লুটে নিচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা
সেবা না দিয়েও স্যুয়ারেজ (পয়োবর্জ্য) খাতে রাজধানীবাসীর কাছ থেকে বছরে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ৩০০ কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। এমনকি প্রতিবছর স্যুয়ারেজ সেবার ওপর বাড়াচ্ছে ট্যাক্সও। নিরুপায় নগরবাসী বাধ্য হয়েই ঢাকা ওয়াসার এ অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করছেন। নিয়ম অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে মানুষের মলমূত্র নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বসানো স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে নেবে। এরপর তা পরিবেশবান্ধব উপায়ে শোধন করে নদীতে ফেলবে। এ শর্তে রাজধানীর বড় একটি অংশের (সব স্থানে নয়) বাসাবাড়িতে স্যুয়ারেজ সার্ভিস সংযোগ দিয়েছে সংস্থাটি। এসব বাড়ি থেকে এ সংযোগ বাবদ পানির বিলের প্রায় সমপরিমাণ ট্যাক্স আদায় করছে তারা। কিন্তু এর মাত্র ৫ শতাংশ পরিশোধন করা হচ্ছে। ৯৫ শতাংশ পয়োবর্জ্যই পানি নিষ্কাশনের নালা হয়ে মিশছে রাজধানীর চারপাশের নদী, ঢাকার ভেতরের খাল ও জলাধারে। দূষিত হচ্ছে পানি ও পরিবেশ। এ থেকেও নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেবা না দিয়ে অর্থ আদায় অনৈতিক, এটি জনগণের অর্থ লুটপাট ছাড়া কিছুই নয়। এর ওপর দূষণের মাধ্যমে তারা আরও ক্ষতি করছে। জানা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে স্যুয়ারেজ খাতে ঢাকা ওয়াসা সার্ভিস চার্জ আদায় করেছে ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। আর এ সময়ে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন মেরামতে খরচ করেছে শুধু ১৬ কোটি টাকা। নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় করা বিপুল অর্থ আর কোন খাতে খরচ করেছে, তার কোনো হদিস নেই। ঢাকা ওয়াসার আট বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব অর্থ খরচের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার জোন-১, ২, ৩, ৫, ৬ ও ৭-এর আওতায় রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকা, বাসাবো-গেণ্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা, গুলশান-বনানী-বারিধারা, মতিঝিল, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা, মগবাজার এলাকা, দনিয়া-শ্যামপুরসহ আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ঢাকা ওয়াসার ৯৬১ কিলোমিটার স্যুয়ারেজ পাইপলাইন। এ লাইন যুক্ত হওয়ার কথা পাগলার সেই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামত না করায় লাইনের ৯৫ শতাংশই এখন অকেজো। ফলে এসব পয়োবর্জ্য সেখানে যাচ্ছেই না। আবার একটি এলাকায় একটি-দুটি ড্রেন থাকলেও পুরো এলাকার হোল্ডিং থেকে স্যুয়ারেজ ট্যাক্স আদায় করছে ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসার এক প্রকৌশলী জানান, ঢাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ সেবার নামে রাজধানীবাসীর সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণা করছে। কেননা ১০ বছরেরও বেশি সময়ে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন সংস্কারের জন্য সামান্য পরিমাণও অর্থ খরচ করা হয়নি। এ কারণে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন নেটওয়ার্ক নষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রকৌশলী উদাহরণ টেনে বলেন, স্যুয়ারেজ পাইপলাইন অনুযায়ী গুলশান-বনানী এলাকার পয়োবর্জ্যগুলো হাতিরঝিলের নিচে স্থাপিত পাইপলাইন দিয়ে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, হাতিরঝিলের নিচ দিয়ে বসানো স্যুয়ারেজ পাইপলাইনগুলো অকেজো। এ কারণে গুলশান-বনানী এলাকার পয়োবর্জ্য হাতিরঝিলে মিশে লেকের পানি নষ্ট করছে। এ পানি বেগুনবাড়ী খাল দিয়ে বালু নদীতে মিশছে। আরেক প্রকৌশলী জানান, ঢাকা ওয়াসা ১০-১৫ বছরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কাজে এককভাবে মনোনিবেশ করেছে। এ কারণে পানি সরবরাহ খাতে মোটামুটি সাফল্য এসেছে। আর পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ও পানি নিষ্কাশন খাতে মনোযোগ না দেয়ায় এ দুটি খাতের অবস্থা ভয়াবহ। ওই প্রকৌশলী আরও বলেন, স্যুয়ারেজ সেক্টরের বড় সমস্যা- পাইপলাইনগুলোর ৯৫ ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। পাগলা শোধনাগার পর্যন্ত স্যুয়ারেজ পাইপ নেটওয়ার্ক রয়েছে খুবই কম এলাকার। এ কারণে অল্প কিছু এলাকার স্যুয়ারেজ পাগলা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যাচ্ছে। বাকি এলাকার পয়োবর্জ্য নগরীর পানি নিষ্কাশন ড্রেনের মাধ্যমে নদী, খাল, ডোবায় পড়ছে। