সমস্যা ভিশনের নয়, যোগত্যার
সম্প্রতি এক টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ করি। যদিও জানি এ ধরনের টকশো সরকারের কাছে গুরুত্ব বহন করে না। সরকার তাদের নিজেদের টকশো শুনতে ও শোনাতেই ব্যস্ত। টকশোর মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, দেশ কোন্ দিকে। প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি প্রদত্ত দীর্ঘমেয়াদি ভিশনও আলোচনায় আসে। আমি বলছিলাম, উন্নয়নের অর্থ রাস্তাঘাট তৈরি নয়, দেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকারগুলো সংরক্ষিত থাকতে হবে। মানুষের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তাই উন্নয়নের প্রধান সূচক। আমার বিশ্লেষণ ছিল, মানুষের অসহায় অবস্থার জন্য নেতাদের ব্যর্থতাকেই দায়ী করতে হবে। তাদের লজ্জিত হতে হবে। পুলিশের ক্ষমতা যত বাড়বে, ব্যক্তির নিরাপত্তা তত হ্রাস পাবে। যে ধরনের অসুবিধা ও সরকারি ব্যর্থতার মধ্যে, বিশেষ করে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানুষ আছে, তাতে আমরা বড় ধরনের বিপদের দিকে যাচ্ছি। তখন টকশোর অপর আলোচক সাংবাদিক বন্ধুটি প্রশ্ন করলেন, তাহলে দেশের হাল ধরবে কে? তার প্রশ্নের জন্য আমি বিরক্তবোধ করি এবং কিছুটা ধৈর্য হারিয়ে ফেলি, যেটা মোটেও ঠিক হয়নি। প্রশ্ন যতই অযৌক্তিক হোক, উত্তর যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। কারণ এ ধরনের প্রশ্ন করা সহজ মনে হলেও এর উত্তর সাধারণভাবে কারও জানার কথা নয়। সাংবাদিক বন্ধুটি কী মনে করে প্রশ্নটি করেছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি। একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ নির্বাচন দেশে থাকলে সহজেই বলা যায়, জনগণ ভোটের মাধ্যমে যাকে চাইবে তাকেই দেশের হাল ধরতে হবে। আর যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না থাকে, তাহলে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। নতুন সরকার সম্পর্কে না জানাটাই জাতির জন্য বড় সংকট। কে হাল ধরবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারার জন্যই আমাদের যত উদ্বেগ,
যত দুশ্চিন্তা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলে নতুন নেতৃত্ব গড়ার সুযোগ থাকত। জনগণও জানতে পারত কে তাদের সমর্থন পাবে। নির্বাচন নেই, আমাদের কাছে উত্তরও নেই। এটাও ভাবা ঠিক নয়, আমাদের মতো লোক সরকার পরিবর্তনের জন্য সরকারের ব্যর্থতার কথা বলে না। আমরা তো চাই সরকার ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠুক, সাফল্য অর্জন করুক। তবে জনগণকে অধিকারহীন করা যাবে না। জনগণকে ক্ষুব্ধ ও নিরাপত্তাহীন রেখে যে কোনো সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা কঠিন। আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশক উদযাপনের কথা উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছিলাম, তার সময়েও লোহা-সিমেন্টের বড় বড় উন্নয়নের কাজ হয়েছিল। জনগণের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে না পারলে শুধু উন্নয়নের কথা বলে সরকারের আশপাশের দুর্নীতিপরায়ণদের খুশি রাখা যায়, জনগণকে খুশি রাখা ভিন্ন ব্যাপার। সরকারের কোনো ডিপার্টমেন্ট সঠিকভাবে চলছে এমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। মনে হচ্ছে উন্নয়নের সরকারকে সরকার পরিচালনার কথা ভাবতে হয় না। নিশ্চয়ই সাংবাদিক বন্ধুটি দেশে যোগ্য লোকের অভাবের কথা বলতে চাননি। পুরনো নেতাদের কাছ থেকে দেশ গড়ার নতুন ভিশন হাস্যকর। নতুন নেতারা নতুন নেতৃত্বের ভিশন দেন নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন তুলে ধরতে। একাধিকবার ক্ষমতায় থাকার পর একই নেতৃত্বের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে জানার কিছু থাকে না। তাদের পরিচয় অতীত। সময় এসেছে সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে জাতির কাছে নিজেদের যোগ্যতার কথা বলার।
তাদের নতুন ভিশন বা রূপকল্প দিয়ে কাউকে আশান্বিত করার কিছু নেই। তাছাড়া জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র হল জাতির ভিশন। যারা শাসনতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন, তারা জনগণের ভালো করার নিজস্ব ভিশন দিলেই জাতি তা গ্রহণ করতে পারে না। এ সহজ কথাটিও ভেবে দেখা হচ্ছে না। দোষ কাউকে দিয়ে লাভ নেই। কারণ, একশ্রেণীর শিক্ষিত সচেতন লোকই দেশের প্রতি দায়িত্বের কথা ভুলে যাচ্ছে। নেতারা সবকিছু বলেই খুশি। তারাই সঠিক এবং সব প্রশংসা তাদেরই প্রাপ্য। আমাদের কাজ হল চাটুকারিতা করে নেতাদের খুশি রাখা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জন্য বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা। নেতারাই বড় বড় দুর্নীতির নেতা। আপন জুয়েলার্সের মামলা ধামাচাপা না দিলে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই জড়িয়ে পড়তেন। এমনটাই সন্দেহ করা হচ্ছে। নতুন নেতৃত্বকে জায়গা করে দেয়ার কোনো চিন্তাভাবনা তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কারও দীর্ঘমেয়াদি ভিশনে বলা হয়নি। আগামী ২০ থেকে ৩০ বছর কি একই নেতৃত্বে চলবে? সুশাসন, জনসেবার মানোন্নয়ন এবং দলের মধ্যে গণতন্ত্রায়নের ব্যাপারটি দুই দলের কোনোটির ভিশনেই পরিষ্কার করা হয়নি। জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র অনুসরণ করলেই তারা জানতে পারতেন সুশাসন কী এবং কীভাবে মানুষের জীবন সুখী ও নিরাপদ করতে হয়। রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা পেশিশক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো কথা তো কোনো দলের ভিশনে ঠাঁই পায়নি। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য দলীয় রাজনীতিতে যে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনা দরকার সে সম্পর্কে আমাদের নেতাদের কোনো ভিশন নেই। কোনো দলের ভিশন দলের নির্বাচনী ম্যানুফেস্টো নয়। ভিশন রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপার। সংসদ এক কক্ষবিশিষ্ট হবে নাকি দু’কক্ষবিশিষ্ট হবে,
এটা কোনো দর্শনের কথা নয়। আমার মতে সুখী ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে নতুন এবং সামগ্রিক চিন্তাভাবনা থাকলে তাকে রাজনৈতিক দর্শন বলা যেত। রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতাদের অক্ষমতার উপলব্ধি ছাড়া কোনো ভিশন নিয়ে হাজির হওয়া দুঃখজনক। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক জীবনধারার অনুকূলে জাতির ভিশন ভাষা পেয়েছে ১৯৭২ সালের মূল শাসনতন্ত্রে। আইনের শাসনের অধীনে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে নিরাপদে জীবনযাপনের যে রূপকল্প জনগণ দিয়েছে, তা অবহেলিত হয়ে আসছে। শাসনতন্ত্রে তাই সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্যের কথাই শুধু বলা হয়নি, ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার সরকারি দায়িত্বের কথাও বলা হয়েছে। শাসনতান্ত্রিক চেকস-অ্যান্ড-ব্যালেন্স কার্যকর থাকলে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব থাকে না। একক কর্তৃত্ব লাভের জন্যই শাসনতন্ত্র কাজ করতে পারছে না। শাসনতন্ত্রের রক্ষক বিচার বিভাগ নিয়েও তোলা হচ্ছে নানা প্রশ্ন। স্বাধীন দেশের জনগণের স্বাধীনতাই মূলকথা। ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা তুচ্ছ করে যারা উন্নয়নের কথা শোনান তাদের জানা উচিত, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য দেশের স্বাধীনতা অপরিহার্য নয়। পরাধীন দেশে উন্নতি-অগ্রগতি হতে বাধা থাকে না। ব্রিটিশ আমলে কি আমাদের দেশে উন্নতি হয়নি? সত্যিকার অর্থে যারা রাজনৈতিক নেতা তারা অবশ্যই বুঝবেন, আইন প্রয়োগকারী পুলিশের রাজনীতিকীকরণের অর্থ হচ্ছে আইনের অপব্যবহার সহজ করা। সাংবাদিকদের দলীয় কর্মী বানানোর অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও চালু রয়েছে। অন্য অপরাধীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পুলিশের অপরাধ করার কথা যখন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আইনের নিশ্চয়তা থাকে না। সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে সংঘটিত দুই মেয়েকে ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর মামলায় পুলিশের ভূমিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের শৃংখলাবিরোধী পুলিশের আচরণের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তাকে কেন্দ্র করেও হচ্ছে নানা অপরাধ। কোনো অপরাধ ঘটলেই দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। বিনা জামিনে আটক রাখা আর পুলিশ রিমান্ডে পাঠানোই এখন বিচার। আদালতের বিচারে কে দোষী তা জানা যাবে অনেক বছর পর। এ ঘটনার পরও সাভারে এক মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। নির্দোষ, নিরপরাধ মানুষের নিরাপত্তা নির্ভর করছে পুলিশের সদিচ্ছার ওপর, কারণ গ্রেফতার হলেই সে অসহায়। সে না পাবে জামিনে মুক্তি, না এড়ানো যাবে পুলিশ রিমান্ড। শুরু হবে টাকার খেলা। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে না পাওয়ার অর্থ আইনের সুরক্ষা অনিশ্চিত থাকা। পুলিশের সার্থকতা হল জনগণের বন্ধুরূপে নিজেদের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখা। বাংলাদেশে আইন হচ্ছে অজুহাত, আইনের অপব্যবহার হচ্ছে বাস্তবতা। ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় এবং প্রতিষ্ঠাযোগ্য সুশাসনকে সাহায্য করার ব্যাপারে বিচার বিভাগ যে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো, সে পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবাধীন রাখতে পারলেই যেন সরকার ভালো চলবে। তারা দেখবেন না দেশব্যাপী কীভাবে নৈরাজ্য চলছে। স্বাধীনতা ও সুবিচারের শেষ আশ্রয় হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। বিচার বিভাগ যাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয় সেজন্য আইনজীবী ও বিচারকদের এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। আইন প্রয়োগকারী হিসেবে পুলিশের নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে। নিজেদের পেশাগত ভূমিকা ও ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। স্বাধীন দেশের এটাই নিয়ম। এখন আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, সেখানে অবাধ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। পার্লামেন্ট বিলুপ্ত না করে নির্বাচন করা সংসদীয় গণতন্ত্র নয়। লুটেরা রাজনীতিতে সহিংসতা বেড়েই চলবে। যখন দেশের বিনিয়োগকারীরা বিদেশে বিনিয়োগ করছে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা একটু কম বলাই ভালো। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না, ছেলেমেয়েরা দাস হয়ে বিদেশে চাকরি খুঁজতে দেশ ছাড়বে- এটা কোনো মর্যাদাশীল জাতির কথা নয়। দাসব্যবসা বন্ধের ভিশন তো কোথাও দেখছি না। আমরা নিজেদের বীরের জাতি বলি অথচ সীমাহীন অন্যায়-অবিচার সহ্য করে চলেছি। নতজানু থাকা আর চাটুকারিতা করে লাভবান হওয়া আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য বলেই অনেকে মনে করেন। জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র জনগণের ভালো থাকার ভিশন। শাসনতন্ত্র না মানার ভিশন আমরা চাই না। সমস্যা ভিশনের নয়, সমস্যা নেতৃত্বের।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments