মেরুদণ্ড সোজা না রাখলে বিতর্ক পিছু ছাড়বে না
বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি একটি অনুসন্ধান কমিটির সহায়তা নিয়েছেন। প্রথমবারেরটি ছিল কয়েকজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী ব্যক্তির সমন্বয়ে; আর, দ্বিতীয়টি সাংবিধানিক পদের অধিকারী তিনজনের সঙ্গে নাগরিক সমাজের দুজন বিশিষ্টজনকে যুক্ত করে। উভয়বারই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একই বিচারপতি।
অনেক ঘটা করে এবারে ওই কমিটি নাগরিক সমাজের আরও ১৬ বিশিষ্টজনের সঙ্গে মতবিনিময় করল এবং এসব অনুশীলন শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে দশজনের নাম সুপারিশ করল। অস্বাভাবিক দ্রুততায় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর চারজন কমিশনারের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করলেন এবং প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে গেল। দশজনের জীবন-বৃত্তান্ত পড়া এবং সেগুলোর গুণগত মূল্যায়নের কাজটি মাত্র ঘণ্টা দুয়েকেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে সম্ভব হলো—এ প্রশ্নের উত্তরে এমনটি ভাবা অমূলক হবে না যে নামগুলো চূড়ান্ত করার কাজটি আগেই হয়ে ছিল। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পেলেন খান মোহাম্মদ নুরুল হুদা। রাষ্ট্রপতি অন্য যে চারজনকে কমিশনার পদে নিয়োগ দিলেন তাঁরা হলেন সাবেক বিচারক কবিতা খানম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের নাম শুনে অনেকেই ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেননি যে এঁরা কারা। সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে নাম প্রকাশ হলেও এঁদের সবার পরিচয় সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ পেতে অনেককে প্রায় পুরো একটি দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনুসন্ধান কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিয়েছেন যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম, তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পেশ করা তালিকায় কে এম নুরুল হুদার নাম ছিল না। আর, কমিশনার পদে নিয়োগ পাওয়া চারজনের মধ্যে আওয়ামী লীগের তালিকায় সাবেক বিচারক বেগম কবিতা খানম এবং বিএনপির তালিকায় সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদারের নাম ছিল।
তাহলে কে এম নুরুল হুদা, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শাহাদৎ হোসেন চৌধুরীর নামগুলো কারা সুপারিশ করেছিলেন? এক দিন পর জানা গেল তরীকত ফেডারেশন নামের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন দলের পেশ করা তালিকার তিনজন নিয়োগ পেয়েছেন। অবশ্য, ওই তিনজনের নাম আরও দু-তিনটি ছোট দলের প্রস্তাবেও ছিল। এই তথ্যে বিস্ময়ের ঘোর কাটানো মুশকিল। যেসব দল কোনো দিন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদও চালায়নি, তারা যোগ্য আমলাদের চিনল, আর সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনের জন্য উপযুক্ত লোক চিনল না? বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দলীয় আনুগত্যের বাইরে আর অন্য কিছু বিবেচনায় নেয় না, এমন ধারণা করাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ সেই সুযোগ নিয়ে সহযোগী ছোট ছোট দলগুলোকে দিয়ে নিজেদের পছন্দের নামগুলোই প্রস্তাব করিয়েছে বলে এখন ইঙ্গিত মিলছে। অনুসন্ধান কমিটি যেসব বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছে তাঁদের প্রায় সবাই প্রস্তাবের জন্য বাছাই করা নাম গণমাধ্যমে প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, নামগুলো আগে প্রকাশ পেলে সম্ভাব্য কমিশনারদের সম্বন্ধে সব ধরনের তথ্য আগাম জানা সম্ভব হবে। তাঁদের কারও কোনো রাজনৈতিক অতীত আছে কি না, কিংবা নৈতিকতার কোনো বিষয় কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কি না, এগুলো আগে জানা গেলে রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা কমিশন গড়তে পারবেন। স্বচ্ছতার সেই আবেদনের প্রতি অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদেরও ইতিবাচক মনোভাব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবে তেমনটি হলো না। ২০১২ সালের অনুসন্ধান কমিটি তাঁদের বাছাই করা দশজনের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করার এক দিন পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কাজী রকিবউদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজন কমিশনারকে নিয়োগ করেছিলেন।
