এমপি হারুনের শত শত কোটি টাকার টেন্ডারবাজির কথা কেউ ভোলেনি
রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় আলোচিত হোটেল দ্য রেইনট্রির মালিক বিএইচ হারুনের অবৈধ সম্পদ, অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপকীর্তির নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রতিদিনই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যেন সাপ বের হচ্ছে! জানা গেছে, আওয়ামী লীগদলীয় এমপি হারুনের রাজনৈতিক কোনো আদর্শ নেই, ‘ক্ষমতা’র কাছাকাছি থাকাই তার মূল টার্গেট। তাই অতীতে তিনি বিএনপির রাজনীতি করেছেন। যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন জাতীয় পার্টিতেও। এমনকি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা হয়েও ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকে ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন শত শত কোটি টাকার টেন্ডার। এ কারণে ওয়ান-ইলেভেনের পর গোপনে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে ছিলেন বিএইচ হারুন। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি সম্পর্কে বিএইচ হারুনকে বহুবার ফোন ও মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলেও আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি কোনো প্রতিউত্তর দেননি। এমপি হারুনের এভাবে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যাওয়া প্রকারান্তরে তার দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নির্বাচনী এলাকা ভাণ্ডারিয়া-কাউখালীতে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করেন হারুন। যদিও ওই নির্বাচনে তিনি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা হোসেনের কাছে হেরে যান। এখানে অবস্থা ভালো হবে না বুঝতে পেরে ১৯৯৬ সালে তিনি মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরের নির্বাচনী এলাকা ঝালকাঠির রাজাপুর-কাঁঠালিয়ায়। মনোনয়ন লাভের চেষ্টার অংশ হিসেবে একবার রাজাপুরে বিএনপির একটি জনসভায় যোগ দেন তিনি। ওই জনসভায় উপস্থিত থাকা এক বিএনপি নেতা যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি পছন্দ না হওয়ায় তাকে সভা মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেন শাহজাহান ওমর।’ এরপর ওই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন নেয়ার চেষ্টা চালালেও সফল হননি তিনি। একের পর এক দল বদলের আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী বিএইচ হারুন। তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন শাহজাহান ওমর পলাতক তখন বিএনপির অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী রফিকুল ইসলাম জামালকে হারিয়ে হয়ে যান আওয়ামী লীগের এমপি। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বার এমপি হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, ২০০০ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেআইসিএল (কাজী ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন লিমিটেড) প্রতিষ্ঠা করেন হারুন। তার ভাই মুজিবুল হক কামাল ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের ডিএমডি। আর তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানের মোট ৬৫ শতাংশের মালিক ছিলেন তারা দু’জন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কেআইসিএলের তৎকালীন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি হতো এখানে। অবশ্য এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খুব বড় কোনো ঠিকাদারি কাজ তখন হয়নি। সারা দেশে সব মিলিয়ে বড় জোর কয়েকশ’ কোটি টাকার কাজ করেছে কেআইসিএল। কিন্তু প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল তখনকার প্রায় সব ঠিকাদারের মুখে মুখে। সে সময় শতকরা ১০ ভাগ ব্ল্যাকমানির বিপরীতে বহু কাজের ভাগ-বাটোয়ারা হওয়ার নজির রয়েছে বিএইচ হারুনের মাধ্যমে।’ তিনি আরও জানান, কেআইসিএল প্রতিষ্ঠার বেশ আগে ১৯৯৭ সালে ডা. বিএইচএম ইকবালের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএইচ হারুন। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করার সুবাদে দলটির ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অনেক নেতার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল বিএইচ হারুনের। এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েই আওয়ামী লীগ নেতা হয়েও চারদলীয় জোট সরকারের প্রভাবশালীদের টেন্ডারবাজিতে খুব সহজেই নিজেকে জড়িয়েছেন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কেআইসিএলের একাধিক সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে গা ঢাকা দেন কেআইসিএলের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। অবস্থা বেগতিক বুঝে গোপনে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান বিএইচ হারুন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে কেআইসিএলের কর্মকর্তাদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালায় দুদক। আলোচিত বিএইচ হারুন বা তার ভাইকে আটক করা না গেলেও গ্রেফতার হন প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই তিনি তখন দেন তদন্ত কর্মকর্তাদের। সেসব তথ্যে উঠে আসে বিএইচ হারুনের নাম। সুচতুর হারুন অবশ্য খুব সহজেই সামলে নেন পরিস্থিতি। মালয়েশিয়ায় থাকাবস্থায় তিনি সম্পর্ক স্থাপন করেন সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের আস্থাভাজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে। তাকে ম্যানেজ করে পৌঁছে যান তৎকালীন সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের এক শীর্ষ ব্যক্তির কাছে। পরে বড় অংকের কথিত দান করার মাধ্যমে আবার ফিরে আসেন দেশে। হাইকমান্ডের বড় বড় নেতাদের ম্যানেজ করার সুবাদে এরপর আর কোনো বিপদে পড়তে হয়নি হারুনকে। ফিরে এসে আবার শুরু করেন জমজমাট ব্যবসা আর রাজনীতি। শোনা যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় ৫-৬ মাস থাকাবস্থায় তিনি সেখানে একটি বাড়িও কেনেন। যেটি এখনও রয়েছে কুয়ালালামপুরে। এসবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের খুশি রেখে কাজ বাগানো ও রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টায় ঢাকার বারিধারা এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা করার গুঞ্জনও রয়েছে বিএইচ হারুনের বিরুদ্ধে। একটি ওভারসিজ কোম্পানির নামে ভাড়া নেয়া ওই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস কর্মকর্তাদের। অবশ্য আলোচ্য ওই ওভারসিজ কোম্পানির মালিকের সঙ্গেও এখন সম্পর্ক খুবই খারাপ হারুনের। সংশ্লিষ্ট এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যে ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য বিএইচ হারুনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে যোগাযোগ স্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টাতেও সাড়া মেলেনি এ আওয়ামী লীগ নেতার। এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তার ভাই মুজিবুল হক কামাল। ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর-কাঁঠালিয়া আসনের এমপি বিএইচ হারুনের অপকীর্তির যেন শেষ নেই। স্বার্থের কারণে তিনি শুধু রাজনীতি না, আত্মীয়তাকে জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হননি। জানা গেছে, স্ত্রীর বড় ভাই আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবালকে সরিয়ে ষড়যন্ত্র করে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে ডা. ইকবালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ উঠে তার নেপথ্য জোগানদাতা ছিলেন এমপি হারুন। সেই মুহূর্তে ডা. ইকবাল যখন আত্মগোপনে তখন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের কোনো সভা কিংবা সিদ্ধান্ত ছাড়াই চেয়ারম্যানের চেয়ারে গিয়ে বসতেন হারুন। যদিও তখন হারুন ছিলেন ওই ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের (ডা. ইকবাল) বিপদের সময় হারুনের ওই চেয়ারে বসার বিষয়টি মানতে পারতেন না কেউ। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেননি। বিএইচ হারুনের এ ষড়যন্ত্র ‘ফাঁস’ হওয়ায় এরপর আর পরিচালকের উপরের কোনো পদে তাকে (হারুন) উঠতে দেয়া হয়নি।
No comments