পুলিশের আবাসন প্রকল্পে ভরাট হচ্ছে খাল!
জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি-শৃঙ্খলার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। আর সেই পুলিশের কারণেই রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে পুলিশ আবাসন প্রকল্পে অবৈধভাবে বালু ভরাট অব্যাহত রাখায় আশকোনা, হাজী ক্যাম্প, কাওলা, বরুয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পয়োবর্জ্যে তলিয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম ছুঁই ছুঁই। তাই ভারি বর্ষণ হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। এছাড়া ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর গুরুতর অভিযোগ, পুলিশ এখনও আইনগতভাবে যে জমির মালিকানা অর্জন করেনি তা ভরাট করছে। আবার পুলিশের হুমকি-ধমকির কারণে প্রকৃত জমির মালিকরা সেখানে গিয়ে বাধা দেয়া তো দূরের কথা অনেকে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট বোয়ালিয়া খাল ভরাট বন্ধ করতে রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ইতিমধ্যে পুলিশকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তারা তাও আমলে নিচ্ছে না। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী হাজার হাজার মানুষ প্রতিকার দাবি করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অবশ্য ঢাকার ডিসি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গেজেটবহির্ভূত ৪৬ একর জমি আমরা পুলিশ হাউজিংকে বুঝিয়ে দেইনি।
যদি পুলিশ এটা বলে থাকে, তবে সেটা সঠিক নয়। আর খাল ও জলাধার বাদ দিয়েই পুলিশের হাউজিং প্রকল্প করার কথা। কিন্তু যদি তারা সেটা না করে তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এদিকে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হাউজিং প্রকল্পে খাল এবং পানি নিষ্কাশন নালা ভরাট করার বিষয়টি জানার পর সংকট নিরসনে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সমাধান কতদূর হয়েছে তা তিনি এখনও জানতে পারেননি। তবে খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের বোয়ালিয়া ব্রিজ সংলগ্ন বরুয়া মৌজায় প্রায় ৪৩০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে এ পুলিশ হাউজিং প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত বোয়ালিয়া খাল এবং এ খালের কয়েকটি শাখা-প্রশাখা ছিল। যা দিয়ে এলাকার পানি নিষ্কাশন হতো। কিন্তু নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে পুলিশ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে একের পর এক খাল ও এর শাখা-প্রশাখাগুলো ভরাট করা হচ্ছে। এতে করে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের দাবির মুখে সম্প্রতি তিনশ’ ফুট সড়কের পাশ দিয়ে সরু নালা করা হয়। যা দিয়ে প্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশন আদৌ সম্ভব নয়। এছাড়া সেখানেই আবার বালু দিয়ে ভরাট অব্যাহত আছে। এলাকাবাসী বলেন, এভাবে তাদের দুর্ভোগের সঙ্গে পুলিশ এক ধরনের মশকরা করছে। সরেজমিন দেখা যায়, বরুয়া টেম্পোস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাগান বাড়ি ব্রিজের নিচে বালু ফেলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে করে আশকোনা,
হাজী ক্যাম্প, লেকসিটি এলাকার পানি বরুয়া এলাকার নিচু জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। বাসা-বাড়ির কানায় কানায় উঠে গেছে পানি। ভারি বর্ষা শুরু হলে ওই এলাকার বাসিন্দারা তাদের বাড়িতে পানি ওঠার আশঙ্কা করছেন। বরুয়ার আশিয়ান মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন পাঁচকানি ব্রিজের নিচে বোয়ালিয়া খালে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এ বাঁধের কারণেও পানি সরতে পারছে না। আরও দেখা গেছে, ৩০০ ফুট সংলগ্ন পুলিশ হাউজিং প্রকল্পের এ অংশে বালু ফেলে খাল, ডোবা, নালা ভরাট করা হচ্ছে। এসব বালুর কিছু অংশ পানিতে ভেসে বোয়ালিয়া খালের ব্রিজের নিচের অংশও ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ব্রিজের নিচে শরীর না ভিজিয়ে হাঁটার অবস্থা তৈরি হয়েছে। বরুয়া এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা কেরামত আলী দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হাউজিংয়ের ভরাট কার্যক্রম এই এলাকার পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি তারা ভরাটের আগে পানি সরে