কিন্তু এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘চাঁদ উঠলে সবাই তা দেখতে পাবে, সুতরাং রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করার আগে কোনো নাম প্রকাশের প্রয়োজন নেই।’ তাঁর কথাগুলো নিতান্তই বিচ্ছিন্ন মন্তব্য ছিল—এমনটি এখন আর যৌক্তিক বলে মনে হয় না। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কোনো নাম প্রস্তাব করেননি কিন্তু তাঁরা শক্ত মেরুদণ্ডের একটি নির্বাচন কমিশন চেয়েছেন এবং সে জন্য বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। তাঁদের অন্তত তিনজন লিখিতভাবে কিছু সংস্কারমূলক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করেছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন তাঁর লিখিত সুপারিশমালায় সাংবিধানিক বিধির আলোকে সব কমিশনারের সমান মর্যাদার কথা বলেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন সমমর্যাদাসম্পন্নদের একজন, অন্য কমিশনারদের ঊর্ধ্বতন কেউ নন। কিন্তু মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দেখা গেল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অন্যদের একটু ফারাক থেকেই গেল। তিনি দশজনের মধ্য থেকে নন, দুজনের মধ্য থেকে বাছাই হলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, বিশিষ্ট নাগরিকদের সুপারিশগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু হলো না। তাহলে কি নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত হোক, সেটা সরকার চাইছে না? ওই বিশিষ্ট নাগরিকদের একজন বলেছিলেন, ‘আমার কাম আমি করুম, তোরে খালি কইয়া লমু’ নীতি অনুসৃত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। এখন আমরা শুনছি যে অনুসন্ধান কমিটির ছয়জন সদস্যের সবাই যে নামগুলোতে একমত হয়েছিলেন,
এ রকম একাধিক ব্যক্তি বাদ পড়েছেন। আলামতগুলো কেন সংশয়ের জন্ম দেয় তা বোঝার জন্য দেশের বাইরে একটু নজর দেব। ব্রিটিশদের সাবেক উপনিবেশগুলোর জোট হচ্ছে কমনওয়েলথ এবং তার ঘোষণায় গণতন্ত্রকে তাদের মূল্যবোধের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা আছে। কমনওয়েলথ সচিবালয় গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য চর্চা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার কাজে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে গত নভেম্বরে একটি রেফারেন্স বই ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট: এ কম্পেনডিয়াম অব কমনওয়েলথ গুড প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে। এই গুড প্র্যাকটিস বা সুচর্চাগুলোর মধ্যে কমিশন গঠন, কমিশনারদের যোগ্যতা, কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের আস্থা অর্জনের মতো বিষয়গুলোর খুঁটিনাটি বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে, সারকথা যেটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানটিকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে, যার মানে হচ্ছে বাইরের বিশেষত সরকারের কোনো নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ অথবা অন্যায় প্রভাব, আর্থিক কিংবা অন্য কোনো স্বার্থের (দেশীয় ও বিদেশি) থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ৫৩টি সদস্যদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি এই নির্দেশনায় বলা হচ্ছে, কমিশনের নিয়োগ এমন একটি প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত যেটি নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন থাকবে এবং যাতে বিচার বিভাগ ও সংসদের ভূমিকা থাকবে।
তবে, সংসদের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্টতই সাবধান করে এতে বলা হয়েছে যে সংসদে যদি ক্ষমতাসীন দলের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থাকে, তাহলে নিয়োগ-প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক দূষণের শিকার হতে পারে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের বর্তমান সংসদে ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ যে পর্যায়ে রয়েছে, তাকে সুপার-মেজরিটির চেয়েও বেশি বলতে হবে। এটি কার্যত বিরোধী দলহীন সংসদ। কমনওয়েলথের নির্দেশনায় সেরা পন্থা হিসেবে এসব পদে প্রার্থীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা বা যাচাইয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। যেকোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর সুযোগ রাখা উত্তম, উল্লেখ করে এতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক গোষ্ঠীগুলোকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজকে প্রার্থী বাছাইয়ে সম্পৃক্ত করেছি ঠিকই, কিন্তু তা এখন অনেকটা লোক দেখানো অনুশীলনেই রূপান্তরিত হলো। প্রার্থীদের বিষয়ে কোনো ধরনের মতামত জানানোর সুযোগ কেউ পেল না। বইটিতে পরিশিষ্ট অংশে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেই দেশের গণতান্ত্রিক বৈধতার মান, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানবিষয়ক আইন, তার অর্থের সংস্থান এবং প্রশাসনিক কাঠামোর বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান সম্পর্কে সেখানে বলা আছে যে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নিয়োগ দেন এবং তিনি একটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশকৃত তালিকা থেকেই এসব নিয়োগ দিয়ে থাকেন। অথচ আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কোনো বিষয় নেই এবং এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতির কমিশনার নিয়োগের কথা।
(কমনওয়েলথ সচিবালয়কে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি ভিন্ন প্রশ্ন হলেও তাদের ভুল তথ্য দেওয়ার দায় কার এবং কোন উদ্দেশ্যে তা করা হয়েছে, সেটা তদন্ত করে দেখা উচিত।) রকিব কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটির সহায়তা নেওয়া হলেও নাম চূড়ান্ত করার কাজটি প্রধানমন্ত্রী করেননি—এমন কোনো দাবি আজ অবধি কেউ করেননি। এবারও অনুসন্ধান কমিটির পেশ করা তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি এককভাবে (প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া) কাউকে নিয়োগ করেছেন, এমনটি ভাবা কঠিন। যে নির্দেশিকার কথা বলছি, তাতে নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এটি হতে হবে অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য, যা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মান পূরণে সক্ষম হবে। কমিশনের গঠন ও নিয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কমিশন এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে যাঁদের প্রতি পুরো সমাজের আস্থা আছে। তাঁদের রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অধিকারী হতে হবে। কমিশনের গঠন এবং নিয়োগের যোগ্যতা, অযোগ্যতা এবং নিয়োগ ও অপসারণের প্রক্রিয়া সংবিধান অথবা অন্য আইনে নির্দিষ্ট থাকা উচিত। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার মধ্যেও যে একটা বড় পার্থক্য আছে তা উল্লেখ করে বইটিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন অবাধ হলেও সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলা যায় না।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সবদিকে কমিশনের স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ও নিরপেক্ষতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে এতে বলা হয়েছে, তাদের কাজগুলোও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। গবেষকেরা বলছেন, একটি দেশে গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামোর মধ্যে, গণতন্ত্রসম্মত স্বাধীন একটি নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার পরও ক্ষমতাসীন দল তাদের পক্ষে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ নিতে পারে। সেখানে কমিশনের তা রুখে দেওয়ার সামর্থ্য থাকতে হবে। নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে তাঁদের যোগ্যতা বা সামর্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা নয়। বরং, আমরা এখন দেখতে চাই তাঁরা প্রমাণ করুন যে তাঁরাও পারেন। আর, সেই দায়িত্ব পালনের সময় তাঁদের উচিত হবে কমনওয়েলথ দেশগুলোর সেরা চর্চাগুলো আয়ত্ত করে তা প্রয়োগ ও অনুশীলন করা। নিয়োগ-প্রক্রিয়ার দুর্বলতা তাঁদের জন্য চাপটা একটু বাড়িয়েই দিল।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments