মিসরে সুপ্রিম কোর্ট শুদ্ধিকরণ!by মিজানুর রহমান খান
বিচার
বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি যেকোনো একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, সেটা মিসর আরেকবার দেখিয়ে দিল। মিসরের সুপ্রিম
জুডিশিয়াল কাউন্সিল ৩১ জন বিচারপতিকে অপসারণ করেছে। মিসরে বেশ কিছুদিন ধরে
‘সরকারবিরোধী’ বিচারপতিদের বিরুদ্ধে একধরনের ‘পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ চলছে।
অভিযোগ হচ্ছে, দেশটির প্রথম নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে
২০১৩ সালে অপসারণে সামরিক বাহিনী যে অভ্যুত্থান করেছিল, এই বিচারকেরা তার
বিরোধিতা করেছিলেন। ইসলামি ব্রাদারহুডের নির্বাচিত নেতা মুরসি ও সামরিক
নেতা জেনারেল সিসির শাসন প্রমাণ রাখছে যে, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র চাইলে
একটি জাতিকে তার সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে নজর দিতে হবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক
সামাজিক বিভাজন, প্রতিপক্ষ দলন ও অব্যাহত অসহনশীলতার রাজনীতি একটি জাতিকে
আত্মহত্যার দিকে ঠেলতে পারে। বিদেশি শক্তি কারও ক্ষমতায় থাকা না–থাকায়
প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু তারা দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে পরিত্রাণ দিতে পারে
না। শুধু ভোট দিয়ে একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করা কিংবা তার ব্যর্থতা
মোকাবিলায় অসাম্প্রদায়িক সামরিক শাসন কায়েম করা কোনোটিই শান্তি ও
স্থিতির রক্ষাকবচ নয়। মিসরে অপসারিতদের মধ্যে অন্তত দুজন বিচারকের বিরুদ্ধে
মুরসির সাংবিধানিক সরকারের পক্ষে রাজপথে গড়ে ওঠা ‘জনতার মঞ্চে’ অংশ নেওয়ার
অভিযোগ আছে। তাঁরা প্রকাশ্যে ব্রাদারহুডের সমর্থনে রাজপথে নেমেছিলেন, যা
বিচারকের পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। সে জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যদের বিরুদ্ধে কী
অভিযোগ এবং কীভাবে তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা
স্পষ্ট নয়। আবার মিসরের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার তল মাপতে হলে একটি তথ্য
মনে রাখাই বোধ করি যথেষ্ট, আর সেটা হলো মাত্র একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে
হত্যার দায়ে আদালত ৫২৯ জন বিরোধীদলীয় কর্মীকে ফাঁসি দিয়েছেন (গার্ডিয়ান,
১৪ মার্চ ২০১৪)। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়া
নিশ্চয় কোনো একটি দেশের নিছক ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
কারণ, বিচারক সর্বজনীন মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে সুরক্ষা দেন। তাই
এটা একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। তাঁদের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হোক
না কেন, তার স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সাম্প্রদায়িক কি অসাম্প্রদায়িক, গোঁড়া
নাকি উদারনৈতিক—এসব জারিজুরি এখানে একদম চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক
অপসারণের প্রক্রিয়া অবশ্যই সর্বজনীনভাবে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
মিসর সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণে ‘ডিউ প্রসেস’-এর
গ্যারান্টি না দিতে পারে, তাহলে তাকে কেবল ধর্মরাষ্ট্র গঠনের প্রবক্তা
ব্রাদারহুডবিরোধী বা ব্রাদারহুডবিনাশী সরকার হিসেবে বাহবা দেওয়ার সুযোগ
নেই। কারণ, তা টেকসই নয়। আর তাহলে এই আশঙ্কাটাই প্রবল হয়ে উঠবে যে মিসরের
সেক্যুলার সামরিক সরকার তার ‘মৌলবাদী’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমাতে সত্যি
জুলুম চালাচ্ছে। এই যুক্তি দুর্বল নয় যে, মিসরের সুপ্রিম কোর্টের যেসব
বিচারক কোনোভাবে ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়’ জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের পক্ষে আর
বিচারিক পদে অধিষ্ঠান থাকা কাম্য নয়। কোনো বিচারক তা তিনি যত বড়ই হোন,
যদি ‘সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে’ জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর শপথ ভঙ্গ ঘটে। তিনি
নিরপেক্ষতা হারান। সুতরাং মিসরের যেসব বিচারক, যার সঠিক সংখ্যা আমরা জানি
না, মুরসির ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ও সংবিধান রক্ষায় ‘রাজনীতিতে’ জড়িয়ে
পড়েছিলেন, তাঁদের অপসারণের প্রতি নীতিগত সমর্থন না দিয়ে উপায় নেই।
সাংবিধানিক সরকার রক্ষার নামে আর যা-ই হোক, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের
তরফে আইনবহির্ভূত ‘অ্যাকটিভিস্ট’ ভূমিকা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু মিসরে গত
দুই বছরে চল্লিশের বেশি বিচারপতিকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল
কমিশন ফর জাস্টিস (আইসিজে) অব্যাহতভাবে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ করে চলেছে।
আইসিজে অবশ্য সংবিধান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেওয়া বিচারকদের একটি
জনবিবৃতিকে ‘বাকস্বাধীনতা’র অনুশীলন হিসেবে সমর্থন করেছে। ওই বিবৃতি মুরসির
‘নির্বাচিত সরকার’ উৎখাতের বিরোধিতা করেছে। মুরসির পক্ষে বিচারকদের একটি
অংশ ‘জাজেস ফর ইজিপ্ট’ আন্দোলনে গেছে। কেউ কেউ মুরসির ‘বৈধতা’ ব্যাখ্যা
করে টিভিতে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এর কোনো কিছুই এটা সমর্থন করে না যে
জেনারেল সিসি সরকারের আমলে অভিযুক্ত বিচারকেরা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে মাত্র
দুই পৃষ্ঠা করে খরচ করতে পারবেন। মনে হচ্ছে বিচারকেরা ন্যায়বিচার থেকে
বঞ্চিত হয়েছেন। তঁারা সামরিক বিচার সংস্কৃতির শিকার। পাকিস্তানে এর আগে
আমরা গণহারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ ও পাল্টাপাল্টি
প্রতিস্থাপনের ঘটনা দেখেছি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ
একটা বড় মাপের স্পর্শকাতর বিষয়। অনেক দেশে শতাব্দীতে দু-একজনকে অপসারণের
ঘটনা ঘটে। যে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যত উন্নত, সেই দেশের উচ্চ আদালতের
বিচারকদের অপসারণ ততটাই কম। সুতরাং নিকট ইতিহাসে পাকিস্তান ও মিসরে পাইকারি
হারে বিচারক অপসারণ বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করছে। আমাদের এসব স্মরণ করিয়ে
দিচ্ছে যে ভাইমার (বর্তমান জার্মানি) নামে একটি রিপাবলিক ছিল। সুপ্রিম
কোর্ট ভেঙে গিয়েছিল বলে দেশটি ভেঙে গিয়েছিল। সুতরাং সাধু সাবধান! ২০১৩
সালের ক্ষমতার পটপরিবর্তন থেকে মিসরের সুপ্রিম কোর্টের বিপুলসংখ্যক
বিচারপতির দুর্দিন শুরু হয়। এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সামরিক সরকারের মধ্যে
সর্বস্তরে ‘আমাদের লোক’ রাখতে যাঁরা আগ্রহী, তাঁরাই বিচার বিভাগে ভিন্নমত ও
পথ অনুসরণকারীদের শুদ্ধিকরণে অতি উৎসাহ দেখান। ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ অনুসরণ
না করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ করা হয়ে থাকলে তা একটি জাতির
জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। যত ভালো কাজের অজুহাতে তা করা হোক না কেন, এর
ফল বিপরীত হতে বাধ্য। এটা মিসরের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উত্তরণকে তা আরও বাধাগ্রস্ত ও বিপৎসংকুল করতে
পারে। কারণ, মিসর সরকার স্পষ্টতই কোনো প্রকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক
প্রক্রিয়া অনুসরণের তোয়াক্কা করছে না। সুপ্রিম কোর্টের ৩১ জন বিচারপতির
অপসারণের ঘটনা রাষ্ট্রীয় বেতারের সংক্ষিপ্ত বুলেটিনে মামুলি খবর হিসেবে
প্রচারিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বদল হলে গোটা সিভিল সার্ভিস বদলে
যায়। মিসর কি বিচার বিভাগে সেই পথ দেখাচ্ছে? সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়
‘মৌলবাদী’ বা ‘জঙ্গি’ বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে শায়েস্তা করার
যে উন্মাদনা মিসরজুড়ে চলছে, তা থেকে জেনারেল সিসির কর্তৃত্ববাদী সরকারের
‘সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনজিং’ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয় না। যতই অনাচার
চলুক, শাসকগোষ্ঠী মানুষকে ব্রাদারহুডের জঙ্গিপনার দোহাই দিয়ে ভয়
দেখাচ্ছে। কিন্তু তার নিজের ক্ষমতাদর্পী জঙ্গিপনা দেশকে রসাতলে নিচ্ছে।
তারা প্রমাণ রাখছে, আইনের শাসন না দিতে পারাটা একটা হাত বাছাই করা বিষয় হতে
পারে না। একটি বলদর্পী, অগণতান্ত্রিক ও ক্ষমতাগৃধ্নু প্রশাসন ‘আমাদের’
জন্য সুশাসন, আর ‘তাদের’ জন্য কুশাসন দিতে পারে না। ২৯ মার্চ ৩১ বিচারকের
অপসারণের খবর প্রকাশ করে বিলাতের দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ
অথচ ভিন্নমতাবলম্বী বা সরকারবিরোধী তারাও ব্রাদারহুডের মতোই দমন-পীড়নের
শিকার।’ বিচারপতিদের অপসারণের প্রক্রিয়া মিসরের সরকারের তরফে বিস্তারিতভাবে
প্রকাশ করা না হলে মিসরের বিচার বিভাগে যা চলছে, তা মিসরীয় জনগণ ও
বিশ্বশান্তির জন্য একটা উদ্বেগজনক সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনজিং হিসেবেই বিবেচিত
হতে পারে।
No comments