একজন ভাওয়াইয়ার সাধক by সফিউল আলম রাজা
এই
তো সেদিনের কথা। উত্তরাঞ্চলের মাঠঘাট-প্রান্তরজুড়ে যাঁর সুর ছড়িয়ে
থাকত। যার মিষ্টি সুরের গান একটিবার শুনতে আগ্রহী আর ব্যাকুল হয়ে থাকত
পথে-প্রান্তরের সহজ-সরল মানুষগুলো। যাঁর গান শুনে মানুষ যেমন কাঁদতেন,
হাসতেন, তেমনি দারুণভাবে উজ্জীবিত হতেন। তিনি ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তি গীতিকার,
সুরকার ও শিল্পী নুরুল ইসলাম জাহিদ। সাড়ে তিন হাজারের অধিক গানের
গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী তিনি। ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন
অসংখ্য আধুনিক, পল্লিগীতি, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ও দেশের গান।
মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোচবিহারের
Welfare Centre for Evacuee Children-নর্থবেঙ্গল জোন থেকে প্রশিক্ষণ শেষে
ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিজের লেখা ও সুরারোপিত গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের
উজ্জীবিত করেছেন। তাঁর সহযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে সার্টিফিকেট গ্রহণ করলেও
তিনি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার
প্রয়োজন বোধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গান লিখেছেন; এ
ছাড়া দেশের বিশেষ দিনগুলো নিয়ে অসাধারণ সব গান লিখেছেন তিনি। তাঁর গান
চলচ্চিত্র ও নাটকেও ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক গানই এখনো বেতার ও টেলিভিশনে
বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে পরিবেশিত হয়ে আসছে। দীর্ঘ চার বছর রোগভোগের পর গত
বছরের ১ এপ্রিল গুণী এই মানুষটি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। সংগীতাঙ্গনের
গুণী এই ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম আপনজন হিসেবে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন
চিলমারী থানা পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে তাঁর প্রথম সান্নিধ্য
পাই। আমার গান শুনে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি অনেক ভালো করবে, চর্চা
করো।’ সুযোগ পেলে তাঁর কাছে যেন যাই। এরপর কতবার যে তাঁর কাছে গিয়েছি,
মুগ্ধ হয়ে গান শুনেছি, শিখেছি, গুরুজির রচনা নতুন নতুন গান দেখেছি, গানের
ভাব বোঝার চেষ্টা করেছি, গান লেখার কলাকৌশল শিখেছি। তিনি একটি বেসরকারি
সংস্থায় শিক্ষকতা করতেন। চাকরির সুবাদে চিলমারীতে থাকতে হতো তাঁকে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দুটি রাত থাকতেন কুড়িগ্রামে নিজের পরিবারের সঙ্গে।
এভাবেই কেটেছে দীর্ঘ ২২ বছর।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের সেই গানের চিলমারী বন্দরের মানুষ ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তি নুরুল ইসলাম জাহিদকেও আপন করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। রংপুর বেতারের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘তিস্তা পাড়ের গানের অনুষ্ঠান ভাওয়াইয়া’ মানেই নুরুল ইসলাম জাহিদের বিশেষ ধারার, ভিন্ন গায়কি আর মিষ্টি সুরের গান। তিনি ছিলেন স্বভাব-গীতিকবি। একদিন বিকেলে তাঁর সঙ্গে বসেছিলাম, হঠাৎ একটি পায়রা (কবুতর) উড়ে এসে ঘরের চালে বসল। পায়রাটি চালে বসেই বাকবাকুম বাকবাকুম করে যেন অস্থির করে ফেলল। আর অমনি গুরুজি লিখে ফেললেন, ‘আরে তুই ক্যানে একেলায় পায়রা রে/ ও পায়রা আসিলু ঘুরিয়া / ওরে মোর মতন কি তোরো জোড়া গেইছে রে ভাঙিয়া...।’ ভাওয়াইয়ার প্রচলিত ধারার গানগুলোতে সুর ও কথার ঔজ্জ্বল্য রয়েছে। প্রচলিত গানগুলো দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা পেলেও শিক্ষিত গীতিকারদের অবদানও কম নয়। সে ক্ষেত্রে গীত রচয়িতা হিসেবে নুরুল ইসলাম জাহিদের বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। শব্দ ও সুরের নির্বাচনে তাঁর পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সংসারের টানাপোড়েন ও অসংগতিগুলো সহজেই উঠে এসেছে তাঁর গানে। গানে তিনি মাঠের চাষি, গাড়িয়াল বন্ধু, নারীর প্রেম ও দীর্ঘশ্বাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। কালা, গাড়িয়াল কিংবা গাড়িয়াল বন্ধুর প্রেম-বিরহের একঘেয়েমি ছকবাঁধা গান থেকে তাঁর গান ভিন্ন স্বাদের, যা ভাওয়াইয়ার পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকসংস্কৃতির ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি প্রথম রংপুর বেতারে ঈদ, পূজা, নবান্ন, পিঠা, বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলো নিয়ে ভাওয়াইয়া রচনা করেন এবং তা সুর দিয়ে বেতারে পরিবেশন করেন। শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি লোকগানের একজন নিবিষ্ট গবেষক। ঐতিহ্য ও লোকসংগীত বিষয়ে তাঁর লেখাও কম নয়। বিভিন্ন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ‘গ্রামবাংলার চিরায়ত সংগীত-পল্লিগীতি’, ‘কুড়িগ্রাম হামার জেলা বাহে’ প্রভৃতি লেখায় পল্লিজীবন ও পল্লিগানের নিষ্ঠাবান গবেষক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন সময় গুরুজির মুখ থেকে অনেক অভিমানের কথা শুনেছি। ভাওয়াইয়া নিয়ে তাঁর নিজের কর্মপরিকল্পনা ও বেতার কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথাও শুনেছি। তাঁর সাড়ে তিন হাজার গানের মধ্যে কতগুলো গান বেতারে সংরক্ষিত আছে? রংপুর বেতারে পাওয়া গেল মাত্র ৩৫টি। অথচ গুরুজির শতাধিক গান আমার অন্তরেই গেঁথে আছে। আর পাঁচ শতাধিক ভাওয়াইয়া গান আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। তাঁর বড় ছেলে সজীবের সংগ্রহেও দুই হাজারের অধিক গানের কথা আছে, কিন্তু সমস্যা হলো সুরগুলো তো ধারণ করা নেই। যে বেতারে থাকার কথা সেই বেতারে তো নেই। যে মানুষটি দেশের জন্য, মানুষের জন্য পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন; এককথায় নিঃশেষ করে দিলেন, তাঁর জন্য এই দেশ, এই সমাজের কি কিছু করার নেই! নুরুল ইসলাম জাহিদ ছাড়া তাঁর পুরো পরিবারটি এখন বিধ্বস্ত। গুরুজির প্রথম প্রয়াণ দিবসে আমাদের প্রথম দাবি, রংপুর বেতারে রেকর্ড করা সাড়ে তিন হাজার গানের অধিকাংশই কে নষ্ট করল তা খুঁজে বের করা হোক। দ্বিতীয়ত, বাংলা একাডেমির মাধ্যমে তাঁর সাড়ে তিন হাজার গানের পাণ্ডুলিপি কয়েক খণ্ডে বই আকারে প্রকাশ করা হোক।