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে স্যুয়ারেজ খাতে ট্যাক্স আদায় হয়েছে ১১২ কোটি ৪৩ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ১৩৩ কোটি ৯ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ১৬৪ কোটি ২৮ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ১৯২ কোটি ৪১ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২০৮ কোটি ৪৯ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০৫ কোটি ৮০ লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২২ শতাংশ স্যুয়ারেজ বিল বৃদ্ধি করেছে ঢাকা ওয়াসা। একই সঙ্গে স্যুয়ারেজ সংযোগও কিছু বেড়েছে। বর্ধিত হিসাবে ঢাকা ওয়াসার স্যুয়ারেজ খাতের ট্যাক্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় চলতি মাসে নতুন করে আবারও ৫ শতাংশ স্যুয়ারেজ বিল বাড়িয়েছে সংস্থাটি। আর এসব স্যুয়ারেজ পাইপলাইন মেরামতে বছরে ৬টি জোনে গড়ে ৩০ লাখ টাকা করে খরচ করা হচ্ছে। যার বাৎসরিক পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ঢাকা ওয়াসার জোন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সিহাবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বছরে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন পরিষ্কারে ২৫-৩০ লাখ টাকা খরচ হয় এ জোনে। এরবাইরে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনায় জোন থেকে আর কোনো কাজ করা হয় না। স্যুয়ারেজ পাইপলাইন নির্মাণকাজ প্রকল্পের আওতায় করা হলেও কয়েক বছর ধরে স্যুয়ারেজ লাইন ব্যবস্থাপনায় কোনো প্রকল্পই নেই বলে জানান এ প্রকৌশলী। ঢাকা ওয়াসার জোন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুজাবত আলী তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, বছরে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন মেরামতে ২৫-৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। আর এ টাকা আমরা খরচ করি দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্লিনারদের পেছনে। কোনো টেন্ডার ছাড়াই সব জোনে এখন এভাবে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে। আর দীর্ঘদিন ধরে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন স্থাপনের কোনো কাজ নেই বলেও জানান তিনি। ঢাকা ওয়াসার জোন-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, বছরে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন পরিষ্কারে ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন ম্যানেজমেন্টে অন্য কোনো খরচ করা হয় না। নতুন করে কোনো স্যুয়ারেজ পাইপলাইনও স্থাপন করা হচ্ছে না। ঢাকা ওয়াসার কোনো অঞ্চলে স্যুয়ারেজ পাইপলাইন স্থাপনের কোনো কাজ চলছে না বলে জানান এই প্রকৌশলী। নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ লাইনগুলো মেনটেইনেন্স করে না। এ কারণে এসব স্যুয়ারেজ পাইপলাইন অকেজো হয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় স্যুয়ারেজ ও খাবার পানি সরবরাহ লাইনও এক হয়ে গেছে। তবে বেশিরভাগ স্যুয়ারেজ মিশছে রাজধানীর চারপাশের নদী, খাল ও ডোবায়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর পানি ও পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন নিয়ে গবেষণা করেছি। এতে আমার কাছে মনে হয়েছে, বর্তমান ঢাকা ওয়াসার ৫ শতাংশ স্যুয়ারেজ লাইনও ঠিক নেই। এ কারণে পাগলা শোধনাগারে খুবই কম পরিমাণ স্যুয়ারেজ পৌঁছে। ইনামুল হক আরও বলেন, আবার পাগলায় যে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে, তা কোনোভাবেই নগরবাসীর পয়োবর্জ্যরে ৫ শতাংশের বেশি শোধনের ক্ষমতা রাখে না। আবার পুরো নগরীর পয়োবর্জ্যও এক স্থানে নেয়া অনেক জটিল। কাজেই অবশিষ্ট পয়োবর্জ্য শোধনে নগরীতে বেশ কয়েকটি প্ল্যান্ট জরুরি। প্রায় একই কথা যুগান্তরকে বলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাছের খান। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসা পাগলা স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যে পয়োবর্জ্য শোধন করছে, তার পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এটাই ওই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের সক্ষমতা। তাছাড়া ঢাকা ওয়াসার বেশিরভাগ স্যুয়ারেজ পাইপলাইন অকেজো রয়েছে। এসব পাইপলাইনের পয়োবর্জ্য ঢাকার চারপাশের নদী, খাল ও ডোবায় পড়ছে। ফলে এসব পয়োবর্জ্য পানি ও পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে। আবু নাছের খান আরও বলেন, ঢাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা সচল করলে বর্তমানের চেয়ে বেশি ট্যাক্স ধরতে হবে। তেমনটি হলে একজন নগরবাসী হিসেবে সেটা পরিশোধ করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সেটা না করে নগরবাসীকে টেকসই স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্ধকারে রেখে বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করছে। এটা জনগণের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার বড় প্রতারণা। এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের সভাপতি এবং ঢাকা ওয়াসার বোর্ড মেম্বার প্রকৌশলী একেএমএ হামিদ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসার স্যুয়ারেজ সেবা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ রয়েছে, এটা সত্য। জনগণ বলছে, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে স্যুয়ারেজ সেবা পাচ্ছে না। আর ঢাকা ওয়াসা বলছে, স্যুয়ারেজ সেবা দিচ্ছে। এ অবস্থায় স্যুয়ারেজ ট্যাক্স আদায় করার বিষয়টি নৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার একজন বোর্ড সদস্য হিসেবে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট করতে চেষ্টা করছে। নতুন কিছু পরিকল্পনাও রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে স্যুয়ারেজ সেবার মান আরও বাড়বে। বিদ্যমান অবস্থায় স্যুয়ারেজ ট্যাক্স নেয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধারা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। তবে জনগণের সেবাও যাতে সুনিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
No comments