ক্রান্তিকালে মনুষ্যত্বের রক্তপাত
ছেলেটি
মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। একপর্যায়ে মেয়েটি আবিষ্কার করল, ছেলেটি আরও
কয়েকজন মেয়ের সঙ্গেও প্রেম করত, তাদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিল,
যার ভিডিও রেকর্ড ছেলেটির ল্যাপটপে খুঁজে পায় সে, তার নিজেরটাসহ। এই
প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি শুধু ছেলেটিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি,
তার বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে আনে সে, দেখতে চেয়েছিল, ছেলেটির হৃদয় কত
বড়! একবার ভাবুন পাঠক, আমরা কোথায় চলে গেছি। ২০১৪ সালে খুলনায় ঘটেছিল এটি।
মেয়েটি আদালতের কাছে সব স্বীকারও করেছে। এতে সম্প্রতি তার ফাঁসির আদেশ
হয়েছে। দেশের সংবাদমাধমে এ খবর প্রকাশিত হয়। প্রেমের সম্পর্ক এখন যেন
ডালভাতে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যমেও ব্যাপারটা কমবেশি সেভাবেই
উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপার আর আছে
বলে মনে হয় না। পুরোটাই যেন এক বিকৃত মজা নেওয়ার ব্যাপার। সে কারণেই
যখন-তখন এই সম্পর্ক ভাঙতে-গড়তে অসুবিধা হচ্ছে না। তবে সবাই যে আবার সেটা
মেনে নিতে পারে, তাও নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তা-ই হয়েছে। মেয়েটি এই
প্রতারণা মানতে পারেনি, আবার তা হজমও করতে পারেনি। ফলে সে এমন বীভৎসভাবে
প্রতিশোধ নেয়। সভ্যতার কিছু রীতিনীতি ও মানদণ্ড আছে, একটি আধুনিক সমাজের
মানুষকে তা মেনে চলতে হয়। তা না হলে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। আমরা স্বাধীন,
কিন্তু স্বাধীনতার মানে এই নয় যে আমরা যা খুশি তা-ই করতে পারি। বরং উল্টো।
স্বাধীন হতে হলে মানুষকে আরও দায়িত্বশীল হতে হয়। সেটা যেমন আমাদের সামাজিক
ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বেলায় সত্য, তেমনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের বেলায়ও। এই
শিক্ষা লাভ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে পরিবার, তারপর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে মানুষ একধরনের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। সম্প্রতি
কিশোরী মেয়ে ঐশীর হাতে তার মা-বাবার খুনের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের
এই বন্ধন আলগা হয়ে গেছে। আবার যে মা এত কষ্ট করে সন্তান লালন-পালন করেন,
সেই মা-ও নিজ হাতে সন্তানকে হত্যা করছেন। সবকিছু যেন ভেঙে পড়ছে। এটা আসলে
মূল্যবোধের ব্যাপার। যেটা একসময় আসত ধর্ম থেকে, তার সঙ্গে সমাজ ও পরিবার তো
ছিলই। মানুষ এখন ধর্ম পালনের ব্যাপারে আগ্রহী হলেও তার নীতি-নৈতিকতা মানছে
না। অন্যদিকে নগরায়ণের কারণে মানুষ একা হয়ে পড়ছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে,
আবার মানুষ সেই একাকিত্ব নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার দক্ষতা
অর্জন করতে পারছে না। ফলে সে উভয় সংকটে পড়েছে। এটা এক ক্রান্তিকাল। আমাদের
পরিবারগুলো আর কিছুর দিকে না তাকিয়ে সন্তানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার শিক্ষা
দিচ্ছে, যেটা আবার বুমেরাং হয়ে পরিবারেই ফিরে আসছে। অর্থাৎ সন্তান
আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহে মা-বাবার খোঁজ নিচ্ছে না। বাবার চেয়ে বাবার সম্পদই যেন
সন্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই আত্মকেন্দ্রিকতার নানা রূপ দেখা
যায়, তার জন্য যেমন নিজের মা-বাবাকে মানুষ ভুলে যায়, তেমনি প্রেমিকা ও
সন্তানও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। সে কারণেই পশ্চিমে মা-বাবা দিবস পালন শুরু
হয়েছে, কারণ বছরের ওই একটি দিনই সন্তান মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
বছরের বাকি দিনগুলো বুড়ো-বুড়ি একাই থাকেন। সেখানে তুষারপাতের সময় কোনো
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা একা মরে পড়ে থাকলেও তাঁর খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না,
দুই-তিন দিন পর পৌরসভার লোক এসে হয়তো তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার করে। সম্পর্ক
আসলে লালন করার ব্যাপার, তার মধ্যে যেমন ভালোবাসা থাকে, তেমনি থাকে দায়িত্ব
ও কর্তব্যবোধ। প্রেমিক-প্রেমিকা বা মা-বাবা-সন্তানের সম্পর্ক থেকে শুরু
করে সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে। এটাই সেই মূল্যবোধ। সেই ব্যাপারটা
হারিয়ে যাচ্ছে, যার অভিঘাত পড়ছে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। ব্যক্তি
বা পরিবার—কেউই তাকে কাউন্সেলিং করছে না। ফলে সে হারাচ্ছে মানসিক ভারসাম্য,
হয়ে উঠছে বিকৃত; যার রূপ আমরা দেখি এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে।
No comments