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের সেই গানের চিলমারী বন্দরের মানুষ ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তি নুরুল ইসলাম জাহিদকেও আপন করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। রংপুর বেতারের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘তিস্তা পাড়ের গানের অনুষ্ঠান ভাওয়াইয়া’ মানেই নুরুল ইসলাম জাহিদের বিশেষ ধারার, ভিন্ন গায়কি আর মিষ্টি সুরের গান। তিনি ছিলেন স্বভাব-গীতিকবি। একদিন বিকেলে তাঁর সঙ্গে বসেছিলাম, হঠাৎ একটি পায়রা (কবুতর) উড়ে এসে ঘরের চালে বসল। পায়রাটি চালে বসেই বাকবাকুম বাকবাকুম করে যেন অস্থির করে ফেলল। আর অমনি গুরুজি লিখে ফেললেন, ‘আরে তুই ক্যানে একেলায় পায়রা রে/ ও পায়রা আসিলু ঘুরিয়া / ওরে মোর মতন কি তোরো জোড়া গেইছে রে ভাঙিয়া...।’ ভাওয়াইয়ার প্রচলিত ধারার গানগুলোতে সুর ও কথার ঔজ্জ্বল্য রয়েছে। প্রচলিত গানগুলো দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা পেলেও শিক্ষিত গীতিকারদের অবদানও কম নয়। সে ক্ষেত্রে গীত রচয়িতা হিসেবে নুরুল ইসলাম জাহিদের বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। শব্দ ও সুরের নির্বাচনে তাঁর পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সংসারের টানাপোড়েন ও অসংগতিগুলো সহজেই উঠে এসেছে তাঁর গানে। গানে তিনি মাঠের চাষি, গাড়িয়াল বন্ধু, নারীর প্রেম ও দীর্ঘশ্বাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। কালা, গাড়িয়াল কিংবা গাড়িয়াল বন্ধুর প্রেম-বিরহের একঘেয়েমি ছকবাঁধা গান থেকে তাঁর গান ভিন্ন স্বাদের, যা ভাওয়াইয়ার পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকসংস্কৃতির ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি প্রথম রংপুর বেতারে ঈদ, পূজা, নবান্ন, পিঠা, বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলো নিয়ে ভাওয়াইয়া রচনা করেন এবং তা সুর দিয়ে বেতারে পরিবেশন করেন। শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি লোকগানের একজন নিবিষ্ট গবেষক। ঐতিহ্য ও লোকসংগীত বিষয়ে তাঁর লেখাও কম নয়। বিভিন্ন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ‘গ্রামবাংলার চিরায়ত সংগীত-পল্লিগীতি’, ‘কুড়িগ্রাম হামার জেলা বাহে’ প্রভৃতি লেখায় পল্লিজীবন ও পল্লিগানের নিষ্ঠাবান গবেষক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন সময় গুরুজির মুখ থেকে অনেক অভিমানের কথা শুনেছি। ভাওয়াইয়া নিয়ে তাঁর নিজের কর্মপরিকল্পনা ও বেতার কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথাও শুনেছি। তাঁর সাড়ে তিন হাজার গানের মধ্যে কতগুলো গান বেতারে সংরক্ষিত আছে? রংপুর বেতারে পাওয়া গেল মাত্র ৩৫টি। অথচ গুরুজির শতাধিক গান আমার অন্তরেই গেঁথে আছে। আর পাঁচ শতাধিক ভাওয়াইয়া গান আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। তাঁর বড় ছেলে সজীবের সংগ্রহেও দুই হাজারের অধিক গানের কথা আছে, কিন্তু সমস্যা হলো সুরগুলো তো ধারণ করা নেই। যে বেতারে থাকার কথা সেই বেতারে তো নেই। যে মানুষটি দেশের জন্য, মানুষের জন্য পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন; এককথায় নিঃশেষ করে দিলেন, তাঁর জন্য এই দেশ, এই সমাজের কি কিছু করার নেই! নুরুল ইসলাম জাহিদ ছাড়া তাঁর পুরো পরিবারটি এখন বিধ্বস্ত। গুরুজির প্রথম প্রয়াণ দিবসে আমাদের প্রথম দাবি, রংপুর বেতারে রেকর্ড করা সাড়ে তিন হাজার গানের অধিকাংশই কে নষ্ট করল তা খুঁজে বের করা হোক। দ্বিতীয়ত, বাংলা একাডেমির মাধ্যমে তাঁর সাড়ে তিন হাজার গানের পাণ্ডুলিপি কয়েক খণ্ডে বই আকারে প্রকাশ করা হোক।
No comments