ভিআইপিতন্ত্রী প্রাইভেট লিমিটেড অ্যান্ড কোং by ফারুক ওয়াসিফ
কিশোরগঞ্জের
মো. এরশাদ মিয়া একজন হবু ভিআইপি। তাঁর ভিজিটিং কার্ডে নিজস্ব বানানে পরিচয়
লেখা: বিশিষ্ট বড় বড় লোকের সঙ্গে সম্পর্ক। বিশিষ্ট ও বড় বড় লোকের ডাকনাম
হলো ভিআইপি। চুম্বকের সঙ্গে লোহার ঘষাঘষিতে লোহাও কিছুটা চুম্বক হয়।
ভিআইপিদের সঙ্গে ওঠবস থাকলে প্রায়-ভিআইপি থেকে ফুল-ভিআইপি হওয়াও ওয়ান-টুর
ব্যাপার। কিছু বিশিষ্ট বড় বড় লোকের সঙ্গে অল্পবিস্তর খাতির আমারও আছে।
ভিআইপি লেন হোক। তারপর খাতিরের ভিআইপির সঙ্গে এই ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’
শহরের রাস্তায় ধূমকেতুর মতো ছুটতে পারব। ভাবলেই কেমন মাথায় শিং গজিয়ে
যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে! দেশটার মাথায়ও শিং গজিয়েছে। এই শিংয়ের নাম ভিআইপি।
প্রাণীদের শিং থাকে দুটি করে আর বাংলাদেশের মাথায় অনেক শিং। উন্নয়নের সুফল
হিসেবে আনাচকানাচে হরদম ভিআইপি গজাচ্ছে। যারা যারা ভিআইপি তাদের পরিচয় আর
দিলাম না, যাঁদের নাম নেওয়া বারণ, তাঁরাও সব্বাই ভিআইপি। তাঁদের
চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুপাতো ভাইবোনেরাও ভিআইপি। ব্যাংক লুটে নেওয়া লোক
ভিআইপি, ৩২ ধারা নামের কালাকানুন দিয়ে যাদের ইজ্জত রক্ষা করা হবে, সেসব
আমলা-এমপিও ভিআইপি। আঙুল ফুলে কলাগাছা সবই ভিআইপি। যেসব সরকারি কর্মচারীর
বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য অনুমতি নেওয়ার আইন আছে, তাঁরা ভিআইপি।
জ্বালানি ও
বিদ্যুৎ খাতের বড় বড় প্রকল্পে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে আইন পাস করা আছে,
অতএব এঁরাও ভিআইপি। যাঁরা উল্টাপথে গাড়ি চালাতে পারেন, যাঁদের সন্তানেরা
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরেও রক্ষা পান, তাঁরা তো কর্মসূত্রেই ভিআইপি।
সকল শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠীর শীর্ষ ব্যক্তিরা মিলে নতুন এই ভিআইপি কাস্ট বা জাত
তৈরি হয়েছে। শ্রমিকনেতা, আয়রোজগারহীন ছাত্রনেতা, বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-কবি
এবং ডট ডট ডট...(শূন্যস্থান আপনারাই পূরণ করে নিন—সবাই ভিআইপি)। এঁদের
স্পর্শ করা আর গনগনে লাল লোহা ছোঁয়া সমান কথা। সুতরাং ভিআইপি কোনো একটা
শ্রেণি না, এটা জাত বা বর্ণ। বাংলাদেশে জাতপ্রথার চল নেই, তার বদলে এই
ভিআইপিপ্রথা নিয়েই জাতের বড়াই করতে পারি আমরা। নতুন পয়দা হওয়া এই কাস্ট বা
জাতটার জন্য তাই ছেড়ে দিতে হবে স্থান। শিশুকে ‘না’ বলবেন না, ভিআইপিদেরও
‘না’ বলবেন না। সবই তো দেওয়া হয়ে গেছে। বাংলার আকাশ তো উন্মুক্তই ছিল
তাঁদের হেলিকপ্টারের জন্য। এখন সড়কও উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দেশটাই তো
ভিআইপি হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কের এই ভিআইপি পথিকেরা মন্দ কিছু দেখতে
পান না, চানও না। তাঁরা দেখেন সুখী-সমৃদ্ধ-শুভ্র বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী গত
বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ গরিবমুক্ত হয়ে যাবে;
বর্তমানে দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ এলাকা উন্নত। তাই সাধারণ মানুষের ওপর
কর-ভ্যাট ইত্যাদি আরোপ করেই চলেছেন। কারণ, ভিআইপি বানানোর কারখানা—
নিন্দুকেরা যার নাম দিয়েছে দুর্নীতির আখড়া, তা তো চালিয়ে যেতে হবে। এই দেশে
বেকার যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে যে লাখো শিক্ষক রাজপথে অনশনে শুয়ে আন্দোলন
করেন, তাঁরাও ভিআইপি। আন্দোলন করেন কেবল শখের বশে। এই বাংলাদেশে কোনো গরিব
নেই, উদ্বাস্তু নেই, পথশিশু নেই। রবিঠাকুরের গানের ভাষায়, তাঁদের ‘চোখে তো
সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, বিশদ জোছনা,
কুসুমকোমল—সকলই আমার মতো। তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া
মরিতে চায়—না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত। সব দেশে
জনগণ অপছন্দের শাসককে বদলায়। বাংলাদেশে শাসকেরা জনগণকে বদলে দিচ্ছেন।
সম্পূর্ণ সংবিধানসম্মত এই তরিকা। সংবিধানে বলা আছে, জনগণই সকল ক্ষমতার
মালিক। জনগণের সংজ্ঞা কী? যাঁরা ক্ষমতার মালিক, যাঁরা শাসকদের টিকিয়ে
রাখেন, শাসকেরাও যাঁদের সেবা দিয়ে যান,
সংজ্ঞামতে তাঁরাই তো জনগণ। অতএব
সংবিধানের ওই ধারার ‘জনগণ’ শব্দের জায়গায় ‘ভিআইপি’ শব্দটা বসালে দেখবেন,
দেশ কী সুন্দর সংবিধানসম্মতভাবেই চলছে। যখন জনগণ শাসক বদলাতে পারে না, তখন
শাসকেরাই পছন্দ মতো জনগণ বানান। ভিআইপিরা হলেন আমাদের শাসকদের সেই ‘প্রিয়
জনগণ’। বাকি জনগণ তাহলে কোথায় যাবে? তাদের জীবন-যৌবন-উদ্যম সব খরচ হবে
যানজটে। হাটে নেওয়া মুরগির খাঁচার মতো গাদাগাদি করে, বাদুড়ের মতো ঝুলে,
ভেড়ার পালের মতো নীরবে তাদের জীবনের চাকা থাইম্যা থাইম্যা চলবে।
উড়ালসড়কগুলোও ভিআইপি পরিকল্পনার ফসল। জনগণের জন্য বরাদ্দ শুধু তলার
ভাঙা-ধুলা-ময়লার রাস্তা। জনগণের নতুন সংজ্ঞাটা হলো, যাঁরা গ্রীষ্মে
তন্দুরের গরম আর বর্ষায় বৃষ্টিবিধৌত হন, কলিম শরাফীর গাওয়া ‘সূর্যস্নান’
সিনেমার ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে সেই দুঃখে চোখেরও পানি’ গানের বাস্তবতা
যাদের জীবন, তারাই জনগণ। যারা জমিদারি প্রজাতন্ত্রের অনুগত প্রজা হয়ে
নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করছে, তারাই জনগণ। যুব ভাইবোনেরা বিসিএস পরীক্ষার
জন্য এই সংজ্ঞাটা মুখস্ত করে রাখতে পারেন। যাত্রাবাড়ীর খুদে ব্যবসায়ী
ইকবাল সংজ্ঞাটা জানতেন না। তাই পুলিশের ব্যক্তিগত হুকুম উপেক্ষা করে ভাল
জনগণ হওয়ার পরীক্ষায় ফেল মেরেছেন। তাঁকে পুলিশ বক্সে ধরে এনে পেটানো হয়।
তিনি নাকি পুলিশের সঙ্গে ‘ব্যবহারটা ভালো করে নাই’। এক পুলিশের ব্যক্তিগত
ব্যাগ তিনি তাঁর দোকানে রাখতে ভয় পেয়েছিলেন। ব্যাগে যদি অবৈধ কিছু থাকে!
যাহোক, জনগণের নতুন সংজ্ঞাটা তাঁকে কারিগরি পদ্ধতিতে অর্থাৎ প্রহার-থেরাপি
দিয়ে বোঝানো গেছে। জনগণের চোখে সব পুলিশই ভিআইপি এবং সব ভিআইপিই জনগণের
বন্ধু। ভিআইপি লেনের প্রস্তাব তাই আমি সমর্থন করি। নাগরিক হিসেবে জনগণের
আসল স্থান, আসল মর্যাদা আর প্রকৃত অধিকার বোঝানোর জন্য এর থেকে মারাত্মক পথ
আর কী হতে পারে? দেড়-দুই কোটির মহানগরে ভিআইপি সড়ক হলে সত্যটা তাঁদের
অন্তরে প্রতিষ্ঠিত। দেশটা খাসজনদের তথা ভিআইপির, আমজনতা হলো ছিবড়া করা আমের
আঁটি, রস খেয়ে তাদের দূরে ফেলে দেওয়া যায়। আধুনিক বিশ্বে গতিই ক্ষমতা। এ
থেকে নতুন শব্দ তৈরি করা যায়: গতিক্ষমতা।
গতিক্ষমতা যাদের বেশি তাদের সুখ,
সমৃদ্ধি, দাপটও বেশি। এ জন্যই তারা ‘কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া
খেলিয়া মরিতে চায়’। কোনো দেশে বৈষম্য ও গণতন্ত্রহীনতা কোন মাত্রায় আছে,
তা বোঝার সহজ উপায় হলো সেদেশের সড়কের দিকে তাকানো। এখানে একেকটা ব্যক্তিগত
বাহন বাসের অর্ধেক জায়গা নিয়ে চলে। একেকটি বাসকে কমপক্ষে ১০০ জন যাত্রী
থাকেন। সেই হিসেবে একেকজন ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক ২০ থেকে ৫০ জনের জায়গা
দখলে রেখে রাস্তায় চলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ি তো একটু উঁচুতলার
মধ্যবিত্তের বাহন। ভিআইপিরা আরো উঁচুতে। তাই তাঁদের দরকার নিজস্ব ভিআইপি
লেন। দেশটা যেভাবে ভিআইপি তৈরির কারখানা হয়ে উঠেছে, তাতে কিছুদিনের মধ্যে
ভিভিআইপিরা বলবেন ভিভিআইপি রাস্তা চাই। জাতপ্রথার নিয়মই তাই। সমানদের মধ্যে
কিছু কিছু মানুষ একটু বেশি সমান। অভিজাত ভিআইপি জাতকে আমরা স্বাগতম জানাই।
তাঁদের গতিক্ষমতা বাড়লে উন্নয়ন, গণতন্ত্র আরো তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে
যাবে। অনেকে মিলে আটকে থাকার চেয়ে ‘লিমিটেড’ লোকজনের জন্য তুমুল গতিক্ষমতা
দেওয়াই কি ভালো নয়? আরও ভালো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ‘ভিআইপিতন্ত্রী
বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে ডাকা।
No comments