কক্সবাজার থেকে সরতে চাইছে না রোহিঙ্গারা
কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে নেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তাঁরা সেখানে যেতে অনাগ্রহী। টেকনাফ ও উখিয়ার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারা এ কথা বলছেন। অধিকার ও মর্যাদা পেলে নিজ দেশ মিয়ানমারেই ফিরে যেতে চান তাঁরা। এ জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। এদিকে ঠেঙ্গারচর পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন।
গতকাল বুধবার সকালে তিনি নৌবাহিনীর স্পিডবোটে করে সেখানে যান। এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেওয়া হবে। সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল ৬ ফেব্রুয়ারি সংসদে বলেন, রোহিঙ্গারা একবার ঠেঙ্গারচরে ঢুকে পড়লে তাদের আর ফেরত পাঠানো যাবে না। এটি ভবিষ্যতে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম থেকে স্পিডবোটে করে ঠেঙ্গারচের যান প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব। তাঁর সঙ্গে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন। সামরিক সচিব যাওয়ার আগেই ঠেঙ্গারচরে অবস্থান করছিলেন হাতিয়ার সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মোহাম্মদ রেজাউল করিম, নোয়াখালী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নবজ্যোতি খীসা, হাতিয়া থানার ওসি মো. গোলাম ফারুক। হাতিয়ার ইউএনও খোন্দকার মোহাম্মদ রেজাউল করিম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব প্রায় দুই ঘণ্টা ঠেঙ্গারচরে ছিলেন। তিনি চরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন। রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে আনা নিয়ে সরকারি চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে তিনি চর দেখতে এসেছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ঠেঙ্গারচরে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য হেলিপ্যাড নির্মাণ, নৌযান ভেড়ানোর জন্য জেটি তৈরি, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করাসহ আরও কিছু অবকাঠামো নির্মাণের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব। চরের গাছ কাটা যাতে বন্ধ রাখা হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনকে বলেছেন তিনি। হাতিয়ার সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসনের কথা ভাবছে সরকার। মূলত এর অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব জায়গাটি ঘুরে গেলেন।
তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে দ্রুত কিছু অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপড়া এলাকার নিবন্ধিত দুটি শিবিরে প্রায় ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন অনিবন্ধিত শিবিরে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তিনটি সীমান্ত ছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার পর সে দেশের সেনা-পুলিশ রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। দমন-পীড়নের শিকার হয়ে গত তিন মাসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে নতুন করে আরও প্রায় ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে। তারা টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির এবং আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় থাকছে। উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কথা বললে তারা (রোহিঙ্গারা) শিবির ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাবে। তখন রোহিঙ্গাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, মিয়ানমার সরকার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতে রোহিঙ্গারা ঠেঙ্গারচরে যেতে রাজি হবে না। এ বিষয়ে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া বলেন, মিয়ানমারে টিকতে না পেরে এ দেশে এসেছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেই তাঁরা খুশি হতেন। পর্যটন বিকাশ, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কক্সবাজারকে ঘিরে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অন্তরায় হতে পারে বলে মনে করেন কক্সবাজার নাগরিক সমাজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সরানোর চেষ্টা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সরানোর চেষ্টা করলে পরিস্থিতি অন্য রকমও হতে পারে। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে সরানোর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো নির্দেশনা পাননি তিনি। যদিও সরকার এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য সেখানে আগে অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ করা হবে। এরপর এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তখন রোহিঙ্গাদের সেখানে যেতে অনীহা থাকবে না।
No comments