রাঙামাটির বিধান কেন বাগেরহাটে চলবে না?by সোহরাব হাসান
কুষ্টিয়ার পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন |
গত
বৃহস্পতিবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার হালচাল দেখতে
মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর গিয়েছিলাম। সেখানে সকালের দিকে ভোটের পরিবেশ কিছুটা
শান্ত থাকলেও দুপুরের পর থেকে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। বিভিন্ন কেন্দ্রে
নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। বিক্ষিপ্ত মারামারির ঘটনাও
ঘটে। তা সত্ত্বেও স্থানীয় লোকজনের ধারণা, প্রথম দফায় সিরাজদিখান উপজেলার
১০টি ইউনিয়নে যে কায়দায় ভোট হয়েছে, দ্বিতীয় দফার পরিবেশ তার চেয়ে ভালো ছিল।
নির্বাচন কমিশনেরও দাবি, দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু
কতটা ভালো? শূন্যের চেয়ে নিশ্চয়ই এক নম্বর পাওয়া একধাপ অগ্রগতি। কিন্তু
সেটি তো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। টেনেটুনে পাস করতে হলেও
নির্বাচন কমিশনকে ৩৩ পেতে হবে। কিন্তু তারা দুই অঙ্কের ঘরেই পৌঁছাতে
পারেনি। প্রথম দফায় সিরাজদিখানের ১০টি ইউনিয়নেই নৌকা ফাঁকা মাঠে গোল
দিয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে ছিলেন না। বিদ্রোহী প্রার্থীরাও ছিলেন
না। কিন্তু এবারে নৌকার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও ধানের
শীষের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ১৮টি ইউনিয়নের
মধ্যে ১১টি পেয়েছে নৌকা, ২টি ধানের শীষ ও ৫টি বিদ্রোহী। দুপুরের পর
হানাহানি ও ভুতুড়ে ভোটের মহামারি না ঘটলে এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ সব
প্রার্থী মাঠে থাকতে পারলে ফলাফল নিঃসন্দেহে ভিন্ন হতো। এই চিত্র কেবল
মুন্সিগঞ্জের নয়, সারা দেশের। দুই পর্বের ফল বিশ্লেষণ ইউপি নির্বাচনের
প্রথম দুই পর্বের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে সত্যগুলো বেরিয়ে আসে তা
ক্ষমতাসীন দল কিংবা নির্বাচন কমিশন কারও জন্যই সুখকর নয়। প্রথম সত্য হলো,
নির্বাচন কমিশন নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। ভোটের হারেও
দেখা গেছে অস্বাভাবিকতা। যেখানে নৌকা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছে,
সেখানে ভোটারের উপস্থিতি স্বাভাবিক। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আর যেখানে তেমন
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, সেখানে ভোটের হার অস্বাভাবিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
নৌকা পেয়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট। দ্বিতীয় সত্য হলো, মারামারি বেশি হয়েছে
নৌকা ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। অর্থাৎ ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে
সমানে সমান’। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে তাঁরা একই দলের নেতা বা কর্মী
ছিলেন। ফলে বিদ্রোহীকে স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা যুদ্ধাপরাধের দোসর বলে উড়িয়ে
দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বরং দুজনই একে অপরকে মোকাবিলা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ
করেছেন এবং সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। এত দিন নির্বাচনী বিবাদটা হতো দুই দলের
মধ্যে, দলীয় নির্বাচনের কল্যাণে তা ‘গৃহযুদ্ধে’ রূপ নিল। অনেক স্থানে
বিদ্রোহীরা বিএনপির সমর্থনও পেয়েছেন। তৃতীয় সত্য হলো তৃণমূলের সুপারিশের
ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়নের কথা বলা হলেও কোনো দল সেটি পুরো মেনে চলেনি।
যেখানে তৃণমূলের কমিটি গঠনেই গড়বড়, সেখানে প্রার্থী বাছাই সুষ্ঠু হবে
কীভাবে? দুই দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা মনোনয়ন-বাণিজ্যের যে অভিযোগ এনেছেন,
তা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। ক্ষমতাসীন দলে এটি বেশি হয়েছে এ কারণে যে
নির্বাচনের অাগে কোনো কোনো মহল থেকে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে, মনোনয়ন পেলেই জয়
নিশ্চিত। চতুর্থ সত্য হলো, তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূরত্ব।
জনগণের সমর্থন আছে এমন নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় এই নির্বাচনে অনেক বেশি
বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হন। পঞ্চম সত্য হলো, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে
ক্ষমতাসীনদের মরিয়া মনোভাব। নির্বাচনের মূল নিয়ামক শক্তি যে ভোটার, সে
কথাটি অনেকেই সজ্ঞানে বিস্মৃত হয়েছেন। সিইসির অর্জন ম্লানতত্ত্ব প্রধান
নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় দফার ভোট ভালো হয়েছে দাবি
করে বলেন, কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইসির সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। একজন
সাবেক আমলা হিসেবে সামরিক ও বেসামরিক আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা
তাঁর আছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেও অন্তত প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে
অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে এতটা আক্ষেপ করতে হতো না। তিনি এখন সাংবিধানিক পদে
আছেন। সংবিধান তাঁকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার সিকি ভাগ ব্যবহার করলেও
নির্বাচনের পর ‘সব অর্জন ম্লান’ হয়ে গেছে বলে আক্ষেপ করতে হতো না। সব অর্জন
ম্লান হওয়ার পর সিইসির সামনে দুটো পথ খোলা থাকে। এক. সেই অর্জন
ম্লানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। দুই. সেটি যদি না পারেন
স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। সিইসি ইউপির পরবর্তী নির্বাচনগুলো আরও
সুষ্ঠু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব তা বলেননি।
আগে আমরা দেখতাম সিইসি ও তাঁর সহযোগীরা নির্বাচনের আগে সারা দেশ চষে
বেড়াতেন, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বিশেষ করে
রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রথম অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রধান অংশীদার রাজনৈতিক
দলগুলোর সঙ্গে কেন তাঁরা কথা বললেন না? কেনই বা তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসন ও
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে দিকনির্দেশনা দিলেন
না? কেন তাঁরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিলেন না যে
কোনো প্রার্থী বা তাঁর সমর্থকেরা মাস্তানি করলে দলকেও তার দায় নিতে হবে।
এখনো চার পর্বের নির্বাচন বাকি আছে। প্রথম দুই পর্বের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা
নিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি ভোটারদের ভোটাধিকার রক্ষা না করে, তাহলে ইতিহাসের
কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচনে অঘটনের জন্য সিইসি দুঃখ
প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে দুঃখ প্রকাশ না করতে হয়, সেই নিশ্চয়তাও
দেশবাসী তাঁর কাছে চাইবে। বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে যে নির্বাচনী
ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে, সেটিকে ধ্বংস করার অধিকার তাঁর নেই। রাঙামাটির বিধান
কেন বাগেরহাটে চলবে না? গত ২৮ মার্চ প্রথম আলোতে খবর বের হয় যে রাঙামাটির
১৯টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। খবরটি টনক নড়ার
মতো। যেখানে আওয়ামী লীগের ভয়ে সারা দেশে বাঘে–মহিষে এক ঘাটে জল খাচ্ছে,
সেখানে এই খবর মেনে নেওয়া কঠিন। ক্ষমতাসীন মহলে নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। আর
ইসিও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে জানিয়ে দিল যে রাঙামাটি জেলার ৪৯টি ইউপিতে তৃতীয়
দফায় ভোট হবে না। ভোট হবে শেষ দফায়। ফলে প্রার্থীরা নতুন করে
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যুক্তি দেখানো হয় যে সব দলের
অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হওয়া উচিত। আমরা তাদের এই বোধোদয়কে স্বাগত জানাই।
এটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। যেখানে প্রার্থীরা প্রার্থিতা ঘোষণা করতে অপারগ,
সেখানে নির্বাচন হয় কী করে? একই সঙ্গে ইসিকে এই প্রশ্নটি করতে চাই যে
তাদের এই বোধোদয়ে এত বিলম্ব হলো কেন? প্রথম দফায় ইসি এ ব্যাপারে সজাগ ও
সতর্ক হলে বাগেরহাটে অন্তত সরকারি দলের ৩২ জন প্রার্থী বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারতেন না। ইসির দায়িত্ব কাউকে বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা নয়। তার দায়িত্ব নাগরিকদের
ভোটাধিকার রক্ষা করা। পত্রিকার খবর অনুযায়ী প্রথম দফায় বাগেরহাট জেলার
৭৪টি ইউপির মধ্যে বিএনপি ৩৪টিতেই মনোনয়ন দিতে পারেনি। সারা দেশে তাদের এই
সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৯। এই জবরদস্তির দায় কমিশন কীভাবে এড়াবে? শুরু থেকেই তারা
পক্ষপাতমূলক আচরণ করে আসছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। সিইসি ও তাঁর সহযোগীরা
শপথ নিয়েছেন যে তাঁরা রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করবেন না।
রাঙামাটিতে নির্বাচন স্থগিত করার পক্ষে ইসি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার
বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এই যুক্তি বাগেরহাটে বা অন্যত্র কেন
প্রয়োগ হলো না? বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ ও আপত্তি সত্ত্বেও কমিশন জেলার ৭৪টি
ইউনিয়নের ৩৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা
দেয়। পরে একটিতে বিএনপির প্রার্থী হাইকোর্টে রিট করে প্রার্থিতা ফিরে পান
আর একটিতে ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ৩২
জন। বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহসভাপতি কামরুল ইসলামের দাবি, নির্বাচন
পরিচালনার কাজে যাঁরা নিয়োজিত বা প্রার্থী, তাঁদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার
জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কেবল বাগেরহাট নয়, প্রথম ধাপের নির্বাচনে
চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৫৪ জন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী
ঘোষণা করে ইসি। আর ১১৯টিতে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি।
দ্বিতীয় ধাপে ৬৩টি ইউপিতে বিএনপির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না
পারলেও তার প্রতিকারে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটি
তাদের কেবল দায়িত্বে অবহেলা নয়, শপথেরও বরখেলাপ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির
প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় যদি ইসি রাঙামাটির ৪৯টি ইউনিয়নের
নির্বাচন স্থগিত রাখতে পারে, তাহলে বিএনপির ৩৪ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র
জমা দিতে না পারার কারণে কেন বাগেরহাটে প্রথম দফার নির্বাচন স্থগিত করল না?
রাঙামাটির বিধান বা নিয়ম কেন বাগেরহাটে চলবে না? আশা করি, দেরিতে হলেও
অবিচারে অভ্যস্ত নির্বাচন কমিশনের বিবেচনাবোধ ফিরে আসবে।
No comments