জিতছে কিন্তু মিডিয়াই
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই ট্রাম্প অভিযোগ করে আসছেন, আমেরিকার মিডিয়া অসৎ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পরে পেন্টাগনে বেড়াতে এসে অন্য কথা বাদ দিয়ে তাঁর মূল কথা ছিল মিডিয়া নিয়ে। উপস্থিত সাংবাদিকদের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘এরা হচ্ছে জগতের সবচেয়ে অসৎ মানুষ, এদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ চলছে।’ এরপর দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। ট্রাম্প এখনো মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সোমবার তিনি এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড দপ্তরে। সেখানেও তিনি পুনরায় উত্থাপন করলেন মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের কথা।
ট্রাম্প সেখানে বলেন, ‘আপনারা তো দেখেছেন প্যারিস ও নিসে কী হয়েছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে মিডিয়া এসব ঘটনা নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ পর্যন্ত করে না। অনেক ক্ষেত্রে এই অসৎ মিডিয়া এসব ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতেও চায় না। হয়তো এর পেছনে কোনো কারণ আছে, আপনারা তা নিশ্চয় বুঝতে পারেন।’ দিন না যেতেই সাংবাদিকেরা হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন প্রাইসকে ঘিরে ধরলেন। ঠিক কোন কোন সন্ত্রাসী ঘটনার কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যেগুলো মিডিয়া এড়িয়ে গেছে? নয়ছয় করে কিছু একটা বোঝাতে চাইলেন তিনি। পরে বললেন, ‘ঠিক আছে, সে রকম একটা তালিকা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেব।’ কথামতো সে তালিকা সাংবাদিকেরা পেয়েছেন, তাতে আছে মোট ৭৮টি ঘটনা, যার সংবাদ দেশের প্রতিটি সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্ক সবিস্তারে প্রকাশ করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস ট্রাম্পের এই মিথ্যাচারের সবচেয়ে মোক্ষম জবাব দিয়েছে। তারা ঘটনাগুলো এক এক করে তালিকাভুক্ত করে তার পাশে কবে, কী সংবাদ তারা প্রকাশ করেছে, তার ওয়েব লিংক তুলে দিয়েছে। এই সন্ত্রাসী তালিকা প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। যে তালিকা ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ করেছে, তাতে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের হাতে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার একটিও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের হাতে কৃষ্ণকায় ও মুসলিম উপাসনালয় আক্রান্ত হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, শুধু ইসলামি সন্ত্রাসীদের ঘটনা তালিকাভুক্ত করার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হয়, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণে শুধু মুসলিমদেরই ‘টার্গেট’ করেছিল।
দেশের মিডিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই অভিযোগ তোলার কী কারণ থাকতে পারে? প্রশ্নটির জবাব দিয়েছে এই মুহূর্তের অত্যন্ত জনপ্রিয় ওয়েব পত্রিকা ‘হাফিংটন পোস্ট’। তারা লিখেছে, এর একটা সম্ভাব্য কারণ হলো তিনি যা বলেন, যা নির্দেশ দেন, দেশের অধিকাংশ পত্রপত্রিকা তা বিনা তর্কে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নির্বাচনী প্রচারণার গোড়া থেকেই মার্কিন মিডিয়া ট্রাম্পকে হয় ঠাট্টার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেছে, অথবা তাঁর বিভিন্ন দাবি ও বক্তব্য মিথ্যা বা বাগাড়ম্বর প্রমাণ করে ছেড়েছে। মূলধারার প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যম ট্রাম্পকে নয়, হিলারি ক্লিনটনকে বিজয়ী হিসেবে আগাম ঘোষণা করেছিল। ফলে এসব মাধ্যমকে, বিশেষত নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও সিএনএনকে নিজের প্রধান শত্রু চিহ্নিত করার ছুতো পেয়ে গেছেন ট্রাম্প। তাঁর প্রধান উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছেন, ‘তোমাদের, অর্থাৎ মূলধারার মিডিয়ার, এখন মুখ বন্ধ রাখা উচিত। দেশের মানুষের “পালস” তোমরা বুঝতে পারোনি।’ ব্যানন আরও একটা কথা নিউইয়র্ক টাইমসকে কিঞ্চিৎ উপহাসের সঙ্গে বলেছেন। তাঁর কথামতো, ‘মিডিয়া হচ্ছে আমাদের “বিরোধী দল”।’এর আগে রিচার্ড নিক্সনসহ এ দেশের অনেক প্রেসিডেন্ট মিডিয়ার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মিডিয়াকে সরাসরি বিরোধী দল হিসেবে তাঁরা কেউ চিহ্নিত করেননি। ব্যাননের কথায় কিঞ্চিৎ সত্যতা আছে। আইনসম্মতভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির এ দেশের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার কথা। কিন্তু গত নির্বাচনে অভাবিত বিপর্যয়ের পর এই দল এখনো নিজেদের ঘর গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঠিক কী অবস্থান গ্রহণ করা উচিত, সে প্রশ্নেও তারা দ্বিধান্বিত। বিশেষত, ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবের ও সাবেক জেনারেলদের নিয়ে যে মন্ত্রিসভা ট্রাম্প গঠন করেছেন, তাঁদের নিয়োগ ঠেকানোর ব্যাপারে এই দলের নির্বাচিত সিনেটররা নিজেদের মধ্যে একমত হতে পারেননি।
গত সপ্তাহে ট্রাম্পের অন্যতম উপদেষ্টা ও সাবেক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার কেলিঅ্যান কনওয়ে দাবি করেছিলেন, ২০১১ সালে ‘বোওলিং গ্রিন ম্যাসাকারের’ জন্য দায়ী ছিল দুজন ইরাকি উদ্বাস্তু, ওবামা সে কারণে ইরাকসহ ১১টি মুসলিম-প্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কথাটা যে মিথ্যা, বোওলিং গ্রিনে কোনো রক্তগঙ্গা বয়ে যায়নি, ওবামা প্রশাসন ১১টি দেশের মুসলিম নাগরিকদের ভ্রমণে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, সে কথা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাবৎ প্রমাণসহ জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএনসহ বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যম। ট্রাম্প তাঁর প্রতি সমালোচনাপূর্ণ যেকোনো খবরকেই ‘ফেইক নিউজ’ বা বানানো খবর বলতে ভালোবাসেন। এটি ছিল সেই রকম বানানো খবরের একটি উদাহরণ। শুধু তফাৎ এই যে এর সূত্র গণমাধ্যম নয়, হোয়াইট হাউস। নিউইয়র্ক টাইমস-এর জিম রুটেনবার্গ ঠাট্টা করে লিখেছেন, বোওলিং গ্রিনে কারও মারা যাওয়া তো দূর, কারও বুড়ো আঙুলটিও কড়কে যায়নি। এই নিয়ে চারদিকে হইচই শুরু হলে কনওয়ে স্বীকার করেন, কথাটা তিনি ভুল বলেছেন। পরে তিনি এক টুইটার বার্তায় ব্যাখ্যা করে বলেন, বোওলিং গ্রিন ম্যাসাকার নয়, তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন ‘বোওলিং গ্রিন টেররিস্টস’। অর্থাৎ এটা মিথ্যাচার নয়, কথার ভুল। সে কথার তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ এসেছে ওয়াশিংটন পোস্ট–এর কাছ থেকে। নানা তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে তারা দেখিয়েছে কনওয়ে এই প্রথম নয়, এর আগে আরও কয়েকবার ঠিক এ কথাই বলেছিলেন। অর্থাৎ কথাটা মিথ্যাই। এই সেই কনওয়ে, যিনি ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে দর্শকসংখ্যা নিয়ে ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস’-এর অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিলেন। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, ওবামার ২০০৯ সালের অভিষেকের তুলনায় তাঁর অভিষেকে অনেক গুণ বেশি লোক এসেছিল। পত্রপত্রিকা, এমনকি দেশের পার্ক সার্ভিস পর্যন্ত দুই অভিষেকের ছবি পাশাপাশি দিয়ে বোঝাল, প্রেসিডেন্ট যা বলছেন তা নির্জলা মিথ্যা। কনওয়ে সেই কথাটাই ব্যাখ্যা করে বললেন, দাবিটা মিথ্যা নয়, সেটি অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস, অর্থাৎ বিকল্প সত্য। এনবিসি টিভির চাক টড সে কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে বলেছিলেন, বিকল্প সত্য বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো ডাহা মিথ্যা। গেল দুদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে ট্রাম্পের নতুন আরেক বিরোধ লেগেছে, এবারের বিষয় হোয়াইট হাউসে তাঁর বাথরোব বা স্নান-পোশাক। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন, তার এক মানবিক চিত্র আঁকতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, খুবই একা একা তাঁকে এখানে সময় কাটাতে হচ্ছে। অনেক সময় তিনি হয় বাথরোব পরে টিভি দেখেন অথবা টেলিফোন নিয়ে সময় কাটান। হোয়াইট হাউসের একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে ট্রাম্পের এই অন্তরঙ্গ পোট্রে৴টটি আঁকা হয়েছিল। খুবই নিরীহ প্রতিবেদন, কিন্তু এটা পড়ে ট্রাম্প এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে তিনি টুইটারে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলেন, ‘ব্যর্থ টাইমস’ আবারও তাঁকে নিয়ে মিথ্যাচার করেছে।
ঠিক কী মিথ্যাচার, তা ব্যাখ্যার দায়িত্ব পড়ে হোয়াইট হাউস মুখপাত্র শন স্পাইসারের ওপর। তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, টাইমস যা লিখেছে, তার সবটাই ডাহা মিথ্যা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো বাথরোবই নেই। সে কথা বলা শেষ হতে না হতে ১৪টি ওয়েবসাইট পুরোনো এক ডজন ছবি বের করে দেখাল কবে, কখন ট্রাম্প বাথরোব পরে শুধু সময় কাটাননি, রীতিমতো পোজ দিয়ে ছবি তুলেছেন। এ ছাড়া, সিএনএন জানায়, হোয়াইট হাউসের প্রতিটি স্নানঘরে এমনিতেই পাট ভাঙা বাথরোব রাখার নিয়ম। তথ্যমাধ্যমের ওপর ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের সদস্যদের অব্যাহত লড়াইয়ের একটা ফল হয়েছে এই যে, মানুষ এখন এসব খবর গোগ্রাসে গিলছে। অধিকাংশ পাঠকই জানতে চান, ট্রাম্প কোথায় মিথ্যা বললেন (যেমন অভিষেকের দিনের দর্শক নিয়ে তাঁর মিথ্যা দাবি), কোথায় হাস্যকর কাণ্ড ঘটালেন (যেমন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর রেগেমেগে ফোন কেটে দেওয়া), অথবা তাঁর দলের সদস্যদের মধ্যে কোন্দল কতটা গভীর হয়েছে (যেমন স্টিভ ব্যাননকে সব অঘটনের কর্তা বর্ণনা করে টাইম ম্যাগাজিন-এর প্রচ্ছদকাহিনি পড়ে ক্ষিপ্ত ট্রাম্পের টুইট, অন্য কেউ নয়, তিনি বস)। ফলে যেসব পত্রপত্রিকা বা টিভি নেটওয়ার্ক এই সব খবর দিয়ে ট্রাম্পকে চাপের মুখে রাখছে, তাদের বিক্রি সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর রুটেনবার্গ মন্তব্য করেছেন, পত্রপত্রিকাকে আক্রমণ করে ট্রাম্প আসলে তাঁদের একটা উপকারই করছেন। প্রমাণস্বরূপ তিনি ভ্যানিটি ফেয়ার মাসিকের কথা উল্লেখ করেছেন। পত্রিকাটি ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের নতুন হোটেলের রেস্তোরাঁয় খেয়ে এসে লিখেছিল, আমেরিকার সবচেয়ে বাজে রেস্তোরাঁ এটি। সেটা পড়ামাত্রই ট্রাম্প টুইট করলেন, ‘কেউ কি দেখেছেন ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকার এখন কী হাল হয়েছে। গেছে, একদম গেছে, কেউ পড়ে না।’ সে কথা প্রচার হওয়া মাত্র ভ্যানিটি ফেয়ার-এর বিক্রির সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে যাওয়া শুরু করে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক পত্রিকাটির গ্রাহক হচ্ছেন। শুধু গত রোববার নতুন পাঠক হয়েছেন ৪১ হাজার। পত্রিকার দেড় শ বছরের ইতিহাসে তার এত গ্রাহক কখনোই ছিল না। ও হ্যাঁ, ট্রাম্পের আক্রমণে নিউইয়র্ক টাইমস নিজেও খুব মন্দ করছে না। কিঞ্চিৎ পরিহাসের সঙ্গেই পত্রিকাটি জানিয়েছে, ট্রাম্প যাকে ব্যর্থ পত্রিকা বলতে ভালোবাসেন, সেই নিউইয়র্ক টাইমস-এর গ্রাহকসংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর ডিজিটাল পাঠকের সংখ্যা বেড়ে ১০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments