সংকটেও আশা–জাগানিয়া
নয় বছর বয়সী যমজ সন্তানের মা আমেনা বেগম। মেয়ে ইফতিদা জাহান অটিজমে, ছেলে তৌহিদুর রহমান সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। দুই সন্তানের চিকিৎসা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে তাঁর। তবে দুই বছর ধরে একটু একটু করে আশার আলো দেখছেন তিনি। টানা চিকিৎসায় ধীরে হলেও হাঁটতে শিখছে তৌহিদুর, ইফতিদাও আগের চেয়ে সুস্থির।
এ জন্য নগরের প্রতিবন্ধীসেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমেনা বেগমের। হালিশহরের বি ব্লকের বাসিন্দা আমেনা বেগম প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুই সন্তানকে নিয়ে কেন্দ্রেই সময় কাটান। মেয়ে ইফতিদা কেন্দ্রের অটিস্টিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। গত সোমবার কেন্দ্রে গেলে কথা হয় আমেনা বেগমের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘স্বামীর আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বাচ্চাদের বিশেষ চিকিৎসার সামর্থ্য ছিল না। পরিচিত একজনের মাধ্যমে বাচ্চাদের নিয়ে কেন্দ্রে আসি। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে।’ নগরের নয়াবাজার গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে প্রতিবন্ধীসেবা ও সাহায্যকেন্দ্র চট্টগ্রামের সাইনবোর্ড। আবাসিক এলাকার এক নম্বর সড়কের আট নম্বর বাসাটিই এখন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে চালু হয়েছে কেন্দ্রটি। সরকারি এই কেন্দ্রে সেবা দেওয়া হয় শনি থেকে বুধবার। রয়েছে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির সেবা। যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ বিনা মূল্যে কেন্দ্র থেকে এসব সেবা নিতে পারেন। পাঁচ বছরের শিশু দেবব্রত নাথ একসময় সোজা হয়েও দাঁড়াতে পারত না। নিয়মিত চিকিৎসায় এখন মায়ের হাত ধরে এলোমেলো পায়ে হলেও হেঁটে বেড়াতে শিখেছে সে। এক বছর ধরে টুকটাক কথাও বলছে। ছেলের উন্নতির কথা বলতে গিয়ে মা প্রীতি রানীর মুখের হাসি কেবলই চওড়া হচ্ছিল। কেন্দ্রের চিকিৎসক শামিমা নাসরিন বলেন, নিয়মিত চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ পেলে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিবন্ধিতা অনেকখানি কমানো সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক পক্ষাঘাত, বাত বা এ ধরনের রোগীরাও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে সুস্থ ও কর্মক্ষম হতে পারেন। কেন্দ্রে ফিজিওথেরাপি নিতে স্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব শামসুল হক। বছরখানেক আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। দুই সপ্তাহ ধরে বিনা মূল্যে কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেন্দ্রের খোঁজ পাওয়ার আগে নয়াবাজার থেকে নিয়মিত চকবাজারে গিয়ে ফিজিওথেরাপি নিতে হতো। অর্থের অভাবে নিয়মিত নিতেও পারতেন না।
তবে এখন তাঁর কপালে নেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ। প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কেন্দ্রে সেবা দেওয়া হয়। চালু হওয়ার পর গত জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ হাজার ২০৪ জন এ কেন্দ্র থেকে সেবা পেয়েছেন। কেন্দ্রের একটি কক্ষ ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুদের খেলার কক্ষ হিসেবে। অটিজম কর্নারে চলছে অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম। ১০ জন শিশুকে এখানে বর্ণ পরিচিতি, আচরণ ইত্যাদি শেখানো হয়। সেবা মিললেও এ কেন্দ্রের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। শহরের মূল কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরের হওয়ায় কেন্দ্রে আশপাশের রোগীই বেশি দেখা গেল। প্রয়োজনের তুলনায় কেন্দ্রের ভেতরের আয়তনটাও বেশ ছোট। ছোট ছোট কক্ষে চলছে চিকিৎসা ও শিক্ষা কার্যক্রম। কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন নেই, প্রতি মাসে বাসাভাড়া বাবদ সরকারি বরাদ্দ ২০ হাজার টাকা। বরাদ্দ কম থাকায় চাইলেও বড় বাড়ি ভাড়া নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে ফিজিওথেরাপিতে ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্রপাতি। কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা বলেন, শহরের মূল কেন্দ্রে হলে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ত। এ ছাড়া কেন্দ্রের প্রচারও কম। দুজন চিকিৎসক ছাড়াও ফিজিওথেরাপি সহকারী ও টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন চারজন। দীর্ঘদিন ধরে স্পিচ থেরাপিস্টের পদটি খালি। কেন্দ্রের প্রতিবন্ধী–বিষয়ক কর্মকর্তা সিতারা ফেরদৌস বলেন, নষ্ট যন্ত্রপাতি ঠিক করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই নতুন যন্ত্র পাওয়া যাবে। বরাদ্দ বাড়ানোর জন্যও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কেন্দ্রের আয়তন বাড়ানো গেলে সেবার মানটা আরও বাড়ানো সম্ভব হতো।
No comments