বহু বাগানের মালিক এখন জেলের মালী
হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। বেশ কয়েকটি চা বাগানও আছে তার। বাগান করার শখ আগে থেকেই। তবে সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন মালীর ভূমিকায়। কারাগারের ভেতরে বেশ কিছু দিন ধরে ঠিকঠাকভাবে অর্পিত দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন তিনি। সিলেটের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এবং কথিত দানবীর রাগীব আলীর কথাই বলা হচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারা অভ্যন্তরে তিনি বাগানে পানি দিচ্ছেন। পরিচর্যা করেন ফুল বাগানের। আগাছা পরিষ্কার করছেন প্রতিদিন। দণ্ডপ্রাপ্ত রাগীব আলীর জন্য এ কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ। তার সঙ্গে আছেন ছেলে আবদুল হাইও। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কারাগারের লাইব্রেরির বই বিতরণ ও গ্রহণের। অনেকটা লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কারাগারে বাবা-ছেলে দু’জনেরই পরনে কয়েদির পোশাক। দুটি মামলায় রাগীব আলী ২৭ বছর এবং তার ছেলে আবদুল হাই ২৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতি এবং প্রতারণা করে তারাপুর চা বাগান দখলের মামলায় তারা সাজাপ্রাপ্ত। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে থাকছেন ৯২৮৯/এ নম্বর কয়েদি রাগীব আলী। ছেলে আবদুল হাইয়ের কয়েদি নং ৯২৮৮/এ।
আইন অনুযায়ী, সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কারা ভোগের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমও করতে হয়। কারাগারের কাজের মধ্যে রয়েছে, রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাগান পরিষ্কার অর্থাৎ মালীর কাজ ও কারাগারের লাইব্রেরির বই ব্যবস্থাপনা। বাব-বেটার জেলজীবন নিয়ে কথা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সগির মিয়ার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাধারণত কারাগারে ভেতরের কাজগুলো ভাগ করে দেয়া হয়। তবে সামাজিক সম্মান আর বয়সের কথা বিবেচনা করে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কাজ দেয়া হয়। রাগীব আলী যেহেতু ৮৩ বছরের বৃদ্ধ, তাই তার ইচ্ছা অনুযায়ী বাগানের মালীর কাজ দেয়া হয়েছে। তিনি নিয়মিত কাজ করেন। বাগান পরিচর্যা করেন। বাগানে পানি দেন। আগাছা পরিষ্কার করেন। তিনি জানান, সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা দিনে ৬ ঘণ্টা ১৫ মিনিট কাজ করেন। সকাল ৮টা থেকে ১১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত আবার দুপুর দেড়টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি বলেন, দুটি মামলা চলাকালীনই রাগীব আলী কারাগারে আসেন। প্রথম মামলার রায়ে ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার পরই রাগীব আলী ও তার ছেলেকে কারাগারের পোশাক দেয়া হয়েছে। তবে রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাইকে দিয়ে তেমন কোনো কাজ করানো যায় না। তিনি কোনো কাজ ঠিকমতো করতেও পারেন না। তাই তাকে লাইব্রেরির বই দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বন্দিদের বই দেন আবার তা ফেরত নেন। তার সাজা হয়েছে ২৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রকাশিত বার্ষিক সাময়িকী ‘হু’জ হু’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালে ১৮ বছর বয়সে লন্ডনে যান রাগীব আলী। সেখানে শেয়ারবাজার, বীমা, আবাসন ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা করে তিনি বিত্তশালী বনে যান। পরে দেশে এসে ব্যবসায় হাত দেন। সাউথইস্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রাগীব আলী সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড, কর্ণফুলী টি কোম্পানি লিমিটেড, রাজনগর টি কোম্পানি লিমিটেডের মালিক। ইউনিয়ন সিন্ডিকেট লিমিটেড, রাগীব আলী সিকিউরিটিজ লিমিটেড, দৈনিক সিলেটের ডাকে তার মালিকানা রয়েছে।
ইংরেজি দৈনিক ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেসের পর্ষদেও তার নাম রয়েছে। সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লিডিং ইউনিভার্সিটি ও ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। একসময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ডেও চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া মাতৃভূমি কামাল বাজারের একটি এলাকাকে নিজের নামে ‘রাগীব নগর’ নামকরণ করেন। কথা হয় সিলেট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উলাহ শহীদুল ইসলাম শাহিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রভাব খাটিয়ে সরকারি স্কুলের জায়গা দখলে নিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের নির্যাতন করেছেন। জালিয়াতি করে দেবত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান দখলে নিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারতেন না। তিনি বলেন, প্রভাবশালী রাগীব আলীর বর্তমান অবস্থা সমাজকে শিক্ষা দেবে। যারা অপরাধ করছেন বা অন্যায় প্রভাব খাটাচ্ছেন, তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময় জামায়াত-শিবিরসহ মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হলে হঠাৎ ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ বনে যান রাগীব আলী। সে সময় তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারাও সংবর্ধনা দেন রাগীব আলীকে। এ সময় নিজের মালিকানাধীন দৈনিক সিলেটের ডাকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ হিসেবে পরিচিত দেয়া শুরু করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে থেকে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।
No comments