পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও বৈষম্য রোধে করণীয়
আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক যেমন পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষার সামগ্রিক মান
ইত্যাদি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সচেতন মহলে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
দুটি পাবলিক পরীক্ষা- জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা
সমাপনীর (পিইসি) আদৌ দরকার আছে কিনা, কিংবা জিপিএ-৫ দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের
চিহ্নিত করা যাচ্ছে কিনা, অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে।
গত কয়েক বছরে
লাগামহীনভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ
করেছে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ব্যর্থ নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে অনেক সময়
হতাশ মনে হয়েছে। আসলে সমস্যাকে যদি আমরা স্বীকার না করি, তাহলে সমাধান
খুঁজে পাব না। কথায় আছে, সমস্যা চিহ্নিত হলেই অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়। একটি
বাচ্চা পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় যদি জানে, তার কিছু সহপাঠী ইতিমধ্যে
প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছে, তাহলে তার ওপর কি পরিমাণ মানসিক চাপ তৈরি হয়, এটা
আমরা নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারি। এ আলোচনা আমি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র
প্রণয়ন নিয়ে সীমাবদ্ধ রাখব, যা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধসহ অন্যান্য কিছু বিষয়ের
উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখি। প্রথমেই পাবলিক পরীক্ষার তিনটি
দিক, প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার হলে নকল ও পরীক্ষার ফলাফলে বিভিন্ন বোর্ডে
অসাম্যতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফাঁসকৃত
প্রশ্ন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই; কিন্তু
পদ্ধতিগত ত্রুটি ও কিছু নীতিহীন মানুষের দায়টা প্রথমেই আসে। তাদের যেহেতু
আমরা আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারছি না, সুতরাং
ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি না করে কৌশলে তাদের নিবৃত্ত করতে হবে। প্রশ্নপত্রের
অনেক সেট করা হলে এবং বিভিন্ন সেটে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিলে, কোন্
পরীক্ষার্থীর হাতে কোন্ সেট প্রশ্ন পড়বে, তা অনিশ্চিত থাকলে, কয়েক সেট
প্রশ্ন ফাঁস হলেও সেগুলোয় শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবে না। পরীক্ষার্থীরা
আগ্রহী না হলে প্রশ্নপত্র ব্যবসায়ীরাও নিবৃত্ত হবে। বর্তমানে প্রশ্নের
কয়েকটি সেট করা হলেও পরীক্ষার আগে একটি সেট নির্দিষ্ট করা হয়। সেটি ফাঁস
হলে পরীক্ষার্থীরা নিশ্চিতভাবেই জেনে যায়, পরীক্ষার হলে কোন্ প্রশ্নের
উত্তর দিতে হবে। পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বন পাবলিক পরীক্ষার আরেকটি
দুর্বল দিক। নকল করা, পাশের জন থেকে দেখে লেখা, ক্ষেত্রবিশেষে উপস্থিত
শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়া ও বাইরে থেকে নকল সরবরাহ ইত্যাদি সমস্যা
এক সময় প্রকট ছিল।
পরীক্ষার হলে বাইরে থেকে আসা নকল অনেকাংশে কমে গেলেও
পরীক্ষার হলে ছাত্রদের নিজেদের মধ্যে ও ছাত্র-শিক্ষকদের পারস্পরিক সহযোগিতা
এখনও ভালোভাবেই আছে। বিশেষ করে নৈর্ব্যক্তিক অংশের উত্তরগুলো পরীক্ষার হলে
অনেকটাই জানাজানি হয়ে যায়। বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফলের অসাম্যতা বর্তমান
পরীক্ষা পদ্ধতির আরেকটি দুর্বল দিক, যা তেমন আলোচনায় আসে না। প্রশ্নপত্র
প্রণয়ন ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ভিন্নতার জন্য শিক্ষার্থীদের পাসের হার,
প্রাপ্ত নম্বর ইত্যাদিতে বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফলের পরিসংখ্যানগত পার্থক্য
আমরা প্রতিবছর দেখতে পাই। এ পার্থক্য ছাত্রছাত্রীদের একাদশ শ্রেণীতে
অনলাইনে ভর্তি, কিংবা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ায়
ভোগান্তির সৃষ্টি করে। জিপিএ দিয়ে বা বিষয়ভিত্তিক নম্বর দিয়ে নির্দিষ্ট
সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হলে এ বিভাজন
প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কয়েক বছর আগে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি
পরীক্ষায় একটি বোর্ডের কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী অংশ নিতে পেরেছিল। সুতরাং
বিভিন্ন বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের সমন্বয় সাধনটাও জরুরি- অন্তত একটি
বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায় তা-ই কাম্য। পাবলিক পরীক্ষার এই তিনটি সমস্যার
সমাধান নিয়ে এখন একটু আলোচনা করা যাক। ধরা যাক, বাংলা বিষয়ের জন্য আটটি
বোর্ড থেকে চল্লিশটি একই মানের প্রশ্নপত্র তৈরি করা হল, যার মধ্য থেকে
বিশটি বা দশটি সেট পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হল। সারা দেশে এই সেটগুলোর
ওপর পরীক্ষা হবে। বিভিন্ন সেটের প্রশ্নপত্রগুলো দৈবচয়নের ভিত্তিতে গোছানো
থাকবে, পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র পাওয়ার আগে কে কোন সেট পাবে, তা জানা যাবে
না। পরীক্ষার্থীরা উত্তরপত্রের মলাটে প্রশ্নের সেট নম্বর উল্লেখ করবে,
বোর্ডগুলো উত্তরপত্রের সেট অনুযায়ী পরীক্ষকের কাছে পাঠাবেন। এভাবে পরীক্ষা
হলে একেকটা প্রশ্নপত্রের সেটে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা
দেবে, আমাদের পাবলিক পরীক্ষার ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী।
এখন প্রতিটি সেটে
প্রাপ্ত গড় নম্বর নিয়ে ছাত্রদের প্রাপ্ত নম্বর প্রমিতকরণ করা হবে।
প্রমিতকরণের উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যাবে পরে। সেই নম্বরের ওপর ভিত্তি
করে প্রতিটি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর ও গ্রেড গণনা করা হবে, তারপর সর্বমোট
নম্বর ও জিপিএ নির্ণয় করা হবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে প্রমিতকরণের
ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করি। ধরা যাক, বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে পাঁচ সেট প্রশ্ন
করা হয়েছে। একই মানের ছাত্রদের ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিলে প্রশ্নের
হেরফের হওয়া স্বাভাবিক। বিভিন্ন সেটে ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বরের গড়
নিচের প্রথম ছকে দেখানো হয়েছে। সর্বশেষ কলামে প্রতিটি বিষয়ে সব সেটে
ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বরের গড় দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে সব সেটের গড়
নম্বরকে সংশ্লিষ্ট সেটের গড় নম্বরের বিভাজন হবে প্রমিতকরণ গুণাঙ্ক, যা
দ্বিতীয় ছকে দেখানো হয়েছে। এখন ধরা যাক, একজন ছাত্র বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে
যথাক্রমে ৫, ১ ও ৩নং সেটে পরীক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে
৬৮, ৬৬ ও ৭২। প্রাপ্ত নম্বরগুলোকে সংশ্লিষ্ট সেটের প্রমিতকরণ গুণাঙ্ক দিয়ে
গুণ করলে তার প্রমিত নম্বর পাওয়া যাবে। তৃতীয় ছকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
১. গড় নম্বর
বিষয় সেট ১ সেট ২ সেট ৩ সেট ৪ সেট ৫ সব সেট
বাংলা ৬০ ৫৯ ৬৩ ৬২ ৫৯ ৬০.৬
ইংরেজি ৫৪ ৫২ ৫৫ ৫০ ৫১ ৫২.৪
গণিত ৫৫ ৬১ ৫৬ ৫৭ ৬১ ৫৮.০
২. প্রমিতকরণ গুণক = সব সেটের গড় বা সংশ্লিষ্ট সেটের গড়
বিষয় সেট ১ সেট ২ সেট ৩ সেট ৪ সেট ৫
বাংলা ১.০১ ১.০৩ ০.৯৬ ০.৯৮ ১.০৩
ইংরেজি ০.৯৭ ১.০১ ০.৯৫ ১.০৫ ১.০৩
গণিত ১.০৫ ০.৯৫ ১.০৪ ১.০২ ০.৯৫
৩. একটি ছাত্রের প্রাপ্ত নম্বরের নমুনা
বিষয় সেট মূল প্রাপ্ত নম্বর প্রমিতকরণ গুণক প্রমিতকরণের পর নম্বর গ্রেড পয়েন্ট
বাংলা ৫ ৬৮ ১.০৩ ৭০ এ (৪.০)
ইংরেজি ১ ৬৬ ০.৯৭ ৬৪ এ-(৩.৫)
গণিত ৩ ৭২ ১.০৪ ৭৫ এ (৪.০)
প্রথমে আসা যাক এ পদ্ধতি কার্যকর করতে কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে কিনা। কয়েক সেট প্রশ্ন তৈরি ও প্রিন্ট করে সুষমভাবে দৈবচয়ন করে প্যাকেটজাত করা কঠিন কিছু নয়, আর খাতায় প্রাপ্ত নম্বর একবার কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ হয়ে গেলে সেট অনুযায়ী নম্বর প্রমিতকরণ করা কোনো ব্যাপারই নয়। যারা এখন বোর্ডে নম্বর টেবুলেশনের দায়িত্বে আছেন, তারা ভালো বুঝবেন। তাহলে এই নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা নেয়া কিংবা ফলাফল তৈরিতে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, শুধু বেশি সংখ্যক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার ওপর নজর দিতে হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে নম্বর প্রমিতকরণকে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা কীভাবে নেবে, বিষয়টি পরে আলোচনা করা হচ্ছে। এখন দেখা যাক, এ পদ্ধতি চালু করলে কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে- পরীক্ষার হলে আশপাশের ছাত্র থেকে দেখাদেখি বন্ধ হবে। কারণ একেকজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন সেটের প্রশ্নপত্র থাকবে। কোনো অসাধু শিক্ষক পরীক্ষার হলে উত্তর বলে দিতে পারবে না। কারণ বললে প্রতিটা সেট বলতে হবে। বাইরে থেকে নকল হলে দিতে পারবে না, কারণ কোন ছাত্রের কোন্ সেট জানা যাবে না। অনেকগুলো সেট ফাঁস করা কঠিন হবে, অনেক সময়সাপেক্ষ হবে মোবাইল দিয়ে অনেকগুলো সেটের ছবি তোলা। এক বা দুই সেট ফাঁস হয়ে লাভ নেই, কারণ কোন্ সেট পরীক্ষার হলে পড়বে, তা তো আগে থেকে জানা থাকবে না। তাছাড়া পরীক্ষার আগের রাতে ২০ সেট প্রশ্নপত্র পেয়ে তেমন লাভও হবে না। যে ছাত্র ২০ সেট প্রশ্নের উত্তর এক রাতে তৈরি করতে পারে, তার এমনিতেই পাস করা উচিত। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুফল হবে বোর্ডে-বোর্ডে ফলাফলের আসাম্যতা দূর করা। বছরভিত্তিক ফলাফলেও আমরা বিস্তর ফারাক দেখতে পাই, নিশ্চয় রাতারাতি ছাত্রছাত্রীদের মানের তেমন পরিবর্তন হয় না। আসলে এই অসামঞ্জস্যতা হয় প্রশ্নপত্রের ভিন্নতার কারণে। এখন আমরা যশোর বোর্ড ও কুমিল্লা বোর্ডের দুজন ছাত্রকে বিচার করছি প্রাপ্ত নম্বর দিয়ে, যদিও তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়েছে। যেহেতু জাতীয়ভাবে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয় নম্বরের ভিত্তিতে কিংবা এসএসসি ও এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বরের একটা অংশ যোগ হয় ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরে,
১. গড় নম্বর
বিষয় সেট ১ সেট ২ সেট ৩ সেট ৪ সেট ৫ সব সেট
বাংলা ৬০ ৫৯ ৬৩ ৬২ ৫৯ ৬০.৬
ইংরেজি ৫৪ ৫২ ৫৫ ৫০ ৫১ ৫২.৪
গণিত ৫৫ ৬১ ৫৬ ৫৭ ৬১ ৫৮.০
২. প্রমিতকরণ গুণক = সব সেটের গড় বা সংশ্লিষ্ট সেটের গড়
বিষয় সেট ১ সেট ২ সেট ৩ সেট ৪ সেট ৫
বাংলা ১.০১ ১.০৩ ০.৯৬ ০.৯৮ ১.০৩
ইংরেজি ০.৯৭ ১.০১ ০.৯৫ ১.০৫ ১.০৩
গণিত ১.০৫ ০.৯৫ ১.০৪ ১.০২ ০.৯৫
৩. একটি ছাত্রের প্রাপ্ত নম্বরের নমুনা
বিষয় সেট মূল প্রাপ্ত নম্বর প্রমিতকরণ গুণক প্রমিতকরণের পর নম্বর গ্রেড পয়েন্ট
বাংলা ৫ ৬৮ ১.০৩ ৭০ এ (৪.০)
ইংরেজি ১ ৬৬ ০.৯৭ ৬৪ এ-(৩.৫)
গণিত ৩ ৭২ ১.০৪ ৭৫ এ (৪.০)
প্রথমে আসা যাক এ পদ্ধতি কার্যকর করতে কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে কিনা। কয়েক সেট প্রশ্ন তৈরি ও প্রিন্ট করে সুষমভাবে দৈবচয়ন করে প্যাকেটজাত করা কঠিন কিছু নয়, আর খাতায় প্রাপ্ত নম্বর একবার কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ হয়ে গেলে সেট অনুযায়ী নম্বর প্রমিতকরণ করা কোনো ব্যাপারই নয়। যারা এখন বোর্ডে নম্বর টেবুলেশনের দায়িত্বে আছেন, তারা ভালো বুঝবেন। তাহলে এই নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা নেয়া কিংবা ফলাফল তৈরিতে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, শুধু বেশি সংখ্যক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার ওপর নজর দিতে হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে নম্বর প্রমিতকরণকে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা কীভাবে নেবে, বিষয়টি পরে আলোচনা করা হচ্ছে। এখন দেখা যাক, এ পদ্ধতি চালু করলে কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে- পরীক্ষার হলে আশপাশের ছাত্র থেকে দেখাদেখি বন্ধ হবে। কারণ একেকজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন সেটের প্রশ্নপত্র থাকবে। কোনো অসাধু শিক্ষক পরীক্ষার হলে উত্তর বলে দিতে পারবে না। কারণ বললে প্রতিটা সেট বলতে হবে। বাইরে থেকে নকল হলে দিতে পারবে না, কারণ কোন ছাত্রের কোন্ সেট জানা যাবে না। অনেকগুলো সেট ফাঁস করা কঠিন হবে, অনেক সময়সাপেক্ষ হবে মোবাইল দিয়ে অনেকগুলো সেটের ছবি তোলা। এক বা দুই সেট ফাঁস হয়ে লাভ নেই, কারণ কোন্ সেট পরীক্ষার হলে পড়বে, তা তো আগে থেকে জানা থাকবে না। তাছাড়া পরীক্ষার আগের রাতে ২০ সেট প্রশ্নপত্র পেয়ে তেমন লাভও হবে না। যে ছাত্র ২০ সেট প্রশ্নের উত্তর এক রাতে তৈরি করতে পারে, তার এমনিতেই পাস করা উচিত। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুফল হবে বোর্ডে-বোর্ডে ফলাফলের আসাম্যতা দূর করা। বছরভিত্তিক ফলাফলেও আমরা বিস্তর ফারাক দেখতে পাই, নিশ্চয় রাতারাতি ছাত্রছাত্রীদের মানের তেমন পরিবর্তন হয় না। আসলে এই অসামঞ্জস্যতা হয় প্রশ্নপত্রের ভিন্নতার কারণে। এখন আমরা যশোর বোর্ড ও কুমিল্লা বোর্ডের দুজন ছাত্রকে বিচার করছি প্রাপ্ত নম্বর দিয়ে, যদিও তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়েছে। যেহেতু জাতীয়ভাবে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয় নম্বরের ভিত্তিতে কিংবা এসএসসি ও এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বরের একটা অংশ যোগ হয় ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরে,
এতে বিভিন্ন বোর্ডের ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। লাখ
লাখ ছাত্রছাত্রী যেখানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, সেখানে প্রমিতকরণের
(স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) কথা অবধারিতভাবে এসে যায়, আমরা এতদিন এই বিষয়টিকে
পাশ কাটিয়েছি। তাছাড়া এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়। যুক্তরাজ্যের
ক্যামব্রিজ শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পর কত নম্বরে কোনো
গ্রেড হবে, তা নির্ধারণ করা হয়, নাহলে ভিন্ন প্রশ্নপত্রের ওপর দেয়া
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরে গ্রেড করলে বিভিন্ন বছরের ফলাফলের মধ্যে
অসামঞ্জস্যতা তৈরি হবে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার, একে অস্বীকার করাই
বোকামি। এখনই আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা আসলে আটটি সেটে পরীক্ষা দিচ্ছে;
কিন্তু তারা এখন দিচ্ছে বিভিন্ন বোর্ডে আঞ্চলিকভাবে, নতুন পদ্ধতিতে
ছাত্রছাত্রীরা ১০ বা ১২টি সেটে পরীক্ষা দেবে; কিন্তু আঞ্চলিকভাবে না, সারা
দেশে- উপরন্তু তাদের প্রাপ্ত নম্বর সমন্বয় করা হবে, যাতে প্রশ্নপত্রের
মানের কারণে তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম হলে
কয়েকশ’ হলে তাত্ত্বিকভাবে এই পদ্ধতি বোঝা হবে; কিন্তু যেখানে লাখ লাখ
ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে, সেখানে এ পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকর হবে।
নির্দিষ্ট মানের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এ পদ্ধতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ; কিন্তু
এখনই প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডে কয়েক সেট করে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়, একইভাবে
সমন্বিতভাবে ২০ বা ৩০ সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কঠিন হওয়ার কথা নয়। এ পদ্ধতিটি
জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি)
পরীক্ষায় অনায়াসে পরখ করা যায়। ভালো ফল এলে মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ড. রাজেশ পালিত : সহযোগী অধ্যাপক, তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ড. রাজেশ পালিত : সহযোগী অধ্যাপক, তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments