ফুলের ওপারের বঙ্গবন্ধু
এই মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি ভরে উঠবে ফুলে। আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুদিনকে স্মরণ করার মূল্য আছে অপরিসীম। তবে অনেক সময় আড়ম্বর আর ফুলেল আনুষ্ঠানিকতার চাপে সত্যিকার মানুষটির কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। সেই ফুলের ওপারে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আছেন তাকে আমাদের আরও নিবিড়ভাবে জানা ও বোঝা দরকার। এটি খুব দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হবে, যদি শেখ মুজিব নেহাত একটি দলের, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মানুষ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের নানা সংকটের একটি তার পরিচয় সংকট। সেই পরিচয়ের সূত্র খুঁজতে দলমত নির্বিশেষে ফিরে যাওয়া দরকার এ দেশের রাজনীতির অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ মানুষ শেখ মুজিবের কাছে। বোঝা দরকার তার শক্তি আর সীমাবদ্ধতাকে। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি জনগণের স্পন্দনের সঙ্গে চলেছেন বরাবর, সে জন্য প্রয়োজনে নিজের অবস্থানও বদলেছেন। তিনি শুরু করেছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে। পাক ভারত উপমহাদেশে বঞ্চিত মুসলমানদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ডায়েরি পড়লেই বোঝা যায়, পাকিস্তানের জন্মের কিছুকালের ভেতরই তিনি টের পেয়ে গেছেন, যে দেশ তিনি চেয়েছিলেন, পাকিস্তান তেমন দেশ নয়। তিনি তখন তার অবস্থান পাল্টালেন। শুরু করলেন পাকিস্তানের ভেতর বঞ্চিত বাঙালিদের স্বাধিকারের আন্দোলন, যার পরিণতি আজকের বাংলাদেশ। আবার নতুন বাংলাদেশের জন্মের পর যখন তিনি দেখলেন সেখানে কৃষক শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষা হচ্ছে না তখন তিনি আবার তার নিজের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবস্থান বদলে প্রতিজ্ঞা করলেন একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর দেশ গড়ার। সেখানে এসে বাধা পেলেন, শিকার হলেন আক্রমণের। কাউকে নকল না করে এ দেশের মাটির আসল পরিচয় খুঁজেছেন তিনি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত বাংলার বদলে বক্তৃতায়, ব্যক্তি জীবনে নিজের লোকজ ভাষায় কথা বলতেন। তিনি সাহেবদের মতো স্যুট-কোট না পরে নিজের মতো করে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিলিয়ে একটা পোশাক তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে একাধারে, মানুষ, বাঙালি এবং মুসলমান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেইসঙ্গে এ ঘোষণাও দিয়েছেন স্পষ্ট করে যে তিনি এমন একটি দেশ গড়তে চান যেখানে সব ধর্মের লোক, নিজ নিজ ধর্মীয় আচার নিদ্বির্ধায় নিরাপদে পালন করবে।
তিনি তার রাজনৈতিক ঘোর প্রতিপক্ষের সঙ্গেও নির্দ্বিধায় আলিঙ্গন করতে পারতেন। এই বাংলাদেশের মাটির শত বছরের ইতিহাসে যে সমন্বয়বাদিতার ঐতিহ্য আছে তা মূর্ত হয়ে উঠেছিল শেখ মুজিবের ভেতর। তিনি এই মাটির জল, হাওয়া থেকে বেড়ে ওঠা নেতা। এই দেশের পরিচয়ের ইঙ্গিত আছে তার জীবনের ভেতর। শেখ মুজিব নিজেকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত করার সুযোগ পাননি। যুদ্ধ শেষে ভেঙে পড়া অবকাঠামো, প্রশাসন, কোটি শরণার্থী, জনজীবনে ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধাস্ত্র, দেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্য, ভেঙে পড়া সীমান্তের সুযোগে ব্যাপক চোরাচালান ইত্যাদি পাহাড় সমান সংকটের ভেতর তিনি শুরু করেছিলেন তার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব, যাতে তিনি তখনও অনভিজ্ঞ। তিনি যেভাবে এসব সংকটের সমাধান চাইছিলেন তা দেশের কোনো কোনো গোষ্ঠীর, আন্তর্জাতিক প্রধান মহাশক্তির ছিল অপছন্দ। তিনি দেশকে ভালোবেসে দিনে দিনে তৈরি করেছিলেন শত্রু। তিনি সে সময়ের সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী দুই শিবিরের ভেতর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে সুতোর ওপর হাঁটছিলেন। সেই নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে একদিন মধ্য আগস্টের এমনি দিনে তার শত্রুরা থামিয়ে দেয় তার পথচলা। ভুলভ্রান্তির ভেতর দিয়ে শিখতে শিখতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন না শেখ মুজিব, পেল না বাংলাদেশ। তারপর কতগুলো দশক চলে গেল আমাদের সেই হারানো পথ খুঁজে পেতে। বর্তমানকে বুঝতে, ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে নিতে আনুষ্ঠানিকতা, আড়ম্বরের ফুলের ওপারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আরও গভীরভাবে বোঝা দরকার আমাদের।
No comments