দেশের প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইট প্রস্তুত
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলাদেশের এই জাতীয় সংগীত এত দিন পৃথিবীর আকাশ-বাতাসেই শোনা যেত। আগামী মে মাসের পর তা মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশের প্রথম নিজস্ব ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম উপগ্রহ (ন্যানো স্যাটেলাইট) ‘ব্র্যাক অন্বেষা’র মহাকাশে উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি শেষ হওয়ায় এই আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
কেবল জাতীয় সংগীত নয়, মহাকাশ থেকে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, নদী, ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে নগর, পাহাড়-সাগর—সবকিছুরই পর্যায়ক্রমিক আলোকচিত্রও এই উপগ্রহ থেকে পাওয়া যাবে। উন্নত দেশগুলো বেশ আগেই কৃত্রিম উপগ্রহের মালিক হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানই শুধু এর মালিক। আগামী মার্চে বাংলাদেশের কৃত্রিম উপগ্রহটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হবে। মে থেকে তা মহাকাশে ঘুরে বেড়াবে। উপগ্রহটির ওজন প্রায় এক কেজি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এবং বর্তমানে জাপানের কিউশু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (কিউটেক) গবেষণারত বাংলাদেশি তিন শিক্ষার্থীর তৈরি এই উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির (জেএএক্সএ) কাছে গতকাল বুধবার হস্তান্তর করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল জাপানে এক অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাদ আন্দালিব কিউটেক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহটি গ্রহণ করেন। পরে তা জেএএক্সএর কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনুষ্ঠানটি জাপানের কিতাকিউশু থেকে ঢাকায় ব্র্যাকের মহাখালী ক্যাম্পাসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানে সৈয়দ সাদ আন্দালিব বলেন, এর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। শুধু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নন,
দেশে মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করেন এবং কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো ছবি ব্যবহার করেন, তাঁরাও এই ঘটনাকে দেশের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, এত দিন বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ভারতের কাছ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের নেওয়া ছবি কিনত। এতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে তা বাংলাদেশের ভূমিরূপ ও প্রকৃতি বোঝার উপযোগী হতো না। দেশীয় কৃত্রিম উপগ্রহ হলে আগের ওই সমস্যা থেকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে মুক্তি পাবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে মহাকাশবিজ্ঞান বাংলাদেশের মানুষের হাতের নাগালে এল। এই পথ ধরে দেশ মহাকাশ গবেষণায় আরও অনেক দূরে এগিয়ে যাবে। মূলত বাংলাদেশের তিন-চারটি সংস্থা গবেষণায় কৃত্রিম উপগ্রহের নেওয়া ছবি ব্যবহার করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস), ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম), স্পারসো ও আবহাওয়া অধিদপ্তর। সিইজিআইএসের উপনির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা বিদেশি কৃত্রিম উপগ্রহের নেওয়া ছবি নিয়ে গবেষণা করি। দেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ থাকলে তা আমাদের আরও গভীর ও ভালোমতো গবেষণা করতে সহায়তা করবে।’ গত বছরের জুনে কৃত্রিম উপগ্রহটি বানানোর জন্য কিউটেকের সঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি হয়। কিউটেকের ল্যাবরেটরি অব স্পেস ক্র্যাফট এনভায়রনমেন্ট ইন্টারঅ্যাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তত্ত্বাবধানে এটা বানানোর কাজে যুক্ত হন তিন শিক্ষার্থী রায়হানা শামস ইসলাম অন্তরা,
আবদুল্লা হিল কাফি ও মায়সূন ইবনে মনোয়ার। স্যাটেলাইটের নকশা প্রণয়ন থেকে চূড়ান্ত কাঠামো তৈরির সব কাজই করেছেন এই শিক্ষার্থীরা। গতকাল জাপানে অনুষ্ঠানে উপস্থিত এই শিক্ষার্থীরা জানান, উপগ্রহটির সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ যুক্ত করা হয়েছে, যা এখান থেকে ডাউনলোড করা যাবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে এবং কিউটেকের শিক্ষা ও প্রযুক্তি সহায়তায় এই উপগ্রহটি তৈরি করা হয়েছে। এটি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় ১০ সেন্টিমিটার করে। এটির কাজ সম্পর্কে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ন্যানো স্যাটেলাইট প্রকল্পের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর মো. খলিলুর রহমান বলেন, এটা মহাকাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি জলাভূমি, নগরায়ণ ও কৃষি পরিস্থিতির উচ্চমানের ছবি পাঠাতে সক্ষম। ৪০০ কিলোমিটার ওপরের কক্ষপথে উৎক্ষেপণের পর এটি প্রতিদিন ১৬ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ঘুরে যাবে দিনে চার থেকে পাঁচবার। এ সময় কৃত্রিম উপগ্রহটি থেকে ছবিও ডাউনলোড করা যাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কৃত্রিম উপগ্রহটি বাংলাদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই একটি গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরির কাজ করছেন ব্র্যাকের আরেক দল শিক্ষার্থী। জাপানে কৃত্রিম উপগ্রহটি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কিউটেকের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইউজি অই, ল্যাবরেটরি অব স্পেস ক্র্যাফট এনভায়রনমেন্ট ইন্টারঅ্যাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিচালক মেংগু চো, জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (রাজনৈতিক)
জিয়াউল আবেদিন প্রমুখ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে স্কাইপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যোগ দেন কিউটেকের সাবেক সহকারী অধ্যাপক আরিফুর রহমান খান। কৃত্রিম উপগ্রহ হস্তান্তর উপলক্ষে ব্র্যাক ক্যাম্পাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড ন্যাচারাল সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন আহমেদ। আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে জাপান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি তোশিয়ুকি নোগুচি প্রমুখ। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন সংস্থার (স্পারসো) সদস্য ও মহাকাশ বিজ্ঞানী হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম উপগ্রহ বেশি উপযোগী। কেননা, এর মাধ্যমে অল্প খরচে এবং সহজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মহাকাশ থেকে পাঠানো বাংলাদেশের ছবি আমরা পেতে পারব। দেশের কৃষি, পরিবেশ, বন, নদী থেকে শুরু করে যেকোনো ভৌগোলিক ছবি পাওয়া সম্ভব হবে। এত দিন এসব ছবি আমাদের বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে কিনতে হতো।’
No comments