মণ্ডার শহর মুক্তাগাছা
হুট করেই দে-ছুট। ছুটছি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া, রাতটা কাটিয়ে পর দিন যাব মুক্তাগাছা। ব্যক্তিগত বাহনে রাত ৯টায় রওনা দিয়ে ঢাকার যানজট ঠেলে ঠুলে পৌঁছাই রাত প্রায় ২টায়। কিছুটা দেরি হওয়ার কারণও রয়েছে, চলতি পথে নানা জায়গায় গাড়ি ব্রেক দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খানিকটা সময় দোকানিদের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছি। ভ্রমণকালীন নানা জায়গার নানা মানুষের জীবনমান সম্পর্কে ধারণা নেয়াটাও আমাদের নিকট বেশ ভালো লাগে। ফুলবাড়িয়া বাজারে আগে থেকেই তাবলীগ জামাতে যাওয়া বন্ধু মোস্তাক অপেক্ষমাণ ছিল। তার সঙ্গে কুশলাদি সেরে আশ্রয় নেই মসজিদে। খুব স্বল্প সময়ের ঘুম কিন্তু তৃপ্তি বোধ বেশ। ফজরের নামাজ আদায় শেষে চলে যাই সৌন্দর্যের চাদরে ঘেরা গ্রামগুলো ঘুরতে। শিশির ভেজা ঘাস জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তা। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম ঘুরে, ফিরি আবার মসজিদে। নাশতা সেরে চলে যাই মুক্তাগাছার পথে। এবারের ভ্রমণসঙ্গী ছিল উজ্জ্বল, কালাম ও চির তরুণ রাজা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই মুক্তাগাছা রাজবাড়ী। ওয়াও রাজবাড়ীর বিশাল ফটকে দাঁড়িয়ে নিজেকে রাজা রাজা মনে হতে লাগল। এটি একটি প্রাচীনতম ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এর বয়স প্রায় তিনশ’ বছর। নিরাপত্তা রক্ষীদের অনুমতি নিয়ে ঢুকে যাই ভেতরে। ওমা একদা মহারাজা আচার্য্য চৌধুরীর বাড়ির এমন ভগ্নদশা কেন? ভাবতেই বেশ অস্বস্তি লাগে। দে-ছুটের বন্ধুরা ইতিহাস-ঐতিহ্যের টানে পুরোবাড়িটি চষে বেড়ানোর চেষ্টা করি। প্রতিটি স্থাপনা বেশ ভালো করে পরখ করি। প্রায় ১০০ একর জায়গার ওপর নির্মিত মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ী। বাড়ির ভেতর আস্তাবল, মন্দির, রঙ মহল, সিন্দুক ঘর, নাট্যমঞ্চ ও বসতঘরসহ আরও অনেক কিছুই রয়েছে। নেই শুধু রাজা থেকে মহারাজা উপাধি প্রাপ্ত জমিদার আচার্য্য চৌধুরী-শৌখিন জমিদার শশীকান্ত চৌধুরীর পদচারণা কিংবা ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানো অবাধ্য প্রজার গগনবিদারী চিৎকার।
তবে যতটুকু অক্ষত রয়েছে তার নির্মাণ শৈলী দেখেই বোঝা যায়, বাড়ির ভেতরের স্থাপনাগুলো ছিল বেশ দৃষ্টি নন্দন। এই বাড়িতে ১৯৪৫ সালে উপমহাদেশের প্রথম ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চ স্থাপন করেছিলেন নাট্যপ্রেমী জমিদার জীবন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী। যা তাদের আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। ভগ্ন অবস্থায় দোতালা একটি ঘর দেখা গেল, জানা যায় গরমের দিনে প্রাকৃতিকভাবেই বাহির দিয়ে ঘামিয়ে ভেতরে ঘরকে রাখত ঠাণ্ডা। জমিদার আচার্য্য চৌধুরীর পূর্ব পুরুষরা থাকতেন বগুড়াতে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে নানা কারণে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরীর চার ছেলে হররাম, শিবরাম, বিষ্ণুরাম, রামরাম তৎকালীন আলাপসিং পরগণায় আসেন। এখানে বসবাসের জন্য মনস্থির করেন। আলাপসিং পরগণার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেন। পরে মুক্তাগাছার জায়গাটা পছন্দ করেন। উল্লেখ্য, আজকের মুক্তাগাছা তৎকালীন সময়ে আলাপসিং পরগণার অধীনে ছিল। জমিদার আচার্য্য চৌধুরীর বংশের প্রথম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী মুর্শিদাবাদ নবাবের খুব আস্থাভাজন ছিলেন সেই প্রতিদানস্বরূপ তিনি ১১৩২ খ্রিস্টাব্দে নবাবের কাছ থেকে আলাপসিং পরগণার বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন। সেই সময় মুক্তাগাছা শহরসহ আশপাশে জলাভূমি ও অরণ্য ঘেরা ছিল। মূলত জমিদার আচার্য্য চৌধুরীর বংশের পূর্ব পুরুষদের মাধ্যমেই মুক্তাগাছা শহরের গোড়াপত্তন। তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন এই বাড়ির জমিদার বাবুরা। তারাই ১৬ হিস্যার জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বাড়ির জমিদার বাবুরা জ্ঞান চর্চায়ও ছিলেন বেশ আগ্রহী। ময়মনসিংহের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তাদের বেশ অনুদান রয়েছে। মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির লাইব্রেরির অনেক দুর্লভ বই বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষিত রয়েছে। রাজবাড়ীর মূল ফটকের সামনেই রয়েছে সাত ঘাটের বিশাল পুকুর। প্রতিটা ঘাটই বাঁধানো। পুকুরের পাশেই দুর্লভ প্রজাতির নাগলিঙ্গম/নেগুরা বৃক্ষ রয়েছে। সেই গাছে এখনও ফুল ফুটে আগন্তুকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ঘাটে বসে বি-মুগ্ধ নয়নে পুকুরের সৌন্দর্য দেখি আর কল্পনাতে ফিরে যাই সেই জমিদারীর আমলে। যখন তাদের সম্মানে বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে আর ছাতা টানিয়ে কোনো প্রজা হেঁটে যেত না। সময়ের আবর্তনে আজ সব কিছুরই বিবর্তন। হারিয়ে যায় সব থেকে যায় ইতিহাস। মুক্তাগাছার শেষ জমিদার ছিলেন রাজা জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে তিনি ভারতে চলে যান। ঘুরাঘুরি শেষে আমরাও মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে ফিরতি পথ ধরি। তাহলে বন্ধুরা আর দেরি কেন? ঘুরে আসুন ধান-নদী-মহিষের সিং এই তিন মিলে গড়া ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা রাজবাড়ী হতে।
যোগাযোগ : ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল-রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের বাস ময়মনসিংহ চলাচল করে। সেখান থেকে সিএনজিতে মুক্তাগাছা।
থাকা-খাওয়া : সর্বশ্রেণীর সাধ্যের মধ্যেই ময়মনসিংহ শহরে মানভেদে অনেক আবাসিক হোটেল ও খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
যোগাযোগ : ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল-রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের বাস ময়মনসিংহ চলাচল করে। সেখান থেকে সিএনজিতে মুক্তাগাছা।
থাকা-খাওয়া : সর্বশ্রেণীর সাধ্যের মধ্যেই ময়মনসিংহ শহরে মানভেদে অনেক আবাসিক হোটেল ও খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
No comments