যাওয়ার বিকল্প কোনো পথও রাখেনি। এতে করে এলাকাটি এখন পানিতে ডুবতে বসার উপক্রম হয়েছে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা (যুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার) মারফত আলী দেওয়ান বলেন, পুলিশ হাউজিং প্রকল্পের উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে এই এলাকার পানি নিষ্কাশন নালাগুলো ভরে ফেলা হয়েছে। এখন নতুন করে তারা ৩০০ ফুটের পাশে সরু নালা করেছে, যা দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এ কারণে আশপাশের এলাকার নিচু জমিগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পুলিশের হাউজিং প্রকল্পে খাল, জলাধার ভরাটের প্রতিবাদ জানিয়ে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটিকে চিঠি দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। জলাধার আইন অনুসরণ করে খাল ও জলাধার ভরাট থেকে পুলিশ হাউজিংকে বিরত থাকতেও অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশকে। চিঠিতে আরও বলা হয়,
‘রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার পক্ষ থেকে সরেজমিন জরিপে দেখা গেছে, কুড়িল-পূর্বাচল লিঙ্ক রোডসংলগ্ন পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির আবাসন প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে বোয়ালিয়া খাল ভরাট করা হচ্ছে, যা জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর পরিপন্থী।’ সাধারণ মানুষের অভিযোগ এবং সরেজমিন প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১৭ এপ্রিল ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (উন্নয়ন) এবং বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দফতর সম্পাদককে এই চিঠি পাঠান। রাজউকের ৩০০ ফুট লেক প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এভাবে খাল ভরাট করলে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১০০ ফুট খাল প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা এ খালটি প্রথমে বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হবে। সেখান থেকে এ পানির গতিপথ বালু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অধিগ্রহণ না করেই জমি ভরাট : বরুয়া এলাকায় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায় ৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ না করেই ভরাট করে ফেলা হয়েছে পুলিশ হাউজিং প্রকল্পে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল মামলাও চলমান রয়েছে। কিন্তু পুলিশ এসবের কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না। এ বিষয়ে বরুয়ার বাসিন্দা ও খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী দেওয়ান যুগান্তরকে জানান, পুলিশ হাউজিং প্রকল্পে আমাদের প্রকল্পে প্রায় ২০ বিঘা জমি রয়েছে। অধিগ্রহণের গেজেট প্রকাশের আগেই সেসব জমি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এসব জমির কোনো ক্ষতিপূরণ করা হয়নি। বরুয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হাউজিং প্রকল্পে আমাদের তিন বিঘা জমি রয়েছে। অধিগ্রহণ গেজেট না হলেও সেই জমি পুলিশ ভরাট করে ফেলেছে। বরুয়ার আরেক বাসিন্দা আবদুল বারেক দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হাউজিং প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এখনও বেশ কয়েকটি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তার প্রশ্ন- এ অবস্থায় পুলিশ হাউজিং প্রকল্পের কার্যক্রম কিভাবে চলে। এ ছাড়া আমাদের ক্ষতিপূরণের টাকাও এখনও আমরা পুরোপুরি বুঝে পাইনি। এ প্রসঙ্গে পুলিশের সহকারী আইজি (উন্নয়ন) ও পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দফতর সম্পাদক গাজী মো. মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, শুধু পুলিশ হাউজিং প্রকল্পের কারণে বরুয়া এলাকার পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। এখানে সমস্যা আরও আছে। তিনি বলেন, বোয়ালিয়া খালের যে অংশ ভরাট করা হয়েছে সে জায়গা ছেড়ে দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৪৬ একরসহ ডিসি অফিস পুলিশ হাউজিংকে সমুদয় জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে। সেখানে ভূমি উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। আর সব জমির টাকা ডিসি অফিসকে পরিশোধ করেছে পুলিশ হাউজিং।
No comments