময় কুমিল্লা কালেক্টরেটের মাঠে একটি সূর্যঘড়ি
দেখেছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ওই ঘড়ির দণ্ডটির ছায়া
দেখতাম। বেলা কত হয়েছে বুঝতে চাইতাম। আরও একটি কথোপকথনের গদ্যাংশ ব্যাকরণ
পড়তে গিয়ে শিখেছিলাম। কথাটি ছিল, ‘বেলা যে পড়ে এল জলকে চল’। এখানে জল আনতে
চলো না বলে কেন জলকে চল বলা হল? এটি কোন কারকে পড়ে? খুবই চমৎকার অভিব্যক্তি
ছিল এই বাক্যটির মধ্যে। বেলা ফুরানোর আগেই জল আনতে হবে। অধ্যাত্মবাদীরা
বলেন, জীবন ফুরানোর আগেই পরপারের সম্বল সংগ্রহ করতে হবে। যে জীবন
মানবকল্যাণে মানুষের ভালোবাসায় উৎসর্গীকৃত, সেই জীবনেই তো ঘটে পরপারের
উৎকৃষ্ট সম্বলের সমাহার। ঘড়ির আবিষ্কার মানুষকে সময়সচেতন থাকতে শিখিয়েছে।
বিজ্ঞানীর নব-নব আবিষ্কারে সময় বাঁচানোর অনেক উপায় সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুতগামী
মোটরযান বুলেট ট্রেন, জেট প্লেন, টেলিফোনে আলাপ সময়কে সংকুচিত করেছে।
জীবনযাত্রা প্রভূত গতি পেয়েছে। বিজ্ঞান যেমন দূরকে নিকট করেছে, পরকে করেছে
ভাই, আবার বিজ্ঞান দিয়েছে গতি, কেড়ে নিয়েছে যতি। গতিময়তা যেমন বিশ্বময়
ভ্রাতৃত্ব ও পরিচয়ের বন্ধন গড়ে তুলতে পারে, তেমনি পারে পাড়াপড়শি, আপনজনদের
সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে। বাংলাদেশে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে অনেকের মৃত্যু
ঘটে। মৃত্যুর পর লাশ রাখা হয় হাসপাতালের হিমঘরে। জানাজা বিলম্বিত হয়।
আমেরিকা থেকে সন্তান-সন্ততিদের আসার জন্যই এই বিলম্ব। অতি আপনজনরা
বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকে বলে জীবনসায়াহ্নে অনেকে একা হয়ে পড়েন। এই একাকিত্বের
কষ্ট অন্যদের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নয়।
এই বিচ্ছিন্নতাও অত্যন্ত
পীড়াদায়ক। বিচ্ছিন্নতা ঘটতে পারে ভাষার ব্যবধানের জন্যও। যে কোনো মানুষ
ভিনদেশি ভাষায় খুব পারদর্শী হতে পারে। কিন্তু তারপরও ভিনদেশি ভাষায় মনের
গহনের একান্ত অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা কঠিন। গল্পকার বনফুলের একটি গল্পে
আছে, একজন এক বিদেশিনীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তাদের জীবন পরম সুখেই
কেটেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লোকটির স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। স্ত্রীকে হারিয়ে
ভদ্রলোক এখানে-ওখানে ভ্রমণ করে সময় কাটান। একবার তিনি নেপালে গিয়ে এক
অতিথিশালায় উঠলেন। তার প্রকোষ্ঠের পাশের প্রকোষ্ঠে উঠল এক নবদম্পতি। ওরা
দু’জনেই ছিল এক ভাষাভাষী। ভদ্রলোক রাতের নিঃসীম নীরবতায় পাশের প্রকোষ্ঠ
থেকে শুনতে পেলেন নবদম্পতির প্রগল্ভালাপ। ওদের চুপিচুপি কথা বলাও রাতের
নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। ভদ্রলোকের মনে হল, তার জীবনে তিনি কখনও তার
বিদেশিনী ভালোবাসার স্ত্রীর সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে পারেননি।
ভাষার ব্যবধান তাদের কোথাও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। ভাষা আন্দোলনের এ
মুহূর্তে এই গল্পটি ভাষাপ্রেমীদের জন্য হতে পারে এক তাৎপর্যপূর্ণ
দৃষ্টান্ত। তাই মানুষ কিভাবে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিষণ্ণতার
গর্ভে ডুবে যেতে পারে, তার রয়েছে নানামাত্রিকতা। ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল
দুরখিম ‘ঝঁরপরফব’ নামে একটি অমর গবেষণা গ্রন্থ ফরাসি ভাষায় রচনা করেছিলেন। এ
গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, ‘আত্মহত্যা যেমন মানুষের অস্তিত্ব
বজায় রাখার কষ্ট থেকে উত্থিত হয় না, তেমনি এর গতিরোধ করার জন্য জীবন
সংগ্রামকে কম কষ্টকর এবং জীবনকে সহজতর করা সম্ভব হয় না। আজকাল যদি অতীতের
তুলনায় বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, এর কারণ এই নয় যে, আমাদের টিকিয়ে রাখার
জন্য অধিকতর কষ্টকর প্রয়াস চালাতে হয়। অথবা আমাদের যথাযোগ্য চাহিদাগুলো কম
পূরণ হচ্ছে, বরং এই কারণে যে, আমরা যথাযোগ্য চাহিদার সীমারেখা আর জানতে
পারি না, অথবা আমাদের প্রচেষ্টা কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে তাও জানি না। আজকাল
অবশ্য প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে। কারণ যোগাযোগ সহজতর হয়েছে, যার ফলে
বৃহত্তরসংখ্যক প্রতিযোগী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপরদিকে
উন্নততর শ্রম বিভাজন এবং জটিল সহযোগিতা এর সঙ্গী হওয়ার ফলে পেশার সংখ্যা
বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈচিত্র্য অর্জন করছে। এর ফলে মানুষ অন্য মানুষের কাছে
প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে, বেঁচে থাকার উপায় বহু গুণিত হচ্ছে এবং তারা দেখতে
পারছে তাদের অবস্থান বিরাজ করছে বিচিত্র ও বিশাল মানবগোষ্ঠীর মধ্যে। এর
মধ্যে নিকৃষ্ট প্রবণতাগুলো স্থান করে নিতে পারে। একই সময়ে সূক্ষ্ম সহযোগিতা
থেকে উৎপাদনের গভীরতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের মোট সম্পদ বৃদ্ধি পায়।
এবং প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষ ভালো বেতন পায়। এর ফলে মানুষের জীবনীশক্তির
ক্ষয় অধিকতর হারে পূরণ করা সম্ভব হয়। বস্তুত এটি নিশ্চিত যে, সমাজের
প্রতিটি স্তরে গড়পড়তা আরাম-আয়েশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও সব সময় তা একই অনুপাতে
হয় না। আমরা যে মিলমিশের অভাবে ভুগি তার কারণ এই নয় যে, দুঃখ-কষ্টের
বিষয়গত কারণ-সংখ্যাও তীব্রতায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক
দারিদ্র্যের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু যোগাযোগটি হল ভীতিপ্রদ নৈতিকতার
দারিদ্র্যে।’ বাংলাদেশে আমরা অর্থনৈতিক দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠছি ধীরে ধীরে।
কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের দারিদ্র্য বাড়ছে বৈ কমছে না। এই দারিদ্র্য
হতে পারে পড়শির ভালো-মন্দের খোঁজ না রাখা, পরিবারের মধ্যে পিতামাতার
‘সোনার হরিণ’ খোঁজার দুর্বার আকাক্সক্ষা ও প্রয়াস সোনার সন্তানটিকে হারিয়ে
ফেলার অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে নিক্ষিপ্ত হয়ে এখন
আমরা আর একে অপরের হাত ধরে চলতে পারছি না। একটা সময় ছিল যখন আমরা অন্যের
অভাব পূরণের নৈতিক তাগিদ বোধ করতাম, কিন্তু সামর্থ্য ছিল কম। এখন অন্যের
অভাব পূরণের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে, কিন্তু সেই অভাব পূরণের নৈতিক তাগিদ অনেক
কম বোধ করছি। এ কারণেই হয়তো আত্মহত্যার মতো সামাজিক ব্যাধি সংক্রমিত
হচ্ছে। নৈতিকতার পুনর্জাগরণেই এই ব্যাধি প্রশমিত হতে পারে। সমাজের গতি এই
জাগরণের বৈরী স্রোতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও ভাবতে হবে কীভাবে একে অনুকূল
স্রোতে পরিণত করা যায়।
No comments