আমরা ক্রিকেট দলের সঙ্গে আছি
বাংলাদেশ
কেমন খেলল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে? আমরা এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে
বিশ্ব শীর্ষ তালিকায় সাত নম্বর দল। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ের
ওপরে। টেস্টে আমরা ৯ নম্বর দল, জিম্বাবুয়ের আগে। টি-টোয়েন্টিতে আমাদের
অবস্থান ছিল ১১ নম্বর, বিশ্বকাপের পরে এক ধাপ এগিয়েছি, হয়েছি ১০ নম্বর,
আফগানিস্তান এখনো আমাদের ওপরে। বাংলাদেশের সঙ্গে যখন ভারতের
খেলা হচ্ছে, তখন আমরা ১১ নম্বর দল, খেলছি বিশ্বের এক নম্বর দলের সঙ্গে!
এরপরেও আমাদের প্রত্যাশা ছিল বেশি। এবং আমরা প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। আর মাত্র একটা রান। ইশ্। একটুর জন্য! একটুর জন্য কত কিছু হয়নি। একটুর জন্য আমরা পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। একটুর জন্য এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিশ্বের এক নম্বর দলটিকে হারাতে পারিনি। আমার সঙ্গে কতজনের কথা হলো, কত জ্ঞানী-গুণী বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, এখনো বলেন, ভাই, ওই একটা রানের কথা ভুলতে পারি না, যতবার মনে হয়, ততবারই কষ্ট হয়, এখনো ঘুমের মধ্যে দেখি, মাহমুদউল্লাহ ছয় মারার চেষ্টা না করে এক নিচ্ছেন। এই যে আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল, আমরা যেকোনো একটা বড় দলকে হারাতে পারব, এমনকি এও ভেবেছিলাম যে হয়তো আমরা সেমিফাইনালে যেতে পারব, সেটা ভিত্তি পেয়েছিল বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে শেষ হওয়া এশিয়া কাপ থেকে। টি-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো নই, সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করে মাশরাফির দল হারিয়ে দিল শ্রীলঙ্কাকে, পাকিস্তানকে। আর এশিয়া কাপের ফাইনালের দিনে খেলা শুরুর আগে আগে বয়ে গেল দুর্ভাগ্যের বাতাস, টসে আমরা হেরে গিয়েছিলাম, আর ম্যাচটা হলো স্বল্পদৈর্ঘ্যের। আর ছিল মুস্তাফিজের না খেলতে পারা। সেখান থেকে দল গেল ভারতের ধর্মশালায়। একদমই কোনো বিশ্রাম পাননি আমাদের খেলোয়াড়েরা। এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষই হয়েছে মধ্যরাতের পর। না ঘুমিয়ে ছেলেরা ভোরবেলা গেলেন এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে দীর্ঘযাত্রা, ট্রানজিট বিরতির ধকল পেরিয়ে ধর্মশালা। বাংলাদেশ যে এশিয়া কাপের ফাইনালে যেতে পারে, এটা কর্তৃপক্ষ ভাবেইনি। বিশ্বকাপের আগে তাঁদের যেদিন অনুশীলন ম্যাচটা ছিল, সেদিন বাংলাদেশ ফাইনাল খেলেছে ভারতের সঙ্গে। মধ্যখানে এক দিন বিরতি দিয়েই মাশরাফি বাহিনী নেমে পড়ল বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে। সেই তিনটা খেলায় বাংলাদেশ যে ভালো খেলেছে, দুটোতে সরাসরি জয়লাভ করেছে, সেটা বাংলাদেশ নিতান্তই বড় দল বলেই পেরেছে। ক্রিকেট মনের খেলা। জিততে পারি—এই আত্মবিশ্বাস থাকলেই জেতা সম্ভব। ধর্মশালা থেকে দিল্লি হয়ে উড়ে যেতে হলো কলকাতা। অথচ আগের সূচি অনুযায়ী পাকিস্তানেরই উড়ে আসার কথা ধর্মশালায়। পাকিস্তান নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ধর্মশালায় গেল না। ফলে বিমানে চড়তে হলো বাংলাদেশকে। এক দিন পরেই খেলা। এশিয়া কাপের পরে একটা দিনের জন্যও কি বিশ্রাম পেয়েছিল বাংলাদেশ দল? এরই মধ্যে এল সেই অপ্রত্যাশিত আঘাত। যাঁরা খেলে গেলেন এশিয়া কাপে, কোনো আম্পায়ার যাঁদের নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তুললেন না, সেই তাসকিন আর আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে রিপোর্ট করলেন আম্পায়াররা। প্রথম খেলার পরেই। প্রিয়তম খেলোয়াড়দের হারানোর শঙ্কায় মাশরাফি কেঁদে ফেললেন সংবাদ সম্মেলনের পর, জানা গেল। এই অবস্থায় দল ভালো খেলে কী করে! আর আমাদের টস–ভাগ্য! এক ভারতের সঙ্গে খেলার দিন ছাড়া একটা দিনও আমরা টসে জিতলাম না। এরপরও মাশরাফিরা ভালো খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এবং ভারতের বিরুদ্ধে। আমি বলব, ভাগ্য একেবারেই আমাদের পক্ষে ছিল না। কী হতো যদি—
১. তাসকিন ও সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ না করা হতো, তাঁরা যদি খেলতে পারতেন।
২. যদি মুস্তাফিজ খেলার উপযুক্ত থাকতেন।
৩. যদি আমরা টসে জয়লাভ করতাম।
৪. যদি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার দিন তামিম ইকবাল অসুস্থ হয়ে না পড়তেন। এগুলোর একটারও ওপর মাশরাফির কোনো হাত ছিল না। এটাকে আমরা বলব, নেহাতই দুর্ভাগ্য। আর গ্রামের বাড়ি থেকে ডেকে নেওয়া হলো শুভাগত হোম ও সাকলাইন সজীবকে। ওঠ ছেড়ি তোর বিয়ে। তাঁরা সড়কপথে রওনা দিলেন শাহজালাল বিমানবন্দরের দিকে। পথে যানজট। সজীব কি ফ্লাইট মিস করবেন? শেষরাতের ফ্লাইট ধরলেন তাঁরা। মধ্যখানে জাহাজ বদল। তারপর বেঙ্গালুরু। বিমান থেকে নেমে তাঁরা সরাসরি চলে গেলেন মাঠে, অনুশীলনে। তারপরের দিনই খেলা। সেই খেলায় নাসিরকে না খেলিয়ে কেন দুজন ভ্রমণক্লান্ত খেলোয়াড়কে নামানো হলো, সেই বিস্ময় অনেকেরই যায় না। তারপরও বাংলাদেশ ভালো খেলেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। আর ভারতের বিরুদ্ধে। শেষ ওভারে মুশফিকুর রহিম পরপর দুই বলে মারলেন দুটো চার। এরপর তিন বলে দরকার ২ রান। ১ রান হলে ম্যাচ টাই। তখন সুপার ওভার খেলতে হবে। আমরা পারিনি। মুশফিক উঠিয়ে মারতে গেলেন। ছক্কা ভেবে যাঁরা লাফিয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের স্তব্ধ করে দিয়ে মুশফিক তালুবন্দী। কিন্তু আমাদের মনে তখনো আশা। কারণ, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তখন স্ট্রাইকিং প্রান্তে। না, আর মনে করতে চাই না সেই দুঃস্বপ্নের রাতটিকে। আমরা যে পারিনি, সেটা বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বলে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার দিন কোহলি কীভাবে ম্যাচটাকে বের করে আনলেন। মুশফিকের মতো তিনিও পরপর চার মেরে চাপমুক্তি উদ্যাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনি ম্যাচটা বের করে আনতে পেরেছিলেন, আমরা পারিনি। পারলে আমরা খুব খুশি হতাম, উদ্বেলিত হতাম, সন্দেহ নেই। পারিনি যে, তা নিয়ে আমাদের আফসোস আছে, হাহাকার আছে, কিন্তু কোনোÿ ক্ষোভ নেই। ওডিআইতে বাংলাদেশ ভারতকে সিরিজে হারিয়েছে, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছে, জিম্বাবুয়েকেও তা-ই। কিন্তু জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টি-টোয়েন্টিতেই আমরা ২-২ ড্র করেছি, এটা মনে রাখলে এ কথা বলা আর কঠিন হবে না যে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা ভালো করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, টি–টোয়েন্টিতে আমরা আফগানিস্তানের কাছে হেরেছি, হংকংয়ের সঙ্গেও আমাদের হারের ইতিহাস আছে। এশিয়া কাপের ধকলের পর বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের তিনটা ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাসকিন ও সানি-কাণ্ডের পর দলের মন গিয়েছিল ভেঙে। মুস্তাফিজ ও তামিমকে সব ম্যাচে না খেলাতে পারায় আমরা পূর্ণশক্তি দেখাতে পারিনি। তা না হলে আমরা আরও ভালো করতাম। কিন্তু যা করেছি, তা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট না হতে পারি, ক্ষুব্ধ বা হতাশ হব না। তামিম সেঞ্চুরি করেছেন, রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, সাকিব বল ও ব্যাটে ভালো করেছেন, মুস্তাফিজ বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বোলার হিসেবে গণ্য হচ্ছেন, এমনকি ব্রেট লির কাছে। মাশরাফির অধিনায়কত্বের প্রশংসা ভারতের সঙ্গে খেলার দিন করেছেন সবাই, এমনকি সুনীল গাভাস্কার পর্যন্ত। জেতা ম্যাচ হেরে গেছি, সেই বেদনা আমাদের যাবে না। কিন্তু ম্যাচটা যে জেতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মাশরাফিরা, সেই গৌরববোধও আমাদের আছে। গতস্য শোচনা নাস্তি। অতীত নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। এটা আমাদের দলের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে ঋদ্ধ করবে। ভবিষ্যতে আমরা এ রকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারব বলে আশা করা যায়। এ কথা আবারও বলব যে বাংলাদেশ যে ক্রিকেটে ভালো করছে, তা এই দেশের মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই জয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টারই একটা অংশমাত্র। ব্যক্তিমানুষ নিজের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতা দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলানোর সংগ্রাম করছেন, তা-ও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশকে। ক্রিকেটও তাই। মুস্তাফিজের উদাহরণ আমরা বারবার স্মরণ করব। সাতক্ষীরা শহর থেকেও ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। ছেলে মাঠে যান, বাবা চান ছেলে পড়াশোনা করুক, চারটা গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছেন। তবু ছেলে ছুটে যান মাঠে। সেজো ভাই তাঁকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যান ৩৫ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা শহরে। সেখানে সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে গিয়ে মুস্তাফিজ ক্রিকেট অনুশীলন করেন। সেই ছেলে, প্রায় কিশোর, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেই নাম লিখিয়ে ফেললেন বিশ্ব রেকর্ডের খাতায়, কি টেস্টে, কি ওডিআইতে, এখন দেখা যাচ্ছে টি-টোয়েন্টিতেও। ওই মুস্তাফিজই বাংলাদেশ। মাশরাফির দুই হাঁটুতে বাটির মতো কী যেন লাগানো—ট্রাউজারের বাইরে থেকেও তা বোঝা যায়। ওই হার না-মানা মাশরাফিই বাংলাদেশ। তামিমের সদ্যোজাত পুত্রসন্তান ছিল ব্যাংককের হাসপাতালে। সেখান থেকে উড়ে এসে তিনি নেমে পড়লেন এশিয়া কাপের খেলায়। এশিয়া কাপে তেমন ভালো করতে পারেননি, কিন্তু দেখিয়ে দিলেন বিশ্বকাপে। আর সাকিব আল হাসান। পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার। ভারতের বিরুদ্ধে খেলায় আইপিএল খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেনের। মাশরাফির পজিশনে ফিল্ডিংয়ে দাঁড়ালেন, ১ ঠেকানোর জন্য। ধোনির জন্য ফিল্ডিং সাজিয়ে সিঙ্গেল ঠেকিয়ে তিনি যে হাসিটা দিয়েছিলেন, তা দেখেই তো মন ভরে গিয়েছিল। সাব্বির তো নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারের চলমান বিজ্ঞাপন, ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর উঁচানো কলারই বলে দেয়, এই বাংলাদেশ নতুন বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তো নির্ভরতার নাম। মুশফিক ফর্ম ফিরে পেতে শুরু করেছেন। আল আমিন বল হাতে সফল হচ্ছেন। সৌম্য সরকার তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেই দুর্দান্ত হয়ে উঠবে দলটা। মাশরাফি বাহিনীকে তাই বলব, তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। আমাদের স্লোগান তো ‘হারি জিতি বাংলাদেশ’। এবং বাংলাদেশের দর্শকদের প্রশংসা আমাদের করতেই হবে, তাঁরা আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে জানেন। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একজন-দুজন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন বটে, সেই জায়গাতেও আমাদের হয়ে উঠতে হবে শোভন ও সুন্দর, এর বাইরে মোটের ওপর বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকেরা যথেষ্ট পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েই আসছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে বলব, ওয়েল ডান বয়েজ। ভালো খেলেছ। ভবিষ্যতে আরও ভালো খেলবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তোমরা ভালো কোনো টুর্নামেন্টে খুব বড় কোনো বিজয় ছিনিয়ে এনে আমাদের এনে দেবে গৌরবের মুহূর্ত, আনন্দের উপলক্ষ। আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
খেলা হচ্ছে, তখন আমরা ১১ নম্বর দল, খেলছি বিশ্বের এক নম্বর দলের সঙ্গে!
এরপরেও আমাদের প্রত্যাশা ছিল বেশি। এবং আমরা প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। আর মাত্র একটা রান। ইশ্। একটুর জন্য! একটুর জন্য কত কিছু হয়নি। একটুর জন্য আমরা পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। একটুর জন্য এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিশ্বের এক নম্বর দলটিকে হারাতে পারিনি। আমার সঙ্গে কতজনের কথা হলো, কত জ্ঞানী-গুণী বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, এখনো বলেন, ভাই, ওই একটা রানের কথা ভুলতে পারি না, যতবার মনে হয়, ততবারই কষ্ট হয়, এখনো ঘুমের মধ্যে দেখি, মাহমুদউল্লাহ ছয় মারার চেষ্টা না করে এক নিচ্ছেন। এই যে আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল, আমরা যেকোনো একটা বড় দলকে হারাতে পারব, এমনকি এও ভেবেছিলাম যে হয়তো আমরা সেমিফাইনালে যেতে পারব, সেটা ভিত্তি পেয়েছিল বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে শেষ হওয়া এশিয়া কাপ থেকে। টি-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো নই, সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করে মাশরাফির দল হারিয়ে দিল শ্রীলঙ্কাকে, পাকিস্তানকে। আর এশিয়া কাপের ফাইনালের দিনে খেলা শুরুর আগে আগে বয়ে গেল দুর্ভাগ্যের বাতাস, টসে আমরা হেরে গিয়েছিলাম, আর ম্যাচটা হলো স্বল্পদৈর্ঘ্যের। আর ছিল মুস্তাফিজের না খেলতে পারা। সেখান থেকে দল গেল ভারতের ধর্মশালায়। একদমই কোনো বিশ্রাম পাননি আমাদের খেলোয়াড়েরা। এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষই হয়েছে মধ্যরাতের পর। না ঘুমিয়ে ছেলেরা ভোরবেলা গেলেন এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে দীর্ঘযাত্রা, ট্রানজিট বিরতির ধকল পেরিয়ে ধর্মশালা। বাংলাদেশ যে এশিয়া কাপের ফাইনালে যেতে পারে, এটা কর্তৃপক্ষ ভাবেইনি। বিশ্বকাপের আগে তাঁদের যেদিন অনুশীলন ম্যাচটা ছিল, সেদিন বাংলাদেশ ফাইনাল খেলেছে ভারতের সঙ্গে। মধ্যখানে এক দিন বিরতি দিয়েই মাশরাফি বাহিনী নেমে পড়ল বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে। সেই তিনটা খেলায় বাংলাদেশ যে ভালো খেলেছে, দুটোতে সরাসরি জয়লাভ করেছে, সেটা বাংলাদেশ নিতান্তই বড় দল বলেই পেরেছে। ক্রিকেট মনের খেলা। জিততে পারি—এই আত্মবিশ্বাস থাকলেই জেতা সম্ভব। ধর্মশালা থেকে দিল্লি হয়ে উড়ে যেতে হলো কলকাতা। অথচ আগের সূচি অনুযায়ী পাকিস্তানেরই উড়ে আসার কথা ধর্মশালায়। পাকিস্তান নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ধর্মশালায় গেল না। ফলে বিমানে চড়তে হলো বাংলাদেশকে। এক দিন পরেই খেলা। এশিয়া কাপের পরে একটা দিনের জন্যও কি বিশ্রাম পেয়েছিল বাংলাদেশ দল? এরই মধ্যে এল সেই অপ্রত্যাশিত আঘাত। যাঁরা খেলে গেলেন এশিয়া কাপে, কোনো আম্পায়ার যাঁদের নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তুললেন না, সেই তাসকিন আর আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে রিপোর্ট করলেন আম্পায়াররা। প্রথম খেলার পরেই। প্রিয়তম খেলোয়াড়দের হারানোর শঙ্কায় মাশরাফি কেঁদে ফেললেন সংবাদ সম্মেলনের পর, জানা গেল। এই অবস্থায় দল ভালো খেলে কী করে! আর আমাদের টস–ভাগ্য! এক ভারতের সঙ্গে খেলার দিন ছাড়া একটা দিনও আমরা টসে জিতলাম না। এরপরও মাশরাফিরা ভালো খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এবং ভারতের বিরুদ্ধে। আমি বলব, ভাগ্য একেবারেই আমাদের পক্ষে ছিল না। কী হতো যদি—
১. তাসকিন ও সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ না করা হতো, তাঁরা যদি খেলতে পারতেন।
২. যদি মুস্তাফিজ খেলার উপযুক্ত থাকতেন।
৩. যদি আমরা টসে জয়লাভ করতাম।
৪. যদি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার দিন তামিম ইকবাল অসুস্থ হয়ে না পড়তেন। এগুলোর একটারও ওপর মাশরাফির কোনো হাত ছিল না। এটাকে আমরা বলব, নেহাতই দুর্ভাগ্য। আর গ্রামের বাড়ি থেকে ডেকে নেওয়া হলো শুভাগত হোম ও সাকলাইন সজীবকে। ওঠ ছেড়ি তোর বিয়ে। তাঁরা সড়কপথে রওনা দিলেন শাহজালাল বিমানবন্দরের দিকে। পথে যানজট। সজীব কি ফ্লাইট মিস করবেন? শেষরাতের ফ্লাইট ধরলেন তাঁরা। মধ্যখানে জাহাজ বদল। তারপর বেঙ্গালুরু। বিমান থেকে নেমে তাঁরা সরাসরি চলে গেলেন মাঠে, অনুশীলনে। তারপরের দিনই খেলা। সেই খেলায় নাসিরকে না খেলিয়ে কেন দুজন ভ্রমণক্লান্ত খেলোয়াড়কে নামানো হলো, সেই বিস্ময় অনেকেরই যায় না। তারপরও বাংলাদেশ ভালো খেলেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। আর ভারতের বিরুদ্ধে। শেষ ওভারে মুশফিকুর রহিম পরপর দুই বলে মারলেন দুটো চার। এরপর তিন বলে দরকার ২ রান। ১ রান হলে ম্যাচ টাই। তখন সুপার ওভার খেলতে হবে। আমরা পারিনি। মুশফিক উঠিয়ে মারতে গেলেন। ছক্কা ভেবে যাঁরা লাফিয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের স্তব্ধ করে দিয়ে মুশফিক তালুবন্দী। কিন্তু আমাদের মনে তখনো আশা। কারণ, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তখন স্ট্রাইকিং প্রান্তে। না, আর মনে করতে চাই না সেই দুঃস্বপ্নের রাতটিকে। আমরা যে পারিনি, সেটা বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বলে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার দিন কোহলি কীভাবে ম্যাচটাকে বের করে আনলেন। মুশফিকের মতো তিনিও পরপর চার মেরে চাপমুক্তি উদ্যাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনি ম্যাচটা বের করে আনতে পেরেছিলেন, আমরা পারিনি। পারলে আমরা খুব খুশি হতাম, উদ্বেলিত হতাম, সন্দেহ নেই। পারিনি যে, তা নিয়ে আমাদের আফসোস আছে, হাহাকার আছে, কিন্তু কোনোÿ ক্ষোভ নেই। ওডিআইতে বাংলাদেশ ভারতকে সিরিজে হারিয়েছে, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছে, জিম্বাবুয়েকেও তা-ই। কিন্তু জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টি-টোয়েন্টিতেই আমরা ২-২ ড্র করেছি, এটা মনে রাখলে এ কথা বলা আর কঠিন হবে না যে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা ভালো করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, টি–টোয়েন্টিতে আমরা আফগানিস্তানের কাছে হেরেছি, হংকংয়ের সঙ্গেও আমাদের হারের ইতিহাস আছে। এশিয়া কাপের ধকলের পর বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের তিনটা ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাসকিন ও সানি-কাণ্ডের পর দলের মন গিয়েছিল ভেঙে। মুস্তাফিজ ও তামিমকে সব ম্যাচে না খেলাতে পারায় আমরা পূর্ণশক্তি দেখাতে পারিনি। তা না হলে আমরা আরও ভালো করতাম। কিন্তু যা করেছি, তা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট না হতে পারি, ক্ষুব্ধ বা হতাশ হব না। তামিম সেঞ্চুরি করেছেন, রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, সাকিব বল ও ব্যাটে ভালো করেছেন, মুস্তাফিজ বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বোলার হিসেবে গণ্য হচ্ছেন, এমনকি ব্রেট লির কাছে। মাশরাফির অধিনায়কত্বের প্রশংসা ভারতের সঙ্গে খেলার দিন করেছেন সবাই, এমনকি সুনীল গাভাস্কার পর্যন্ত। জেতা ম্যাচ হেরে গেছি, সেই বেদনা আমাদের যাবে না। কিন্তু ম্যাচটা যে জেতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মাশরাফিরা, সেই গৌরববোধও আমাদের আছে। গতস্য শোচনা নাস্তি। অতীত নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। এটা আমাদের দলের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে ঋদ্ধ করবে। ভবিষ্যতে আমরা এ রকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারব বলে আশা করা যায়। এ কথা আবারও বলব যে বাংলাদেশ যে ক্রিকেটে ভালো করছে, তা এই দেশের মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই জয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টারই একটা অংশমাত্র। ব্যক্তিমানুষ নিজের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতা দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলানোর সংগ্রাম করছেন, তা-ও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশকে। ক্রিকেটও তাই। মুস্তাফিজের উদাহরণ আমরা বারবার স্মরণ করব। সাতক্ষীরা শহর থেকেও ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। ছেলে মাঠে যান, বাবা চান ছেলে পড়াশোনা করুক, চারটা গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছেন। তবু ছেলে ছুটে যান মাঠে। সেজো ভাই তাঁকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যান ৩৫ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা শহরে। সেখানে সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে গিয়ে মুস্তাফিজ ক্রিকেট অনুশীলন করেন। সেই ছেলে, প্রায় কিশোর, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেই নাম লিখিয়ে ফেললেন বিশ্ব রেকর্ডের খাতায়, কি টেস্টে, কি ওডিআইতে, এখন দেখা যাচ্ছে টি-টোয়েন্টিতেও। ওই মুস্তাফিজই বাংলাদেশ। মাশরাফির দুই হাঁটুতে বাটির মতো কী যেন লাগানো—ট্রাউজারের বাইরে থেকেও তা বোঝা যায়। ওই হার না-মানা মাশরাফিই বাংলাদেশ। তামিমের সদ্যোজাত পুত্রসন্তান ছিল ব্যাংককের হাসপাতালে। সেখান থেকে উড়ে এসে তিনি নেমে পড়লেন এশিয়া কাপের খেলায়। এশিয়া কাপে তেমন ভালো করতে পারেননি, কিন্তু দেখিয়ে দিলেন বিশ্বকাপে। আর সাকিব আল হাসান। পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার। ভারতের বিরুদ্ধে খেলায় আইপিএল খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেনের। মাশরাফির পজিশনে ফিল্ডিংয়ে দাঁড়ালেন, ১ ঠেকানোর জন্য। ধোনির জন্য ফিল্ডিং সাজিয়ে সিঙ্গেল ঠেকিয়ে তিনি যে হাসিটা দিয়েছিলেন, তা দেখেই তো মন ভরে গিয়েছিল। সাব্বির তো নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারের চলমান বিজ্ঞাপন, ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর উঁচানো কলারই বলে দেয়, এই বাংলাদেশ নতুন বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তো নির্ভরতার নাম। মুশফিক ফর্ম ফিরে পেতে শুরু করেছেন। আল আমিন বল হাতে সফল হচ্ছেন। সৌম্য সরকার তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেই দুর্দান্ত হয়ে উঠবে দলটা। মাশরাফি বাহিনীকে তাই বলব, তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। আমাদের স্লোগান তো ‘হারি জিতি বাংলাদেশ’। এবং বাংলাদেশের দর্শকদের প্রশংসা আমাদের করতেই হবে, তাঁরা আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে জানেন। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একজন-দুজন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন বটে, সেই জায়গাতেও আমাদের হয়ে উঠতে হবে শোভন ও সুন্দর, এর বাইরে মোটের ওপর বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকেরা যথেষ্ট পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েই আসছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে বলব, ওয়েল ডান বয়েজ। ভালো খেলেছ। ভবিষ্যতে আরও ভালো খেলবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তোমরা ভালো কোনো টুর্নামেন্টে খুব বড় কোনো বিজয় ছিনিয়ে এনে আমাদের এনে দেবে গৌরবের মুহূর্ত, আনন্দের উপলক্ষ। আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।
No comments