যুদ্ধশিশুর বয়ান
দিনাজপুরের
রানীশংকৈলের সুধীর বর্মণ মাছ খান না। তাঁর মা খান, স্ত্রী খান, মেয়ে খায়।
তিনি খান না। কখনোই খেতে পারেন না, মাছে সুধীরের গন্ধ লাগে। ‘মাছে-ভাতে
বাঙালি’ সুধীরের মাছ খেতে গন্ধ লাগে কেন? একাত্তরের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের
সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, তার নানা
মাত্রার ভেতর মাছও একটা। পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালির মাছ খাওয়াও ছিল একটা
অপরাধ। পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে থাকার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে একজন
বাঙালি সামরিক অফিসার লিখেছেন, তাঁকে প্রায়ই পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা বলত,
‘তুমলোক বাঙালি হো। কুছ কামকা নাহি হো। ছোটা ছোটা আদমি হো। ছেরেফ মাছলি
খাতে হো।’ মাছ খাওয়া বাঙালির মাছের মতোই কম বুদ্ধি, কম জোর—এই বদনামের
স্মৃতি সে সময়ের অনেকেরই আছে। পাকিস্তানে, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের ভেতর মাছ
বিশেষ জনপ্রিয় না; বিপরীতে তাদের মেনু৵তে মাংসের প্রাধান্য। মাছের গন্ধ
তাদের অপছন্দ। আচমকা আমার সুধীরের ক্রোমোজোমের দিকে মনোযোগ যায়। চমকে
উঠে ভাবি, তাঁর রক্তেও তো আছে এক মাছনাখোশ পাঞ্জাবি পাকিস্তানি সেনার বীজ।
তাঁর ষাটোর্ধ্ব মা টেপরি বর্মণের ত্বক এখনো কেমন টান টান। টেপরির ভাই
আমাদের জানান, একাত্তরে তাঁর এই বোন ছিল অপরূপ রূপসী। এ গাঁয়েরই একজন এসে
তাঁদের বলেছিল, এই বোনকে যদি তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পাঠিয়ে
দেন, তাহলে তাঁদের পুরো পরিবার বেঁচে যেতে পারে। তারপর টেপরি মাসের পর মাস
কাটিয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে। টেপরির বিনিময়ে রক্ষা পেয়েছিল তাঁর
পরিবার। দেশ স্বাধীন হলে ঘরে ফিরে আসেন টেপরি গর্ভে সুধীরকে নিয়ে। লোকে
বলেছে নষ্ট করে ফেলতে। কিন্তু টেপরির বাবা বললেন, ‘রেখে দে, তোর তো কেউ
থাকবে না, এই ছেলেই তোকে দেখবে।’ টেপরি আমাদের জানান, চারজন ছিল পাকিস্তানি
সেনা, প্রতি রাতে আসত তারা। প্রত্যেকের মুখ মনে আছে তাঁর। টেপরি বলেন,
ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে ভাবেন ওই চারজনের ভেতর কার মতো
দেখতে হয়েছে ছেলেটা? সুধীর যখন বড় হচ্ছে, তখন ছেলেরা তাকে বলত ‘পাঞ্জাবির
বাচ্চা’। খেলত না তার সঙ্গে। কিন্তু প্রতিবাদ করত না সুধীর, ‘ঝগড়া করতে তো
সঙ্গে লোক লাগে, আমার কে আছে?’ বলেন সুধীর। এক পাঞ্জাবি সেনার রক্তে বন্দী
হয়ে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিরালম্ব এক জীবন কাটায় সুধীর। জীবনটা
কেমন লাগে আপনার—সুধীরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘কেমন ফাঁকা ফাঁকা
লাগে।’ ভ্যান চালিয়ে তাঁর মা, মেয়ে, স্ত্রীর অন্নসংস্থান করেন সুধীর। তাঁর
পকেটে একটা ছোট্ট মোবাইল। কী আশ্চর্য, সেই মোবাইলের রিংটোন ‘এক সাগর রক্তের
বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা...’। এক যুদ্ধশিশুর এই রোমহর্ষক গল্প
শুনি শবনম ফেরদৌসীর জন্মসাথিডকুমেন্টারিতে। ডকুমেন্টারিতে শবনম আমাদের
জানাচ্ছেন, তিনি নিজে জন্মেছেন বাহাত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকার হলি ফ্যামিলি
হাসপাতালে। তাঁর বাবার কাছে তিনি জেনেছেন, যেদিন তিনি জন্মেছেন, সেদিন হলি
ফ্যামিলি হাসপাতালে জন্মেছিল মোট ১৩টি শিশু এবং তাদের ভেতর ছিল চারজন
যুদ্ধশিশু। শবনম এরপর খুঁজতে বের হন তার জন্মসাথি সেই চারজন যুদ্ধশিশুকে।
তাঁর এই ডকুমেন্টারি সেই ব্যক্তিগত অনুসন্ধানযাত্রারই ইতিবৃত্ত। হারিয়ে
যাওয়া রেকর্ড, প্রশাসনের অসহযোগিতায় সেই জন্মসাথিদের খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে
পড়ে শবনমের জন্য। শবনম জানতে পারেন, অগণিত যুদ্ধশিশুকে দত্তক হিসেবে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দূরদূরান্তের দেশে। কিন্তু এই অনুসন্ধান-প্রক্রিয়াতেই
কাকতালীয়ভাবে তিনি পেয়ে যান দেশের ভেতরই থাকা কতিপয় যুদ্ধশিশুর সন্ধান।
সুধীর তেমনই একজন। পেয়ে যান সিলেট অঞ্চলের আরেক নারী যুদ্ধশিশু
শামসুন্নাহারকে। শামসুন্নাহার যুদ্ধাপরাধ বিচারের একজন সাক্ষীও বটে। কিন্তু
সুধীরের মতো শামসুন্নাহারের কোনো সংসার নেই। তিনি গ্রামবিতাড়িত,
উদ্বাস্তু। যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী দেওয়ার কারণে হত্যার হুমকি মাথায় নিয়ে
পালিয়ে বেড়ান তিনি। দেখা হয়ে যায় কানাডাপ্রবাসী আরেক যুদ্ধশিশু মনোয়ারা
ক্লার্কের সঙ্গেও। একটা জন্মসনদের আশায় মনোয়ারা এসেছেন বাংলাদেশে। এই
জন্মসনদ না থাকায় কানাডায় তিনি তাঁর সন্তানের অধিকারও দাবি করতে পারছেন না।
দেশের ইতিহাস ও সমাজ নিয়ে নানা মাত্রার ভাবনায় সবাইকে শামিল করা প্রয়োজন
এখন। ভালো প্রামাণ্যচিত্র এ ক্ষেত্রে হতে পারে এক শক্তিশালী মাধ্যম
মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের বয়ান জনসমক্ষে তুলে আনার প্রক্রিয়া কিছুকাল আগে
থেকে শুরু হলেও যুদ্ধশিশুদের আশ্চর্য বৈপরীত্যভরা জটিল জীবনের বয়ান এতটা
স্পষ্ট করে বুঝি এই প্রথম শোনা গেল। ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের সাধারণ অবহেলার
পথ ধরেই হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য।
যুদ্ধশিশু বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান,
শবনম যাদের অভিহিত করেছেন ‘বিজয় শিশু’ বলে। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বিষয়ে
ভিনদেশি গবেষক পিএইচডি করছেন তা জানি, কিন্তু দেশের ভেতর তাদের নিয়ে
কর্মকাণ্ড বিরল। শবনম ফেরদৌসীকে অভিনন্দন চলচ্চিত্রের পর্দায় এমন একটা
গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্বল্পালোচিত বিষয়কে হাজির করার জন্য। চলচ্চিত্র ভাষারও
চমৎকার প্রয়োগ দেখি প্রামাণ্যচিত্রটিতে। ইনভেস্টিগেটিভ ডকুমেন্টারি ধারায়
শবনম নিজেই এই ছবির চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। যুদ্ধশিশু খোঁজার
চড়াই-উতরাই যে পথে তিনি হেঁটেছেন মুনশিয়ানার সঙ্গে, তিনি সেই পথের সঙ্গী
করে নেন দর্শকদেরও। দক্ষ এডিটিংয়ে কৌতূহলের দোলাচলকে জাগিয়ে রাখেন। একটু
একটু করে উন্মোচন করেন তিনি শক্তিশালী এসব মানবকাহিনি। ক্যামেরাও ছবিটির
মেজাজের সঙ্গে সমান্তরালে চলে। সুধীর আর শামসুন্নাহারের হাহাকারের
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রকৃতি যেন নতুন ব্যঞ্জনায় উপস্থিত হয়। টেপরির
বিভীষিকার ভাষ্যের ফাঁকে পোষা টিয়া পাখির ক্লোজআপ আনে নাটকীয়তা। বাংলাদেশে
প্রামাণ্যচিত্রের গৌরবজনক ঐতিহ্য আছে, যার শুরু জহির রায়হানের স্টপ
জেনোসাইড দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর কোনো
সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। এ দেশে নিয়মিতই নানা ধারার প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত
হচ্ছে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের সংগঠনও আছে। কিন্তু টিভিতে বা কোনো
বিশেষ প্রেক্ষাগৃহে এসব ছবির দু-একটা প্রদর্শনী হয়েই তা বাক্সবন্দী হয়ে
পড়ে। একাত্তর টেলিভিশনের প্রযোজনায় জন্মসাথি ছবিটির প্রদর্শনী হয়েছে সেই
চ্যানেলেই। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে যদি এ দেশের আপামর মানুষ এই
প্রামাণ্যচিত্র দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ছবিটি দেশের প্রধান
প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শন করা জরুরি বলেই মনে করি। বাংলাদেশ তার জাতি
গঠনের নানা জটিল পথ অতিক্রম করছে। দেশের ইতিহাস ও সমাজ নিয়ে নানা মাত্রার
ভাবনায় সবাইকে শামিল করা প্রয়োজন এখন। ভালো প্রামাণ্যচিত্র এ ক্ষেত্রে হতে
পারে এক শক্তিশালী মাধ্যম।
No comments